এবি ইন শর্ট || জাহেদ আহমদ

এবি ইন শর্ট || জাহেদ আহমদ

আমাদের দেশে প্রোলিফিক রাইটারদের ক্ষেত্রে যে-জিনিশটা হয়েছে, যেমন হুমায়ূন আহমেদ কি ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখের ক্ষেত্রে, এবির ক্ষেত্রেও হয়েছে অনেকটা তা-ই। বিস্তর গল্পগাছা/উপন্যাস নামধেয় বইয়ের প্রণেতা এরা, প্রায় আড়াই-তিনশ বই বাজারে রয়েছে এদের লেখা, সেইখান থেকে তাদের ভালো কাজগুলো খুঁজিয়া বাইর করা চাট্টেখানি কথা নয়। বিশল্যকরণী বিছড়াইতে যেয়ে গোটা গন্ধমাদন কান্ধে তোলার ব্যাপার ঘটাইতে হয় তখন। শ-তিনেক গাদাগুচ্ছের বই থেকে গোটা-তিরিশেক সাহিত্যোত্তীর্ণ বই বাইর করতে যাবার মতো সশ্রম দায় কে আর নেবে। এদের গোটা-কয় ‘ভালো’ কাজের সমুজদার পাঠক চেয়েছেন এরা যেন সমুজদারবৃত্তের বাইরে বের না হন, অন্যদিকে এরা চেয়েছেন বাজারের সবার হয়ে উঠতে, এরা বাজারসেরা হতে চেয়েছেন এবং তা হয়েছেনও, ফলে একসময় ক্ষীণকায় সমুজদারশ্রেণি জাত্যাভিমানে গেছেন দূরে সরে। এবির ক্ষেত্রেও অবিকল তা-ই হয়েছে। এবি যত গণগ্রাহ্য হয়েছেন ততই মিডলক্লাস ড্রয়িংরুম-সমুজদারদের বিরাগভাজন হয়ে গেছেন। উনি বৃহত্তর জনতার জন্য সংগীত করেছেন যত, ততই কুড়িয়েছেন তার আদি ফ্যানবেইসের উপেক্ষা ও অবজ্ঞা। কারণ যে একেবারেই ছিল না তা কে বলবে? কারণ নিশ্চয় ছিল উপেক্ষা লাভের এবং কারণ আছে। এইটা শুধু এবি নয়, দেশের প্রায় সমস্ত পার্ফোর্মিং আর্টিস্টদের ক্ষেত্রে এমতো ঘটতে দেখা যায়। কেন ঘটে এমন, সংস্কৃতিরিসার্চাররা তা রসিয়ে রসিয়ে একদিন নিশ্চয় বলবেন।

বহুপ্রজ বাচ্চু মিউজিশিয়্যান হিশেবে কেমনতর বহুপ্রজ ছিলেন সেই বিষয়ে একটা ধারণা আমরা সকলেই রাখি। তিন-চাইরটা বাক্য খর্চে এবির সংগীতপ্রজনন সম্পর্কে একটা আন্দাজ এই অনুচ্ছেদে করতে চাইছি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানদের মধ্যে এবি ছিলেন সবার চেয়ে ব্যস্ত কম্পোজার। নিজের ব্যান্ড, সোলো, নবাগত শিল্পীদের অ্যালবামে অ্যারেঞ্জার ও কম্পোজার হিশেবে ব্যস্ততা, সতীর্থ ব্যান্ডগুলোর বাদ্যযোজনা ও বাদনসহায়তা, ঢাকাই ফিল্মি গানাবাজানা থেকে শুরু করে অ্যাড/টিভিসি নির্মাণের অবধারিত অনুষঙ্গ জিঙ্গেল কম্পোজিশন ও রেন্ডিশনে এবি ছিলেন নির্ভরতার অন্য নাম। সত্যি বলতে, ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানদের নিয়া বাংলাদেশের মূলধারা মিউজিক-ইন্ডাস্ট্রির যেটুকু তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও সন্দেহ ছিল, এবি একঝটকায় তার দানবীয় সংগীতসামর্থ্য ও সৃজনকুশলতা দিয়া বাজারকুতুবদের অবিশ্বাস দূরীকরণে অবদান রাখেন। সুফল হিশেবে এবির পরে একে একে ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানরা বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিউজিকমিডিয়ায় কাজ পাইতে থাকেন। অনতিবিলম্বে দেশের মিউজিকবাজারের ভার পুরাপুরি এই তারুণ্যস্পন্দিত মিউজিশিয়্যানদের হাতে আপনাআপনি চলে আসে। এক্ষেত্রে এবির কন্ট্রিবিউশন স্বীকার করতে হবে সর্বাগ্রে।

এলআরবি-র স্টুডিয়োঅ্যালবাম সাকুল্যে কয়খানা, তার একক অ্যালবাম সংখ্যায় কয়টা, তার সুরারোপিত ও সংগীতায়োজিত সংকলন কয়শতাধিক ইত্যাদি ইনফো গ্যুগল করলেই মিলবে এক্ষুনি। ডিস্কোগ্র্যাফির তথ্যাবলি উইকিপৃষ্ঠায় আছে। কাজেই আমরা আইয়ুব বাচ্চুর কাজের ফিরিস্তি দিতে যেয়ে অ্যাভেইলেবল সোর্সের ইনফোগুলোর পুনরাবৃত্তি করছি না হুদাই। স্মৃতিনিষ্ঠ হলে এবির সময়টাকে যেভাবে ক্যাপ্চার করা যাবে, সেকন্ডারি ইনফোসোর্স এক্সপ্লোর করে সেভাবে এবিকে ক্যাপ্চার করা আরও বহুদিন দূরের ব্যাপার। কেননা আইয়ুব বাচ্চু ও তার সতীর্থ সংগীতশিল্পীদের যেভাবে মেইনস্ট্রিম রিফ্লেক্ট করে এসেছে, সেখানে সিরিয়াসলি মিউজিকের উপস্থাপন গরহাজিরই ছিল বলতে হবে। এবি বাংলাদেশের বিরলগণ্য ফ্যুলটাইম মিউজিশিয়্যান হওয়া সত্ত্বেও তারে নিয়া মূল্যাঙ্কনধর্মী ফিচার আর্টিক্যল প্রচারিতে দেখি নাই মেইনস্ট্রিম/অফস্ট্রিম কোনো মিডিয়ারেই। জীবদ্দশায় তো হয়ই নাই, শিল্পীর প্রয়াণের পরে এখন হয় কি না তা-ই দেখবার অপেক্ষা আছে। এমনিতেই বাংলাদেশে গান নিয়া আলোচনা মানেই হচ্ছে রবীন্দ্রসাহিত্য, নজরুলসাহিত্য, লালনসাহিত্য এবং খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে করিমসাহিত্য প্রচার করে বেড়ানো। রকমিউজিক নিয়া সাহিত্যবৃদ্ধ/সংগীতবুদ্ধু তরুণযুবাদের লেখালিপ্ত হবার কোনো তোড়জোড় তো দেখি না। যা দেখি তা ওই শুধু বাচ্চুভাই-জেমসভাই-ম্যাকভাই করে আহাউহু ফোঁপানো আর ক্যাসেটকালেক্টরদের কাউয়া-কা-কা। আর আছে রকের জঁরা নিয়া ক্যাচরম্যাচর বড়াই-বারফট্টাই খামাখা।

আইয়ুব বাচ্চু এই লিটফেস্টের বারফট্টাইওয়ালা বাংলায় বালছাল সাহিত্য না করে কেবলই মিউজিক করে গেছেন দিবারাতি, এইটুকু মনে রাখব। যদি স্মৃতিনিবন্ধ ফাঁদতেই হয় তার গান নিয়া, তার গানগুলো শোনার স্মৃতি যদি চারণ করতেই হয়, তাইলে আরেকটু দূরত্বে যেয়ে আরও সময় নিয়ে সেইটা করতে হবে। এখন, এই মুহূর্তে, তার দুই-একটা গানের নামই নিতে পারব শুধু। ‘রূপালি গিটার’, ‘সেই তুমি’ — এই দুই ভীষণ-জনপ্রিয় কম্পোজিশনের কথাটা পাড়া যাক।  অন্যান্য কত অসংখ্য গানের কথাও তোলা যায়, সেই সময় এবং পরিসর পাচ্ছি না আপাতত। ‘রূপালি গিটার’ আর ‘সেই তুমি’ শুধু। দুইটাই চিরস্মরণীয়া গান, আজও অম্লান, দুইটাই। কিন্তু কথাটা এইসঙ্গে কবুল করে নিতে হয় যে এবি ঢের উল্টাপাল্টা গানও গেয়েছেন বৈকি, বিস্তর কাব্য/সংগীতগুণহীন গীতাখ্য, অন্তত আমার বিবেচনায়। গিটারবাদন আর টিউন কম্পোজিশনের ধুন কপি করেছেন ধুমিয়ে, ক্যারিয়ারের পিকে থাকার সময়টাতেও, অবশ্য তখন অনেকেই অভিযুক্ত হয়েছেন এই দায়ে, বেশি সংখ্যায় গাইতে গেলে এমন হয় অবশ্য। অচিরেই এমটিভি ইত্যাদি চ্যানেল ঘরে ঘরে অ্যাভেইলেবল হয়ে যায়, আর আমরা ব্যাপারগুলো অনেক বেশি বেশি ধরে ফেলতে থাকি, আর একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি।

কিন্তু ঘটনাটা হচ্ছে, অ্যাক্নোলেজ না করেই বিদেশি মিউজিকের অনুসৃতি ব্যান্ডসংগীতে ব্যাপক হয়েছে বলে যে-অভিযোগ, এইটা আদতে খতিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে জেনারালাইজড একটা হারামিপনা আমাদের ‘সাংস্কৃতিক’ অকালপক্ব সংগীতসাহিত্যসমুজদারদের। নয়া ধারায় কাজ করতে যেয়ে একলষেঁড়ের মতো দুনিয়ার বহুকিছুই নিতে হয়েছে দুইহাতে সেইসময়ের সক্রিয় সমস্ত কম্পোজারদেরেই। চিনিয়ে দিতে হয়েছে পুরানা পান্থসখাদেরে নয়া রাস্তার নিশানা। আর টার্গেট অডিয়েন্স রিচ্ করতে যেয়েও পুরা সাফল্য ধরা দিয়েছে তাদের মুঠোয়। এইসব অভিযোগ-ডামাডোলের বহুকাল উজিয়ে এসে আজকে যখন অভিযুক্ত ওই গানগুলো শুনতে যাই, দেখি যে নকলি চিহ্ন সত্ত্বেও তো গানগুলো বাংলা গানই হয়েছে। এবির যে-কোনো গানেই মিউজিকের এবং সুরকাঠামোর সাযুজ্য তো অগোচর থাকে না।

তাছাড়া এবি নিজেও লুকিয়ে রাখেন নাই তাঁর গিটারগুরু তথা তার গুরুস্থানীয়দের নামঠিকানা। অ্যানিওয়ে। এবির বরাতেই পিঙ্ক ফ্লয়েড, স্যান্টানা, জিমি হেন্ড্রিক্স প্রমুখের নাম শুনেছে দেশের বৃহৎসংখ্যক তরুণ-কিশোর এবং আগ্রহী হয়েছে এই বিশ্ববিশ্রুত সংগীতকারদের গানবাজনা শুনতে। এবির মতো এবং এবির আরাধ্য গুরুপ্রতিমদের মতো গিটার বাজাইতে আগ্রহী হয়েছে। একবাক্যে এবিকে নকলনবিশির ধুয়া তুলে খারিজ করার লোকের যেমন দেখা পাওয়া যায় এদেশে, তেমনি এবি বলতে অজ্ঞান হয়ে যায় এমন লোকেরও ভিড় বিস্তর এদেশে। এই দুইয়ের কোনোটাই মিউজিকবান্ধব নয় নিশ্চয়।

এবির অনেক ভালো ও সো-ফার মৌলিক গানও কম নয় একেবারে — এইটা আলবৎ সকলেই স্বীকার যাইব। প্রচুর পচা লিরিক্স যেমন তিনি ওঁচা সুরে ফেলে দিয়ে ক্যাসেটকোম্প্যানির পেট ভরিয়েছেন, সুধারসভরা গানের বাণিচিত্রও তেমনি কম নয়। এবং তার ভার্স্যাটালিটিও উল্লেখযোগ্য। ‘রক্তগোলাপ’ অ্যালবামের টিউনগুলোতে একেবারে অন্য আইয়ুব বাচ্চু। ‘দরোজার ওপাশে’ গানটার এবি, কিংবা ‘বাংলাদেশ’ সুরটার-কথাটার এবি, কিংবা জেমসের সঙ্গে যৌথ-অ্যালবামদ্বয়ের গানগুলোর এবি এককথায় চির-অনবদ্য। ওই দুই অ্যালবামের নাম মনে পড়ে — ‘ক্যাপসুল ৫০০ এমজি’ এবং ‘স্ক্রুড্রাইভার্স’। পরে ‘পিয়ানো’ ও ‘যন্ত্রণা’ নামে আরও দুইটা অ্যালবাম বেরোয় একই ধারার সাফল্য অনুসরণে। এছাড়া তার ব্যান্ড এলআরবি-র অ্যালবামগুলোতে এক্সপেরিমেন্টেশন উপহার পেয়েছি অনেক, ‘মাধবী’ গানটার কথা ও গায়নভঙ্গি মনে পড়ে — “মাধবী, সে এক নষ্ট নারী” ইত্যাদি মুখপাতের পঙক্তি ছিল সেই গানে, যেমন তার একটা একলাইনের গান — “আমাকে আমার চেয়ে বড় করে দাও হে প্রভু / এ পথ থেকে আমায় ফেরাও” — আজও ভুলি নাই। স্রেফ এই একটা লাইন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিলম্বিত্ লয়ে গেয়ে যাওয়া, আর মন্দ্রস্বর ও আচ্ছন্ন আবহের গিটারবাদন।

তবে একটা ব্যাপার সবসময় দেখেছি এবিফ্যানদের মধ্যে যে তারা বাদক এবিকে নিয়া আলাদা আহ্লাদ করছেন। অবশ্যই গিটারিস্ট এবি অতুলনীয় বাংলায়। লিডগিটারে এবি বাংলাদেশের পথিকৃৎ মায়েস্ট্রো। কথাটা হচ্ছে এ-ই যে, একজন মিউজিশিয়্যান যদি লিরিসিস্ট-কম্পোজার-অ্যারেঞ্জার হিশেবে এস্কোয়্যার হয়ে থাকেন তাইলে তার একটামাত্র পরিচয় আলাদা হাজির করলে তারে খণ্ডিত ও খর্ব করা হয়। গিটারে এবির কব্জি, কনুই ও আঙুলের জয়গাথা গাইলে একজন বাগগেয়কার আইয়ুব বাচ্চুকে একাবদ্ধ করে ফেলা হয়। একটা বাদ্যযন্ত্রে একজনের দক্ষতা নিশ্চয় তার শিল্পীসত্তার পরিচয় নয়। স্কিলের জয়গান গাইব কারিগরের ক্ষেত্রে, শিল্পীর ক্ষেত্রে গাইব তার দক্ষতা-উপচে-ওঠা ম্যাজিকের। গিটার বাজাইতে দক্ষ পোলাপান তো বছর বছর উৎপাদিত হয় মিনিমাম কয়েকশ।

সবচেয়ে বেশি সিগ্নিফিক্যান্ট ছিল সেইসময়ের ব্যান্ডভোক্যালদের মধ্যে এবির ভয়েস কোয়ালিটি। বিশেষ একটা কায়দায় আর্ত সক্রোধ ক্রন্দনচিৎকার চিরে বেরোত তার গলা থেকে, কন্ট্রোল্ড গ্রাউলিং, যেইটা আগে ছিল না বাংলা ব্যান্ডগানে। কিংবা মাকসুদে এইটা আলাদা ফিচার নিয়া হাজির ছিল, জেমসে তো বটেই এবং ডিফ্রেন্ট স্ট্রোক ও মেজাজে। মাকসুদের ছিল একটা হাহাকার-হাওয়ার গলা, আর জেমসের তো বলা বাহুল্য ঘৃণা-ও-গর্জন-একাকার-করা অতিজাগতিকতা। যা-হোক, এবির এই টোন্যাল ইফেক্ট শ্রোতাকে আকৃষ্ট যেমন করত, বিকৃষ্টও করত বৈকি। অতি ও যথেচ্ছ ব্যবহারে, আমার মনে হয়, এবির এই স্বরপর্দা হারিয়ে ফেলে অ্যাপিল। তবে এবিগীত অনেক ভালো লিরিক্স রয়েছে, যে-ই হোন গীতিকার, এবং সেসবের প্রেজেন্টেশনও উন্নত, যেমন জেমস্ বা মাকসুদ ও অন্যান্য তখনকার লিডিং ব্যান্ডগুলোর, এসবের একটা সামগ্র্য পর্যালোচনা বা সর্ট-অফ রেট্রোস্পেক্ট দরকার। বাংলাদেশ পার্টের বাংলাগানের বলতে গেলে সূচনাকালের সবচেয়ে বেশি অবদায়ক অধ্যায় এর ব্যান্ডগান ও রকমিউজিক, অন্তত আমার এইরকমই বিবেচনা, কাজেই এর একটা সামূহিক সমীক্ষাচিত্র বা একধরনের সঞ্চিতা সামনে এনে দেখার সময় এসেছে এখন।

হার্ডরক দিয়া আইয়ুব বাচ্চু শুরু করলেও পরে ক্যারিয়ারের বিভিন্ন ফেইজে রকমিউজিকের আরও সমস্ত ঘরানা ইস্তেমাল করতে চেয়েছেন। সফট ব্লুজ, সাইকাডেলিক, অল্টার্নেটিভ রকের কিছু আদরা ইত্যাদি যত-যা-কিছুই তিনি করেছেন, লক্ষ করব মেলোডি জিনিশটা তার মজ্জাগতই ছিল। নিজের স্টুডিয়োরেকর্ডেড অ্যালবামগুলোর মধ্যে মেলোডি ফিরে ফিরে এসেছে, ‘ফেরারী মন’ আনপ্লাগড অ্যালবামটার স্মৃতি ইয়াদ করব, ‘মন চাইলে মন পাবে’ অ্যালবামে “গগনে তারাগুলো নিভে যাওয়া এক রাতে / এলোমেলো স্মৃতিরা সব হারালো ভুল পথে” গানে কিংবা “সেই তারাভরা রাতে / আমি পারিনি বোঝাতে” ইত্যাদি গান আইয়ুব বাচ্চুর আরেক রাজ্য। অসংখ্য নতুন শিল্পীর অভিষেক ও প্রতিষ্ঠা আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের নাম নিলেই বোঝা যাবে ট্যালেন্ট গ্রুমিঙের ক্ষমতা বাচ্চুর কোন পর্যায়ে ছিল। সেই শিল্পীর নাম হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। প্রথম অ্যালবামটা বাইর হবার পরে এবির চেয়েও জুয়েল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বললে বেশি বলা হয় না। খালি জুয়েলই তো নয়, এবির সুরে ও সংগীতযোজনায় এমন অনেক শিল্পীর গান গগনচুম্বী প্রিয়তা লাভ করেছিল বাংলাদেশে। সেই গানগুলোর পুনরাগম দরকার বাংলাদেশের প্রায়-পথে-বসা আজকের মিউজিকসিনে।

একটা ব্যাপার লক্ষ করব, যদিও অসাধারণ বাংলার পুরাতনী গীতলতা আর প্রতীচ্যের আধুনিকতা দিয়া বাচ্চু জয় করছিলেন মেলোডিপ্রিয় শ্রোতার মন, চান্স পাইলেই বাচ্চু হার্ডরকে ফেরত আসছিলেন প্রত্যেক বছরেই একবার করে হলেও। আজকের যে ট্রেন্ডি মেটাল মিউজিকের মজমা, আইয়ুব বাচ্চুকে এই জেনারেশন মাথায় তুলে রাখবে তার হার্ডরক কম্পোজিশনগুলোর জন্যেই। ‘নীল মলাট’, ‘পাগল’, ‘জারজ সন্তান’, ‘নষ্ট করেছে আমাকে’, ‘আবারও এলোমেলো’, ‘হায় স্বাধীনতা’, ‘স্বপ্ন’, ‘সুখ’, ‘হকার’, ‘ঘুমভাঙা শহরে’, ‘জীবনের মানে আমি পাইনি তো খুঁজে’, ‘ব্যাপারটা আমি বলব কাকে’, ‘গতকাল রাতে’ ইত্যাদি নাম্বারগুলো সমাগত সংগীতপ্রজন্মের কাছে আরও বহুকাল সশ্রদ্ধ প্রশ্রয় লাভ করে যাবে।

যে-জিনিশটা শেষে এসে স্বীকার করবেন সকলেই যে এবির প্রস্থানের ভিতর দিয়া বাংলাদেশের অভ্যুদয়োত্তর সবচেয়ে তাজা সাংস্কৃতিক সংবেদনার সমুজ্জ্বল অধ্যায়টা আপামর মানুষের স্বীকৃতি অর্জন করল প্রকাশ্য দিবালোকে। এখন আর কোনো ভুঁড়িয়াল ইন্টেলিজেনশিয়া বা অ্যাকাডেমিয়ার উটপাখিড্ডিমেরা আইয়ুব বাচ্চু ও তার সতীর্থদের গান শুনে শেয়ালের হুক্কাহুয়া বলে স্লেজিং করবে না। আরম্ভ হয়েছে এবিমৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উল্টোবুজলি বিদূষকদের প্রশংসাকান্না। বাংলাদেশের চারদশকজোড়া জ্যান্ত সংগীতের মৃত্যু এই বিদূষকদের হাতেই হতে চলেছে, এই ব্যাপারে সন্দেহ করি না। “আবার শুরু হলো বলে / এ যে আগুনে জল ঢালার পালা” — মাকসুদুল হকের লেখা লিরিকের এই লাইনটুকু মনে পড়ছে ব্যান্ডমিউজিকের গনগনা আগুনে এবিপ্রয়াণের পরে এত সমস্ত প্রভাষক-বিদূষকদের প্রশংসাপানির বেহুঁশ পিচকারি ছিটাইতে দেখে সামাজিক সংযোগমাধ্যমগুলোতে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you