শোষণ-উপযোগী সম্পদের খোঁজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের আনাচকানাচে হন্যে হয়ে ঘুরেছে। প্রতি ইঞ্চি ভূমি তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। ১৮২৩ সালে এক বাণিজ্যিক অন্বেষণ (Mercantile exploration) চলাকালীন রবার্ট ব্রুস নামের জনৈক ইংরেজ অভিযাত্রী আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে বন্য চা গাছ আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই চা-এর বাণিজ্যিক চাষাবাদের চিন্তাভাবনা চলতে থাকে।
১৮৩৫ সালে আসামের লাখিমপুরে উপমহাদেশের প্রথম চা-বাগান চালু করা হয়। এর তিন বছর পর নমুনা হিসেবে ১২টি সিন্দুক-ভর্তি চা ইংল্যান্ডে পৌঁছে। চা-এর প্রথম চালানটি দীর্ঘ যাত্রাপথে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; তা সত্ত্বেও আসাম-চা এর স্বাদ-গন্ধ ব্রিটিশদের পাগল করে তোলে।
ব্যাপক চাহিদার কারণে চা-বাগানের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ১৮৫৫ সালে সুরমা উপত্যকায় বন্য চা আবিষ্কৃত হয়। আসামের ডারাং ও কামরূপের পর চতুর্থ চা-বাগানটি স্থাপিত হয় সিলেটের মালিনীছড়ায়; সিপাহি বিদ্রোহের বছর।
পশ্চিমা ঘাগি বনিকেরা পঙ্গপালের মতো আসাম ও শ্রীহট্টে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গোরা চা-করেরা অধিক মুনাফার ধান্দায় সস্তা শ্রম খরিদ করতে চাইল। স্থানীয় শ্রমিক না পেয়ে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, নাগপুর, সাঁওতাল পরগণা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশ থেকে হতদরিদ্র নরনারীকে ধরে ধরে আনা হলো। সেসব সহায়সম্বলহীন অসহায় মানুষের রক্ত-ঘামে প্রসার ঘটতে লাগল চা-শিল্পের।
চা-শিল্পের বিকাশের স্বার্থে শ্রীহট্ট ও কাছাড় জেলাকে বাংলা থেকে কেটে জুড়ে দেওয়া হলো নব-সৃষ্ট আসাম প্রদেশে; ১৮৭৪ সালে। প্রায় একশো বছর পশ্চিমা চা-করেরা লুটেপুটে খেলো এই অঞ্চলের চা-সম্পদ। কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে গেল ইংল্যান্ডে৷ আর চা গাছের সবুজ চাদরের নিচে চাপা পড়তে লাগল বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার চা-শ্রমিকের শোষণ-বঞ্চনা ও নির্যাতন-নিপীড়নের করুণ উপ্যাখান।
চা সপুষ্পক উদ্ভিদের টীয়েসি (Theaceae) গোত্রভুক্ত মাঝারি আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ। চা বৃক্ষ ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কিন্তু পাতার সংখ্যা বৃদ্ধি ও সংগ্রহের সুবিধার জন্য বাগানের গাছগুলোকে ছেঁটে ছেঁটে গুল্মে পরিণত করে রাখা হয়। চা গাছকে সাধারণত ৪ ফুটের অধিক লম্বা হতে দেয়া হয় না। বারংবার ছাঁটার ফলে গাছ ঘন ঝোপে পরিণত হয়।
ইংরজি টী (tea) শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে গ্রিকদেবী টীয়ার (Thea) নাম থেকে। ‘চ’-প্রধান চীনা ভাইদের হাতে পড়ে টী হয়ে গেল চি এবং এই চি-এর বিবর্তিত রূপ চা। অর্থাৎ রূপান্তরিত আকারে হলেও চা শব্দটির সঙ্গে গ্রিকদেবী টীয়ার নামটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল। উল্লেখ্য, গ্রিক পুরাণে বর্ণিত টাইটানদের একজন ছিলেন টীয়া। তিনি টাইটান ইউরেনাস ও ধরিত্রী দেবী গিয়া-র কন্যা। টীয়ার নামানুসারে চা-পরিবারের নামকরণ করা হয়েছে টীয়েসি (Theaceae) এবং একটি গণ নাম রাখা হয়েছে টীয়া (Thea)।
চা গাছের দ্বিপদ নাম Camellia sinensis (সমনাম: Thea sinensis)। গণ নাম ক্যামেলিয়া সপ্তদশ শতকের মিশনারি Georg Josef Kamel-এর স্মরণিক এবং প্রজাতিক পদ সাইনেন্সিস অর্থ চীনদেশীয়। যেহেতু চীনে প্রথম চা গাছ পাওয়া গিয়েছিল, তাই ধারণা করা হয়েছিল প্রজাতিটির ‘সেন্টার অব অরিজিন’ কেবল ওই দেশে। কিন্তু পরে বরাক উপত্যকা ও সুরমা উপত্যকায় বন্য চা গাছ আবিষ্কৃত হয়। এই বন্য জাতটিকে পোষ মানিয়ে উৎকৃষ্ট চা উৎপাদন করা হয় এবং এখনও হচ্ছে। কিন্তু প্রজাতিক পদের পূর্বনামটিই বহাল থেকে যায়।
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025
- শাহজালাল শাহপরান গ্রামবাঙলায় গাজির গান || তুহিন কান্তি দাস - November 22, 2025
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025

COMMENTS