বিসর্গতে দুঃখ, চন্দ্রবিন্দুতে মোক্ষ

বিসর্গতে দুঃখ, চন্দ্রবিন্দুতে মোক্ষ

ভেসে যায় আদরের নৌকো
ভেসে যায় সোহাগের সাম্পান
সিগারেটটুকরোরা
মুখচোরা
শিখছে স্নান
নুড়িঘেরা বালির স্তূপ
জোনাকির রূপ
বুকে নিয়ে চুপ

এই গানটা, আদরের নৌকো,  প্রায় বিশ বছর বা বিশ না-হলেও পনেরো/ষোলো তো হবেই শুনে আসছি। আজও অমলিন, আজও সমান রিফ্রেশিং মেলাঙ্কলিয়া, আজও অনবদ্য। চন্দ্রবিন্দু-র   অ্যালবামে এইটা আছে। এই গানটা লিরিক্যালি, লিরিক্সের দিক থেকে, এতই ইন্টেন্স এবং এতই প্রোফাউন্ড বিউটি যে এই বিষয়ে বেশি বিশদ করবার শক্তি কিংবা আসক্তিহীন অসুরতা আমার অন্তত নাই। লিরিক্স দিয়ে এমনতর স্যুরিয়্যাল ইল্যুশন তৈয়ার করা যায়, এইটা আগে বেশি ছিল না বাংলায় এক্সাম্পল। কবীর সুমন, তখন তো সুমন চট্টোপাধ্যায় বলা বাহুল্য, মনে রেখেই বিবৃতিটা পাঞ্চ করে রাখা গেল। শুধু এই গানেই নয়, এরপরে অনেক গানে এই জিনিশ চন্দ্রবিন্দু  করেছে দেখতে পাবো আমরা, নার্সারি রাইম ধাঁচটাকে স্ক্যাফোল্ড করে একের-পর-এক গানে এহেন স্যুরিয়্যালিটি এবং অ্যাবসার্ডিটি বিনিয়োগ করেছে এই দলটা বাংলা গানে। বেফায়দা হয়নি, বিনিয়োগ সফল হয়েছে, শ্রোতা-গানামোদিরা ব্যাপারটা ভালোভাবেই নিয়েছে।

এ-মুহূর্তে চন্দ্রবিন্দুর অন্য-সমস্ত গান রেখে এই গানটা মনে পড়ছে একটি বিশেষ কারণে। এর অসাধারণ সুরসৃজন বা আবহরচনা ইত্যাদি কারণে এ-মুহূর্তে গানটা স্মরণ করছি এমন নয়। এ নিয়ে, বাংলা লিরিক্স রচনায় এই দলটার কন্ট্রিবিউশন ও ইউনিক জায়গাটা কোথায় এইসব নিয়ে, একটা আলাদা বাতচিত হতেই পারে। এক্ষণে, এখন, এই গানে ফিমেলভয়েসের প্রয়োগটার জন্য গানটা আলাদাভাবেই ইয়াদ হচ্ছে। এমন গান বাংলায় কমই বের করা যাবে যা শুনে আপনার মনে হয়েছিল যে এই গান কোনো মেলভয়েসে গেয়ে এই ইম্প্যাক্ট/এফেক্ট আনা সম্ভব; খুব কম গানই এমন পাবেন যেখানে ফিমেলভয়েসটা খাপে-খাপ লিরিকের আত্মা হয়ে গিয়েছে। ইংরেজি এমন অসংখ্য গান আছে, এমনকি নিজের শোনা ইংরেজি গানের এক্সপেরিয়েন্স থেকে একনিঃশ্বাসে একশ ফিমেলভয়েসের ইংরেজি গান উল্লেখ আপনিও করতে পারবেন।

মহীনের ঘোড়াগুলি-র ক্ষেত্রে এই জিনিশটা আমরা আগে দেখেছি অবশ্য। অসাধারণ তিনটি ফিমেলভয়েস সুচারু প্রয়োগ লেজেন্ড গৌতমের ব্যান্ডটাকে একটা আলাদা তাৎপর্যে রেখেছে আমাদের কাছে আজও। “রাবেয়া কি রোকসানা / ঠিক তো মনে পড়ে না / অস্থির এ-ভাবনা / শুধু করে আনাগোনা” — এই গানে সেই ফিমেলভয়েস আজও অসম্ভব বিষণ্ন করে যায় আমাদেরে। এহেন অসহায় বিষণ্নবোধ কম বাংলা গানেই হবে আপনার। অথবা ঘোড়াদেরই কয়েকটা গানে এই তিনটি ভয়েসের পূর্ণমাত্রিক ব্যবহার, যেমন : আমার দক্ষিণখোলা জানলা / মাঘের এই একান্ত দুপুরবেলা — এই গানে সেই ভীষণ দুর্ধর্ষ সোপ্র্যানো-অপেরাগায়িকার আদলে কণ্ঠলগ্নি, ‘গানমালা’ শিরোনামের ট্র্যায়ো গানে, বা ‘পড়াশোনায় জলাঞ্জলি’ গানে সেই জ্যলি টিউন ও টোন্যাল এফেক্ট, আর টেরিফিক সেই গান দুইটা : “ও গঙ্গা তুমি চলেছ ঢেউয়ে ঢেউয়ে কোথায় / কখনো জোয়ারে আর কখনো ভাটায় / তবু রয়েছ দু-তীরেই বাঁধা হায়”, এবং গৌতমেরই যেন অটোবায়োগ্র্যাফিক সেই “ছিল বন্ধু এক আমার / পেলেম হঠাৎ দেখা তার / ভবঘুরে চালাচুলো নাই” গানে ফিমেলভয়েস এত অবধারিত সুপ্রযুক্ত যে এর তুলনা আমি পাই না বাংলায়। কে ছিলেন এই তিন শিল্পী? ক্যাসেটখাপগুলো খোয়া গিয়েছে চিরতরে আমার জীবন থেকে, এখন মনেও পড়ে না হায় সেই ফিমেল আর্টিস্ট তিনজনের নাম, তবে একজনের নাম ঋতুপর্ণা ছিল সম্ভবত, এইটুকু মনে পড়ে।

এমন একটা কণ্ঠ অবশ্য ভূমি  ব্যান্ডেও পেয়েছি পরে, ‘দিলদরিয়া’ গানে, বা ‘দুষ্টু হাওয়া এসে বলে’ গানটায়। যেমন মনে পড়বে একটা কণ্ঠ, ফিমেল ভয়েসের প্রসঙ্গ এলে, স্টানিং ফিমেল ভয়েস, লোপামুদ্রা মিত্র। অসম্ভব শক্তিস্বরুপিণী এক ভয়েস। হুইটনি হিউস্টনের বাংলা ভার্শন ভয়েস মনে হয় এই শিল্পীকে আমার বরাবর। ‘যাও পাখি’ গানের আবেদন কোনোদিন ফুরাবে কি? রিসেন্টলি একটা সিনেমায় লোপামুদ্রা একটা গানে সেই ‘যাও পাখি’ স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছেন হুহু সুরে, সেই মহাজাগতিক হাহাকার, “কতবার তোর বাড়ি গিয়ে ফিরে এলাম / আমার মতে তোর মতন কেউ নেই” — রূপঙ্কর বাগচী নিজে যে-ভার্শন গেয়েছেন, সেইটার চেয়ে লোপামুদ্রা ভার্শন এত অসহনীয় মধুর হয়েছে যা বলার নয়। হ্যাঁ, মৌসুমী ভৌমিকের ভয়েসও ভালো, কিংবা স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তও মন্দ নয়, কিন্তু গলার ভালো-মন্দও তো অনেক রকম হতে পারে জীবনানন্দবর্ণিত কবিতাকথার মতন; এবং অমীমাংসিত, বিশেষত ফিমেলভয়েস ফ্যাসিনেশন ব্যাপারটা, ব্যাখ্যাতীত। দরকারও নাই দুনিয়ার সবকিছু ব্যাখ্যা করবার।

চন্দ্রবিন্দু  ওই আদরের নৌকো  গানের টোনটা আর ব্যবহার করে নাই পূর্ণাঙ্গভাবে, পরবর্তীকালের কোনো অ্যালবামে, এইটা একটা আফসোস। যদিও ব্যাকভোক্যাল বা হামিং হিশেবে খুব সুন্দর প্রয়োগ রয়েছে বেশ-কয়েকটা গানে, যেমন দুর্ধর্ষ একটা গান “বন্ধু তোমায় এ-গান শোনাব বিকেলবেলায় / আরেকবার যদি তোমাদের দলে নাও খেলায়” — এবং এই গানে নেপথ্য থেকে ছায়াকণ্ঠী দোহার তথা হামিং, মার্ভেলাস্! এমন আরও বেশ কয়েকটা গানে ফিমেল ভয়েসের দোহারকি ব্যবহার করেছে বটে চন্দ্রবিন্দু, তবে আস্ত গান ওরা আর পরে করায় নাই। লিরিক্স অ্যালাও করে নাই বলেই হয়তো, কে জানে।

এইখানে ফের একবার গানটা ফিরে দেখা যাক অক্ষরে, দেখা যাক চুপছবিটিরে একদৃষ্টে তাকিয়ে :

ভেসে যায় আদরের নৌকো
তোমাদের ঘুম ভাঙে কলকাতায়
হ্যালোজেন বৃষ্টিকে
রঙ লিখে
ঘর পাঠায়
ভিখিরিরা স্বপ্ন পায়
তুষারের রাজধানী ধুয়ে যায় জ্যোৎস্নায়

ধুয়ে যায় আদরের পথঘাট
ভেসে যায় আরামের অঞ্চল
রেলিঙের ঘুমঘোরে
টুপ করে
কাঁদল জল
ডানাভাঙা একলা কাক
পথ ঘেঁষে থাক একলাটি থাক

এ-জন্মের রেলগাড়িরা যায়
জলপরী হাত ধুলো হাওয়ায়
হাওয়াকে সে আঁকে তার ডানায়
এই নরম চুল
ধুলোর ফুল
যায় ভেসে যায়

ভেসে যায় আদরের নৌকো
ভেসে যায় সোহাগের সাম্পান
সিগারেটটুকরোরা
মুখচোরা
শিখছে স্নান
নুড়িঘেরা বালির স্তূপ
জোনাকির রূপ
বুকে নিয়ে চুপ
(কবি : চন্দ্রিল ভট্টাচার্য; কবিতাগ্রন্থ/অ্যালবাম : চ; প্রকাশক : চন্দ্রবিন্দু)

জাহেদ আহমদ ২০১৩ 


গানপারে অ্যালবামরিভিয়্যু 

COMMENTS

error: