বিষয় : অশ্বত্থামা সিনড্রোম || সত্যজিৎ সিংহ

বিষয় : অশ্বত্থামা সিনড্রোম || সত্যজিৎ সিংহ

১.
অশ্বত্থামা মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের একজন। যত সভা, পারিষদ, যুদ্ধের স্ট্রাটেজি হয়েছে — সব জায়গায় তাকে গুরুত্ব সহকারে রেখেছেন মহাকবি ব্যাস। তিনি দুর্যোধনের সমবয়সী পাশাপাশি অস্ত্রগুরুও। যেদিন দ্রুপদের দেশ থেকে দ্রৌপদীকে না পেয়ে হতাশ মনে হস্তিনায় দুর্যোধন ফিরছিলেন, সেদিন সারাক্ষণ অশ্বত্থামা তার পাশে ছিলেন, কিন্তু সান্ত্বনার জন্য একটা শব্দও খরচ করেননি। যেদিন পাশাখেলায় হারবার পরে দ্রৌপদীকে ভরা মজলিশে অপমান করা হয়েছিল সেদিনও অশ্বত্থামা টুঁ শব্দ প্রতিবাদ করেননি।

পাণ্ডবরা অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যর কাছ থেকে খুব বেশি আশা করেননি। কারণ তিনি দুর্যোধনের সভার চাকরি করেন। বয়সও হয়েছে অনেক। কিন্তু অশ্বত্থামা তরুণ। অস্ত্রশিক্ষার দিনে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র অর্জুনের সাথে কঠিন সব অধ্যবসায়গুলো একত্রে ভাগাভাগি করেছেন। তিনি অর্জুনের প্রিয় শুভানুধ্যায়ীও একজন। অন্তত তিনি তো প্রতিবাদ করতে পারতেন! পারতেন না!!

মহাযুদ্ধের ১৭তম দিনে এসে অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বলছেন, যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানাতে, ততদিনে পাণ্ডবদের জয় পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেছে, সঙ্গীসাথি শত ভাই হারিয়ে নিঃস্ব দুর্যোধন। কিন্তু এই কথাটা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে যখন দুর্যোধন শুনছেন না কারো কথা, ঘাউড়ামি করে কৃষ্ণকে পর্যন্ত বেঁধে ফেলবার হুমকিধামকি দিচ্ছেন — তখন কি অশ্বত্থামা পারতেন না দুর্যোধনকে যুদ্ধের পরিণতির কথা বলে তাকে আটকাতে! পারতেন না!!

মহাযুদ্ধর ঠিক কদিন আগে ভীষ্ম যখন তার দলের শক্তি নিয়ে একে একে ব্যাখ্যা করছেন — অশ্বত্থামার কথা এলে তিনি বললেন, “সে দারুণ এক যোদ্ধা। গোটা কুরুকুলে এক অর্জুন ছাড়া ওর ধারেকাছে কেউ নাই। তিনি চাইলে গোটা পাণ্ডবসমাজ তছনছ করে দিতে পারেন। কিন্তু আফসোসের কথা কি জানো, নিজের জীবন তার কাছে বড় প্রিয়। একজন ক্ষত্রিয়ের কাছে যুদ্ধের ময়দানে মরাবাঁচার চিন্তা করা কি সাজে? কিন্তু দেখে নিও, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিনও সে বেঁচে থাকবে।” ভীষ্মের কথা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছিল।

অশ্বথামা নিজেও বিশ্বাস করতেন — তার মতন অজেয় এ জগতে নাই কেউ। কিন্তু যেদিন তার পিতা মারা গেলেন, সেদিন প্রতিশোধের সময় তিনি এই করব সেই করব বলে আস্ফালন করেছিলেন। দিন-চারেক পরে দেখা গেল — মধ্যম মানের কিছু যোদ্ধা ছাড়া তিনি আসলে পাণ্ডববাহিনীর কিছুই করতে পারেন নি। শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে সেরা কথাটাই বলেছেন, “অশ্বথামা নিজেই জানে না, সে কি সিদ্ধান্ত নেবে।” গোটা জীবন তাকে সংশয় নিয়ে কাটাতে হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় সে যদি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিত, হয়তো কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত।

২.
অশ্বত্থামা অসম্ভব রূপবান পুরুষ ছিলেন। দুর্যোধন তাকে দ্রৌপদীর রূপের কাঙাল লাজুক প্রেমিক বলে অনেকবার অপমান করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অশ্বত্থামা বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাননি এ বিষয়ে। সারাজীবন ব্রহ্মচর্যা পালন করবেন বলে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের দিন তিনি নারীশিশুদের যেভাবে কচুকাটা করে ফালাফালা করে দিচ্ছিলেন, সেদিন তার নৃশংস রূপ দেখে গোটা মহাভারত স্তব্ধ হয়ে যায়। যে-শিশু একদিন দুধ খেতে না পেরে চালের পিটুলি খেয়ে দুধের স্বাদ ভুলেছিল — সেই শিশু একদিন দানব হয়ে উঠবে তা কি বিধাতা জানত?

৩.
এই রাষ্ট্রযন্ত্রের যুগে অশ্বথামা কে নয়? আপনি যা চান — তা-ই কি ঠিকঠাক ঘটে? আপনি যেখানে প্রতিবাদ করবার কথা সেখানে করেন? যখন বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে সীমানাটা ধসে পড়ে সেদিন অশ্বত্থামার মতো নির্জন প্রান্তরে মুখথুবড়ে পড়তে আপনাকেই তো আমি দেখেছিলাম, দেখিনি?


COMMENTS

error: