নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো নামটিই নতুন — আব্দুল লতিফ (Abdul Latif) — নাম শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন ইনি আবার কে? আর যারা পুরাতন তারাও হয়তো বলবেন, — ও! আব্দুল লতিফ! — উনার গান তো শুনেছি, ভালো গান করতেন। ব্যস, এই শেষ!
অপরদিকে সরকারি দায়িত্বশীলরা তোতাপাখির মতো তাঁর মৃত্যু কিংবা জন্মবার্ষিকীতে একটি ছোট শোকগাথা দিয়েই নিজেদের দায়মুক্তি ঘটান।
বর্তমানে আমরা বাঙালিরা বেঁচে আছি ঠিকই, কিন্তু আগের সেই বাঙালি হয়ে নয়। স্বার্থবিহীন যেন আমাদের কলমটি লিখতে চায় না, মুখটি কথা বলতে চায় না। যার ফলে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাটির ক্ষণজন্মা মনীষীদের জীবনী, শিল্পসৃষ্টি ও অমূল্য অবদানসমূহ।
দিবসপ্রেমে যদিও আমরা পিছাইয়া নাই, কিন্তু অনেকেই জানে না কেন বা কি কারণে কোন দিবস পালিত হয়। শিকড় থেকে সরতে সরতে অতি শীঘ্রই শিকড়বিহীন এক জাতিতে পরিবর্তিত হওয়ার যেন প্রতিযোগিতা চলতেছে এখানে এখন।
সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করবার চেষ্টা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে রাখা জরুরি যে বাংলাদেশের ইতিহাস মানে মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারের ইতিহাস না; বরং বাংলাদেশের ইতিহাস মানে এই দেশের প্রতিটি মানুষের ইতিহাস; — যেখানে কৃষক, শ্রমিক, জেলে, কামার, কুমার, খেটে-খাওয়া মানুষ কাউকে তুচ্ছ করে দেখা মানে সত্য ইতিহাস অস্বীকার করা।
সাথে সাথে এটাও দিবালোকের মতো সত্য যে বাংলার যে-কোনো সংগ্রামে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাস চিরস্মরণীয়। প্রতিটা সংগ্রামে তাদের লিখনী আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামে জোয়ার এনে দিয়েছে, জোশের সঞ্চার করেছে।
এই-রকম এক কালজয়ী শিল্পী ও ভাষাসৈনিকের নাম আব্দুল লতিফ, — যিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, ও সুগায়ক শিল্পী ছিলেন। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ প্রতিটা আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর রচিত গান চুম্বকের মতো বাঙালিদের আকর্ষিত করেছিল, দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তুলেছিল, সংগ্রামী হতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।
অসংখ্যা কালজয়ী গানের রচয়িতা ও সুরকার আব্দুল লতিফের রচিত কালজয়ী গানের কয়েকটি গান স্মরণ করতেছি নিবন্ধের একাংশে, এরপর শিল্পীজীবনের কিয়দংশ স্মরণ করে এই লেখা পাঠকের দরবারে পেশ করব।
আব্দুল লতিফের গীতিসৃজন : কয়েকটি বিখ্যাত গানের সূচনাপঙক্তি
১.
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়
২.
সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা
সোনা নয় তত খাঁটি
বলো যত খাঁটি — তারচেয়ে খাঁটি
বাংলাদেশের মাটি রে আমার বাংলাদেশের মাটি
৩.
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়
দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়
৪.
পরের জায়গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই
৫.
দুয়ারে আইসাছে পালকি
নাইয়রি যাও তোলো রে তোলো
মুখে আল্লা-রসুল সবে বলো
আব্দুল লতিফের সুরসৃজন : কয়েকটি বিখ্যাত সুরের নমুনা স্মরণ
শুধু নিজের লেখা গানেই সুর দিয়েছেন আব্দুল লতিফ, তা নয়। নিজে লিখেছেন অসংখ্য, জনপ্রিয়তার নিরিখে এবং কালোত্তীর্ণতার বিবেচনায় তাঁর গানসংখ্যা হাতের পাঁচ আঙুলে গণনায় বেগ পেতে হবে যে-কাউকেই। লিখেছেন, সুর ও সংগীত রচনা করেছেন নিজের গানের, নিজে গেয়েছেন, এবং সুর করেছেন অন্যের লেখা গানেরও। লতিফের সুর-করা গানের মধ্যে এখানে কয়েকটা মাত্র উদ্ধৃত হচ্ছে :
“তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি
রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন(ও) করিলি রে বাঙালি
তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি”
বিখ্যাত ও জনহৃদয়গ্রাহী এই গানটির সুর করেন আব্দুল লতিফ। গানটির রচয়িতা কবি শামসুদ্দিন আহমদ।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি”
শিরায়-ধমনীতে একেবারেই মিশে-যাওয়া বাংলাদেশী ও গোটা বাঙালি জাতির এই প্রভাতফেরিগীতির গীতাখ্য মূলত একটি কবিতা, কবিতাটির রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং এই কবিতাটিকে গানে রূপায়িত করে এর প্রথম সুর দেন আব্দুল লতিফ — যে-কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে। পরবর্তীকালে শহিদ আলতাফ মাহমুদ গানটার নতুন সুর দেন যা বর্তমানে প্রচলিত।
“বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে সেই জনতা”
আব্দুল লতিফের সুরে এই গানটাও অত্যন্ত জনপ্রিয়, অনবদ্য সুরের এই গানটা তাঁর সুরারোপিত অন্য অনেক গানেরই মতো যুগধর্ম শরীরে বয়ে নিয়েও যুগোত্তীর্ণ।
জনপ্রগতি ও জাতিবিকাশের আন্দোলনে একজন সংগীতদ্রষ্টা আব্দুল লতিফের ভূমিকা
বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, ভাষাসৈনিক আবদুল লতিফ ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। এই দেশের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে শেষ অবধি তার সংশ্লিষ্টতা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও তাৎপর্যবহ। আমাদের দেশে এতগুলো গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি দ্বিতীয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবদুল লতিফ একজনই ছিলেন; — প্রতিভায়, ব্যক্তিত্বে, সারল্যে, সহজতায়, সহৃদয়তায় তাঁর তুলনা কেবল তিনিই।
বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনকে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রধান উৎসরূপে চিহ্নিত করা হয়। সেই আন্দোলন ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হতে হতে ৩০ লক্ষ প্রাণের তাজা রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা। আর এই-সকল আন্দোলনসংগ্রামের প্রতিটি মিছিলে আবদুল লতিফের অগ্রণী সাহসী ভূমিকা মাঠপর্যায়ে যেমন ছিল, তেমনি লিখনী ও কণ্ঠযুদ্ধেও ছিল সমান তালে এবং তাৎপর্যে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটিকে সুর দিয়ে গানে তিনিই প্রথম রূপান্তরিত করেন। কয়েক বছর তার সুরেই গানটি গাওয়া হয়েছিল। পরে শহিদ আলতাফ মাহমুদ গানটির নতুন সুর দেন। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি গাওয়া হয়।
সেই-সময় আব্দুল লতিফ গানটি সুর করে জনসমক্ষে গাওয়ার পর তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাঁকে, সহ্য করতে হয়েছিল নির্মম মানসিক নির্যাতন। গানটি আর না-গাওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠী চাপ দিচ্ছিল। এজন্য তিনি প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতায় ভুগেছেন। তিনি সে-সময় ভাবছিলেন, ওরা কেন আমাদের মুখের কথা কেড়ে নিতে চায় — যে-কথায় যে-ভাষায় দাদা কথা বলেছেন, বাবা বলেছেন, সেই মায়ের ভাষার ওপর ওদের কেন এত আক্রোশ? সেই জিজ্ঞাসা থেকে তিনি লিখেছেন একুশের অবিস্মরণীয় আরেক গান :
“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়…”
এই গানটি শুনে কবি ফররুখ আহমেদ প্রাণভরে দোয়া করেন আব্দুল লতিফের জন্য। কবি ফররুখ সেই-সময় আব্দুল লতিফকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, একদিন তুমি অনেক বড়মাপের শিল্পী হবে। এই একটি গানেই ভাষা-আন্দোলন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম, পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতন নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছিল এবং তাঁর গাওয়ার প্রতিবাদী ভঙ্গিতে এমনভাবে তা মানুষের মনে দাগ কেটেছিল যার জন্য শ্রোতা — ছাত্রছাত্রী শিক্ষার্থী, যুবক, তরুণ — সবাই নতুন সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল।
আবদুল লতিফ কেবল লোকসংগীতশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন গণসংগীতের অন্যতম পুরোধা পুরুষ, গীতিকার, সুরকার ও ভাষাসৈনিক। পুঁথিপাঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন উত্তুঙ্গ খ্যাতির অধিকারী। তাঁর সবচাইতে বড় গুণ ছিল, তিনি ঠিক সময়ে ঠিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে গান রচনা করতে পারতেন। সময়োপযোগী অনেক গান লিখে সুরারোপ করেছেন, গেয়েছেন, সবাই যা পারে না সহসা, যা বিশেষ কিছু ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব হয়।
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে রাজনৈতিক মুক্তির যে-যুদ্ধ সেদিন নির্বাচন বিজয়ের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল, তার পেছনে শেরেবাংলা, শহিদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বে নিপীড়িত মানুষকে একজোট করেছিলেন, তেমনি জাগরণী গানের যে-বিপুল ভূমিকা মানুষকে সাহস জুগিয়েছিল, তার অগ্রনায়ক ছিলেন আবদুল লতিফ।
আব্দুল লতিফের সমসাময়িক যারা গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং শিল্পী ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শহিদ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, আবুবকর খান, বদরুল হাসান, মোশাররফ হোসেন, সুখেন্দু চক্রবর্তী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কলিম শরাফী, আনিসুল হক চৌধুরী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, আবুবকর সিদ্দিক, গাজীউল হক, সলিল চৌধুরী, নিজামুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, বিডি হাবিবুল্লাহ, শামছুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
বাঙালির জাতি-অগ্রগতির প্রত্যেকটি পর্যায়ে আব্দুল লতিফ গান বেঁধেছেন এবং সেই গানগুলো হয়েছে কালজয়ী। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আব্দুল লতিফ রচনা করলেন :
“হকের নায়ে চড়বি কে রে আয়
হক হাল ধইরা বইস্যা রইছে
ভাসানী তার বইঠা বায়।
আতাউর আর মুজিবরে
গুণের রশি টাইনা ধরে
দেখ রে নায়ে ভাই সোহরাওয়ার্দী
মাস্তুলে তার পাল ওড়ায়।”
এরপর ’৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থানকে উদ্দেশ্য করে ছাত্রদের উৎসাহিত ও প্রেরণা দেওয়ার জন্যও অসংখ্যা গান লিখেছেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের সময় তিনি লিখলেন :
“দুঃখের দইরা হইবা যদি পার
দেখো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
হাল ধইরা বইসা নৌকায়।”
এছাড়া ‘সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা / সোনা নয় তত খাঁটি’ গানটিও ওই সময়েই রচনা করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে আবদুল লতিফ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত ‘তমঘায়ে খেদমত’ পদক প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি নিয়মিত গান লিখে দিতেন যা বেতারের প্রায় সব শিল্পীরাই গাইতেন।
আব্দুল লতিফের গান শোনা মাত্রই শ্রোতাদের রক্ত গরম হয়ে যেত, কখনো তাঁর রচিত লোকগান শুনে বাংলার মাটির গন্ধ খুঁজে পেতেন শ্রোতারা। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আবদুল লতিফ লিখলেন এবং গাইলেন :
“দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়”
এই গান বাঙালির বরেণ্য ভাষাবীর, মুক্তিযোদ্ধা, আজন্ম লড়াকু দেশপ্রেমী মেহনতি জনতা যারা আবহমান লড়াই করে চলেছে অস্তিত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠার, তাদের জন্য অনুপ্রেরণা আর সাহসের একটা গান।
আব্দুল লতিফের জন্ম ও জীবনসংক্ষেপ
এই ক্ষণজন্মা গীতিকার, সুরকার ও কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল লতিফ ১৯২৫ সালে বরিশালের রায়পাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। এ-আকর্ষণ তাঁর গ্রামে তাঁকে গায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। গান গাওয়ার অপরাধে তাঁর ফুফু তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফুফুর কাছে গানগুলি ছিল ইসলামবিরোধী। কিশোর আব্দুল লতিফ এ-ঘটনার আকস্মিকতায় বিচলিত না-হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফুফুকে একটি গান শোনাতে চান এবং তাঁর ফুফু সে-গান শুনতে সম্মত হন। আবদুল লতিফ আল্লাহ-রসুলের প্রশংসায় ভরা আববাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের একটি ইসলামি গান গেয়ে শোনান। গান শুনে ফুফু মুগ্ধ হন এবং তাঁকে গান গাওয়ার অনুমতি দেন। এভাবেই পারিবারিক স্বীকৃতি নিয়ে আবদুল লতিফের শিল্পীজীবনের শুরু।
আবদুল লতিফ যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন ১৯৩৯ সালে সিক্সটিন বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল ফোর্স-এ তিনি নির্বাচিত হন। ছয়মাস পর এ ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়। পরে তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সরাসরি রাজনীতিতে যোগ না-দিলেও তিনি রাজনীতি সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন। চল্লিশের দশকের প্রথমদিকে তিনি কলকাতায় কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে যোগ দেন। সংস্থার অফিস ছিল কলকাতার গোপাল মল্লিক লেনে।
রাজনীতিসচেতন নতুন শিল্পীদের এখানে গান শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। গান শেখাতেন সুকৃতি সেন। আবদুল লতিফও তাঁর কাছে গান শেখেন। তাদের গানের দলে এবং ক্লাসে তিনি ছিলেন একমাত্র মুসলমান শিল্পী। এ সময় নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা সংঘটিত হলে মহাত্মা গান্ধী শান্তিমিশনে নোয়াখালি আসেন। আবদুল লতিফ কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে বরিশাল থেকে স্টিমারে নোয়াখালি চলে যান। কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজে এক সভায় তিনি নোয়াখালি বিষয়ক জনসভায় গান্ধীর সামনে সমবেতভাবে শান্তির গান পরিবেশন করেন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী মমতাজ আলী খানের সখ্য গড়ে ওঠে।
আব্দুল লতিফ কলকাতা থেকে ১৯৪৮ সালে ঢাকা আসেন। এখানে বিখ্যাত গায়ক ও সংগীতপরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৭-পরবর্তীকালে দেশের হিন্দু শিল্পী-গীতিকারদের দেশত্যাগের ফলে পূর্ববাংলায় বড় রকমের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ-সঙ্কট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তিনি আব্দুল লতিফকে গান লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি প্রথমে আধুনিক গান ও পরে লেখেন পল্লিগীতি।
আব্দুল লতিফের মেজাজে গণসংগীতের উপাদান ছিল, সেটা তাঁর প্রথম জীবনের কলকাতাপর্বেই পরিলক্ষিত হয়। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে কোরাসে তাঁরা যেসব গান গাইতেন, তা ছিল গণসংগীত। এটা ছিল তাঁর রন্ধ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। বরিশালের গ্রামীণ জীবনধারার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর মানসজগৎ ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। কীর্তন, পাঁচালি, কথকতা, বেহুলার ভাসান, রয়ানি গান, কবিগান, গুনাই যাত্রা, জারি-সারি, পালকির গান প্রভৃতি সংগীতের সুর তিনি নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন। এটাই পরবর্তীকালে সংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁকে বিশিষ্টতা এনে দেয়।
তাঁর গানগুলিতে পূর্ববাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এ-গানটিতে তিনি বাংলাদেশের লোকসংগীতের আবহ ও সুরটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গানটি পূর্ববাংলার ঐতিহ্য স্মরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রতীকী গানের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।
আব্দুল লতিফ সংগীতের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। বাল্যকাল থেকে গ্রামবাংলার জীবনযাপনপদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, সংগীতকলার সঙ্গে পরিচিত হলে তাঁর নিজের মধ্যে একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করে। উদার ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত আবদুল লতিফের সংগীতে পরিস্ফুট হয় অসাম্প্রদায়িক লৌকিক গণচেতনা।
রেডিওর সঙ্গে তিনি যুক্ত হন ১৯৪৮ সালে পল্লিগীতি ও আধুনিক গান পরিবেশনের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে তাঁর প্রবেশ ঘটে। প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে জহির রায়হানের ‘আনোয়ারা’ ছবিতে গান করেন।
১৯৬৯ সালে সংগীত পরিচালনা করেন জহির রায়হানের ‘শেষ প্রশ্ন’ ছবির। এর আগে ১৯৫৬ সালে তিনি সংগীত-শিক্ষকতায় যোগ দেন বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমিতে। দেশের বিখ্যাত বহু শিল্পীর তিনি ছিলেন ওস্তাদ। ১৯৫২ সালে ভাষার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে সমস্ত সংগীতআসরে অপরিহার্য ব্যক্তি ছিলেন আব্দুল লতিফ। বিশ্বাস ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনড় ও নিরাপোস। রাজনৈতিক দল-মত-পথ নির্বিশেষে সব মানুষের তিনি ছিলেন প্রিয়জন। আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহু অভিধায় চিহ্নিত, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আব্দুল লতিফের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর লিখিত গান সব এখনও সংগ্রহ করা যায়নি। তবে তাঁর তিনটি গানের বই প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৮৫ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি প্রকাশ করে তাঁর ‘ভাষার গান, দেশের গান’। এতে আছে বাংলাভাষা সম্পর্কিত চবিবশটি গান, দেশের গান একান্নটি, পঁচানব্বইটি গণসংগীত, দুটি জারি এবং আটটি মানবাধিকার সম্পর্কিত গান। তাঁর অন্য আরেকটি বইয়ের নাম ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, এটি তাঁর মরমী গানগুলোর সমবায়ে একটি সংকলন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
জীবদ্দশায় তিনি শতাধিক সম্মাননা ও পদক পেয়েছেন। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। ১৯৭৯ সালে একুশে পদক, ২০০২ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন তিনি। এছাড়া পেয়েছেন কুমিল্লা থিয়েটার পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি পদক, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, জাতীয় জাদুঘর পদক, নজরুল অ্যাকাডেমি সম্মাননা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পদক, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা পদক, বাংলা অ্যাকাডেমি পদক, শেরেবাংলা পদক, ভাষাসৈনিক সম্মাননা ইত্যাদি।
জীবনাবসান
গণমানুষের মহান এই শিল্পী ২০০৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভাষার মাসেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে যাত্রা করেন। কিন্তু তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন তাঁর ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ দিয়ে। তাঁর কালজয়ী রচনা প্রকৃত বাঙালির স্মৃতিতে থাকবে যুগ যুগ। দুঃশাসন আর মুক্তির লড়াইয়ে তাঁর অমিত সৃষ্টিসম্ভার বাংলার আপামর মানুষকে প্রেরণা জোগাবে, শক্তি দেবে, সাহস দেবে। এজন্য বাঙালির হৃদয়স্পর্শী গণসংগীতশিল্পী আব্দুল লতিফের মৃত্যু নেই। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই তিনি যুগের পর যুগ প্রকৃত বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
রচিত ও সুরারোপিত দুইটা গানের পূর্ণাঙ্গ
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁর রচিত দুটি গান পূর্ণভাবে তুলে দিতেছি নিচে :
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।।
কইত যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়?
কও দেহি ভাই
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়?
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।।
সইমু না আর সইমু না, অন্য কথা কইমু না
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,
আহা যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,
এই জানের বদল রাখুম রে ভাই বাপদাদার জবানের মান
ও হো … হো … হো … বাপদাদার জবানের মান।।
যে শুইনাছে আমার দেশের গাঁওগেরামের গান
নানান রঙে নানান রসে ভইরাছে তার প্রাণ।
ঢপ-কীর্তন, ভাসান-জারি, গাজীর গীত আর কবি-সারি
আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা নাইচা নাইচা কেমন গায়!
আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা নাইচা নাইচা কেমন গায়!
ওরা কাদের মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়।।
তারই তালে তালে হৈ ঢোল-করতাল বাজে ঐ
বাঁশি-কাশি-খঞ্জনি-সানাই, (আহা) বাঁশি-কাশি-খঞ্জনি-সানাই
এখন কও দেখি ভাই এমন শোভা কোথায় গেলে দেখতে পাই
ও হো … হো … হো … কোথায় গেলে দেখতে পাই।।
পুবাল বায়ে বাদাম দিয়া লাগলে ভাটির টান
গায় রে আমার দেশের মাঝি ভাটিয়ালি গান, (ভাই রে) ভাটিয়ালি গান
তার ভাটিয়াল গানের সুরে মনের দুঃখু যায় রে দূরে
বাজায় বাঁশি সেই-না সুরে রাখাল বনের ছায় … রাখাল বনের ছায়
ওরা যদি না-দেয় মান আমার দেশের যতই যাক
তার সাথে মোর নাড়ির যোগাযোগ, আছে তার সাথে মোর নাড়ির যোগাযোগ
এই আপদ-বিপদ দুঃখে কষ্টে এ গান আমার ভোলায় শোক
ও হো … হো … হো … এ গান আমার ভোলায় শোক
এই ঠুং-ঠুঙা-ঠুং দোতারা আর সারিন্দা বাজাইয়া
গাঁয়ের যোগী ভিক্ষা মাগে প্রেমের সারি গাইয়া গো প্রেমের সারি গাইয়া।।
একতারা বাজাইয়া বাউল ঘুচায় মনের সকল আউল।।
তারা মার্ফতি মুর্শিদি তত্ত্বে পথের দিশা দিয়া যায়
মার্ফতি মুর্শিদি তত্ত্বে পথের দিশা দিয়া যায়
ওরা তাদের মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়।।
ওরে আমার বাংলা রে, ওরে সোনার ভাণ্ডারে
আরো কত আছে যে রতন … আহা আরো কত আছে যে রতন
মূল্য তাহার হয় না দিলেও মণিমুক্তা আর কাঞ্চন
ও হো … হো … হো … মণিমুক্তা আর কাঞ্চন
আরেক কথা মনে হইলে আঁখি ঝইরা যায়
ঘুমপাড়াইনা গাইত যে গান মোর দুঃখিনী মায়।
ও মায় সোনা-মানিক-যাদু বলে চুমা দিয়া লইত কোলে
সোনা-মানিক-যাদু বলে চুমা দিয়া লইত কোলে
আরো আদর কইরা কইত মোরে আয় চান আমার বুকে আয়
আদর কইরা … আরো আদর কইরা কইত মোরে আয় চান আমার বুকে আয়
ওরা মায়ের মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়।।
কও আমার মায়ের মতো গান, আমার মায়ের মতো প্রাণ
বাংলা বিনে কারো দেশে নাই, বাংলা বিনে কারো দেশে নাই
এই মায়ের মুখের মধুর বুলি কেমন কইরা ভুলুম ভাই
ও হো … হো … হো … কেমন কইরা ভুলুম ভাই
এই ভাষারই লাইগা যারা মায়ের দেয় ভুলান
দেশের মাটি বুকের খুনে কইরা গেছে লাল।।
মনে কইরা তরার কথা কান্দে বনের তরুলতা।।
তাই তো ঘরে ঘরে কত মা তায় চোখের জলে বুক ভাসায়
ওরা মায়ের মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়।।
কইরো না আর দুঃখশোক শোনো রে গাওগেরামের লোক
শোনো শোনো গঞ্জের সোনা ভাই,
তোমরা শোনো শোনো গঞ্জের সোনা ভাই
একবার বুক ফুলাইয়্যা কও দেখি ভাই
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই … রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই …
[কথা ও সুর : আব্দুল লতিফ]
২.
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।
আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি
জানা আছে জগৎময়
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা।।
সতেরোশো সাতান্ন সনে,
ভাইবা দেখেন পড়বে মনে
দাম দিছি পলাশীর মাঠে
ইতিহাস তার সাক্ষী রয়
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।।
দাম দিয়াছি একাত্তরে পঁচিশে মার্চ রাতে রে
সর্বহারা করছে মোরে পশ্চিমা ডাকাতে রে
বাপের সামনে বলুক তো ঝুট!
মেয়ের ইজ্জত হয়নি কি লুট?!
আজো বাংলার আকাশ-বাতাস
তারই শোকে উদাস হয়।
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।।
দাম দিয়াছি মায়ের অশ্রু বোনের সম্ভ্রম রে
বলতে কি কেউ পারো তোমরা
সে-দাম কারও কম রে?
কত কুলের কুলাঙ্গনা নাম নিয়াছে বীরাঙ্গনা
দুঃখে বাংলার পদ্মা-মেঘনা-যমুনা যে উজান বয়।
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।।
দাম দিয়াছে বুদ্ধিজীবী নামীদামী লোক কত
এই জনমে কি ফুরাবে ভাই আমার বুকের সেই ক্ষত!
ঊনিশশো একাত্তর সালে ষোলোই ডিসেম্বর সকালে
অবশেষে দুঃখিনী এই বাংলা মা যে আমার হয়।
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।
আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি
জানা আছে জগৎময়
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা।।
(সংক্ষেপিত)
[কথা ও সুর : আব্দুল লতিফ]
উপসংহার
বাংলাদেশের সংগীত তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কালজয়ী প্রতিভা ছিলেন আব্দুল লতিফ। বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত তাঁর সমস্ত সংগীত, তাঁর গান, তার গায়কী। তিনি যখন গান গাইতেন, দর্শক-শ্রোতারা সে-গানের মধ্যে খুঁজে পেতেন নিজেদের প্রতিবাদের ভাষা। আব্দুল লতিফ একটি কালোত্তীর্ণ চিরায়ত সত্তা। আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই কালজয়ী শিল্পীকে। তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে ইতিহাসে থাকবে।
… …
- ভোটের গান রচনায় শাহ আবদুল করিম || আজিমুল রাজা চৌধুরী - December 29, 2018
- লোকগানে সিলেটের নারী কিংবদন্তিরা || আজিমুল রাজা চৌধুরী - December 12, 2018
- অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় বাউল আবদুর রহমান : প্রসঙ্গ শাহ আবদুল করিম || আজিমুল রাজা চৌধুরী - October 16, 2018
COMMENTS