কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : বাংলা সনেটের মুকুটহীন সম্রাট || মিহিরকান্তি চৌধুরী

কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : বাংলা সনেটের মুকুটহীন সম্রাট || মিহিরকান্তি চৌধুরী

শেয়ার করুন:

 

বাংলা সাহিত্যজগতে এমন বহু সৃষ্টিশীল প্রতিভা রয়েছেন, যাঁদের কর্মজীবন ছিল উজ্জ্বল, নিরলস সাধনাময়, অথচ তাঁদের যথাযথ স্বীকৃতি এসেছে বহু পরে—বা কখনও-বা আদৌ আসেনি। সাহিত্যিক গৌরবের আলো অনেক সময়েই নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে কিছু নক্ষত্রকে উপেক্ষা করে যায়, বিশেষত যদি তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার প্রচারহীন, প্রাতিষ্ঠানিক অনুগ্রহবর্জিত বা প্রথার বিপরীতে অবস্থান করা হয়। কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী (১৯১২ু১৯৬৬) সেইরকমই এক নিভৃতচর্চার সাধক, যিনি ভাষা, সুর ও সংস্কৃতির বহুধা ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রেখেও সাহিত্য-ইতিহাসের মূলস্রোতে স্থান পাননি যে গুরুত্ব তিনি প্রাপ্য ছিলেন। তাঁর ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করা শুধু আবেগের প্রকাশ নয়, বরং একটি জরুরি সাহিত্য-ঐতিহাসিক কর্তব্য—যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জাতির সংস্কৃতি ও কাব্যচেতনা গঠনে প্রান্তিক ও অবহেলিত প্রতিভারাও কতখানি কার্যকর হতে পারেন।

আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী ছিলেন একাধারে কবি, সনেটকার, গীতিকার ও লোকগবেষক—যার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন অপরিমেয় অবদান। তাঁর সাহিত্যকর্মে যেমন বাংলার লোকঐতিহ্যের শব্দমাধুর্য ও সুরধ্বনি মিশে আছে, তেমনি আছে ক্লাসিক রীতির শৃঙ্খলাপূর্ণ সৌন্দর্য। তিনি যে যুগে সাহিত্যচর্চা করছিলেন, সে সময়ে আধুনিকতার স্রোত ও ঐতিহ্যবাহী ধারার মধ্যে ছিল প্রবল টানাপড়েন। এই দ্বৈত স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন এক স্বতন্ত্র কাব্যভুবন, যা আজও পাঠকের মন ছুঁয়ে যায় তার স্বর, সুর ও সংকেতের অভিনবতায়।

 

বিস্মৃত এক সনেটকার, যার তুলনা নেই
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী বাংলা ভাষায় এক হাজারেরও বেশি সনেট রচনা করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। সংখ্যার দিক দিয়ে এই পরিমাণ নিজেই বিস্ময়কর, তবে তাঁর কাব্যিক উৎকর্ষ আরও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাঁর সনেটগুলোতে কেবল কাঠামোগত শৃঙ্খলাই নয়, রয়েছে একটি দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি, সমাজসংলগ্ন ভাবনা, এবং বাংলা কাব্যঐতিহ্যের প্রতি এক অনুপম শ্রদ্ধাবোধ।

বাংলা সাহিত্যে সনেটের যাত্রা শুরু হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে, যিনি ইতালীয় ও শেক্সপিয়রীয় ঐতিহ্যকে বাংলা ভাষায় প্রয়োগ করেন। রবীন্দ্রনাথ এই ধারাকে ভাবগম্ভীরতা ও ভাষার সৌন্দর্যে আরও শাণিত করেন। গফ্ফার দত্তচৌধুরী তাঁদের অনুবর্তী হলেও, তিনি কেবল অনুকরণ করেননি; বরং নিজস্ব বর্ণভাষায় ও ছন্দানুশাসনে এই ছন্দবদ্ধ রূপকে আত্মস্থ করেছেন। তাঁর কবিতাগুলো নিছক অনুশীলন নয়—সেগুলো হয়ে উঠেছে আত্মসন্ধানী ও যুগসচেতন চেতনাপুঞ্জ।

একটি লক্ষণীয় দিক হলো, প্রতিটি সনেটের শেষে কবি স্থান ও সময় উল্লেখ করেছেন, যা তাঁর সময়নিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এটি কেবল তথ্যের প্রয়োজনে নয়—বরং কবি নিজেই যেন কালের এক সচেতন দলিলকারী, একান্ত আত্মজৈবনিক ও ইতিহাসসচেতন মননচর্চাকারী।

বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতা : গান, কবিতা ও গবেষণায় অবিচল
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী কেবল কবি ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক স্রষ্টা—যাঁর প্রতিভার বিস্তার ছড়িয়ে রয়েছে গানে, গবেষণায় ও লোকসংস্কৃতির নানা স্তরে। ছয় শতাধিক গান রচনা করেছেন তিনি, যার একটি বড় অংশ সিলেটি উপভাষায়। তাঁর গান শুধু গীতধ্বনির মোহ নয়, তা হয়ে উঠেছে একটি জনপদের আবেগ, চেতনা ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। “তসবিহ রেখে দূরে, তলোয়ার হাতে নাও”—এই গান যেমন ধর্মীয় উদ্দীপনা ও মুক্তির আহ্বান, তেমনি “ওগো সজনী, গোয়া গাছো ট্যাক্সো লাগিলো নি”—এরকম গান প্রকাশ করে এক আঞ্চলিক, লোকজ প্রেম ও বেদনার ঐশ্বর্য। এই দ্বৈতধারা—উদাত্ত মানবতাবাদ ও লোকজ অভিজ্ঞতার সম্মিলন—তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

লোকগবেষণা তাঁর আরেক পরিচিত ও প্রগতিশীল ভূমিকা। গুরুসদয় দত্তের তত্ত্বাবধানে তিনি যে বিপুলসংখ্যক সিলেটি লোকগান সংগ্রহ করেন, তা এক ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য। এগুলো পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই কাজের মূল কৃতিত্বদাতা হিসেবে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর নাম ছায়ায় ঢাকা পড়ে। এই বিস্মরণ শুধু ব্যক্তি-অবমাননা নয়, এটি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির দায়ভারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

 

মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতা : সাহিত্যপ্রবাহে উপেক্ষিত এক প্রতিভা
বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূলধারায় আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর স্থান হয়নি—এ এক নির্মম সত্য। সৃষ্টিসম্ভারের বিপুলতা, শৈলীর নিখুঁততা ও বিষয়বৈচিত্র্য সত্ত্বেও তিনি রয়ে গেছেন প্রান্তে, আঞ্চলিকতার গণ্ডিতে। তাঁর জীবদ্দশায় কোনও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি; অথচ মৃত্যুর সময় তাঁর ঝুলিতে ছিল পঞ্চাশটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। পাঠকের অভাব ছিল না—সিলেট, কাছাড় এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয় কবি; কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে যে আলোচনার দরকার ছিল, তা হয়নি—না প্রবন্ধে, না পত্রিকায়, না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

এই নিঃসঙ্গতা শুধু তাঁর একার নয়; সিলেটি আরেক প্রতিভাবান কবি শরচ্চন্দ্র চৌধুরীও পড়েছেন একই অবজ্ঞার ছায়ায়। শরৎচন্দ্র তাঁর ‘দেবীযুদ্ধ’ কাব্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তবু জাতীয় সাহিত্যস্রোতে তাঁকেও উপেক্ষিত থাকতে হয়েছে। এই দুই কবির প্রতি অবহেলা বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র-প্রান্ত বিভাজনের দুঃখজনক বাস্তবতাকে নগ্ন করে তোলে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন আমরা আঞ্চলিকতা বনাম মূলধারা-র সংকট নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, তখন আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর মতো কবিকে পুনরাবিষ্কার ও পুনর্মূল্যায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ মুক্তি।

 

আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী, গুরুসদয় দত্ত ও সিলেটের লোকগান সংগ্রহ
বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে একটি দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে আছে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর প্রতি তৎকালীন সাহিত্যাঙ্গনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তাঁর প্রতি অবিচার করেছেন। জানা যায়, গুরুসদয় তাঁকে যুক্ত করেছিলেন ব্রতচারী অন্দোলনের সঙ্গে এবং পরে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিলেট অঞ্চলের সমৃদ্ধ লোকসংগীত সংগ্রহের। শ্রমনিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় আবদুল গফ্ফার ওই দায়িত্ব পালন করেছিলেন; সমগ্র সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন লোকগানের বিপুল সম্ভার। সংগৃহীত গানের ওই সংকলন গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমাও দিয়েছিলেন গুরুসদয়। কিন্তু ১৯৪১ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটলে গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। দীর্ঘকাল পর ১৯৬৬ সালে গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে নির্মলেন্দু ভৌমিকের নাম সহযোগে গ্রন্থটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রকাশনার সম্পাদক-সংকলক-সংগ্রাহকের নামপত্রে কিংবা নির্মলেন্দু ভৌমিকের ভূমিকা-পৃষ্ঠার কোনও স্থানেই সংগ্রাহক হিসেবে নামোল্লেখ হয়নি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর। তবে নির্মলেন্দু ভৌমিকের ইচ্ছাতেই এমনটি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য কোনও অজুহাতের কোনও সুযোগ নেই।

কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সাহিত্য সংযোগ
কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর কবি নজরুল ঘনিষ্ঠতার সন্ধান পাওয়া যায়। এর পর আন্তরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হন কবি জসিমউদ্দীন, কবি আব্দুল কাদির, বেনজীর আহমেদ, হুমায়ূন কবীর, ফররুখ আহমেদ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সুফিয়া কামাল, আলিম হোসেন প্রমুখের সাথে। কিন্তু কবি আবদুল গফফারের রবীন্দ্র ঘনিষ্ঠতা বা সান্নিধ্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ তাঁর কুলভাই গুরুসদয় দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের লোক। তিনি কি একবার কবি আবদুল গফ্ফারকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যেতে পারতেন না? নিয়ে গিয়ে বলতে পারতেন না যে, ইনি হচ্ছেন কবি আবদুল গফ্ফার, সনেট লিখেন, গান লিখেন, কবিতা লিখেন। আমার জ্ঞাতিভাই, কুলভাই, এক গোষ্ঠীর। তিনি এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে (বা তাঁকে নিয়ে এসেছি আপনার সাথে দেখা করাতে) অথবা আপনার আশীর্বাদ নিতে (ওই সময়ের বা সব সময়ের সাম্মানিক ভাষ্য)। গুরুসদয় দত্তের মতো রবীন্দ্র প্রভাবে আলোকিত ব্যক্তিত্বের এহেন উদাসীনতা আমাদের নিদারুণ মনোকষ্টের কারণ হয়ে আছে। বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবেই উত্থাপন করলাম, আগেও করেছি।

 

উত্তরসূরিদের পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টা
সৌভাগ্যজনকভাবে, গত এক দশকে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা সাহিত্য-ইতিহাসের এক আশাব্যঞ্জক বাঁক। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘নির্বাচিত গান’ সংকলন, যেখানে স্বরলিপি সহ অনেক গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘সনেটসমগ্র’—এতে স্থান পেয়েছে তাঁর প্রায় এক হাজার সনেট। ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’—যা তাঁর বহুমাত্রিক কাব্যপ্রতিভার প্রামাণ্য দলিল। এই তিনটি বই কেবল সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য নয়, গবেষক ও শিক্ষাবিদদের জন্যও মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই পুনরুজ্জীবনপ্রয়াস প্রমাণ করে—যদি উত্তরসূরি প্রজন্ম আন্তরিক হয়, তবে বিস্মৃত প্রতিভাও সময়ের গহ্বরে থেকে ফিরে আসতে পারে সম্মানের আসনে।

 

উপসংহার : পুনর্মূল্যায়নের এখনই সময়
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী ছিলেন নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়া এক কবি, যিনি ভাষার মাধ্যমে সমাজ, ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে একত্রিত করেছিলেন। তাঁর সনেট বাংলা সাহিত্যে এক মূল্যবান সংযোজন, তাঁর গান আমাদের লোকচেতনার প্রতিফলন। এখন সময় এসেছে তাঁকে শুধু স্মরণ নয়, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার, গবেষণার আওতায় আনার, এবং সাংস্কৃতিক অনুবাদে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দেওয়ার।

২০২৫ সালে তাঁর ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা যদি তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারি—তবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাপ্য স্থানটি তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। সেই কবিকে, যিনি মুকুটহীন রাজা ছিলেন বাংলা সনেটের, আজ আমরা সময়ের পালাবদলে অভ্যর্থনা জানাই—সম্মানের মুকুটে।

মূল স্রোতধারা ও লোকজধারার এক সেতুবন্ধন হয়ে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী আজও আমাদের চেতনাজগতে জেগে থাকুন।


মিহিরকান্তি চৌধুরী। লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট


গানপারে আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you