আমার জন্ম, শৈশব-কৈশোর ও তরুণদিনের প্রথম প্রহরগুলো কেটেছে যেই গাঁয়ে, একটা উপজেলাগাঁয়ে, সেই গাঁয়ে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু ছিল। তখন এবি ছিলেন তার ক্যারিয়ারের একদম মধ্যগগনে। অনেক পরের দিকে, এই শতকের প্রায় শুরুর সময়ে, আমাদের পাড়াগাঁয়ে ইলেক্ট্রিসিটি আসে এবং আইয়ুব বাচ্চু প্রবল বিক্রমে তার গলা আর গিটার নিয়া আমাদের গাঁয়ে সংগীতের জাল বিছাইতে আরম্ভ করেন। ততদিনে আমাদের গাঁয়ে টেপরেকর্ডার ঘরে ঘরে না হলেও অনেক ঘরেই এসে গেছে। এবি নয় কেবল, অন্যান্য ব্যান্ডশিল্পীদের গানগুলোও মোটামুটি শোনার একটা স্কোপ পাওয়া ব্যাটারিচালিত টেপরেকর্ডার চালিয়ে।
ব্যাটারি দিয়া চালানো অডিও প্লেয়িং ডিভাইস ওইসময় আমাদের বাড়িতে একটা ছিল। তবে ব্যাটারি দিয়া চালিত শ্রবণযন্ত্র খুব বেশি সময় চালানো যেত না। ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যেত দুম করে। ব্যাটারি অ্যাফোর্ড করবার একটা হ্যাপা ছিল। তবে এর বাইরে লোক্যাল বাজারে বা আত্মীয়-কুটুমবাড়িতে গেলে একটা সুযোগ পাওয়া যেত বিদ্যুতের সহায়তায় প্রায় নিরবচ্ছিন্ন গান শোনার বা নাটক-সিনেমা দেখার। আমাদের পাড়াগাঁয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা হবার আগে এইভাবে আমরা গানবাজনাবাদ্যি বিনোদনের ব্যাপারটা সেরেছি।
এরপরে একসময় ইলেক্ট্রিসিটি এলে ব্যান্ডমিউজিক পুরোদমে শুনতে শুরু করি বিছানায় চিত-কাইত টেনশনফ্রি হয়ে। ব্যাটারি ফুরাইবার টেনশন চিরতরে শেষ হয়ে যায়। ক্যাসেটের দুই পিঠের সব গান রিপিটেডলি শুনতেও সমস্যা থাকল না আর। যে-গানটা ভালো লাগে সেই গান রিওয়াইন্ড করে একাধিকবার শোনার সুবর্ণ সুযোগ আসে। ম্যাক, এবি, জেমস্ শোনার জোয়ার আসে আমার জীবনে এই পিরিয়ডে।
‘ফেরারী মন’ নামে একটা অ্যালবাম আছে এবির। এইটা আমার অলটাইম ফেব্রিটের মধ্যে শীর্ষস্থ। এমনিতে ‘সেই তুমি’, ‘ভাঙা মন’, ‘নীরবে’, ‘হাসতে দ্যাখো গাইতে দ্যাখো’ ইত্যাদি অসংখ্য কম্পোজিশন আছে যেইগুলো মুখস্থপ্রায় ছিল। হয়তো এখনও মনে পড়বে এই লিরিক্স ও টিউন্স চেষ্টা চালাইলে। এবি নিজের কম্পোজিশনগুলোকে দ্রুত শ্রোতার ভিতরে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছেন।
ইলেক্ট্রিসিটিবিচ্ছিন্না পাড়াগাঁয়ের দু-পহরে এবির গান বাঁশবনাচ্ছন্ন মধুরিমায় বেজে চলেছে … একটি কিশোর ছেলে সেই গান শুনছে … একটি কিশোরী ইশকুলের ফ্রক ছেড়ে কামিজ এবং ক্রমে শাড়িতে উত্তরিত হচ্ছে …
… …
- ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, আইয়ুব বাচ্চু ছিল || শোভন সরকার - November 7, 2018
COMMENTS