চাহিদা বেশি হলে দাম বাড়বে না! তাছাড়া এসব তো মেশিনের পণ্য না। হাতের কাজের পণ্যের দরদামের তারতম্য হওয়া অস্বাভাবিক না।
আমি রিসেন্টলি সংঘটিত আড়ং জটিলতার প্রেক্ষিতে উপরের তিনটা বাক্য লিখে আড়ং-জরিমানার সংবাদপ্রতিবেদনটা আমার ফেসবুকটাইমলাইনে শেয়ার করেছিলাম। অনেকেই বাঁকা বাক্যবাণপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এসে সেই লিঙ্কশেয়ারিং জায়গাটায়।
এটা একটা হস্তশিল্পের বাজার। কামার, কুমার, তাঁতি বা গ্রামীণ সংস্কৃতির বাজার। ঐতিহ্যের আলো জ্বালাতে বাণিজ্যিক মুনাফাখোর বলেই আমার স্টেটমেন্টকে সমালোচনা করছেন অনেকেই। ভালো। আমি নিজে আসলে খুবই দুঃখিত হতে পারছি না। তাই বেহুদা প্যাচাইতে বসলাম।
আমি গ্রামে বড় হইছি। গজকাপড়ে মা দুই বোনরে নিজের ডিজাইনের জামা ছাড়া দোকানের জিনিস কমই কিনে দিছেন। সুচিত্রা সেনের গলার কাটে ব্লাউজই সর্বোচ্চ দৌড়। নাগরিক জীবনে প্রবেশের পর দেখলাম, জানলাম ব্র্যান্ডের বাজার। আর গত সাত বছর নিজের একটা বিজনেস দাঁড় করানোর চেষ্টায় অসংখ্য অভিজ্ঞতা জমা হইছে।
আমি ঢাকার ভেতরের প্রায় পঞ্চাশজন নারী প্রডিউসারকে চিনি। তারা আমার খুব কাছের বন্ধু। গল্পের বন্ধু। সিনেমার মতো, দুটা সেলাই মেশিন থেকে দুইশ মেশিনের কারখানা চালায়। বিশ হাজার থেকে বিশ কোটি টাকার মালিক। আপনারা চাইলে একদিন শুধু চা খেতে দাওয়াত দিলাম।
ভাবছেন পাব্লিকের টাকা? লুটেপুটে বড় হইছে? একদম না। পরিশ্রমের সাথে দক্ষতা আর রুচিশীলতা। আর ক্রেতারাই এ বাজার তৈরি করেছে। হস্তশিল্পের অসংখ্য আইটেম প্রডিউস করে অনেক তরুণ বেকারত্ব জয় করেছে।
আড়ং-এর পক্ষে সাফাই নয়, তাদের চেইনে অসংখ্য নারীর জীবনকে কল্পনা করি। আয়শা আবেদ ফাউন্ডেশনে গিয়ে দেখেছি কত নিরাপদ আর স্বাবলম্বী হবার সহযোগিতা বিদ্যমান সেখানে।
পাকিস্তানি আর ভারতীয় কাপড়ের বাজারে সয়লাব দেশ। আড়ং, দেশি দশ, নিপুণ, শৈশব, জয়িতা-র সাথে লা রিভ, ভাসাবি, মান্যবর থাকবে। ক্রেতা তার সামর্থ্যানুযায়ী কিনবে। বরং আমাদের মানসিকতা তৈরি রাখতে হবে আমার প্রয়োজন মিটানোর জন্য দেশের পণ্য আগে নাকি বিদেশি!
প্রাইসট্যাগের ভুল হয়, এটা আনকনশাস মিসটেক। হিউমেন মিসটেক।
আমি দেখেছি যারা সমালোচক, তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ একজনকে চিনি যার নিত্যব্যবহৃত প্রায় প্রতিটা পণ্যই আড়ং-এর! তাদের মধ্যে এমন কয়েকজনকে চিনি যারা চা-এর অফার করলে বলেন, আরে এতদিন পর খাওয়াবা তো থাই কিছু খাওয়াও! এমন কয়েকজনকে চিনি যারা প্রতিদিন মেকাপ করে তারাই পার্লারের সমালোচক! কয়েকজনকে চিনি তারা বড় রেস্তোরাঁয় চেকইন মারে নিয়মিত!
আমি আজ সকালে যে চা খেয়েছি তা দুহাজার টাকা কেজির। বাজারে চারশ টাকার কেজিও পাওয়া যায়। ন্যাশনাল টি বোর্ডের চা। এটার দাম বেশি কেন জানি না, তবে এটা টি মিউজিয়ামে পাওয়া যায়।
হররোজ জীবনকে সাধারণ রাখি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই সংগ্রহে রাখি না। উপহার পেলেও অতিরিক্ত মনে হলে অন্যকে দিয়ে দেই।
মাছে, ফলে, মিষ্টিতে, ওজনে, দামে কত ভেজাল আমরা নাহ!!!
কয়েকটা প্রাসঙ্গিক পয়েন্ট এইখানে রেখে যেতে চাইছি যাতে পরে কখনো সবিস্তার কথা বলতে পারি :
১. আড়ং দক্ষতা উন্নয়ন আর বাজার তৈরি করে দেয়। একজন নারী ইচ্ছা করলে স্বাধীনভাবে নিজেও সে দক্ষতায় ব্যবসা করতে পারে। নারীর দক্ষতা না বাড়লে দেশের বিজনেস কিভাবে বাড়বে?
২. নিদৃষ্ট একটা পণ্যের গরমিল হাজারটা পণ্যের বাজারে হাত দিতে পারে না। তাছাড়া ভোক্তা অধিকারে আছে যে পণ্যের দাম বেশি রাখলে তা প্রমাণ হলে চারগুণ বেশি আদায় করা। সেটাই কেন হলো না এক্ষেত্রে?
৩. আড়ং স্বীকার করেছে যে এইটা তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। বলেছে এইটা প্রাইসট্যাগের ভুল এবং একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যা-ই হোক, এইটা আড়ঙের চরম অপেশাদার আচরণের প্রকাশ বলতেই হবে।
৪. আমি নিজেও একজন উদ্যোক্তা। তাই বলে প্রতিযোগিতার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের উপর অন্যায় দেখে ঈর্ষান্বিত অযৌক্তিক মতামত তো রাখতে পারি না।
৫. আড়ং অনেক কারিগরি সহযোগিতা করে থাকে দেশের নারী-উদ্যোক্তা উন্নয়নে। তাছাড়া একজন নারী যখন তার পণ্য বাজারজাত করার নিশ্চয়তা পায় তখন সে কাজটা আরও অনেক দূর অব্দি এগিয়ে নিতে পারে। আমাদের সাথেও অনেক নারীকর্মী কাজ করেন যারা কোনো-না-কোনোভাবে আড়ং-এর সাথে যুক্ত ছিলেন।
৬. বিজনেসে স্বল্পপুঁজির নারীরা তাদের সৃজনশীল কাজের জন্য অনুপ্রেরণা পায় আড়ং ঘিরে।
৭. অবশ্যই ভোক্তা অধিকারের জায়গায় থেকে প্রতিবাদ হবে, প্রতিবাদ হোক সমস্ত অনিয়মের, এইটাই সুস্থতা। আড়ং যা করেছে তা তো অনিয়মই, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনিয়ম যা-হোক। তবে এর জন্য শাস্তি নির্ধারণ আইন মোতাবেক হওয়া উচিত। প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেয়ার মতো কোনোকিছুই ছিল বলে এইখানে আমার মনে হয় নাই।
৮. কোনোভাবেই যেন কোনো জনউদ্যোগ বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে প্রতিবাদ অভিপ্রেত। দেশে এমনিতেই প্রতিষ্ঠানসঙ্কট ও উদ্যোগহীনতা আছে। কাজেই এমনকিছু করা যাবে না যাতে একটা-দুইটা সবেধন নীলমণি দেশজ প্রতিষ্ঠান যা আছে তা-ও তলিয়ে যায়। আমার জানামতে আড়ঙের চেঞ্জ অপশন রয়েছে এবং যে-কোনো কমপ্লেইন তারা খুবই সিরিয়াসলি নেয়।
৯. আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে দাম উঠানামার জন্য কাজের ফিনিশিং বা ম্যাটেরিয়াল ম্যাটার করে। ডিজাইনের চাহিদাজনিত বিষয়টি বাজারে আনতে তখন দাম বাড়তে পারে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বা ক্রেতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কি এই ধরনের প্রতিষ্ঠানপীড়ন বা প্রতিষ্ঠান নিবর্তনের আচরণ কোনো জনহিতকর উদ্যোগ হতে পারে? ভোক্তা অধিকারে কেউ পণ্যের গড়মিল করলে সেই পণ্যের চারগুণ পর্যন্ত আদায় করতে পারে। একটা পণ্যের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারে কি না আমি জানি না।
১০. আমরা যে-প্রতিষ্ঠানটা দাঁড় করানোর উদয়াস্ত পরিশ্রম করছি কয়েকজন নারী মিলে, সেই প্রতিষ্ঠানের নাম জয়িতা। ধানমন্ডিতে এর একমাত্র আউটলেট। জয়িতা একটা সরকারসমর্থিত সংগঠন। এর অনেক বিষয় আর-পাঁচটা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। নারী ব্যবসায়-উদ্যোক্তা উন্নয়নের দেশচিত্রটা যারা জানেন তারা জয়িতা সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন আশা করতে পারি।
নিজেকে নিজে বদলাই। প্রতিনিয়ত। প্রলোভন, লোভ, ভুলভাল থেকে দূরে থাকার বদল। সবার জন্য শুভকামনা।
পোস্টস্ক্রিপ্ট : রোজাঈদের মরশুমে আড়ং-এর উত্তরা শাখায় একই পণ্য বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ ওঠে এবং এর প্রেক্ষিতে প্রায় অব্যবহিত তৎক্ষণাৎ চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এবং উত্তরা শাখাটি সাময়িকভাবে বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেন সরকারের অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। মুহূর্তেই বিষয়টি অনলাইন মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সেইদিনই রাতে এই কর্মকর্তাকে বদলির প্রজ্ঞাপনও জারি হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে আড়ং একটি বক্তব্য দিয়েছে তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে। আড়ং যা বলেছে সেই ফেসবুকবক্তব্যে, প্রাসঙ্গিক কারণে সেই বক্তব্যটা আমরা হাজির রাখতে পারি নিবন্ধের সঙ্গে। আড়ং বলছে :
গত ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের লাখো মানুষ আড়ং-এর উপরে আস্থা রেখে চলেছেন। তাঁদের দৈনন্দিন জীবন এবং উৎসবের রঙিন মুহূর্তগুলোয় আড়ং-কে সঙ্গী করেছেন, সেজন্য আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবের আগে কখনোই আড়ং পণ্যে দাম বাড়ায় না। … মূল্যতালিকায় কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়লে যে-কোনো সময় সম্মানিত ক্রেতারা অভিযোগ জানাতে পারেন সংশ্লিষ্ট আউটলেটে। প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ ক্রেতাকে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা আড়ং-এর সব আউটলেটে অনেকদিন আগে থেকেই রয়েছে। … এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে কল করুন আড়ং-এর কাস্টমার কেয়ার নম্বরে … এছাড়াও, নিকটস্থ আড়ং আউটলেটে যোগাযোগ করে অথবা আমাদের ফেইসবুক পেইজের ইনবক্সে আপনার প্রশ্ন জানাতে পারেন। আন্তরিক ধন্যবাদ আড়ং এবং এর শিল্পী-কারিগরদের সাথে থাকার জন্য যারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে।
খুজিস্থা বেগম জোনাকী। নির্বাহী পরিচালক, ফ্যামিলি টাইস। উদ্যোক্তা, জয়িতা ফাউন্ডেশন
COMMENTS