দিনগুলো সোনার খাঁচায় বাঁধা নাই ঠিকই, কিন্তু উড়ন্ত স্বর্ণরেণু হয়ে সেই তীব্র রজনী-দিবসগুলো সুরমা গাঙের সন্নিহিত হাওয়ায় নিত্য প্রবাহিত। বলছিলাম আমাদের উদাত্ত উদ্দাম সেই দিনগুলোর কথা। আমাদের সেই থিয়েটারদলের তাতানিতে তুখোড় সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। মাঝরাতে ব্যান্ডের গান গেয়ে এলোপাথাড়ি স্ট্রিটলাইটপোস্টের গায়ে দলামোচা সিগ্রেটপ্যাকেটের ঢিল ঠুকে ঠুকে ডেরায় ফেরা। আমাদের সেই হৃদয়োত্তাল এলআরবি আর তারই হরিহর-আত্মা আইয়ুব বাচ্চু, সংক্ষেপে এবি, সোনার খাঁচায় নয় স্ট্রিটল্যাম্পোস্টের লাইট অ্যান্ড শ্যাডোয় দেখতে পাই নিতিদিন আজও।
স্বৈরাচার-হটানো ওই সময়টায় ব্যান্ডের গানবাজনা আমাদেরে ব্রেইক-থ্রু দিয়েছে ব্যাপকভাবে, এই কথাটা আমি স্বীকার করি অকুণ্ঠ। অন্য কোনো গানই ঠিক ওই সময়টায় দাঁড়াবার প্রণোদনা বা বাঁচবার স্পর্ধা আমাদের ভিতরটায় জাগাতে পারছিল না। ব্যান্ডমিউজিক ম্যুভমেন্টের পিকটাইম ছিল নব্বইয়ের মাঝভাগটা। লাস্ট সেঞ্চুরির নব্বইয়ের দশকটা। মাইলস্, সোলস্, ফিডব্যাক, রেনেসাঁ, চাইম, নোভা, আর্ক, প্রমিথিউস, ওয়ারফেজ … কত কত তুখোড়-তুরন্ত ব্যান্ড আরও! সবারই ছিল শ্রোতামাতানো সংগীত ও পঙক্তিমালা। আমাদের রাত্রিদিবা গ্রাস করে রেখেছিল দুর্ধর্ষ ওই মিউজিক্যাল দলগুলো।
কত রকমের গানই তো শুনতাম তখন, হিন্দি-ইংলিশ হেভি বিটের গানবাজনা, তবে ব্যান্ডের গানেই ছিল আমাদের পরানভোমরাটা রাখা। আধুনিক বাংলা গানের শিল্পীরা, ভারতীয় আধুনিকতার শিল্পীরা, বাংলাদেশের ব্যান্ডের অভিনবতার ধারেকাছেও নাই কেউ। ফলে ব্যান্ডগানেই চিত্ত টগবগায় আমাদের, এমনকি আজও! অন্যান্য পুরাতনী মিউজিক, কলকাত্তাইয়া গান, ইংলিশ সফট মেলোডি ইউটিউবে এই বয়সে এসে শুনি ঠিকই; কিন্তু বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের সমান সংযোগ কোনোকিছুতেই ফিল্ করি না।
আমাদের জেনারেশনের সংযোগের সমস্ত উপাদান নিয়ে ব্যান্ডমিউজিক হাজির ছিল সবসময় আমাদেরই বিপদে-আপদে। রেনেসাঁর একেকটা অ্যালবাম অনেক অনেক দিন লাইন-বাই-লাইন বইপড়ার মতো মনোনিবিষ্ট শুনেছি। ফিডব্যাকে জেগেছি তীব্র অনলহল্কায়। মাইলসের গান শরীরে নিয়ে প্রেম করেছি। সোলসের ছন্দে-তালে ক্রেডলে যেন দুলেছি। হ্যাপির গানে অ্যান্থেমের মতো সন্ধ্যায় বিষণ্ণ ও পবিত্র হয়েছি। এবং এলআরবি … এবং এবি … এবং বাচ্চু … এবং দ্য বস্!
বস্ দেরিতে এসেও ধস নামিয়ে দিলেন আমার সকাল দুপুর বিকাল সন্ধ্যায়। রাতে তো বসের গ্রাউলিং শুনতে শুনতে ঘুমাইতে গেছি তিরিশ ইন্টু বারো তিনশ ষাট দিন। দুই-চাইর দিন উদি দিয়েছি কোনো অচেতন বাস্তবতায় হয়তো। বসের গাওয়া গানগুলোর সব-কয়টাই না-হলেও অধিকাংশই ক্লাস্ জিনিশ। বলতে চাইলে একটা নয়, একগাদা গানের নাম বলতে হবে। এরচেয়ে সবার প্রিয় সবচেয়ে বেশি হিট ক্রেইজ গানটার কথাই বলি না-হয়? হ্যাঁ, ‘সেই তুমি’। আমারও প্রিয়। অসম্ভব প্রিয়। জোস্ একটা গান। বসের গান শুনেই গিটার শিখবার শখ হয়েছিল। উনার অন্যান্য গানের মতো এই গানেও গিটারকারুতা আলাদাভাবে লক্ষণীয়।
তখন আমাদের লম্বা ঝাকড়া চুলওয়ালা বন্ধুদের একটা গ্রুপই ছিল আলাদা। আমরা আইয়ুব বাচ্চুর গিটারগর্জানো গান শুনতাম, চুলের ছাঁটও উনার মতোই পিছনহেলানো লম্বা স্পাইরাল করে নিয়েছিলাম, রইল কি আর বাকি? টিশার্ট। বসের বাইসেপ-ফোলানো নধর দেহে ব্ল্যাক ও অন্যান্য বর্ণিল চক্রাবক্রা টিশার্ট দেখে আমরাও সদলবলে গেলাম অভিন্ন ইউনিফর্ম গায়ে চাপাবার সিদ্ধান্তে। এবং টিশার্টে লেখায়ে নিলাম “সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে / সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম / কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি / কীভাবে এত বদলে গেছি এই আমি / বুকেরই সব কষ্ট দু-হাতে সরিয়ে / চলো বদলে যাই” … একসঙ্গে একাধিকের প্রেমে-পড়া আমাদের সেই বয়সে এই টিশার্টের বক্ষলিখন দিয়া আমরা সামলাইতে সচেষ্ট হয়েছি যার যার প্রণয়িনীদেরে, কেউ কেউ সফলও হয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি কেউ। বসের খয়রাত থেকে কেউই বঞ্চিত হই নাই। বস্ ছিলেন আমাদের সুখেদুখে সহায় হয়ে সকলেরই পাশে।
এখনও শোনা হয় উনার গান, আগের মতো হুল্লোড়ে এখন শোনা হয় না, খুব একলা অবসাদের মুহূর্তে, আপিশের একচিলতে অবসরে, কানফোন গুঁজে এবির গান এখনও শুনি। রিসেন্টলি এমন একটা ব্যক্তিগত অবসন্ন ক্ষণ এসেছিল কুড়ি/পনেরো দিন আগে। এবং শুনেছি এবি। ইউটিউবে। একটা গানই ফিরিয়ে ফিরিয়ে শুনে যাওয়া। “হাসতে দ্যাখো গাইতে দ্যাখো / অনেক কথায় মুখর আমার দ্যাখো / দ্যাখো না কেউ হাসিশেষে নীরবতা” … কার দায় পড়েছে আমার হাসিশেষের নীরবতা, আমার মুষড়ে-পড়া হালত দেখে একটু প্রবোধ দেবে আমায়? হাসিই সইতে পারে না, কান্না তো বহু দূরের বাত।
বসের কন্সার্ট আমি মিস্ করি নাই পারতপক্ষে। এত অসংখ্যবার উনি সিলেটে কন্সার্ট করতে এসেছেন, আমিও অনেক কন্সার্টে গেছি। মিডিয়ায় টেলিভিশনজার্নালিস্ট হয়ে কাজ শুরু করার সুবাদে উনাকে পয়লাবার কাছ থেকে দেখেছি গীতিআরা সাফিয়া আর রাশেদা কে. চৌধূরী যে-সময়টায় কেয়ারটেকার সরকারে এসেছিলেন সেইবার। ২০০৬ থেকে ২০০৮ মধ্যবর্তী সময়টায় ক্যাডেট কলেজে এবি শো করতে এসেছিলেন। কলেজের রেস্ট্রিকশন ছিল কড়া। আমি যে-হাউজে কাজ করতাম সেইটার অনুমোদন ছিল প্রবেশের এবং ক্যামেরার ডিরেকশনে ছিলাম আমি। ছিলাম স্টেজের উপরেই। ব্যাকড্রপ ঘেঁষে সামনে-পেছনে ক্যামেরা রল্ করেছি সুযোগ বুঝে। একসময় দেখি কিসের ক্যামেরা আর কিসের চাকরি বাঁচানো, কোন ফাঁকে এবিরিদমের জাদুতে স্পৃষ্ট হয়ে আমি নিজেই ফিদা নাচতে লেগেছি, বস্ আমার নাচ দেখে আমাকে আরও নাচার প্রশ্রয় দিয়েছেন। বসের আশকারায় আমি তো উদ্বাহু নেচেছি। স্লিম ছিলাম তখন, চুল ছিল নজরকাড়া দিঘল, কালো তো অবশ্যই, দেখতেও অত বেঢপ ছিলাম না, আর গ্রুপথিয়েটার করার কারণে শরীরে আড়ষ্টতাও ছিল না, ক্যাডেটস্টুডেন্টরা নাচ দেখে ফুর্তি পেয়েছিল বলেই টোম্যাটো ছুঁড়ে নাই। শীতের রাত ছিল। টোম্যাটো ছুঁড়লে তো শেষরাইতে স্নান করতে হতো। ওই স্মৃতি, বসের সঙ্গে ক্যাডেট কলেজে একস্টেজে আনন্দ করার স্মৃতি জীবনেও ভুলব না আমি।
কিন্তু তুলনা খুঁজি না আমি। জীবনের কোনো অভিজ্ঞতারই তুলনা আদতে হয় না। আইয়ুব বাচ্চুরও তুলনা হয় না। আইয়ুব বাচ্চু একটা সারাজীবনের অভিজ্ঞতা। আইয়ুব বাচ্চু একটা ঘটনা। এর তুলনা হয় না। ‘আনপ্লাগড’ অ্যালবামের সেই মিউজিশিয়্যান আইয়ুব বাচ্চুর তুলনা আমি কোথায় গিয়া পাবো? “গগনের তারাগুলো নিভে-যাওয়া এক রাতে / এলোমেলো স্মৃতিরা সব হারালো ভুল পথে” — এই আইয়ুব বাচ্চুর তুলনা কই ভুবাংলায়? “দুঃখিনী এই রাতে হায় / বিষাদ ছুঁয়েছে আমায়” — এই আইয়ুব বাচ্চু দুইটা আছে একশতকের ভিতরে? আইয়ুব বাচ্চু ইজ্ আইয়ুব বাচ্চু। দ্য বস্! বাচ্চু বাচ্চুই। নির্বিকল্প। আইয়ুব বাচ্চুকে পাওয়া যায় না দ্বিতীয় কোনো চ্যানেলে বা দোসরা শাখায়। এবিঅ্যাফেক্ট এবিতেই পাওয়া যায়।
এছাড়া আরও অনেক গান, কোনটা রেখে কোনটা গাইব? ধ্রুপদী চিরায়ত সংগীতের লিরিকের আবেদন নিয়ে এবির গানের সংখ্যা হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। ‘সেই তারাভরা রাতে’ শোনে নাই এমন পাতকের স্থান রৌরব নরকেও হবে না। আর ‘এখন অনেক রাত’ বাদ দিয়া আপনি স্বর্গে যাবেন, এত সোজা? “আমার দুটি আকাশ ছিল / একটিতে স্বপ্ন আর একটিতে দুঃস্বপ্ন / আজ স্বপ্নেরাও হয়ে গেছে দুঃস্বপ্ন / এখন দুটি আকাশে মেঘেরা প্রবল” … এই গানটা ভুলে গেলে নিজের কাছেই-বা মুখ দেখাব কোন মুখে? এইসব ডাকাতিয়া গানের কথা আলাপে এনে বোঝানো মুশকিল। অতএব মুশকিল এড়িয়ে সংক্ষেপে শেষ করি।
আইয়ুব বাচ্চুর এমন অসংখ্য গান আছে যেগুলো ওইভাবে বাজারপ্রিয় হয়নি, কিন্তু সমস্ত কন্সিডারেশনের শেষে সেই গানগুলো বহমান বাংলা গানে একেকটা কালোত্তীর্ণ সংযোজন। দুই কি তিনটারই নিশানা এইখানে বলেছি শুধু। ফলে, আমি মনে করি, যে-বাচ্চুকে গেল দুই/তিন দশক ধরে পেয়েছি আমরা, তাকে যেভাবে রিসিভ করেছি, এইটা আংশিক আইয়ুব বাচ্চু। খণ্ডিত আইয়ুব বাচ্চু এইটা। তার পুনরুজ্জীবন হবে একদিন মার্কেটে-আন্ডারকারেন্ট সেই লিরিক ও মিউজিকপিসগুলো শ্রোতাকানে গেলে।
এইটা বাজারেরই একটা ধর্ম যে, রেইটেড একটা আইডেন্টিটির বাইরে একজন আর্টিস্টের ভার্সেইটিলিটি সম্ভাব্য কনজ্যুমারের সামনে আনে না। মার্জিন প্রোফিটে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এমন রিস্কের শঙ্কা থেকে বাজার সবসময় শিল্পীকে একটা আবদ্ধ প্রকোষ্ঠে বেঁধে রেখে বেচতে চায়। বেচা ব্যাহত হতে পারে এমন ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে চায় না বাজারসর্দার তার পণ্যটির মোড়ক বদলিয়ে। আর আমাদের মিউজিকের বাজারটা তো অত প্ল্যানড কিছু না, আধাখেঁচড়া সাংগীতিক একটা বাজার আমাদের। নাটক-সিনেমার বাজারের দশা আরও অকহতব্য।
অচেনা হয়ে গেছে সে। সেই তুমি গিয়েছ অচেনা হয়ে। সেই আমিও বদলে গেছি কীভাবে যেন। ধর্মই জীবনের — বদলে যাওয়া। আফসোস করি না; — আমরা এবির সময়ে বেঁচেছি, কৃতার্থ যৌবন আমাদের।
… …
- উড়নচণ্ড যৌবনে এবি, টিশার্ট, লম্বু চুল, আমি ও সেই তুমি || লিটন চৌধুরী - October 19, 2018
COMMENTS