করোনাকাল আমাদের অনেককেই জোর করে নিজের মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছে। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ায় বাধ্য করেছে। এ-রকম একটা ইনটেন্স সময়ে মানুষ, — অন্তত যাদের ভাবনার সময়, সুযোগ অথবা তাগিদ আছে তাদের অধিকাংশই আশ্রয় নিচ্ছে শিল্পের কাছে। গানের কাছে, সিনেমার কাছে, কবিতার কাছে। সৃষ্টি করতে হয়তো সবাই পারে না, কিন্তু শিল্প উপভোগের অধিকার অন্তত সবারই আছে।
কবিতার কথাই ধরা যাক। কবিতার সংজ্ঞা মনে হয় পাঠকের উপরই নির্ভর করে। কেন মানুষ কবিতা পড়ে, কিংবা পড়তে চায়? নেহাতই একজন অজ্ঞ পাঠক হিসেবে বলতে পারি, — যা আমি অনুভব করি কিন্তু ঠিক প্রকাশ করতে পারি না, কিংবা যেভাবে প্রকাশ করি তার চেয়েও তীব্রভাবে, অন্যভাবে প্রকাশ করতে চাই, এবং যা আমি আগে কখনোই অনুভব করিনি, এমন সব অনুভূতির চমক-লাগানো ঝলকানি অনুভব করতে চাই বলেই কবিতা পড়ি। এর মধ্যে কিছু অনুভূতি শ্বাশত, কিছু একান্তই ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, আর কিছু এই সময়ের বাস্তবতায় তৈরি।
Some Texts are missing অথবা কিছু মায়া রহিয়া গেল সাঈদ জুবেরীর কবিতার বই। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে এই বইয়ের অনেক কবিতাই আমার আগেই পড়া। তবু লকডাউনের এই সময়ে আমি বারবার পাতা উল্টেছি এই বইয়ের।
আমার সংজ্ঞা অনুযায়ী, এর নামটাই একটা গভীর কবিতা; হাতে নিলে প্রথমেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে যে-কবিতাটা অনুভব করতে হয়। শিল্পী রনি আহম্মেদের মিস্টিক প্রচ্ছদ, আমার চোখে একটা কনট্রাস্ট তৈরি করে। ঠিক জীবনের দ্বান্দ্বিকতার মতো।
তারপরই পাওয়া যাবে কবির নিজের কথা, যেখানে তিনি দাবি করেছেন, তার জীবনের একটা খণ্ডিত সময়ের চিন্তা, যাপনের সত্য-মিথ্যার বিভ্রান্তি, আর বাস্তবতার সাথে তার ফারাক থেকে তৈরি লেখা নিয়ে এই বই; — যা কখনো কবিতা, কখনো গল্প কিংবা গদ্যের ভাব-ভঙ্গি নিয়ে মায়া তৈরি করতে থাকে। তাহলে, কবিতা কিংবা গদ্য না, এই বইয়ে যা আছে তা আসলে মায়া। বিভ্রম অর্থে, নাকি প্রেম? বিচারের ভার নিশ্চয়ই আমার, পাঠকের।
এই বইয়ের প্রথম লেখা ‘আ্যলিস ইন দ্য মাইনফিল্ড’। এটা কবিতা না, এটা একটা শ্বাসরুদ্ধকর জার্নি। এই মাইনফিল্ড একবিংশ শতাব্দীর। আমার কালের, আমার স্থানের, আমার অভিজ্ঞতার। লেখক একইসাথে সাবজেকটিভ এবং অবজেকটিভ। স্যাটায়ারের ঢঙে তিনি প্রেমিকার সাথে বসে সিনেমা দেখার বর্ণনা দিচ্ছেন, এমনকি যখন কান্না গিলে ফেলার কথা বলছেন তখনও সেই একই বিদ্রুপের সুর। তবু তার কষ্টটুকু পাঠকের সাথে ঠিকই কমিউনিকেট করে।
“কিছুই হইতে না চাইয়া, কিছুই হইতে না পারার দ্বৈরথে, জন্মান্ধের স্বপ্নদৃশ্যে, এই দৃশ্য-দুনিয়ার কোনো মীমাংসা হইল না…অসংখ্য আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া প্রতিবিম্বে নির্দেশ অমান্যকারী কোনো দেহভঙ্গি খুঁইজা না পাইয়া, স্বাধীনতার গপ্পোগুলায় আস্থা হারায়া ফেলতে হইল।”
(জন্মান্ধের স্বপ্নদৃশ্য)
আমার একজীবনের অসহায়ত্বের কথা দুই বাক্যে বলে ফেলা হয়েছে এখানে। তাই আমার কাছে এটাই কবিতা। আমি এটাই পড়তে চেয়েছিলাম।
“রাখালের জীবনী লইয়া তুমি মইরা যাইবা লোকাল বাসের কন্ডাক্টর হিসাবে, গণপিটুনিতে, বেধড়ক”
(লা-পাত্তা)
প্রমিত-আঞ্চলিকতা, সাধু-চলিত, বাংলা-ইংরেজি এমনকি হিন্দি, জগাখিচুড়ি শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করে আমি নিজে কথা বলি। আমার বাস্তবতায় ফেক আইডি, ফেসবুক যতখানি প্রাসঙ্গিক, এই মায়া-কবিতাগুলোও ঠিক সেই ভাষায় লেখা, ঠিক ততখানি প্রাসঙ্গিক।
“অফিসে আঙুলের ছাপ দিয়া প্রবেশের সময়
হুদাই নীল চাষীদের কথা মনে পইড়া যায়
মানুষ কি হেরে যাচ্ছে! নাকি, হেরে গেছে!!”
(জার্নাল ১৯)
কোন-এক অজানা কারণে, বইয়ের ব্যাক-কভারে এক কবি-সাংবাদিক এই বই পড়তে আমাকেই আহ্বান করেছেন, পাঠিকা সম্বোধন করে। যেন কেবল আমার জন্যেই এই বই। কিন্তু নারী হিসেবে আমি তো সাহিত্যের মূলধারার অনেক অনুভূতি থেকেই চিরবিচ্ছিন্ন, তাহলে? যদিও নিজের কবিতায় জুবেরী দাবি করেছেন, “পুরুষের দুনিয়ায় গোপনে ছেলেদের বেশে বের হওয়া” তিনি একজন নারী। কিন্তু সেই দাবি ধোপে টেকে না। কেননা, আরেক কবিতায় তিনি অম্লানবদনে স্বীকার করেছেন, একমাত্র “বিছানাতেই তিনি হইলেও হইতে পারেন তুখোড় নারীবাদী”। কিংবা ‘উড়ন্ত মেয়েছেলে’ কবিতায় টের পাওয়া যায়, ফাঁসের দড়িকে আশ্চর্য ডানা হিসেবে ব্যবহার করা মেয়েদের দেখে তার ভালো লাগে নাই। ভয় পেয়ে পালিয়েছেন।
ফলে পাঠিকা হিসেবে আমি কবির সাথে কমিউনিকেট করতে পারলেও, তাকে নিজের সাথে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সম্পর্কটা অস্বস্তির, সন্দেহের, অবিশ্বাসের।
“একটু দুরত্বে থাকো
নচেত খুন হয়ে যেতে পারো তুমি
আর আমি হয়ে যেতে পারি খুনী
তোমার চোখেও দেখছি একই বার্তা লেখা”
(সহাবস্থান)
প্রেমের নামেও কবি ধোঁকা দিয়েছেন। ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন শুধু বিচ্ছিন্নতার কথা। কখনো কখনো যদিও এই তীব্র বিচ্ছিন্নতাবোধই দুটি মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে।
“মেলায় হারায় যাওয়া একটা শিশু সারাদিনমান কানতে কানতে বিকালের দিকে ক্লান্ত হইয়া ভিড়ের দিকে চোখ তুইলা তাকায় দেখতে পায় — চোখের নিচে শুকায় যাওয়া একই রকম কান্নার দাগ লইয়া তার দিকে চাইয়া আছে আরেকটা হারানো শিশু…”
(যেভাবে আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাই, প্রিয়)
… …
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
- সিনেমার চিরকুট ৮ - January 19, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২ - January 17, 2025
COMMENTS