জালাল উদ্দিন খাঁ ও অস্তদিনের বাউল গান || নূরুল হক

জালাল উদ্দিন খাঁ ও অস্তদিনের বাউল গান || নূরুল হক


কবি নূরুল হকের একটি অগ্রন্থিত প্রবন্ধ : ভূমিকা


পাক্ষিক ‘উত্তর আকাশ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আরো অনেক পরে নেত্রকোণা মহকুমা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণ গ্রন্থাগার  থেকে প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘সৃজনী’। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পযন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সৃজনীর সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খালেকদাদ চৌধুরী। এই ‘সৃজনী’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন কবি নূরুল হক। অনুসন্ধানে জানা যায় নূরুল হক মূলত পত্রিকার কবিতার অংশটি দেখতেন। এই সাহিত্যপত্রিকাটি সারা বাংলাদেশেই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এই সৃজনী পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই উনিশশ-উনাশি সালে ‘সৃজনী সাহিত্য সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি রফিক আজাদ, কবি হাসান হাফিজ  অতিথি হয়ে এসেছিলেন। এই সাহিত্য সম্মেলনে যে-সেমিনার হয়েছিল তাতে মূল প্রবন্ধ পড়েছিলেন কবি নূরুল হক। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘সাহিত্যে দুর্বোধ্যতা’।

এই সৃজনীর এপ্রিল ১৯৮৪ (বৈশাখ ১৩৯১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নূরুল হকের ‘জালাল উদ্দিন খাঁ ও অস্তদিনের বাউল গান’ প্রবন্ধটি। এই ছোট্ট প্রবন্ধটির চিহ্ন ধরে প্রকৃত অর্থেই হাওরাঞ্চলের ভাব ও ভাবুকতার অনুসন্ধান করা যায়।

আমরা জানি জালাল উদ্দিন খাঁ-র পরিবারের সাথে কবির অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। আশুজিয়া হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে কিশোর কবি বাংলার ভাবান্দোলনের মহান পুরুষ জালাল উদ্দিন খাঁ-র ছেলে কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের ভাবশিষ্য হয়ে রোজ তাঁদের বাড়িতে যেতেন। কবি খান মোহাম্মাদ আবদুল হাকিমের পারিবারিক লাইব্রেরি আবেহায়াৎ সাহিত্য মঞ্জিলের বিপুল গ্রন্থনিকেতনেই প্রস্ফুটিত হয়েছিল কবির মানসজগৎ। বাংলার বাউল ঘরানার শ্রেষ্ঠ পুরুষ জালাল উদ্দিন খাঁ-র ধী, প্রজ্ঞা ও গান কবিকে খুব অকর্ষণ করেছিল। জালাল উদ্দিন খাঁ-ও কিশোর কবিকে খুব পছন্দ করতেন। কবির কথাতেই স্পষ্ট হবে জালাল খাঁ স্কুলপড়ুয়া সেই কিশোর ছেলেটাকে কতটা পছন্দ করতেন। কবি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘আমার সাথে উনার খুব-যে দেখা হতো এমন নয়। মাঝে মাঝে দেখা হতো। দেখা হলেই একটা অদ্ভুত কথা বলতেন। আমি বাচ্চা ছেলে, তবু এই কথাটা আমাকে খুব অবাক করত। বলতেন, তুমি আর শান্তি (অধ্যাপক যতীন সরকারের ডাকনাম স. মো.)  ছাড়া এখন নেত্রকোণা-ময়মনসিংহে লেখাপড়া করে খুব বেশি লোক নাই। তুমি আর শান্তিই আছো’।

জালাল উদ্দিন খাঁ-র প্রজ্ঞা ও সাধনাকে অনুভবজাত হয়ে সুর ও কথার শক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন — এমন মননস্নিগ্ধ লোক বাংলার সারস্বত সমাজে খুব দুর্লভ। প্রকৃত অর্থে নূরুল হকের এই লেখাটি জালালের সাধনঘরে পৌঁছুবার সূত্রপথ। লেখক একটা উত্তরাধিকারজাত জ্ঞান ঢেলে দিয়েছেন এই প্রবন্ধে। তাঁর গান ও মমনকে কবি কতটা ধারণ করতেন কবির কথাতেই তা স্পষ্ট হবে : “ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন জনের কণ্ঠে তাঁর গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। তবে আসরে জালাল খাঁ-র কণ্ঠে যে গান শুনেছি তাঁর কোনো তুলনা হয় না। আসরে খুব যে তাকে পেয়েছি, এমন নয়। তবে যে-দু/একটা আসরে তাঁকে পেয়েছি সেই স্মৃতি আজো উজ্জ্বল। সেই অমূল্য স্মৃতির উজ্জ্বল আলো যখন চোখের সামনে ভাসে তখন বুঝি, আজকাল যারা তার গান গাইতে চেষ্টা করেন তারা কেউ আসলে গাইতে পারেন না। আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না। জালাল খাঁ-র উত্তরপুরুষের মধ্যে ফারুক কিংবা মোরশেদ যাদের কথাই বলেন, তাদের কণ্ঠেও জালালের গান শুনে আমি মজা পাই না। আমার চোখে আসরের সেই দৃশ্যটাই ভেসে আসে। তিনি যখন আসরে উঠতেন, লোকজন বলাবলি করত এই যে সিংহের গায়ের সিংহডা উঠছে। সিংহের গায়ের সিংহ গায়েন উঠছে। তাঁর গানের গলা এত মধুর ছিল না; কিন্তু দরদ ছিল, গায়কী ছিল, পরিবেশন-নিবেদন ছিল। তাঁর কণ্ঠের মধ্যে এমন একটা ওজস্বী ভাব ছিল যেন পর্বতের চূড়া থেকে সুর নামছে। দরদী সেই কণ্ঠে যখন গান ধরতেন মনে হতো ভূমণ্ডল কাঁপছে। তাই আমার কাছে মনে হয় এখনের গায়েনেরা জালালের গানটা গাইতে পারে না। কণ্ঠ ভালো থাকলে সুরটা তারা দিতে পারে কিন্তু গায়কীটা দিতে পারে না। শোনো, গানের দুটো দিক আছে। একটা গায়কীয় দিক, অন্যটা নায়কীয় দিক। নায়কীর দিকটা হয়তো এরা দিতে পারে; অর্থাৎ সুরের স্ট্রাকচারটা হয়তো এরা দিতে পারে কিন্তু গায়কীটা এরা দিতে পারে না। অন্তত আমি কারো মধ্যে পাই না।”

বাংলার ভাব ও মরমী সাধনায় হাওরাঞ্চলের গৃহী বাউলের যে জীবনচর্যার যে-অপূর্বতা কবি জালাল উদ্দীন খাঁ সাজিয়েছেন — নূরুল হক এই প্রবন্ধে তা-ই অনুসন্ধান করেছেন। ১৮৯৪ সালে নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭২ সালের ৩১ জুলাই তিনি প্রয়াত হন। কবি নূরুল হক আশুজিয়া স্কুলের ছাত্র ছিলেন এবং জালাল খাঁ-ও আশুজিয়া স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। সেই অর্থে দু-জনেই সতীর্থ। দু-জনেই লোকান্তরিত। তাঁদের দু-জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ জালাল খাঁ-র  প্রয়াণ দিবসে কবি নূরুল হকের এই প্রবন্ধটি আপনাদের কাছে হাজির করছি। — স. মো.


জালাল উদ্দিন খাঁ ও অস্তদিনের বাউল গান
নূ রু ল  হ ক


মানুষ জীবন যাপন করে সমাজে। সমাজ-কাঠামোর উৎপাদনবাস্তবতার মধ্যেই তার অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ ভিত্তি। কিন্তু অমৃতের পুত্র প্রত্যক্ষেই নিঃশেষ হতে চায়নি। চাওয়া-না-চাওয়ার অঙ্গুলিসংকেতেই সে সমাজ গড়ে তুলেছে অন্য বাস্তব, তার অধিকাঠামো। খোলা বাস্তবের পাশাপাশি সেই মহাবাস্তব ইতিহাসে সঞ্চিত হয়ে মানুষের সাথে আগুয়ান হয়ে এসেছে। উৎপাদনবাস্তবে তাই শরীরী জীবনের, দেহলালনের প্রয়াস আর অধিকাঠামোয় তার প্রিয়ংবদা সত্তার তথা চিৎশক্তির উদ্ভাস শিল্প তথা চারুবৃত্তিময় যে কোন গহনকর্মই কেবল সামাজিক সুপারস্ট্রাকচারের মগডালে ফুটে থাকা শত কোরকের একটি কোরকই নয় বরং সর্বাধিক মনোহর, গুরু-গভীরতাচারী এবং ব্যঞ্জনাময় অঙ্গও বটে। অন্তত এর মধ্যে দাঁড়িয়েই একটা সমাজের হৃদয়-পাতার পত্ পত্ আর ফুসফুসের একান্ত দপ্ দপ্ শুনতে পাওয়া যায়। মানব-সত্তাবাহিত সাধনস্রোতে এর চেয়ে ইঙ্গিতময়ী আরাধনা আর নেই। তাই উৎসারিত শিল্পধারার মধ্যেই খুঁজতে হয় কোনো জন-এলাকার বাস্তব লোকের মর্মসার আর বিদ্যুচ্চমকী অন্তরচিত্র। এই যদি হয়, কোনো অধিকাঠামোই হয় সেই কাঠামোর নীচে-থাকা মানুষের মর্মায়িত পরিচয়, তাহলে বাউল গানের পুনর্বাসন, তা যতো অক্ষর-বঞ্চিত মানুষের কীর্তিচিহ্নই হোক না কেন, হয়ে পড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিস্তীর্ণ প্রতিপাদ্য। অন্তত একটি দীর্ঘজীবিত সমাজ-কাঠামোর অন্তরাকুতি এর মধ্যে ছায়া ফেলে এসেছে, চির-জায়মান মুখাবয়ব উৎকীর্ণ করে এসেছে। আমাদের বিদ্বান ও নমস্য পণ্ডিতবর্গের কাছে ব্যাপারটা উপেক্ষনীয় হলেও রবীন্দ্রনাথের মতো সর্বায়ত মনীষীর পক্ষে এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা আদৌ সম্ভবপর হয়নি। কেবল বাউল গান কেন, লোকসাহিত্য শুদ্ধ সমগ্র লোকচারু তথা বিলীয়মান সমাজের অধিকাঠামোর অনেক হারানো রেশ ও বিদায়ী সূত্র প্রসঙ্গেই তিনি আমাদের চিন্তা ও দৃষ্টিকে প্রথম সচকিত করে তোলেন এবং সেই সঙ্গে তার দ্বারাই লালন শাহ, হাছন রাজা প্রমুখ মহাজন বাউলদের কিছু কিছু রচনা সরস্বতীর বরপুত্র ধিকৃত পুত্র নির্বিশেষে সকল শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টিসীমার নাগালে প্রবেশ করে। বোঝা গেল অক্ষরবিশিষ্ট শিক্ষিত মানুষের বাইরেও এমন সব স্বজনকর্তা রয়েছেন, যাদের হৃদয়ে আন্দোলিত হয়েছে মানব-রহস্যের গভীরতম বোধন ও ইশারা ইহজাগতিক অস্তিত্বের মৌল সমস্যা ও মহৎ অনুবেদনা।

বাউল গান প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের সমতল নিবাসী জীবনের সাদা-সিদে মানুষের একটি লুপ্তপ্রায় মননচারু ও উৎসারণ ধারা, সংবেদনী জীবনচর্চার একটি গূঢ়তাসম্মত আঙ্গিক; জগৎ ও জীবনকে, জীবনের পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষাকে আপনার মধ্যে সঞ্চারিত করার গ্রাহী মানুষের একটি হরিৎ কৌশল।

কোন্-পথ-থেকে-যে-কোন্ পথ আর কোন্-মত-থেকে-যে-কোন্ মত তৈরী করে এসেছে এই বাউল জগৎ তার ইতি-উপাদান উদ্ঘাটন করা এখনকার দিনে আর সম্ভব নয়। একেবারেই আচ্ছন্ন। কারণ এসব আজ হারানো ইতিহাসের ভ্রষ্ট ধূম্রজালে একবারেই আচ্ছন্ন। ফলে বাতুল বা বজ্রাকুল, ব্যাকুল না আউলিয়া — এ জাতীয় কোন্ শব্দ-পরিভাষার দুর্নিরীক্ষা ঔরসে ‘বাউল’-এর আদি-উদ্ভব সে-নিয়ে পাণ্ডিত্যের মল্লমাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীর ঘাটতি নেই। ফলত সিদ্ধান্ত-সংঘর্ষ লেগেই আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে না আরো হাজার বৎসর আগে, কি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের জীবনরাগে বাউল ধ্যান-গ্রন্থনার অশরীরী পদপাত, নাকি এর উৎসমূল প্রোথিত হয়ে আছে আরো অনির্দিষ্ট দূরে — একেবারে আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিসীমারও ওপারের কোনো অতীতে, সেই নির্বিন্দু লোকদ্যোতনায় — তা নিয়েও উক্তি-স্বাতন্ত্র্যের কমতি নেই। প্রাচীন জনসত্তার মঞ্জুরিত অভীপ্সা ও ধ্যানকর্ম না পালযুগীয় তান্ত্রিকতা, না বৈষ্ণব সহজিয়াবাদ, না গুরু-নানক-দাদু-কবীরের সাধনমার্গ, না সূফীতত্ত্বের মরমী আকুলতা বাউল সাধনার ভাবঅঙ্গ তৈরী করেছে তা নিয়েও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মহাজনদের অবস্থান-দূরত্ব তুচ্ছ নয়। এসব সমস্যার কোনোটা নিয়েই আমার আজকের আলোচনা নয়। কেবল এটুকু জানলেই যথেষ্ট যে, ‘মন তুমি কৃষিকাজ জানো না, এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা’ — এ ধরনের মানসধ্যানভঙ্গির অবস্থান ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ-কাঠামোতেই৷ কৃষিভিত্তিক সমাজকাঠামোর অনড় অচল প্রবাহের মধ্যেই তৈরী হয় নিয়তিবাদ, সেই সূত্রে, বিশ্বাসে অতিলৌকিকতা তার উপজাত হয়। ধর্ম তথা জগৎকারণ জগৎবহির্ভূত কোনো অবস্থানে নির্দিষ্ট ধরনের প্রত্যয়। ফলে বাউল-সাধনার ধর্ম, অতিলৌকিতা, তন্ত্রমন্ত্র এমন নিবিড়ভাবে আশ্লিষ্ট হয়ে আছে। ‘তন্ত্রমন্ত্রে পাতালি যে ফাঁদ দিবে সে কি ধর / আর অি একালি এ বাট রুন্ধেলা তা দেখি কাহ্ন বিমন ভইলা’ — পঙক্তিদ্বয়ের স্থূল নৈকট্যই বলে দেয় যে বাউল ধ্যান-ধারণার সঙ্গে প্রাচীন লোকমননের আত্মীয়তা কত সুনিবিড়। এই বাট সম্ভবত রুদ্ধ হয়েছে আরো আগেই যখন বাস্তবের সংগ্রাম ক্লান্ত মানুষ জীবনের সহজ প্রকৃতির নিয়মেই হৃদয়ের অবারিত উৎসার খুঁজতে গিয়ে বাধা পেয়েছে, বিরস প্রতিপার্শ্বের ধাক্কা। ভিন্ন পথেই তাকে তখন তৈরী করতে হয়েছে স্বকীয় ও স্বরচিত পূর্ণতা। এই কারণেই পৃথিবীর যে-কোনো শিল্পের অন্তরস্রোত যেদিকে প্রবাহিত বাউল সাধকেরও সংগ্রথিত গুঞ্জরণ আর উপলব্ধি সমূহ সেই অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে উদ্দিষ্ট হয়েই উচ্চারিত। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায় / ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তার পায়’ — এই বহুল প্রোক্ত পঙক্তির ‘অচিন পাখী’ ধরার প্রয়াস সকল শিল্পতপস্যার মূলেই।

বাউল সাধনা অতিলৌকিক ধারণার মধ্যে অবস্থান করে ও সর্বতোপরিচয়ে এ এক মানবীয় সাধনা। এরা মানুষ বলেই এ দেশীয় সমাজ-ইতিহাসে যে-সমস্ত আবেদনময় ভাবতরঙ্গ উত্থিত হয়েছে তার প্রতিটি আঁক চিহ্নিত রয়েছে বাউলের বহুবিচিত্র অনুভূতিধারায়; বলা যায় এর মধ্যেই সংগুপ্ত হয়ে আছে দূরবর্তী ও নিকটবর্তী অনেক রকম সংবাদ এবং জীবনের নানামুখী ইশারা। ধ্যানবৈচিত্র্য এত স্বচ্ছন্দে এতে সাঙ্গীকৃত হয়ে আছে যেজন্য রবীন্দ্রনাথ অতি সহজ কণ্ঠেই মন্তব্য করেন যে, “এই গানের সুরে ও ভাষায় হিন্দু মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি।” মূলত মানুষের সহজ প্রকৃতির মধ্যে তাদের অন্বিষ্ট সন্ধান করতে হয়েছে বলেই সর্বপ্রকার আপাতবিরোধী ধ্যানপ্রবাহেই তাঁদের কর্মের অঙ্গীকার রয়েছে। আবার সহজ প্রকৃতি শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ধাক্কায় আহত হয়ে সাধকগণ সন্ধান করেছেন অটল মানুষ বা ‘মনের মানুষ’। এইভাবেই জীবনের ছাপ, চলমান সময়ের দাগ সেই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচনা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিকতম বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ-র গীতিগুচ্ছ পর্যন্ত সকল তাত্ত্বিকতা অতিক্রম করেই পরিস্ফুট হয়েছে। এই জন্য বাউল সাধনাকে আমরা আসক্তিময় জীবনচর্যার সাধনা হিসাবেই গণ্য করব।

দুই/
দূর অতীতে বাউল গানের শিকড় প্রোথিত বলেই এ-শিল্পধারার সকল সাধক মহাজনদের পরিচয় সংগ্রহ খুবই কঠিন। গবেষকগণ যাদের নামধাম সংগ্রহ করেছেন তাদের মধ্যে সিরাজ সাঁই, পাগলা কানাই, লালন শাহ, মদন বাউল, গগন হরকরা, হাউরে গোসাঁই, পাঞ্জু শাহ, হাছন রাজা, দুদ্দু শাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। লোকসাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বাউল সাহিত্যে বিদ্যমান বলে বাউল গানগুলিকেও সামগ্রিকভাবে লোকায়ত সমাজেরই রচনা বলতে পারি। যেমন দ্বিজ কানাই বা মনসুর বয়াতীর রচনার মধ্যে আমরা আরো অনেক অচেনা শিল্পীর অবদান অনুভব করি তেমনি এ জাতীয় সকল সৃষ্টিকর্মেই এক রচয়িতা অন্য রচয়িতার মধ্যে অবলীলায় আত্মলীন হয়ে থাকে। ফলে একে অপরের রচনায় পঙক্তি-সাযুজ্য বহুল পরিমাণে লক্ষযোগ্য। এর মধ্যে ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব-উত্তরাধিকার খুব প্রচণ্ড নয় বলেই আমার ধারণা। হয়তো কালানুক্রমে কেউ আগে, কেউ পরে — হয়তো কারো রচনায় ব্যক্তিত্ব অধিক পরিস্ফুট অথবা কারো রচনায় তা স্বল্পস্ফুট — এইটুকুই যা। বাউল সাহিত্যের সমালোচকগণ যদিও সিদ্ধান্ত করেছেন যশোর কুষ্টিয়ার দিকেই এর কর্ষণ ও পুষ্টি হয়েছে সর্বাধিক। তবু ময়মনসিংহ যে তার নিজস্ব প্রকৃতি দিয়েই তাকে বিকশিত করেছে এ তথ্য তাদের গোচরে আসেনি। যে লোক-অঞ্চল তার ভৌগলিক, আর্থিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের নিজস্বতার ফলশ্রুতি হিসাবে উপস্থিত করেছে লোকগাথার সমৃদ্ধতম রূপ সে-অঞ্চল বাউল সাহিত্যে মোটেই মৌনব্রত অবলম্বন করেনি। ময়মনসিংহের এক বিখ্যাত সাধক দীন শরৎচন্দ্রের গান সম্পর্কে সমালোচনা করতে গিয়ে ১৩৪১ সালে গবেষক কামিনী কুমার কর রায় মন্তব্য করেন যে, কোনো জীর্ণ ভূর্জপত্রে এই গানগুলি পাওয়া গেলে অশিক্ষিত কবি দীন শরৎ চণ্ডীদাসের মর্যাদা লাভ করতেন। দীন শরৎ চণ্ডীদাসের সম-পর্যায়ভুক্ত হোন বা না-হোন সে-বিষয় আমাদের আলোচ্য নয়, আমরা শুধু এই উক্তি থেকে এই অজ্ঞাত-বাউল সাধকের শক্তিমত্তা সম্পর্কে অল্পবিস্তর সচেতন হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আশ্চর্যের বিষয় বাউল গানের ইতিহাসে তার নামটি পর্যন্ত নেই যদিও তার অনেক গানই পুস্তকাকারে ছাপা হয়েছিল। ময়মনসিংহের বাউল মানস গঠনে যেমন শীতালং ফকির আরকুম শাহের অবদান অসামান্য তেমনি অন্যান্য গায়কের মধ্যে কুবীর সাঁই, লাল মামুদ, রসিদ উদ্দিন, অখিল ঠাকুর, উকিল মুন্সি প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ প্রসিদ্ধ। লালনের গানেও কুবীর সাঁইয়ের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ‘আর আমি মরলে কে গাবে তোর গান’ — রসিদ উদ্দিনের এ গান আবেদনের গুণে কার না অন্তরে স্থান লাভ করে। লাল মামুদ, রসিদ উদ্দিনের রচনাসমূহ এখনো হারানো অতীতে বিলুপ্ত। এই বিলুপ্তির অন্ধকার থেকে কে তাদের টেনে বর্তমানের আলোয় নিয়ে আসবে? দীন শরতের গান প্রায় বেশিরভাগই ছাপা হয়েছিল সেগুলির কোনো পুস্তক এখন আর বাজারে কি অন্য কোথাও লভ্য নয়। সমস্ত কিছু আজ বিস্মৃতির মহাগ্রাসে কবলিত। সর্বশেষ বাউল সাধক হিসাবে জালাল উদ্দিন খাঁ-র নামটা এলেও ময়মনসিংহের বাউল সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য, গভীরতা, তত্ত্ব, মনস্বিতা আর মানবীয়তায় সমৃদ্ধ তার গান এক বিচিত্র ভূজক্ষেত্র তৈরী করেছে। আমাদের ধারণা অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের বাউল-ইতিহাসে জালাল উদ্দিনের নাম এক অতি উজ্জ্বল সংযোজন বৈ কিছু নয়। মোট কথা, সাজিয়ে গুছিয়ে এগুলোর ইতিহাস-পথ তৈরী করলে দেখা যাবে ময়মনসিংহের বাউলে প্রচুর ময়মনসিংহত্ব বিদ্যমান। যশোর কুষ্টিয়ার গানে যেখানে তত্ত্বীয় যান্ত্রিকতা প্রাধান্য লাভ করেছে, ময়মনসিংহের বাউল গানে সেখানে লোকগাথার মতোই জীবনের সরস আবেদনে সমৃদ্ধ হয়েছে। যখন কোনো প্রোষিতভর্তিকার কথা বাউলের একতারায় শুনি ‘পাড়া-পড়শী নারী যত স্বামীর গর্ব করে রে, আমার কি আর লয় না মনে রূপ দেখাইতাম তারে রে’ — রচয়িতার অসাধারণ হৃদয়বেদিতার ক্ষমতায় স্তব্ধ না-হয়ে উপায় থাকে না। এ অঞ্চলের বাউল গান তত্ত্বকথা অতিক্রম করে লোকগাথার মতোই স্বচ্ছন্দে জীবনদরদী হতে পেরেছে। এ ইতিহাসের রূপরেখা তৈরী ব্যতিরেকে বাংলা বাউল গানের ইতিহাস অসম্পুর্ণ থাকতে বাধ্য।

তিন/
জালাল উদ্দিন খাঁ, যাঁর জীবন ও রচনা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়, তিনি ১৮৯৪ সালে কেন্দুয়া থানার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং লোকান্তরিত হন ১৯৭২ সালে। এই দীর্ঘ জীবনকালের মধ্যে তিনি বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। স্থানীয় আশুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও প্রচলিত পথে জীবনের কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেলেন না। বরং এক কৃচ্ছ্র-বিপ্লবী ও বিদ্রোহী জীবনে আকর্ষিত হয়ে গান সাধনা ও সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে তত্ত্বালোচনায় মজে গেলেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি একজন বাউল তত্ত্বজ্ঞ হিসাবে স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হন। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে সেই সময়কালটা প্রকৃতপক্ষে বাউল গানের বিলুপ্তির সময় — কিন্তু জালালে এসে কেমন করে জানি শেষবারের আরেকবার তাঁর ঔজ্জ্বল্য নিয়ে জ্বলে উঠলো। জালাল উদ্দিন, বাউল ধ্যান-মননের মধ্যে সংযুক্ত করলেন এক বিদ্রোহী সংরাগ এবং যথা কারণেই তার তত্ত্বজিজ্ঞাসা মোল্লা-মৌলভী তথা শাস্ত্রীয় যন্ত্রীদের গুরুতরভাবে জখম করে। এই সম্প্রদায় তখন প্রচণ্ডভাবে তাঁর উপর ক্ষেপে যায়। কিন্তু গায়ক জালাল এইসব জড়দ্গব গতানুগতিকতাবাদীদের মোটেই ধার ধারতেন না বরং জীবন ভোগের ক্ষেত্রে হয়ে পড়লেন আরো উত্তাল ও উদ্দাম যেন বাঁধভাঙা স্রোত এসে সমাজ-গড্ডালে তাকে টেনে নিয়ে গেল। ফলে তার গান ক্রমেই বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতা ও গভীরতার বাহন হয়ে উঠলো। আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, সংসারতত্ব, লোকতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি শতধা ধারায় তার স্বাক্টসমূহে উপযুক্ত আবেদন ও শক্তির চিহ্ন নিয়ে গলা ও কলম দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো এবং কালে তিনি ময়মনসিংহের সমস্ত গায়কদের কাছেই একেবারে নমস্য বাউল ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। তার গান ময়মনসিংহের বাইরে, সিলেটে উত্তর কুমিল্লায় ও আসামের কোনো কোনো স্থানে জনপ্রিয়তা অর্জন করল। জালালী সুর ও জালালী গানের প্রচলন একটি ঘরানার মতো হয়ে ছিলো। অবশ্য বাউল-ইতিহাস রচয়িতার দৃষ্টিধন্য তিনি কখনো হননি কেবল সংশ্লিষ্ট শিল্পে রসপিপাসু মানুষের কাছেই তার মূর্তি সুগঠিত হয়ে দেখা দেয়।

চার/
মানুষ থুইয়া খোদা ভজ এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজ কোরান খোঁজো পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে
জালাল উদ্দিন খাঁ-র বাউল গানে এই হলো বিদ্রোহী মানবসত্তা। বাউল গানের যুগ যখন গতায়ু তখন জালাল উদ্দিন খাঁ অবশ্যই তাকে এক নতুন চরিত্র দিতে হয়েছে — বিদ্রোহই হলো তার এই নতুন বৈশিষ্ট্য। বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বের কারণেই জালাল এক পৃথক আসনের অধিকারী। পূর্বতন রেশের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে না দিয়ে এক বিদায়ী সাহিত্যধারার মধ্যে এভাবেই তিনি শক্তি সঞ্চার করলেন। তত্ত্বজ্ঞানের প্রচুর অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাঁর সৃষ্টিতত্ত্ব ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেনি বরং জীনব-রহস্যের অচেনা আকুতি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে প্রকাশ লাভ করেছে।

তুমি আমি দুয়ের মাঝে গোল বাঁধিল অবিশ্বাসে
ক্ষুদ্র একটা নাও বাঁধিয়া এক সাগরে যাই ভেসে

এই ভেসে যাওয়া কেবল তত্ত্বকথা নয় বরং যন্ত্রণাময় অস্তিত্বের কোনো নিঃসীম পাড়িহীনতার মধ্যে, শিল্পীর সত্তাতরীকে উত্তাল তরঙ্গ ঘের করে রাখে। এ কারণেই তার উচ্চারণ মহৎ ও হৃদয়গ্রাহী যদিও এক নাস্তিক্য অবস্থানের মধ্যে তার অন্বেষণ-সততার আশ্রয় খুঁজতে হয়।

নাই তুমি নাই মিশে গেছ
.         ফুল জাগানো আলো হাওয়ায়
আজ অবধি তাই তোমারে
.          খুঁজতে গিয়া কেউ নাহি পায়।

অবিশ্বাসী জালালের এই অস্থিরতাই তাকে সারাজীবন গাইয়ে ছেড়েছে। তাঁর গানে জীবন ও সমাজের নানা অবাক অংশ গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছে। শিল্পের যে বৈশিষ্ট্য কোনো সৃষ্টিকে স্থায়িত্বে নিয়ে যায় জালাল খাঁ-তে তা প্রচুর পরিমাণে মূর্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। যখন তিনি প্রেমের গান রচনা করেন তখন তা অতি সহজ লোকায়ত ভঙ্গির সংস্থানে হয়ে ওঠে হৃদয়ছোঁয়া।

কোন সাগরের মানিক তুমি রে
কোন বাগিচার ফুল
তুমি আমার ময়না টয়া
পরাণ বুলবুল রে
কোন সাগরের মানিক তুমি রে।

প্রকৃতপক্ষে জালাল খাঁ-র রচনা-সমুদ্রে বিধৃত হয়ে আছে আমাদের লোকসমাজের প্রবহমান ভাব ও চৈতন্য, বেদনা ও আকুতি, সৌন্দর্য ও রহস্য, সর্বোপরি এক অসঙ্গত বাস্তবের চমৎকার স্বরূপ দর্শন।

জগত ভরে কান্না হাসা ভালবাসা
করতে মানুষ ভাও পেল না
নিশিদিনে ওঠে মনে যার কারণে
থাকতে আছে মন দেওয়ানা।

এই ‘কান্নাহাসা’ ভালোবাসা করতে ‘ভাও’ না-পাওয়া মানুষের জীবনসংগীতই হলো জালালগীতিকা। এ ব্যাপারে আমাদের বিধান ও শিল্পরুচি মানুষের আশু দৃষ্টিক্ষেপ অতীব প্রয়োজন।


বাংলার মরমি সাধক কবি জালাল উদ্দিন খাঁ-র প্রয়াণদিবসে এই রচনাটা আবিষ্কৃত হলো যেইটা লিখেছেন অনেক অনেক আগের একটা সাহিত্যপত্রিকায় সদ্যপ্রয়াত কবি নূরুল হক। জালাল খাঁ প্রয়াণদিনে জনসমাজে এইটার পুনরাগম হচ্ছে প্রথম দশকের কবি ও গবেষক সরোজ মোস্তফা-র হাতবাহিত হয়ে একটি ঋদ্ধ ভূমিকাসমেত। উল্লেখ্য, কবি নূরুল হকের কোনো গদ্যগ্রন্থ অদ্যাবধি প্রকাশিত না-হলেও কবি-অভিপ্রেত গদ্যের একটা পাণ্ডুলিপি জীবদ্দশাতেই প্রকাশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বলে জানা যায় প্রয়াত কবির  ‘কবিতাসমগ্র’-সম্পাদনকার সরোজ মোস্তফার জবানিতে। এছাড়াও, কে বলবে, বর্তমান প্রবন্ধের মতো অনেক/কতিপয় রচনা এখনও অগোচরে রয়ে গেছে কি না। — গানপার


কবি নূরুল হক প্রয়াণ ও স্মরণ : কয়েক রচনা
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you