আইলাম্বর, বাঘের পাঁচালি ও বাঘের ব্রত || সজলকান্তি সরকার

আইলাম্বর, বাঘের পাঁচালি ও বাঘের ব্রত || সজলকান্তি সরকার

মেঘালয় পাহাড় থেকে বিশেষ করে গারো পাহাড় থেকে শীতকালে পাদদেশে লোকালয়ে বাঘ নেমে আসতো। হাওরের কৃষিজীবী মানুষ তখন বাঘের কবলে পড়ে জমিন থেকে আর বাড়ি ফিরতে পারতো না। তখন থেকেই প্রাণরক্ষায় দলগতভাবে বাঘ হটাতে নানা কৌশলী কার্যক্রম শুরু হয়। তন্মধ্য আইলাম্বর দলীয় উদ্যোগটি ছিল বেশি কার্যকর। গাঁয়ের জোয়ানরা লাঠিসুটা নিয়ে গানে গানে দলগতভাবে বাঘ তাড়াতো। বাঘ তাড়ানোর এই দলকেই মূলত বলা হয় আইলাম্বর।

একসময় আইলাম্বর গান গেয়ে লাঠিসুটা দিয়ে বাঘ তাড়াতে গিয়েও মানুষ যখন প্রতিদিন বাঘের খাদ্য হতে থাকে তখন তারা বাঁচার নানারকম পথ খোঁজে। বাঁচার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কেউ বাঁচে বলে, কেউ ছলে, কেউবা কৌশলে।

হাওর জলারণ্যে তখন সংগ্রামী পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও জীবনসংগ্রামে থেমে থাকেনি। পুরুষের সাথে সরাসরি যুদ্ধের পাশাপাশি জীবন রক্ষার শক্তি লাভে বাঘের পাঁচালি পাঠে দলীয় উপাসনায় মিলিত হয় কেউ কেউ। বিপদমুক্তি কিংবা মনের দৃঢ়তা বাড়াতে এটা ছিল তাদের নতুন কৌশল, নতুন বিশ্বাস বা আত্মশক্তির উপাসনা।

উপাসনায় বাক্যপাঠে আত্মমগ্ন মানুষ ভাবাবেগে মনোবাসনা প্রকাশ করতে মনের অজান্তেই সুরের আশ্রয় নেয়। উপাসনার কথাগুলো সুরে সুরে প্রকাশের ওই ধারাই পাঁচালিসংগীত। যার আদিরূপ অত্যন্ত চমৎকার। ভাবাবেগমিশ্রিত সুন্দর লোকভাষায় রচিত পাঁচালি মানুষের বিশ্বাসের দৃঢ়তা বাড়াতে সাহায্য করত। এ উপাসনায় প্রথমে কোনো উপাচার ব্যবহার হতো না। আদি উপাসনা উপাচারহীন। ব্রতে উপাচার ব্যবহার হয়। উপাসনায় আত্মমগ্ন হয়ে সমস্যা সমাধানের শক্তি ও পথ খুঁজে নেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। লৌকিক পীরের উপাসনাও ছিল। তৎকালে বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য উপাসনার কথাগুলোর সুরেলা প্রকাশই বাঘের পাঁচালি। যেমন—

গাহ গাহ রে ভাই বাঘের পাঁচালি,
ষোল-সত্র বাচ্ছা লইয়া নামিল বাঘুনি।
বাঘুনির বাঘাই আছে কোন কোন গাউ,
কান পেতে শোন ধ্বনি হেঁউয়ালির রাউ।
হেঁউয়ালির রাউ শুনি পরান কাঁপে ডরে,
বাত্তুয়া খেতঅ বাঘের ছাউ গ্যত্-গুত্ করে।
বাত্তি জ্বালাও আঁড়ি-বুড়ি জাগো লখিন্দর,
বাঘাই পীরের দোআই লাগে আইলাম্বর আইলাম্বর।

পরবর্তীকালে উপাচার ব্যবহারে ব্রত উপাসনার রেওয়াজ চালু হয়। শুরু হয় উপাচার বা সিন্নি সংগ্রহের মামুলতা। গানে গানে প্রাণের নিরাপদ আশ্রয়। তাই জীবনের প্রয়োজনে লোকসাহিত্যের এ শাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে উপাচার সংগ্রহের প্রয়োজনে একটি পাচাঁলিসংগীত তুলে ধরা হলো—

গাহ গাহ রে ভাই বাঘের পাঁচালি,
ষোল্ল-সত্র বাচ্ছা লইয়া নামিল বাঘুনি।
ষোল্ল-সত্র বাচ্ছা না রে ষোল্ল-সত্র ছাউ,
আমার বাঘাই আছে কোন্ কোন্ গাউ।
কোন্ কোন্ গাউ আছে বগ্ বগ্ ছাগল,
বগ্ বগ্ ছাগল রাখে লক্ষ্মীন্দর পাগল।
লক্ষ্মীন্দর লক্ষ্মীন্দর কিনা কাম করিলা,
মাঘ মাসের তেরো তারিখ চাইল-কড়ি মাগ্যাইলা।
চাইল দেও চিরা দেও হাছি ভরা ঘি,
সিন্নি দিয়া বিদায় করঅ বড় গৃহস্থের ঝি।
সিন্নি দিতে-দিতে যদি তুমি করঅ হেলা,
দুই নয়ন খাইবা তুমি ঠিক্ দুপুইরা বেলা।
ঠিক্ দুপুইরা বেলা না রে আন্ধাইর-গুন্ধাইর রাইত,
সিন্নি দিয়া রাখ গ তোমার চদ্দঅ গোষ্ঠীর জাইত।

সংকট মোকাবিলায় তখন সমাজের মানুষ নানাভাবে নানা রীতিতে তার মনের আকুতি প্রকাশ করেছে। তাই সময় ও সংকট উপযোগিতা বিবেচনা করে নানা ঢঙে এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। যেখানে পাঁচালিসংগীত একটু ভিন্ন সুর ছন্দ ও তাল-লয়ে পরিবেশন হতো। যার ভাব-আবেগেও থাকত ভিন্নতা।
.

বাঘের ব্রত, ব্রতকথা কেচ্ছা
বাঙালি লোকাচারে ব্রত পালনের রেওয়াজ এখন আর আগের মতো নেই। একসময় ব্রত ছিল সংকটকালীন আচার। বর্তমানে সংকট সমাধানে আগাম মানত করে ব্রত পালনের রীতি চালু আছে। তখন চমৎকার শব্দ সংযোজনে কথা ও কেচ্ছার মাধ্যমে ব্রতের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হতো। ব্রত একটি আদি দলীয় উপাসনা যাতে নানা উপাচার আছে। এতে মন্ত্র নেই, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরও বালাই নেই। ব্রতের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে সরাসরি কিছু চায় না। সৃষ্টিকর্তার শক্তিকে অনুসরণ করে সমস্যা সমাধানে বিষয়ভিত্তিক উপাসনা করে যা মূলত লোকজ পদ্ধতি। যেখানে নির্দিষ্টজনের চাওয়াপাওয়ার প্রশ্ন নেই। তখনকার মানুষ প্রকৃতির কাছে সরাসরি কিছু চাইত না। তারা প্রকৃতিকে অনুসরণ করে নিজেই জয় করে নিতে চাইত। তাই তৎকালে পাহাড় থেকে নেমে আসা বাঘের মোকাবিলা করতে মানুষ বাঘের ব্রত পালন করত। বিশেষ করে হিন্দু সমাজে আগাম সংকট সমাধানে মাঘ মাসে এ ব্রত পালনের রেওয়াজ বা প্রথা ছিল বা এখনও আছে।

সাধারণত ‘বিন্যাছনের’ একটি ‘চাটাই’ তৈরি করে তাতে ব্রতের উপাচার হিসেবে চালের ‘সিদ্ধপিঠা’ ও পায়েস দিয়ে জঙ্গলে বা ঝোপঝাড়ে বাঘের উদ্দেশে নিবেদন করা হতো। শুধু তা-ই নয়, থাকত মাছ সহ পঞ্চব্যঞ্জন ও অন্ন। ব্রতের উপাচার একেবারেই লৌকিক। গিরস্ত বধুরা নানা রকম ব্রতকথা ও কেচ্ছার সাহায্যে জীবনের নিরাপত্তা প্রার্থনা করে এ আচার সম্পন্ন করতো। গাঁয়ের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে বাঘ সেজে হাউমাউ করে পিঠাপায়েস খেতো। নানা রঙে মুখ সাজিয়ে তারা বাঘের ভূমিকায় অভিনয় করত। ব্রতচারী বিনয়ের সঙ্গে আমন্ত্রণ করে খেতে দিত ব্রতের প্রসাদ। এভাবেই বাঘ নিধন নয় সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ আচার পালন হতো। যা ‘বাঘের ব্রত’ নামে পরিচিত।

বাঘের ব্রতে কেচ্ছা বা ব্রতকথা জানাশোনা লোকদের তৎকালীন সমাজে বেশ কদর ছিল। বিশেষ করে বয়স্ক মহিলারা ব্রতকথার দায়িত্ব পালন করতেন। তারপর বংশপরম্পরায় তা চলতে থাকে। বর্তমানে গারো পাহাড় থেকে লোকালয়ে নেমে আসা জংলার বাঘ আর নেই, তাই নেই আগের মতো বাঘের পাঁচালীপাঠ কিংবা ব্রত। একালে সমাজের বাঘ বড়ই ভয়ংকর। যাকে চেনা চেনা লাগে তবুও চিনানো না যায়। তাই আমার নিবেদন—

শোন শোন শোন রে ভাই বাঘেরও পাঁচালি
দেশে আইল নয়া বাঘ খেলে পলাপলি।
বাঘের পাছায় লেজ নাই হাঁটে দুই পা’য়
চুপি চুপি শিকার করে বোঝা বড় দায়।
বাঘের মাথায় লম্বা চুল টগবগাইয়া চায়
আবালবৃদ্ধ ছাইরা দিয়া যুবতীরে খায়।
চিনা চিনা লাগে বাঘ চিননও না যায়
ঘড়ি চশমা পরে বাঘ স্যুট কোট গায়।
লোকালয়ে থাকে বাঘ জংলা হইছে খালি
সমাজেতে বসত করে খেলে পলাপলি।
আরে ধর বাঘ মার বাঘ ওরে লখিন্দর
হাতে হাতে লাডি ধর জাগো আইলাম্বর।

(সংক্ষেপিত)


সজলকান্তি সরকার রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you