ভুটানের সিনেনির্মাতা পি. সি দর্জি নির্মিত চলচ্চিত্র Lunana: A Yak In The Class দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। ছবিটি গত বছর অস্কারের শর্ট লিস্টে স্থান পাওয়ায় আলোচিতও বটে! ভুটানের নিজস্ব সিনেভাষার বিকাশ-প্রকাশের ইতিহাস দীর্ঘ নয়। গত তিন দশক ধরে দেশটির নিজস্ব সিনেভাষা গতি লাভ করেছে মাত্র। নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত হিন্দি সিনেমা চুটিয়ে রাজত্ব করেছে সেখানে। নব্বইয়ের গোঁড়ায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সিনেমা বানানোর যজ্ঞ শুরু হয়। তারপর থেকে ফি বছর ত্রিশ-চল্লিশটির মতো সিনেমা পর্দায় অবমুক্ত করা হচ্ছে। ওটিটি প্লাটফর্মেও ভুটানের সিনেকারগণ জায়গা করে নিতে চলেছেন। সে যাহোক, পি. সি দর্জির কল্যাণে ভুটানিদের সিনেযাত্রার খবর করতে গিয়ে মনে হলো তিন দশকের যাত্রায় তাদের সিনেমার ভাষা ও বয়ান এগিয়েছে। মেধাবী ও তারুণ্যদীপ্ত নির্মাতারা একে-একে সেখানে উঠে আসছেন। ভুটানি সিনেমার নয়াতরঙ্গে বৌদ্ধ জীবনদর্শনে মাথা মোড়ানো খিয়েনসে নরবু-র ছবির সঙ্গে এই সুবাদেই পরিচয়। অন্তজ্য শ্রেণিকাঠামোয় বন্দি ভাস্কর শ্যাম আর দেবদাসী লীলার প্রেমকাহিনি ঘিরে আবর্তিত Vara: A Blessing হচ্ছে প্রথম ছবি যেটা আমি দেখেছি। ছবিটি ২০১৩-য় মুক্তি পেলেও এ-সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ জানা ছিল না। ইংরেজি ভাষায় নির্মিত সিনেবয়ানে সামন্তবাদী গ্রামীণ সমাজে অসম প্রেমের কাহিনির সঙ্গে বর্ণপ্রথা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার সাংঘর্ষিক জটিলতা ক্যামেরায় উঠিয়ে আনতে পরিচালককে বেশ ব্যগ্র মনে হয়েছে। আরণ্যিক গ্রামীণ সমাজে ভাস্কর শ্যাম ও দেবদাসী লীলার অসম প্রেম ছবিতে সফল পরিণতি পায় না। বর্ণপ্রথার নিগড়ে জৈববাসনার চোরাটান হার মানতে বাধ্য হয়। প্রেম এক মহান শিল্পকলা; সকল রক্ত আর কান্নাকে অতিক্রম করে অজেয় ভাস্কর্যে খোদাই মূর্তির মতো সে চিরকাল জেগে থাকে; তার চোখ থেকে রক্ত ও কান্না অবিরত ঝরে কিন্তু তবু সে জাগ্রত থাকে চিরকাল;—এই বার্তাটি ছবিতে যে-কারণে অধরা থাকে অথবা অতিরঞ্জন এড়াতে পরিচালক সেভাবে কাহিনি তামাদি করেন। নরবু-র ছবির প্রসাদগুণ সম্ভবত তাঁর চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফির মধ্যে নিহিত। কাহিনির সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে পরিচালকের এই কারুকাজ দেখতে বেশ লেগেছে। ভাস্কর ও দেবদাসীর বিফল প্রণয় সারবস্তু হলেও আরণ্যিক প্রকৃতির দৃশ্যায়ন, ধ্রুপদি সংগীতের সঙ্গে কর্নাটকী নৃত্যের মিলন মনোগ্রাহি ছিল। দেবদাসী লীলার চপলতাভরা উচ্ছলতার ফোঁকর গলে যত রক্ত ও ক্রন্দন সেখানে চুঁইয়ে পড়েছে তাকে ক্যামেরায় তুলে আনতে নরবুকে সজাগ মনে হয়েছে। ছবির মূল কাহিনিতে তিনি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন বলে ধারণা করি। মূল গল্পে ভাস্কর শ্যাম মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক ছিল বলে জেনেছি। গল্পের পটভূমি সাজাতে বসে অথবা ঝুঁকি ও বিতর্ক এড়াতে কাজটি তিনি করতে বাধ্য ছিলেন হয়তো! ছবিটি সরাসরি ভুটানি বা বাংলা ভাষায় নির্মিত হলে তৃতীয় মাত্রায় উপনীত হতে পারত। বাংলা বলছি এ-কারণে, আদি কাহিনিটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রক্ত আর কান্না নামের ছোটগল্প থেকে তিনি ধার করেছিলেন। ইংরেজি সংলাপ ব্যবহারের কারণে যারপরনাই শুরু থেকে বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেরুদূরত্ব মনে প্রবল হয়। চিত্রনাট্য ও সংলাপে প্রাণ-প্রতিষ্ঠার ঘাটতি মনে অস্বস্তির মতো বহে। ভুটানি বা বাংলায় গমন করলে সংলাপ ও অভিনয়ের এই জায়গাটি আরো জোরালো হয়ে উঠতেও পারত। স্বকীয়তা অন্বেষণে নেমে ভুটানের সিনেভাষা ক্রমশ আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে চাইছে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পি. সি দর্জির লুলানার সিনেবয়ানে বিষয়টি চোখে পড়ে। যতদূর জানি, ভুটান হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা দেশের অগ্রগতিকে জিডিপি-র পরিবর্তে জিএনপি (Gross National Happiness) দিয়ে পরিমাপ করে। জাতীয় সুখ মাপার তরিকাটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভুটানবাসীর মনোজগতে এর প্রভাব বা দ্বন্দ্বিকতা তাদের সিনেভাষায় জায়গা করে নিয়েছে। দর্জির ছবিটি যেসব দর্শক দেখেছেন তাদের সেটা অজানা থাকার কথা নয়। বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিক মর্ম ও সংবেদন ছবির উপজীব্য হয় প্রায়শ। সেটা দর্জি বা নরবু-র ছবিতেও উঁকি দিয়েছে বৈকি। যদিও পি. সি দর্জির তুলনায় নরবুকে এখানে খানিক ম্লান মনে হয়েছে। সিনেমায় সাহিত্যের ভাষান্তর জটিল ও দুরূহ কাজ। সুনীলের বয়ান থেকে পরিচালক কতটা কী বেরিয়ে আসতে পেরেছেন অথবা কী পরিমাণ নতুনত্ব সেখানে যোগ হলো, সেটা মূল গল্প না পড়া অবধি বিবেচনা করা মুশকিল। সিনেমাটিক এক্সপোজার তৈরিতে তাঁর সচেতনা অবশ্য এই ইশারা দেয়,—সুনীলের গল্পের এ্যাডাপ্টেশনে তিনি স্বাধীনতা নিয়েছেন। বর্ণপ্রথার দুঃসহ জাঁতাকলে বন্দি লীলার বলিদান আরো সংবেদী হতে পারত কি-না এই প্রশ্নও ছবিটি দেখতে বসে মনে জাগে। সে যাহোক, যদি দেখে থাকেন তো ভালো। আর না দেখে থাকলে সময় করে দেখে নিয়েন। আরণ্যিক প্রকৃতির মাঝে নৃত্য ও সংগীতের যুগলবন্দি সমাহারে গাঁথা সিনেবয়ানটি মনে হয় না বিরক্তি উদ্রেক করবে মনে। লিংক : Vara: A Blessing (2013); Dircetor: Khyentse Norbu; Adaptation: Sunil Gangopadhyay; |
COMMENTS