বাংলা সনেটের মুকুটহীন সম্রাট কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর ১১১তম জন্মবার্ষিকী  || মিহিরকান্তি চৌধুরী

বাংলা সনেটের মুকুটহীন সম্রাট কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর ১১১তম জন্মবার্ষিকী || মিহিরকান্তি চৌধুরী

গত ০২ জুন ২০২৩ শুক্রবার বিকেল ৪টায় সিলেটের জেলা পরিষদ মিলনায়তনে কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর ১১১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা তবারক হোসেইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কবির ‘সনেটসমগ্র’-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী স্মৃতি পর্ষদ, সিলেট-এর সভাপতি কবিপুত্র আলী মোস্তাফা চৌধুরী । প্রধান অতিথি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন লেখক ও গবেষক এবং সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মানবিক অনুষদের ডিন ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, কবি ও প্রাবন্ধিক এ কে শেরাম, কবি ও লেখক এনায়েত হাসান মানিক এবং লেখক, অনুবাদক ও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট-এর ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিহিরকান্তি চৌধুরী । আরও উপস্থিত ছিলেন শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস, গল্পকার মাহবুব জামান, কবি ড. মোস্তাক আহমাদ দীন, কবি সুমন বণিক, কবি আবিদ ফায়সাল, কবি ধ্রুব গৌতম, কবি আবদুল গফফারের পুত্রবধূ প্রফেসর করবী দত্ত ও আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী স্মৃতি পর্ষদ, সিলেট-এর সম্পাদক বিমান তালুকদার প্রমুখ।

এর আগে বিকেল ৩টায় শিশুশিল্পীদের মধ্যে আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী রচিত গানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রকাশনা অনুষ্ঠানশেষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদ ও পুরস্কার প্রদান করা হয়, ক্রেস্ট প্রদান করা হয় অতিথিদের। সবশেষে শিশুশিল্পীদের দলীয় ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশিত হয়।

আমার আলোচনায় আমি কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর সনেটের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে আধুনিক কবিদের সনেট নিয়েও আলোচনা করি। দেখা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে বিদেশি সাহিত্যফুলের চারা বাংলা সাহিত্যের বাগানে লাগিয়েছিলেন তার চরম উৎকর্ষ লাভ করে রবীন্দ্রনাথের হাতে। ইংরেজি সাহিত্যের মতোই বাংলা সাহিত্যের সনেট প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই কলাকৃতি তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। ওয়াট ও সারের প্রায় পঁচিশ বছর পরে ইংরেজি সাহিত্যে ফিলিপ সিডনি গীতিকাব্যের অন্যতম মুখ্যবাহন হিসেবে সনেটকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলা সাহিত্যে সনেট প্রবর্তনের প্রায় কুড়ি বছর পরে রবীন্দ্রনাথের সাধনায় এই কলাকৃতি বাংলা সাহিত্যে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ পেত্রার্কীয় বা শেক্সপীয়রীয় কোনও বিশেষ ধারার ধার ধারেননি। তিনি বিচিত্র পরীক্ষানীরিক্ষার মাধ্যমে নিজস্ব ধারা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

কবি আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরী কবিতা, সনেট লিখেছেন, লিখেছেন গান। জানা যায়, কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী ছয় শতাধিক গান রচনা করেছিলেন। তবে, কবিতাই ছিল তাঁর সিগনেচার আইডেনটিটি বা মুখ্য পরিচয়। এটাই ছিল তাঁর চারণভূমি, সৃজন-আনন্দের কেন্দ্রস্থল। কবিতার সৃজন-আনন্দই আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীকে সংগীতের জগতে আকৃষ্ট করেছিল।

তাঁর রচনার বিশেষ দিক হল : কবিতা, সনেট লিখেছেন প্রমিত বাংলায়, গান লিখেছেন আঞ্চলিক ভাষায়। তিনি বিশ্বমানব ও লোকজ মানব — দুই সত্তাকেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার অসাধারণ এক কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, সফলও হয়েছিলেন।

কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী বিধিবদ্ধভাবে চরণ ও মাত্রার আবশ্যকতা থেকে বিচ্যূত হননি। আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রতিটি সনেটের নিচে রচনার স্থান ও সময়ের উল্লেখ করেছেন। তাঁর সনেটগুলোর বিষয়ের বৈচিত্র্য একটা বিশেষ দিক। বহুমাত্রিক বিষয় ছিল তাঁর বিবেচনায়। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যের আর কোনও ভাষায় একক কোনও কবি হাজারের উপর সনেট লিখেছেন যেটা সম্ভবপর হয়েছে কবি আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরীর তুলনামূলক এক সংক্ষিপ্ত জীবনে। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আমার প্রশ্ন ছিল, এত প্রতিভাধর কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতধারায় কেন মূল্যায়ন হয়নি যেমনটি হয়নি ‘দেবীযুদ্ধ’ কাব্যের খ্যাতিমান রচয়িতা সিলেটের বালাগঞ্জের কবি শরচ্চন্দ্র চৌধুরীর।

সিলেটের লোকজ সংগীত সংগ্রহ নিয়ে কিছু কথা ছিল আলোচনাতে। গুরুসদয় দত্ত ও আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী ছিলেন অভিন্ন বংশধারার উত্তরপুরুষ। ঐতিহ্যগর্বী আবদুল গফফার আদি বংশগৌরব ধারণ করার সদিচ্ছা থেকেই নিজের নামের পদবিতে ‘দত্ত’ ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। গুরুসদয় দত্তের ব্যাপক পরিচিতি, সুখ্যাতি ও সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক মনষ্কতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন আবদুল গফফার। ফলে তাঁর সঙ্গে তিনি স্থাপন করেছিলেন যোগাযোগ। জানা যায়, গুরুসদয় তাঁকে যুক্ত করেছিলেন ব্রতচারী অন্দোলনের সঙ্গে এবং পরে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিলেট অঞ্চলের সমৃদ্ধ লোকসংগীত সংগ্রহের। শ্রমনিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় আবদুল গফফার ওই দায়িত্ব পালন করেছিলেন; সমগ্র সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন লোকগানের বিপুল সম্ভার। সংগৃহীত গানের ওই সংকলন গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমাও দিয়েছিলেন গুরুসদয়। কিন্তু ১৯৪১ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটলে গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। দীর্ঘকাল পর ১৯৬৬ সালে গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে নির্মলেন্দু ভৌমিকের নাম সহযোগে গ্রন্থটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রকাশনার সম্পাদক-সংকলক-সংগ্রাহকের নামপত্রে কিংবা নির্মলেন্দু ভৌমিকের ভূমিকাপৃষ্ঠার কোনও স্থানেই সংগ্রাহক হিসেবে নামোল্লেখ হয়নি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর। আমার আলোচনায়, নির্মলেন্দু ভৌমিকের ইচ্ছাতেই এমনটি হয়েছে বলে মত দিয়েছি। অন্য কোনও অজুহাতের কোনও সুযোগ নেই। আসলে নির্মলেন্দু ভৌমিকই তা দেননি, সোজা হিসাব। আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর অবদানকে অস্বীকার করার মানসিকতার নিন্দা জানিয়েছি আনুষ্ঠানিকভাবে। বলেছি, কাজটা ভালো হয়নি। কলিকাতা অঞ্জলি পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত’-এরও ভূমিকা ও সংকলন ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক। এত বড়ো বড়ো এলাকায় কি তিনি একাই এ-কাজগুলো করেছেন? তবে বাঙালি লেখকরা এমন করে থাকেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। ‘বিশ্বপরিচয়’ প্রমথনাথ সেন ও রবীন্দ্রনাথের যৌথ নামে প্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল কিন্তু শুধু কবির নামেই হয়েছে। এই গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের ঋণ স্বীকার করে লিখেন, “তিনি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতাম না, তা ছাড়া অনভ্যস্তপথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলাত না। তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি, সাহায্য পেয়েছি।” তবে এটা বলেলনি প্রমথনাথ শুরু করে কতদূর এগিয়েছিলেন। আসলে পুরো পাণ্ডুলিপিই প্রমথনাথ প্রস্তুত করেছিলেন। সেখানে আমূল পরিবর্তন ও সম্পাদন সাধিত হয় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক। সিলেটে রাধারমণের গানের দুইজন সংগ্রাহকের অভিন্ন বয়ান। কে কারটা?

কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর নজরুলঘনিষ্ঠতার সন্ধান পাওয়া যায়। এর পর আন্তরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হন কবি জসিমউদ্দীন, কবি আব্দুল কাদির, বেনজীর আহমেদ, হুমায়ূন কবীর, ফররুখ আহমেদ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সুফিয়া কামাল, আলিম হোসেন প্রমুখের সাথে। কিন্তু কবি আবদুল গফফারের রবীন্দ্রঘনিষ্ঠতা বা সান্নিধ্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ তাঁর কুলভাই গুরুসদয় দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের লোক। তিনি কি একবার কবি আবদুল গফফারকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যেতে পারতেন না? নিয়ে গিয়ে বলতে পারতেন না যে, ইনি হচ্ছেন কবি আবদুল গফফার, সনেট লিখেন, গান লিখেন, কবিতা লিখেন। আমার জ্ঞাতিভাই, এক গোষ্ঠীর। তিনি এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে (বা তাঁকে নিয়ে এসেছি আপনার সাথে দেখা করাতে) অথবা আপনার আশীর্বাদ নিতে (ওই সময়ের সাম্মানিক ভাষ্য)। গুরুসদয় দত্তের মতো রবীন্দ্রায়িত ব্যক্তিত্বের এহেন উদাসীনতা আমাদের নিদারুণ মনোকষ্টের কারণ। বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছি। রবীন্দ্রনাথের সাথে কবি আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরীর সাক্ষাৎ ঘটলে কী হত তা মনিপুরি নৃত্যের অবস্থান দেখলেই অনুমান করা যায়। সবকিছুর পরেও বাংলা সনেটের মুকুটহীন সম্রাটের নাম কবি আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরী।

কবি আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরীকে নিয়ে আমার পরিকল্পনার কথা বলি। আমার সেদিনের উপস্থাপনার পেছনে আছে ৩৫০০ শব্দের অসম্পূর্ণ প্রবন্ধ। মাত্র এক সপ্তাহে এর বেশি লিপিবদ্ধ করতে পারিনি তবে কনসেপ্ট পরিস্কার, সেটা মুখে বলেছি। জুন মাসের মধ্যে এটিকে ৬০০০ শব্দের প্রবন্ধে প্রসারিত করে বুকলেট আকারে প্রকাশ করব। এই প্রবন্ধের ইংরেজি ভার্শন হবে। জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার জন্য ‘সনেটসমগ্র’ ও ‘নির্বাচিত গান’ দুটি গ্রন্থের ৭০০ শব্দ (সাহিত্যপাতায়) করে বাংলা ও ইংরেজি চারটা রিভিয়্যু জুন মাসেই (২০২৩) প্রকাশিত হবে। কাজ শেষ। এত কম সময়ে বেশ কিছু কাজ করার মূলে রয়েছে, কবির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ, তাঁর সৃষ্টিতে বিমোহিত হওয়া।

কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর আদিনিবাস জকিগঞ্জের বাদে-কুশিয়ারকুল পরগণার বাগরসাঙ্গন গ্রামে। এই পরগণারই মাইজগ্রামে (বর্তমান করিমগঞ্জ) আমার মামারবাড়ি, নদীর এইদিক-ওইদিক। কবির অবস্থান বিবেচনায় কবি আমার আত্মীয়, মাতুল।

মাতুল কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

ব্যানারে ব্যবহৃত কবিপ্রতিকৃতির শিল্পী  পরিতোষ হাজরা


মিহিরকান্তি চৌধুরী : লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you