লাইভ ফ্রম টাইটানিক (দ্বিতীয়াংশ) || স্লাভো জিজেক

লাইভ ফ্রম টাইটানিক (দ্বিতীয়াংশ) || স্লাভো জিজেক

টাইটানিক ডুবল কেমনে? বেশিরভাগ দর্শকেই বলবেন আইসবার্গে ধাক্কা খায়ে। খেয়াল করে দেখবেন, ডুবো বরফপাহাড়ে ধাক্কা খাইবার লগে-লগেই কিন্তু জাহাজ ডুবতেসে না, জাহাজ ডুবতে শুরু করছে সেই মুহূর্ত থেকে যে-মুহূর্তে সেক্স সেরে জ্যাক-রৌজ্ যুগলটা যায় একটা ওপেন স্পেসে, একদম উপরের জাহাজডেকে, এবং দুইজনা গাঁটছড়া বাঁধবার — মানে, একলগে থাকবার — ডিসিশন নেয়। সেই সিক্যুয়েন্সেই দেখবেন পয়লা পানি ঢোকে এবং টাইটানিক তলাইবার শুরুয়াৎ হয়।

— হ্যেই ল্যুক অ্যাট দিস্!

লক্ষ করব যে প্রায়ই হিস্ট্রিতে যেসব বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটে সেসব ঘটনা পৌরাণিক আখ্যানের ফর্মেশন পায় এবং ব্যক্তি বা আইডিয়া ইত্যাদি জিনিশগুলাকে এন্ড অফ দি ডে এই মিথগুলাই দিশা দেখায়। ইয়াদ করে দেখুন ১৯৬৮ সালে চেখোস্লোভ্যাকিয়ায় তথাকথিত প্রাগ-স্প্রিং লম্বাকরণের নেপথ্যে সোভিয়েত আর্মি এবং ওয়ার্শো মিত্রবাহিনীর যেই ইন্টার্ভেনশন।

মানুষমুখো সোশ্যালিজমের চেহারা ইন্ট্রোডিউস করাইবার চেখ ডেমোক্র্যাটিক কম্যুনিস্টদের অ্যাটেম্পটা আরেকবার ইয়াদ করাই। ইউজ্যুয়্যালি এই ব্রুট্যাল সোভিয়েত ইন্টার্ভেনশনটারে আমরা প্রাগ-স্প্রিং ঘটনাটার দিবাস্বপ্নহন্তারক সাব্যস্ত করিয়া থাকি। কিন্তু আমি মনে করি উল্টো, হন্তা নয়, বরং প্রাগের গণজাগরণের স্বপ্নটারে বাঁচিয়েছে এই ইন্টার্ভেনশন। হয় চেখোস্লোভ্যাকিয়া আর-পাঁচটা সাধারণ উদারপন্থী ক্যাপিট্যালিস্ট স্টেইটের দিকে টার্ন নেবে, অথবা আরেকটা জিনিশ হতে পারে যেইটা ওই যেইসব জায়গায় রিফর্মিস্ট কম্যুনিস্টেদের ভাগ্যরেখা আমরা দেখসিলাম তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্টরা চাইত বা চাইতে বাধ্য হতো নির্দিষ্ট একটা সীমা নির্ধারণ করে নিতে। এইরকমই বলত হয়তো যে, আচ্ছা, ঠিকাসে বাবা, স্বাধীনতার আস্বাদ চাইসিলা তা পাইসো অতএব আইসো এইবার সীমানাটা দাগ দিয়া দেখায়া দেই। ফ্রিডমের ফান তো নিলা, আর কত, আসো তোমার লিমিটটা বাৎলায়া দেই তোমারে। এইখানে দেখেন খিয়াল কইরা যে, ওই যে বলতেসিলাম, সোভিয়েত ইন্টার্ভেনশনটা আদতে একটার পরে একটা এবং এইভাবে অ্যা সিরিজ অফ কম্যুনিজমের পসিবিলিটি পয়দাইবার খোয়াবটা জারি রাখসে।

এইখানে, এই টাইটানিকে, দেখবেন যে একটা সাময়িক বিপর্যয়ের ভিতর দিয়া আমরা পাই পীরিতি-প্রেমেরই আখ্যান একটা যা কিনা যেভাবে ঘটেছিল সেভাবেই দেখাইবার দাবিটা জানায়া যায় এবং তার ভিতরের আইডিয়াটা চুপায়া ব্যাপারটারে একদম ইটার্নিটির জায়গায় নিয়া যাইতে চায়। টাইটানিকের বিপর্যয়টারে আমরা আল্টিমেইটলি ইটার্ন্যাল ল্যভের মায়াবিভ্রম অটুট রাখবার একটা মরিয়া চেষ্টা হিশেবেই দেখতে পাবো।

সম্ভবত আরেকটা জিনিশ এইখানে দেখতে পাবো আমরা, আর তা হচ্ছে, আইডিয়োলোজি ইফেক্টিভলি কীভাবে কাজ করে এই জিনিশটা। টাইটানিককাণ্ডটাকে স্যুপার্ফিশিয়্যাল দুইটা লেভেল থেকে দেখবার মতো রসদ-আলামত হাজির আছে। একটা হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টের লেভেল এবং আরেকটা ল্যভ স্টোরির লেভেল। তবে আমাদের উদার প্রোগ্রেসিভ মাইন্ডগুলার কাছে দুইটা লেভেলই প্রায় সমানে সমান গ্রহণযোগ্যতা বা আশকারা পায়। এই দুইটাই কিন্তু ট্র্যাপ, ফাঁদ। দুইটাতেই আছে এমন একটাকিছু যা আমাদের মনোযোগটাকে একটুখানি নিচে নামায়ে নেয়, ঢিলাঢালা করে দেয়, যেন ঘটনাটা আসলেই ঢিলাঢালা, আমাদেরে একটু খুলেমেলে দেখাতে হেল্প করে, এমন একটা মেস্যাজের পুনরুদয় ঘটায় আমাদের মধ্যে যে গরিবের ভাইট্যালিটি নিষ্ঠুরভাবে এস্তেমাল করে হলেও ধনিকেরা আপন গোত্রটারে রিভাইট্যালাইজ করে নেবে এতে দোষের কিছু নাই।

— দ্যেয়ার’জ্ নো ওয়ান দ্যেয়ার স্যার।

দুর্দান্ত একটা ডিটেইলের দেখা পাই আমরা এই ডায়লগের সিক্যুয়েন্সে, যা কিনা আমাদেরে সবকিছু বলে দেয়।

— কাম ব্যাক।

যখন কেইট উইন্সলেট বুঝতে পারে যে ডিক্যাপ্রিয়ো মরে গেছে, সে চিল্লানি শুরু করে স্বাভাবিকভাবেই :

— আই উইল নেভার লেট গ্য। আই প্রোমিজ্। আই উইল নেভার লেট গ্য।

… অদ্ভুত ব্যাপার খিয়াল কইরেন যে এই দৃশ্যে একইসঙ্গে কেইট মরা ক্যাপ্রিয়োরে একটু একটু করে বয়া বা কাঠের ওই খণ্ড থেকে দূরে ঠেলাইতে থাকে।

কেইট উইন্সলেটরে এইখানে দেখতে পাই মিডিয়েটরের ভূমিকায়, নিয়তির পরিহাস সামলাইবার মিডিয়েটর বলতে পারি জিনিশটারে। হলিউডে এই টাইপের যুগল চরিত্র তৈরির লম্বা ইতিহাস রয়েছে। স্টোরি যা-ই হোক যা-তা নিয়াই হোক, হতে পারে সেইটা দুনিয়ার তামাদি হওয়া নিয়া বা মানবতার অস্তিত্বঝুঁকি বা অস্তিত্বহুমকি যা-ই হোক গল্পটা, বা দুনিয়ার কোনো মহাযুদ্ধ, যা-নিয়া আখ্যান হয় হউক, কাপল্ ক্যারেক্টার নির্মাণের ফর্ম্যুলা মোটামুটি একই।

নীতিটা তো অভিন্নপ্রায় যে, সবসময় খিয়াল করি আমরা এই জিনিশটা, একটা কাপল্ থাকে যাদের সংযোগসূতাটা বা মিলনসূত্রটা প্রায়শ হুমকির মুখে পড়ে এবং একই কিসিমের ছিত্তমের ভিতর দিয়া পাত্রপাত্রী মিলিত হবার নসিব লাভ করে অন্তিমে। হ্যাপিলি মিলিত হয় তারা। আর এই কিসিমের ‘অবশেষে তাহারা সুখেশান্তিতে বাস করিতে লাগিল’ উপসংহার খালি যে হলিউডি ফিল্মেই খিয়াল করি তা-ও তো নয়।

slavoj zizek


অ্যা পার্ভার্ট’স্ গাইড টু ফ্যামিলি থেকে বাংলায় জাহেদ আহমদ।

উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে এই লেখাটা মূলত একটা ভিডিয়ো কন্টেন্ট হিশেবে বেরোয়, একটা ফিল্মই ইন-ফ্যাক্ট, যেখানে স্লাভো জিজেক (Slavoj Zizek) রীতিমতো অভিনয়ই করেছেন বলতে গেলে, লেখক যেখানে একটা আনকনভেনশন্যাল রোলে অ্যাক্টিং করতে করতে অ্যাঙ্কর বা কমেন্টেটরের ভূমিকায় অ্যানালিসিসটা চালান। টাইটানিকের নিমজ্জনমুহূর্তের ফেইক রিয়্যালিটি নির্মাণ করা হয় সেই ভিডিয়ো কন্টেন্টের বা অভিনব সেই ফিল্মের সেটে এবং ক্যামেরনের বানানো ১৯৯৭-এর টাইটানিক ম্যুভিসিনগুলা থেকে কাট-কাট অংশগুলো শো করা হয় লেখকের আলাপফোকরে। অ্যা পার্ভার্ট’স্ গাইড টু ফ্যামিলি, অ্যা পার্ভার্ট’স্ গাইড টু সিনেমা, অ্যা পার্ভার্ট’স্ গাইড টু আইডিয়োলোজি ইত্যাদি শিরোনামে এই ফিল্মগুলা বানিয়েছেন সোফিয়া ফিয়েনেস। অ্যানিওয়ে। এইটা বা এই ফিল্মগুলা অ্যাভেইলেবল ভিডিয়ো কন্টেন্ট হিশেবে। একটি বা একাধিক স্ক্রিপ্ট ভার্শন পাওয়া যায় এই কন্টেন্টের। ভিডিয়ো কন্টেন্ট দেখে নেয়াই ব্যেটার, শুধু শুধু পড়ার চেয়ে।

ট্র্যান্সলেশন নয়, এইটা ভাষান্তরের সময় স্বাধীনতা নেয়া হয়েছে বাক্যে-বাক্যান্তরে। এই নিবন্ধ ছাড়াও অন্যান্য গদ্যে এবং বক্তৃতায় স্লাভো জিজেক টাইটানিক নিয়া আলাপ জুড়েছেন কালচারাল বা সোশিয়োপোলিটিক্যাল ফেনোমেনা/অ্যাস্পেক্ট ধরে বিভিন্ন কথাপ্রঙ্গসূত্রে। নেক্সট কোনো অনুবাদপার্টে টেন্ডেন্সিটা থাকবে এক্সপ্লোর করা সেই জিনিশগুলাই, জিজেকের বিভিন্ন কথিকা থেকে টাইটানিক বিষয়ক কৌতুক-ফোঁড়নগুলা এনে জুড়ে দেয়ার একটা ট্রাই থাকবে। এই বাংলা লেখার নামটাও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নেয়া। — জা. আ.


 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you