হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব

হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা দুটো নাটক নিয়ে কেউ তেমন কথা বলে না। টুডে ইজ ফ্রাইডে  ১৯২৬ সালে লেখা শেষ হয়। এটা একটা একাঙ্কিকা নাটক। মাত্র তিনটা চরিত্র আছে এখানে। কাহিনিটা এমন যে তিনজন রোমার সৈনিক একটা শুঁড়িখানায় প্রায়ই একসাথে বসে। তারা তাদের দেখা ক্রুশবিদ্ধ হবার কাহিনি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। এর মধ্যে সেই বিকেলে যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ হবার কাহিনিও চলে আসে, যা তারা খুব কাছ থেকে দেখেছিল পেশাগত কারণে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনজনের তিন রকম প্রতিক্রিয়া। প্রথম সৈনিক যিশুর অহিংস্রতাকে খুব সম্মানের চোখে দেখেন। তার কথায় বোঝা যায়, “সেদিন তাকে আনন্দিত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।” এই কথাগুলো যেনো হেমিংওয়ের নিজের কথা। আর একজন সৈনিক নানা রকম প্রশ্ন করে যাচ্ছিল ঐ বিষয়ে আর এই ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি করছিল। তৃতীয় সৈনিক তার ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলেছিল, “আমার মধ্যে তেমন কোনো দুঃখ কাজ করেনি। শুধু মনে হয়েছে যেন নরকে বসে আছি।”

তার অপর নাটকটি হলো দ্য ফিফথ কলাম । ১৯৩৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিন্ট থিয়েটার কোম্পানি ম্যানহ্যাটনে প্রথম এই নাটকটি মঞ্চস্থ করে। ১৯৩৬-এ স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তখন নর্থ আমেরিকান নিউজপেপার অ্যালিয়েন্স, এর যুদ্ধ বিষযক সাংবাদিক হিসাবে হেমিংওয়েকে নিয়োগ দেয়। ফ্রাঙ্কো একবার মাদ্রিদের জনগণের জন্য চার কলামের একটা উপদেশবাণী পাঠ করেছিল আর পাঁচ নম্বর কলাম পাঠ করেছিলেন লয়ালিস্ট পার্টির গোপন সদস্যদের উদ্দেশ্যে যারা এই শহরেই ছিল। দ্য ফিফথ কলাম  — ফ্রাঙ্কোকে করুণা করার জন্য তিনি এটা লেখেননি। তিনি একজন সাংবাদিক হিসাবেই এটা লিখেছিলেন, যদিও তিনি ছিলেন রিপাবলিকানদের গোপন সমর্থক। তিনি অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে হোটেল ফ্লোরিডায় ছিলেন।

মাত্র কদিন আগে একটা অপ্রকাশিত চিঠি উদ্ধার হয়েছে। সেখানে তিনি ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর হার্বার্ট ম্যাথিউ, ইউনাইটেড প্রেস-এর হেনরি টি. গেরেলের কাছে ব্যাখ্যা করছেন, “ডেইলি এক্সপ্রেস-এর সেফটন দেলমার, কোলিয়ারস-এর মার্থা গেলহর্ন, ভার্জিনিয়া কাউলেস, তারপর হেয়াস্ট যে এখন লন্ডন টাইম-এর জন্য কাজ করে, জরিস আইভেন যিনি ‘স্পানিশ আর্থ’ বানিয়েছেন, জনি ফর্নো যিনি এর ছবি তুলেছেন, ‘আমেরিকান উইকলি’-এর জোসেফিন হাবস্ট এবং মানবাধিকার সংস্থার নানা কর্মী, সিডনি ফ্রাঙ্কলিংক যে আমার হয়ে কাজ করে, সমস্ত বিভন্ন দেশের উর্ধ্বসেনা কর্মকর্তা, মহান সব নেতা কারা ছিল না সেদিন সন্ধ্যায় হোটেল ফ্লোরিডায়।”

দ্য ফিফথ কলাম -এর ভূমিকায় লিখেছেন “হোটেলটিতে কয়েকবার বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।” এর সাথে সাথে লিখেছেন, “তাই যদি মনে করা হয় যে নাটকটির মধ্যে আসলেই কিছু নেই তাতে তেমন কিছু আসে যায় না। আর যদি এটা ভালো মনে হয় তবে সম্ভবত ত্রিশটি বোমা এটা লিখতে সাহায্য করেছে আমাকে।”

সেই চিঠিতে তিনি আরও খোলাসাভাবে কথা বলেছেন : “১৯৩৭-এর শেষের দিকে যখন আমি পুরোদমে নাটকটি লিখছি তখন হোটেলের টপ ফ্লোরে একটা জনপ্রাণিও ছিল না। কেউ যদি নিতান্ত পাগল হয় তবে টপ ফ্লোরে যাবে বোমার আঘাতে মরার জন্য। কিন্তু দুটো রুম যেখানে আমরা থাকতাম তাকে সেনাবাহিনীর লোকেরা ডেথ অ্যাঙ্গেল বলে ডাকত। হোটেলের যে-কোনো অংশ আক্রান্ত হতে পারত এবং হয়েছেও তাই। যতক্ষণ-না গ্যারবিতান পাহাড় থেকে বিদ্যুৎউৎস সরিয়ে না নেওয়া হচ্ছে, যতক্ষণ-না কামানগুলোর মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ ১১২ আর ১১৩ নম্বর রুম আক্রান্ত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ এর চারপাশে তিনটা আলাদা বাড়ি ছিল আর রাস্তার ওপাশেও একইভাবে বাড়ি ছিল যা এই রুম দুটিকে ঘিরে রেখেছে।”

“হোটেলের অন্যান্য অংশ বাইশটা ভারী বোমার আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর আমার কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেল। হোটেলের যে-অংশে বোমার আঘাত কম পড়ার কথা সেখানে থাকাই বেশি শ্রেয় বলে মনে হয় আমার কাছে, কারণ তুমি জানো কোথায় কোথায় বোমাটি বিস্ফোরিত হতে পারে। এর থেকে বরং অন্য হোটেলেই যাওয়া ভালো যেখানে তোমাকে খুঁজে পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই বা ছাদে বোমা পড়ার কোনো ভয় নেই।”

“হ্যাঁ আমার বেশ আত্মবিশ্বাস ছিল হোটেল ফ্লোরিডায় থাকার সময়। তখন ফ্রাঙ্কো মাদ্রিদে প্রবেশ করেছে। ১১২ আর ১১৩ নম্বর রুম এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে। এটা ভাবনার অতীত।”

মিন্ট থিয়েটার কোম্পানি কোনো নাটকের উদ্বোধনী নিয়ে জমকালো আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করে না। কিন্তু দ্য ফিফথ কলাম -এর প্রিমিয়ার অনুষ্ঠান বেশ ভালোভাবেই পালন করা হয়েছে। কোম্পানির শিল্পনিদের্শক জনাথান ব্যাঙ্ক সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, “এটা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, সেবারই প্রথম হেমিংওয়ের নাটক পেশাগত দক্ষতার সাথে আমেরিকায় মঞ্চস্থ করা হয়।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, “এর একটা ত্রুটিপূর্ণ মঞ্চায়ন হতে পারত। সেভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৬৩ সালে এটা একবার প্রদর্শিত হয়েছে। মিখায়েল পায়েলের বায়োগ্রাফিতে আমি এটা দেখেছি। আমি এও জানি চল্লিশের দশকে তিনিই স্কটল্যান্ডের মঞ্চে এটা পরিচালনা করেছেন।”

হলিউডের বেঞ্জামিন গ্লেজার যিনি অ্যা ফেয়ারঅয়েল টু আর্ম স্-এর চিত্রনাট্য লেখার জন্য বিখ্যাত তিনি হেমিংওয়েরদ্য ফিফথ কলাম -এর নানা পরিবর্তন সাধন করে ‘অ্যাডপটেশন’ আকারে এর একটা ভিন্ন মাত্রা দেন। এখন পর্যন্ত সেটাই প্রদর্শিত হয়ে আসছে কোনোরূপ পরিবর্তিত না হয়ে। দ্য ফিফথ কলাম  লেখার পর থেকে তা নানা করণেই প্রদর্শিত হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত থিয়েটার গিল্ড ১৯৩৯-এর পর স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদের আপোসহীন ক্রুসেড’ হিসাবে এ নাটকটির সব দায়দায়িত্ব নিয়ে নেয়। ১৯৪০ সাল থেকে বেঞ্জামিন কর্তৃক পরিবর্তিত দ্য ফিফথ কলাম  নিয়মিত প্রদর্শিত হয়ে আসছে। তবে এই পরিবর্তন নিয়ে হেমিংওয়ের তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না, কেননা তিনি তখন তার স্প্যানিশ যুদ্ধ সম্পর্কিত বিখ্যাত উপন্যাস ফর হুম দ্য বেল টলস  লিখে চলেছেন। এমনকি কখনও তিনি এটা দেখতে পর্যন্ত যাননি। জনাথান ব্যাঙ্কের মতে, “এটা বলা যায় যে ঐ নাটকের আশি পার্সেন্টই গ্লেজার পরিবর্তন করেছেন, মাত্র দশ পার্সেন্ট কন্টেক্সট ছিল হেমিংওয়ের। এরা পুরোটাই পুনঃনির্মিত করেছেন গ্লেজার। ভালোই এবং ভয়ংকরও এটা।”

হেমিংওয়ের দ্য ফিফথ কলাম অ্যান্ড দ্য ফার্স্ট ফোরটিনাইন স্টোরিস  ১৯৩৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ফিলিপ রোলিং নামে একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল, তিনি তাদের সহকর্মী আর কম্যুনিস্টদের ‘কমরেড’ নামে ডাকতেন। গ্লেজার কর্তৃক পুনঃনির্মিত দ্য ফিফথ কলাম এ এই চরিত্রগুলো পুরোপুরি অনুপস্থিত। ব্যাঙ্কের মতে এই পরিবর্তন সম্ভবত ১৯৪০ সালে থিয়েটার গিল্ড করেছে শুধুমাত্র কিছু রাজনৈতিক কারণে। হেমিংওয়ে যা আবিষ্কার করেছিলেন, যা ভেবেছিলেন সে-সমস্তের ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে গ্লেজারের নির্মাণে।

গ্লেজার বেশ কয়েকটি সফল চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। তার অ্যা ফেয়ারঅয়েল টু আর্ম স্  খুবই বিখ্যাত একটি চিত্রনাট্য যা হলিউডে বেশ সাড়া ফেলেছিল। বেঞ্জামিন গ্লেজার আবার ছিলেন হেমিংওয়ের আইনউপদেষ্টা মরিস প্রেইচারের শ্যালক। কথা ছিল যে মরিসই এই চিত্রনাট্য লেখার বিষয়ে গ্লেজারকে সাহায্য করবেন। গ্লেজারের মতে, দ্য ফিফথ কলাম  নাটকে একটা নাটকীয় বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের দরকার ছিল। এর জন্য এটা পুনরায় লেখার প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে হেমিংওয়ে পাবেন ৫০ পার্সেন্ট রয়ালিটি। আর এই পুনঃলিখা যদি হেমিংওয়ের পছন্দ হয় তবে এটা তার নামে প্রচারিত হবে। না হলে এটাকে বলা হবে ‘অ্যাডাপটেশন’।

ব্যাঙ্কের মতে, “কিছু কিছু বিষয় দেখে আমার মনে হয় যে, হেমিংওয়ে মনে করতেন লিখিত নাটক আর তার মঞ্চায়ন আর উপন্যাস থেকে সিনেমা করা এ-দুটোর মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এটা তার পক্ষে কখনোই বলা সম্ভব হয়নি যে আসলে এটা কিছুই হয়নি।”

গ্লেজার এই নাটকের কী বেশি অপছন্দ করেছিল? এটা বোধহয় এখন বোঝা যায়। একটা নারী চরিত্র, ডরোথি ব্রিগ্রেজ যিনি মার্থা গেলহর্নের আদলে গড়ে উঠেছেন। সে ছিল হেমিংওয়ের উপপত্নী, পরে অবশ্য সে তার তৃতীয় স্ত্রী। ডরোথিরও গেলহর্নের মতো একটা ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনি আছে, প্রথমত সে একজন বিবাহিত লোকের সাথে অপরাধহীনের মতো প্রেম করতে থাকে এবং এরপর রোলিং-এর সাথেও একইভাবে।

গ্লেজার এই-জাতীয় বহুগামী একটা নারী চরিত্রে পরিবর্তন করল। ফলে সে শেলের আঘাতে বিক্ষত রোলিং দ্বারা কাহিনির শুরুতেই তাকে ধর্ষণ করালো। ফলে স্বভাবতই তার প্রতি একটা স্বতঃস্ফূর্ত করুণার ছায়া ফেলা গেল প্রথমেই।

“আমার মনে হয় গ্লেজার ব্যর্থ হয়েছিল এমন একটা দারুণ এবং জটিল চরিত্রের উপর আলো ফেলতে।” — ব্যাঙ্ক এমনই মনে করেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে, “কয়েকজন মানুষকে একটা বোমা-আক্রান্ত হোটেলের মধ্যে বন্দি করে একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। কোনো সাধারণ অবস্থায় এটা ঘটা সম্ভব নয়। হেমিংওয়ে পরে লিখেছেন তারা পরস্পরকে ধর্ষণ করা শুরু করল।” হেমিংওয়ের লেখা সাত পৃষ্ঠার একটা চিঠি ব্যাঙ্ক আবিষ্কার করেছেন ইয়েলের ব্রেইনেক লাইব্রেরিতে। এটা খুঁজে পাওয়া গেছে বেশ পরে; যখন থিয়েটার গিল্ড-এর যা পাবার তা তারা পেয়ে গেছে।

হেমিংওয়ের ইচ্ছা ছিল চিঠিটা নিউ ইর্য়ক টাইমস-এ ছাপা হোক। কিন্তু তার প্রায় সত্তর বছর পর তা ছাপা হলো তাও আবার কিছু অংশ বাদ দিয়ে।

“খাবার ছিল খুবই বাজে এবং অপর্যাপ্ত। ফলে আমরা আমাদের ঘরেই রান্না করতাম। সে-সময় সিডনি ফ্র্যাঙ্কলিন সকালের নাস্তা তৈরি করত। আর সে-সময় কেউ যদি খাদ্য সহ আমাদের আড্ডায় এসে উপস্থিত হতো তবে তাকে স্বাগত জানানো হতো। নতুবা তাদের মাত্র একবেলা খেতে দেওয়া হতো। কিন্তু পরের বেলায় তাদেরকে একপ্রকার অপমান করেই তাড়িয়ে দিত সিডনি।

সিডনির রাগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেদিনই পৌঁছায় যেদিন মিস গেলহর্ন তার নিজের ঘরে রাখার জন্য কয়েক কৌটা কমলালেবুর জ্যাম চায়। কারণ সে আর মেসে সকালের নাস্তা করতে পারছিল না, কারণ সেগুলো ছিল মুখে তোলার অযোগ্য।”

সেইসময় হেমিংওয়েকে পোপ নামে ডাকা হতো। এবং নর্থ আমেরিকান নিউজপেপার অ্যালিয়েন্স-এর জন হুইলার ছিল তার বস্। তিনি হেমিংওয়ের এককথায় প্রচুর ডলার দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সেখানে আর বাকিদের কাকে কত দেওয়া হলো সে-বিষয়ে তিনি খুব বেশি উদাসীন ছিলেন।

“এই মেয়ে নিজেকে কী ভাবে? — সিডনি এই কথা জিজ্ঞেস করেছিল আমাদের সকলকে। ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি পোপ একদিনে যত কাজ করে এই মেয়ে তার এক কানাও করতে পারবে না একমাসে। পোপ যদি খুব স্থিরচিত্তের হতো!’ — খুব কাতর কণ্ঠে এই কথা বলেছিল সিডনি। সে-সময় সিডনি আমার মাত্র দশ পার্সেন্ট পেত। তবে আমরা কোনো ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হতাম না। সিডনি আমার মহান এবং পুরনো বন্ধু। সে ছিল বুলফাইটার। এবং সে জানে টাকার জন্য মৃত্যুর সম্মুখে নিজেকে কতটা উন্মুক্ত করতে হয়।”

হেমিংওয়ে একটা বোমা হামলার বর্ণনা করেছেন এভাবে :

“সব দৃশ্যের হয়তো বর্ণনা হয় না। যেদিন প্রথম হোটেল ফ্লোরিডার উপর বোমা হামলা হলো সেটা হয়তো চলচ্চিত্রে দেখানোর মতো একটা ভালো দৃশ্য। যখন দিনের বেলায় বোমা হামলা শুরু হলো, প্রথম বোমাটা হোটেল বিল্ডিং-এর কাছে এসে পড়ল তখন সমস্ত হোটেলে গোছগাছ শুরু হয়ে গেল। (সেদিন সাতটারও বেশি বোম পড়েছিল আর এগারোশ রাউন্ড গুলি ফুটেছিল শহরে।) ছোট ছোট দলে লোকজন চলে যাচ্ছিল রুম ছেড়ে। দম্পতিরা তাদের পিঠের উপর রাতে শোবার জন্য তোষক বেঁধে হোটেলের বিভিন্ন তলা থেকে দিশেহারা অবস্থায় নেমে আসছিল। ধ্বংসস্তূপ আর ধুলোর মেঘের মধ্যে অ্যান্টেনিও ডি সেন্ট এক্সোপেরিতে হলুদ গ্রেপফ্রুটস বিক্রি হচ্ছিল। বোম আক্রমণের প্রথম দিন ভ্যালেসিয়ার কাছ থেকে সে দু বুসেলে এই ফল কিনেছিল।

ধ্বংস। চারপাশে শুধু ধুলো আর ধুলো। মানুষ তোষকের নিচে ঘুমাচ্ছে। মেয়েদের চিৎকার অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে ভোর হবার আগেই।

ধ্বংস। চারপাশে শুধু ধুলো আর ধুলো। বারুদের তীব্র গন্ধ। স্ফুলিঙ্গের শলাকা নেমে আসছে যেন আকাশ থেকে। মেয়েরা ভাবতেই পারেনি শুয়ে তারা এমন অনন্ত বাস্তবতার মুখোমুখি হবে যতক্ষণ-না তারা গভীর কোনো চিন্তার ভেতর নিজেদের হারিয়ে ফেলছে।

এই ঘটনাকে একটা নাটকে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া আর পদ্ধতির কিছু বর্ণনা করেছেন হেমিংওয়ে চিঠির শেষ অংশে :

“এই নাটকটি সম্পর্কে বলা যায় : কোনো স্থান সম্পর্কে বর্ণনা না করে মাত্র সংলাপ লিখে যাওয়া বেশ উত্তেজনাকর এবং আনন্দদায়ক। তুমি বলতে পারো জায়গাটা এমন। উপন্যাসের মতো তোমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করার দরকার নেই এক্ষেত্রে। পাঠকরা হেঁটে বেড়াবে এবং এতেই বিশ্বাস করবে। একজন সেটডিজাইনার তার জ্ঞান থেকে এই কাজটি অতি সহজেই করতে পারে।

আমি সংলাপ টাইপরাইটারের বদলে পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলাম কেননা টাইপরাইটার থেকে আমার পেন্সিল দ্রুত চলে। কিন্তু আমি যখন দেশ বানাই, নগর গড়ি বা নদীর জন্ম দেই কোনো উপন্যাসে তখন খুব ধীরে ধীরে লিখতে থাকি। কেননা সেখানে এদেরকে প্রতিনিয়ত আমার গড়ে তুলতে হয়। তা না হলে এরা জীবন্ত হয়ে উঠবে না। কেউই খুব দ্রুততার সাথে বা খুব সহজেই খুব ভালো কিছু সৃজন করতে পারে না।

একটা নাটক তৈরি হয় এটা লেখার পর। অন্য লোকের মহান সৃষ্টি তুমি তখনই বুঝবে যখন তুমি লিখতে আসবে। আমি এখন একবছর একমাস যাবৎ খুব ধীরে ধীরে একটা উপন্যাস লিখছি। এক্ষেত্রে আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারে না। কিন্তু একটা সফল নাটকের কৃতিত্ব নির্ভর করে মঞ্চ, পরিচালক আর অভিনেতাদের কঠোর পরিশ্রমের উপর। আমার কাছে বেশ মজার বিষয়টা। বেশ, একবারের জন্য হলেও নাটক লেখা, এমন আদানপ্রদান মন্দ নয়।

একটা সৌভাগ্যের বিষয় যে আমাকে মার্চ ১৯৩৭ থেকে মে ১৯৩৮ পর্যন্ত হোটেল ফ্লোরিডার একটা কক্ষে থাকতে হয়েছিল। সে-সময় হোটেল ফ্লোরিডার কক্ষে বসে আমি এমন অনেককিছু শিখেছিলাম যা তুমি পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্ত থেকেই শিখে নিতে পারো। আমি আমার সমস্ত সময় হোটেলের কামরায় কাটাইনি। কিন্তু যতবারই আমি এই কক্ষে ফিরে এসেছি ততবারই নতুন কিছু-না-কিছু শিখেছি। বোমবর্ষণ আর তার পরবর্তী মুহূর্তুগুলো, জীবনের যে-কোনো জিনিস নিয়েই রসিকতা করার মতো ক্ষমতা আমাকে দিয়েছে।”


  • লাল জীপের ডায়েরী   পত্রিকায় এইটা ছাপা হয়েছিল ২০১২ নভেম্বরে।

    … …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you