ভণিতা, রাজ্যিনীতিকথার

ভণিতা, রাজ্যিনীতিকথার

রাজ্যির নীতিকথার বাইরেও দুনিয়া বিরাজে। এবং শুধু বিরাজে বললে কমিয়েই বলা হয়, ঢের বড় ও অগাধভাবেই বিরাজে; যেমন দুর্নীতিচিত্তিরের বাইরেও ভুবনে ঢের বিচিত্র ছবিছায়া আছে দেখবার, দেখাবার, দলাদলি-দলনমলনের বাইরেও দুনিয়া আছে, — এহেন প্রতীতি যেন খুয়ায়া না ফেলি। ঠিক একইভাবে যেন মনে রাখি যে, এই-যে নীতি এই-যে দুর্নীতি এই-যে বাদ এই-যে প্রতিবাদ এই-যে ইশ্যুভিত্তিক জিন্দাবাদ আর ইশ্যুভিত্তিক নিন্দাবাদের নর্তনকুর্দন, এগুলোর ভেতরে শুয়েবসে থেকে, এগুলোর সঙ্গে থেকে, এগুলোর লগে প্রেমে-ঘেন্নায় পরিপ্লুত মত্ত অবস্থায় থেকে এগুলোর বিচার নির্ণয়, এগুলোর কামরা-অভ্যন্তরে নিজেরে অন্তরীণ রেখে এগুলোর মুকাবিলা করা, এগুলো সম্যক দেখা ও দেখানো সত্যি হাতির দুধের মতো। অথবা চামচিকের চশমা যথা। রাজার হয়েই শিঙেয় ফোঁক দিবার তরে দেওয়ানা একদল, আরেকদল রাজ্যির বারোটা বাজানোর হঠকারী মণ্ডূক।

তৎপরতার লগে কীর্তিকলাপের লগে লিপ্ত থেকে ‘দেখা’ এবং অবধারিতভাবে দেখানোর গলতটুকু অজানা নয় এখন আর। যুগটা আজকে এমন যে সক্কলেই তৎপর, সক্কলেই লিপ্ত, সক্কলেই কীর্তিমত্ত, সুহরাব-রুস্তম সক্কলেই। মিনিটে মিনিটে ফাইট দিতে দিতে একটা-গোটা জাতি ফিট হয়ে আছে — (মূর্ছা বা ফেইন্ট অর্থে বাংলায় এই ফিট-হওয়া বোঝানো হয়) — কেউ বুঝতে পারছে না; বা, পারলেও স্বীকার করছে না। তা, ফাইটিং নিশ্চয় অ্যাপ্রিশিয়্যাবল্; হিংটিংছট তো বাংলামঞ্চে ব্যাপক শ্রদ্ধার কাণ্ড। কথা হচ্ছে, একটা গান মনে-পড়ার কারণে একটু থমকাতে হয় সামটাইম্স। মৌসুমী ভৌমিকের সেই গানটা, “আমি একবার, শুধু একবার আমি বাইরে দাঁড়াব / একবার, শুধু একবার” … কোন ঘন গভীরের ভিতরে আছেন শিল্পী যে এমনটা আকুতি বাইরে বেরোনোর? উত্তরও তো জানা, গানেই আছে সহজিয়া সুরে। এবং, জাস্ট লিস্যন্ টু ইট, ইজ্ নট দ্য অ্যান্সার ব্লোয়িং ইন্ দ্য উইন্ড, মাই ফ্রেন্ড? এই-যে এই জীবনের ‘ভালোথাকা-বাসা-ভালোলাগা’ ব্লা ব্লা, এইগুলো থেকে বেরিয়ে একবার এইগুলোকে দেখতে চান মৌসুমী ভৌমিক সত্যিকারের দর্শকদৃষ্টিতে, ‘আমি ভালোবাসাবাসি খেলাতে ক্লান্ত’ কথাটা আগেই শিল্পী নিয়েছেন কয়ে একই গানে, এবং এই ভালোবাসা নামক জন্তুটার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে একবার এই মোহন জন্তুটাকে দেখতে চান ভৌমিক। যদি দেখে ফেলেন আপনেও, ইচ্ছেটা যদি হৃদয়ে-দেহে ধরিয়া রাখেন দেখবার, তো বুঝবেন ভিতরে থেকে দেখাদেখির দাবি আসলে বেফায়দা। বাইরে বেরিয়েই গোটা বাস্তব/বস্তুটার অবয়ব ও অন্তর সম্পর্কে মন্তব্য করা যায় যে “দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচাসোনা” ইত্যাদি।

ডিড য়্যু গেট মি? কিন্তু ঘটনাঘটনের অভ্যন্তরে গ্যাঁট হয়ে থেবড়ে বসে থেকে চেতনার আতশবাজি ফোটানো আর বিপ্লবের বড়াই প্রকাশিয়া ফুটানি মারার দিন দেখছি শিশুস্বাধীন বাংলাদেশ থেকে এখনও বিদায় নেয় নাই। নিবেও না সহসা। বাংলাদেশে বেয়াকুফদের বসন্ত অনেক দীর্ঘ হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নাই সংগত কারণেই। বিতিকিচ্ছিরির ভিতরে থেকে, বিতিকিচ্ছিরির সঙ্গে লেপ্টে থেকে এবং বিতিকিচ্ছিরির বেনিফিশিয়্যারি হয়ে, বিতিকিচ্ছিরি সম্পর্কে ডিক্রি প্রোভাইড করে চলেছি আমরা বাপ-ভাই চোদ্দগোষ্ঠী মিলে। এর একটা ভালো ফল নিশ্চয় মিলবে ভেবে বসিয়া আছি হা হয়ে। লেবেঞ্চুশের ভিতরে সেঁধিয়ে গেলে লেবেঞ্চুশ চোষা যেমন হয় না, ব্যাপারটা তেমনি। কিন্তু তৎপরতা আর লিপ্ততার নামে আমরা মান্দাতা আমলের অ্যাকশন-রিফ্লেকশনের প্র্যাক্সিস্ চালায়ে চলেছি কী সোৎসাহ স্ফূর্তিতে! দ্যাখো, গণ্ডার চিমটি ঠাহর করে ঠিক কয়দিন পরে যেয়ে, হ্যাভ ফর্গটন্, স্যরি ব্রো, স্যরি সিস্!

যে-জন দিবসে মনের হরষে দশটা কার্যক্রমের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা সগৌরব ডিক্লেয়ার করে, সে যে কোন জঙ্গলের জন্তু আর কোন গোয়ালের গণ্ডার, ‘তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা’ যিনি লিখেছিলেন — সেই ট্যাগোর — তিনি নিশ্চয় জানেন। সমস্তকিছুর সঙ্গে যে লিপ্ত থাকে, সে যে কিচ্ছুটির সঙ্গেই লিপ্ত না তা-ই প্রমাণ করে। বেবাক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে যে — যেমন, হয়তো, পোলিটিশিয়্যানরা — সে আসলে কোত্থাও অংশ নেয় না। ব্যাপারটা বিনয়ের সেই ‘দৃশ্যত সুনীল, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে’ … যেন ওই-রকমই অনেকটা। ঠাকুর থাকলে আজি — তিনি তো বিশ্বের শায়ের — এই বিতিকিচ্ছিরিতায় পথ দেখাইতে পারতেন হয়তো-বা। আমি তো পথ দেখাবার মতো এলেম রাখি না। আর পটে-আঁকা ম্যাপে আঙুল/পয়েন্টার ঠেকিয়ে ন্যাভিগেইট করার চেয়ে একসঙ্গে সড়কে হেঁটে হেঁটে পেরোনোটাই আমার কাছে লার্নিং বেইসড এনভায়রনমেন্টের নিদর্শন। অতএব হাঁটা যাক? তথাস্তু।

তদুপরি যিনি কবি, আইদার গ্যুড অর ব্যাড ব্যাপার না, তিনি নিশ্চয় জিনিশগুলো কোনো-না-কোনো ফর্মে বোঝেন বলেই আমার ধারণা। আমি মনে করি, কবির ক্ষেত্রে হিসাবটা আলাদা। তাদের তথ্যোপাত্তনির্ভর অ্যানালিসিসের চেয়ে ‘ভাইব্রেশন’ নজরে রাখতে হয়, কেননা কাব্য অলোয়েজ্ ভাইব্রেটেড করে যায় বিফোর ইট ইজ্ অ্যান্ডার্স্টুড, জীবনানন্দ সুন্দর করে বলেছিলেন ‘অনুভূতিদেশ থেকে আসা আলো’ এবং ‘হৃদয়ের নির্দেশ’ ইত্যাদি নির্ভর করতে হয় একজন ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’-সম্পন্ন কবিকে। ম্যাথমেটিক্স দিয়া ব্যাখ্যাবিশ্লেষের কেরানিপণ্ডিত দুনিয়ায় নিত্য পয়দা হচ্ছে দেশে দেশে। সেইখানে যেন কবি ভিড় না করেন বৃথা। আর করলেও প্রোফিট কম নয়; দেশে বেমুরদ বেল্লিকদের ডিমান্ড তো সবখানে এবং সর্বকালে যেয়াদা।

আচ্ছা। তারপর, মনে হয় আমার, সাম্প্রতিক বাহাসগুলোতে পার্টিসিপেইট করা তার পক্ষেই কিছু সুগম ও সহজতর হয় যে প্রলয় সম্পর্কে রইতে পারে আন্ধা। ঠাকুরের কবিতার রেফ্রেন্স হিশেবে এইখানে এসেছে ‘প্রলয়’ শব্দটা, জানি, বাহুল্যই হলো বলা। মানে স্রেফ বাহাসের নেশায় বাহাস, তর্কের জন্য তর্ক করা, যাকে বিতং করে বলি আমরা কেউ কেউ ‘তর্ক জারি রাখা’। আমি নিজের জন্যে, নিজমনে, সেসব তর্কাতর্কে অংশগ্রহণের কতিপয় পন্থা মাঝেমধ্যে ভাবি। ঠিক সফল হব না জেনেও পন্থাগুলো প্রায়শ প্রয়োগও করি। কিন্তু তারপরেও চারপাশে, ফেসবুক ইত্যাদিতে এবং কথিত মূলধারা মাধ্যমগুলোতে, যেসব রাজনৈতিক ধারাভাষ্য দেখি নিয়মিত, এইসবের ভিতরে প্রচুর আলগা স্মার্ট জিনিশের চটকদার উপস্থিতি সত্ত্বেও কতিপয় জিনিশ মিসিং দেখতে পাই। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছি এবং মনে হচ্ছে এইটা আর-কেউ লক্ষ করছে না। আদতে হয়তো লক্ষ করছে বেবাকেই এবং শুধু লক্ষ করেই বসে নেই, নিশ্চয় অ্যাড্রেসও করছে সবাই যথাযথ জোরেশোরে, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সেভাবে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না। ব্যাপারটা অতিকায় হচ্ছে দিন-কে-দিন। কোন ব্যাপারটা ইঙ্গিত করতে চাইছি, বিস্তারিত এই মুহূর্তে না-বলতে পারলেও, একটু খুলে দেখাইতে চেষ্টা করি।

সিন্স লাস্ট টেন ইয়ার্স, আমি ঠিকঠাক হিসাব কষে এক্স্যাক্ট পিরিয়ড অফ টাইমটাও বলে দিতে পারব, আমাদের সমস্ত পর্যালোচনাভাষ্য জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে। একজন ভাষ্যনির্মাতা আজকে এমনকি ঈদের দিনেও ময়দানে মানুষের সঙ্গে কোলাকুলি করেন না, আমাদের সেই সুযোগটাই মিসিং হয়ে গেছে, তেনারা মাছবাজারে বা আনাজবেপারির দুয়ারে যান না, আমরা কেউই যাই না, অ্যাগোরা বা নন্দন বা স্বপ্ন মেগামুদিদোকান থেকে মাংশ খরিদ করে ফ্ল্যাটে ফিরে ল্যাপে লেখেন দৈনন্দিন পোলিটিক্যাল্-সোশিয়োইকোনোমিক্যাল্ কমেন্ট্রি। জিনিশটা ন্যাচারালিই হয় ফ্র্যাগমেন্টেড, কম্পার্টমেন্টালাইজড, বায়াসড। আমি আমাকেই খালি দেখি। নিজের মুক্তি খুঁজি। কিন্তু নিজে মুক্ত হওয়ার একটাই পথ আমি জানি, সেইটা হচ্ছে অন্যকে মুক্ত করা; ‘আমি’ বলতে এখন সবাই আমরা মেগাশপের কাচঘেরা চারিদিকে যে-একটা ‘উল্টা বিম্ব’ ফোটে আমার, — শুধু সেইটেকেই বুঝি; কিন্তু খোলা জায়গায় পাঁচমেশালি বিত্তের ও চিত্তের মানুষের ভিড়ে বাজারসদাই করলে সেখানে নকল কাচে প্রতিফলিত ‘সঙ্কীর্ণ আমি’-র খোমা না দেখে একটু বড়সড় একটা ‘আমি’ দেখতে পেতাম। তখন আমার অ্যানালিসিসটাও হতো ছত্রিশ ইঞ্চি সিনাসম্পন্ন। অনেক তফাতে এসে গেছি আমরা সেই জায়গাটা থেকে। এখন আর ফেরা যাবে কি না আমি সন্দেহসঙ্কুল। তবে যারা জাতির পাল্স ধরতে চাইবে, ভাষ্যপ্রণেতা হতে চাইবে যারা, তাদেরকে সেই ফেরার প্রক্রিয়াটার যথাসাধ্য সংলগ্ন রইতে হবে। এছাড়া উপায় নাই। কিংবা আছে হয়তো, উপায়, আমি ঠিকঠাক তথ্যাবগত নই এতদব্যাপারে।

একটা উদাহরণ দিচ্ছি। রিসেন্ট যে-ঘটনাটা, ঢাকা অ্যাটাক, সিনেমা নয়, আর্টিস্যানের সেই নৃশংস ঘটনা, আমি এইটা নিয়া লিখতে দেখছি সবাইকে। এমনকি আমি নিজেও ফোড়ন কাটার মতো টুকটাক লিখছি। কিন্তু ‘হোলি আর্টিস্যান্ বেকারি’ নামটা আমি জীবনে প্রথম শুনেছি। এবং আমার জানামতে একজনও পাই নাই এখনও যারা দৈনিক পত্রিকায় লিখছেন কলাম-উপসম্পাদকীয় প্রভৃতি কিন্তু গুলশানের ওই-রকম জায়গাগুলোতে গিয়েছেন কোনোদিন কিংবা ধারণা রাখেন ন্যূনতম গুলশানবাসী সম্পর্কে। এই স্ফীতকায় শ্রেণিটা আমি চিনি না অথচ রচনাশৈলীতে এমন একটা ভাব ধরিয়া রাখি যেন ওরা যা ও যেমন আমিও অবিকল তা ও তেমন। অন্যদিকে এর উল্টোদিকের যে জায়গাটা, স্লামডগদের কথা ভাবা যাক, কালেভদ্রে এদেরে নিয়াও আমি যে ‘মহৎ’ লেখাপত্র লিখি তাতে এমন ঘটনা ঘটাই মনে হয় যেন ওদের সমস্ত দুঃখদৈন্যের অসুখ ও সুচিকিৎসা আমি জানি এবং এদের আশু ‘উন্নয়ন’ আবশ্যক! হাতের তালুর চেয়েও ছোট্ট একটা ল্যান্ডে এহেন দুরতিক্রম্য অজানা-আচিনা!

তাহলে আমি আসলে কোথায়? ফেসবুকের আমার অসংখ্য কবিসাহিত্যিক অ্যানালিস্ট বন্ধুবান্ধব এবং তাদের স্মার্ট বুলির লেখাপত্র আসলে ওই দুই জায়গার কোথাও প্রবেশিতে পারে না। আমাদের কাছে এখনও ‘সোনারগাঁ’-‘শেরাটন’ এবং কালক্রমে ‘রেডিসন’ প্রভৃতি দৃষ্টিগ্রাহ্য অট্টালিকাগুলো প্যশ্ রেস্ট্যুরেন্ট হিশেবে গণ্য, যেসব জায়গায় জীবনে এক-দুইবার হয়তো-বা যাবার সুযোগ পাবো অথবা পাইসি সামহাউ অলরেডি; কিন্তু রচনায় দিনরাত ওইসব জায়গার নাড়িনক্ষত্র জানি বলিয়া ভান করছি এবং অচেনাকে চিরচেনা দাবি করছি। ইত্যবসরে ‘লেইক্ শোর’ বা ‘হোলি আর্টিস্যান্’ প্রভৃতি অধিকতর প্যশ্ প্লেইসের উৎপত্তি। ঠিক উল্টোদিকের মানুষগুলো, হোক তারা গ্রামের বা মাদ্রাসার বা সাধারণ ছাপড়া চাদোকানি, ওদের ক্রোধঘৃণা-রঙতামাশাগুলোও আমরা/আমি চিনি না। আমি খালি রগড় করে যাওয়াটাকেই তাই পাথেয় করে ভাবছি লিখনের বৈতরণী/পুলসেরাত পাড়ি দিতে পারব। ভুল ভাবছি। কিংবা আরামে আছি। কমফোর্ট জোনে থাকছি। নিউইয়র্ক টাইমসের আর্টিক্যল্ পড়ে শেয়ার দিচ্ছি এবং আমার বন্ধুরাও ব্যতিক্রমবিরলভাবে এক্স্যাক্ট তা-ই করছে। লেখকদের এই হাল এই আমল আমি দেখছি বাংলাদেশে। এর কোনো উত্তরণ আপাতত আমি দেখছি না। আমি নিজে তো উত্তরিত হচ্ছি না সহসা তা জানি অন্তত। বহুদিন খালি নিজের মনগড়া ‘দেখা’ থিয়োরাইজ্ করে যাব ইংরেজি তিনঅক্ষর-পড়া বিদ্যা জাহিরিয়া।

এই জায়গাটা যারা ধরবে, তারাই হবে রাজনৈতিকতাদীপ্ত জনভাষ্যকার অফ দি ফিউচার অথবা আজকের বর্তমানতার পোলিটিক্যাল্ অ্যানালিস্ট। অতএব যতটা পারা যায় আমি আমার জায়গাটাকে জেনে নিয়ে যেন উতোর-চাপানে যাই এবং নিত্য সংযোগ রেখে যেন লিখি নিজের জায়গাটার সঙ্গে, নিজেরে রিডিফাইন্ করতে যেন উদ্যমী থাকি সদা। যার সংযোগ গুলশানের সঙ্গে, সে তা-ই নিয়ে লিখবে। যার সংযোগ গজারিয়া হাটের বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে, সে লিখবে তাদেরে উপজীব্য করে। এই দুইখানেই কিন্তু পোলিটিক্স অভিন্ন। গরিবের জন্য এক পোলিটিক্স আর ধনিকের জন্য অন্য, মোটেও নয়। একই পোলিটিক্সের ফল দুইজনের কাছে দুই ভিন্ন দুয়ারী। কিন্তু ফোকাস্ করতে হয় একটা অডিয়েন্সকে। তখন গোড়ার কথাগুলো ধরা যায় যেইটাকে আমরা জিয়ন-মরণ পোলিটিক্স বা যা-ই-হোক বলি। দুইদিকে থাকলে, — দুই নৌকায়, — নদীর স্রোতদোলা বা মাতন উপভোগ করা যায় কিংবা ভাটিয়ালি যায় গাওয়া, গাঙের সিচ্যুয়েশন্ ঠাহর করা যায় না।

কিন্তু বইপড়া ধারাভাষ্য রচনা আখেরে আমাদের মরদেহ সৎকারে লাগবে না আমি নিশ্চিত।

পরে ফের এই প্রসঙ্গ লইয়া আলাপ সঞ্চালিতে পারি আমরা। রাইট নাউ, রাইট ইন হিয়ার, আমি কিছু স্বকপোলকল্পিত খেদের জায়গা নিয়া আলাপ করতে পারি যেখান থেকে ব্রেক-থ্রু হয়তো-বা আমি — নিজের জন্য হলেও — পাবো।

তবে একটা ব্যাপার ছোট্ট করে বলে রাখি আপাতত। সরাসরি নিত্যকার রাজনীতিদ্বন্দ্ব নিয়া লিখলে, যেমন ধরা যাক আমাদের আওয়ামীলীগ-বিএনপি ইত্যাদি রেস্লিং, সেভাবে কখনোই জিনিশটা ক্যাপ্চার করা যাবে না। ক্যাপ্চার করতে হলে ছোট্ট খাতার পাতায় কাঁটাকম্পাস বসিয়ে থিয়োরেমটা আঁকতে হয়। যেমন পানি কি, এইটা ব্যাখ্যা করতে গেলে কেবল হাইড্রোজেন-অক্সিজেন যৌগ বললে একটুও বলা হয় না, পানি বুঝাইতে গেলে পানি থেকে বেরোতে হয় সমগোত্রীয় অন্য যৌগের পানে, তেমনি সস্তার ভাজিপরোটার দোকানে সকালের সেঁকা রুটি-ডালডিম খেতে বসে বাংলাদেশের রাজনীতিগিট্টুটা আরও নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ সম্ভব। অথবা প্যাকেজ্ নাটক দেখতে বসে, অথবা পাব্লিক বাসে চেপে, অথবা ভারতীয় যৌথ প্রযোজনার বাংলাদেশী সিনেমায় নিজের সমুদয় দেখাদেখি নিগূঢ় হওয়া আদৌ অসম্ভব নয়। শেষের দেখাকাণ্ড, ম্যুভি ইত্যাদিতে চেপে, এখন বাংলায় সক্কলেই করতেসেন বিধায় এইটা ক্রমশ পরিত্যাজ্য বুদ্ধিমান লেখক কর্তৃক। মোদ্দা কথা, দুধ নিয়ে যে লিখবে ফিচার, সে মিল্কভিটা আর আড়ং প্ল্যান্ট ঘুরে এসে স্মার্ট একটা লেখা নামিয়ে ফেলবে এবং ফেলছে এবং ফেলে ফেলেই যাবে ঢের বহুদিন আরও। নতুন দিনের লেখক দুধ নিয়ে লিখতে যেয়ে গরুর কাছে যাবে, গোয়ালে তো যাবেই, রাখালের কাছে যাবে, যাবে গোয়ালিনীর কাছে, গোয়ালার কাছে, ঘাসের মাঠের কাছে, এবং অতঃপর অন্য-অন্য সংশ্লিষ্ট সর্বস্তরে যথাসম্ভব। উপায় নাই এছাড়া। আমি পারব না। মাঠের কাছে, ভুখানাঙ্গা নিরীহ নয়নের গাভিমুখগুলোর কাছে, যেতে পারার সদিচ্ছা আমার মতো শ্রমচোরার পক্ষে এ-জন্মে হচ্ছে না ধরেই নেয়া যায়। কিন্তু কেউ পারবেই শিগগির আমি জানি।

কাজেই, লিখি যতই মন্দ, লেখার কথা যখনই ভাবি তখন এই-রকমে একটা আইডিয়াল জায়গা থেকেই ভাবি, এবং আমি জানি বেহুদা জটিল করেই ভাবি। কিন্তু শর্টকাট কোনো পথ বোধহয় নাই জীবনের। যেইটা আছে, সেইটাই তো করে চলেছি সবাই দলে দলে। স্মার্ট স্যুইসাইড। রসাল ফলের ভিতরে থেকে দাবি করছি নিজেরে মহোত্তম রসবিশারদ হিশেবে। এখানে এই আমের ভিতরে কে রে? — জ্বে, জেনাব, আমি পোকা। — আচ্ছা, আচ্ছা, তাইলে তো হইলই। পোকারাই ইহধামে আম্ররসজ্ঞ। অথচ সত্যিকারের আম্র উপভোগ, সম্ভোগ ও সেবনের জন্য দরকার আমের বাইরে বেরিয়ে আমের দিকে নেত্রপাত। কই, কে শোনে কাহারে! বেহুদা, বেফায়দা, খামাখা!

আচ্ছা। আরেকটা ব্যাপার আমার মনে হয়, সেইটা আমি নিজে নিজে হামেশা ভাবি, এই-যে এত এত ‘পোলিটিক্যাল আড্ডা’ চারপাশে এবং আমি ও আমরা তাতে অংশগ্রহণ করতে ব্যগ্র সবসময়, এই ব্যাপারটা আজকাল আমাকে বেজায় ভাবায়। আজকাল বলতে ফেসবুককালের কথা বলছি।

ঠিক আগের কালের আড্ডাগুলোর আলাপ আমি তুলছি না। আজকের কালের আড্ডাগুলোকে আমি দুইটা ভাগে ফেলে দেখতে চেষ্টাশীল থাকি সবসময়। এক হচ্ছে, স্রেফ বিনোদনকল্পে আড্ডা এবং দুই হচ্ছে, হেল্দি একটা কাজের আড্ডা। আরও ব্রেইকডাউন্ সম্ভব আড্ডার, আমি মোটা দাগে বললাম বর্তমানের কথাপ্রাসঙ্গিকতায়।

বিনোদনকল্পে আড্ডাগুলো সংগঠিত হয় আপনার-আমার ইয়ারবখশির সঙ্গে তথা আমাদের সমশ্রেণির লোকের লঙ্গরখানায় লাইন ধরে বসে। ব্যাপারটা আমরা মাহাত্ম্য যুক্ত করতে যেয়ে বলি যে ‘সমমনাদের সঙ্গে আড্ডা’। আরও প্রচার করতে ব্যগ্র থাকি যে আড্ডা নাকি সমমনাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়াই বাঞ্ছনীয় ও উৎকৃষ্ট। ঘোড়ার আণ্ডা। আমার মনের সমান মন তথা একেবারেই ‘ইজ্ ইক্যুয়্যাল্ টু আমার মন’ দুনিয়ায় বিরাজে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না। আবিশ্বসংসারে একেক মন একেক ধরন। ‘সমমনা’ ব্যাপারটা রাজনৈতিক একটা স্ট্যান্ড তথা ধাপ্পা। যাকগে। সেকেন্ড আড্ডাটা, যাকে আমরা বলতে চেয়েছি কাজের আড্ডা, সেইটা আসলেই ইন্ট্রেস্টিং একটা ব্যাপার। এই আড্ডায় আমি নিজেকে একবার ‘ইউজড টু’ করিয়ে নিতে পারলে এখনকার যুগের আড্ডার মধ্যে এসেন্সটা পাওয়া যাবে এনশিয়েন্ট যুগের ‘আদর্শবিশেষায়িত’ আড্ডার। এই দ্বিতীয় আড্ডায় ‘অংশগ্রহণ’ করতে পারলে ‘আমার’ প্রসার হয়, সম্প্রসারণ হয়, এবং প্রসারিত করে নিতে পারি ‘নিজের’ জগৎটাকেও। বলছি, বিস্তারিত, দ্বিতীয় আড্ডাটা নিয়ে।

এখন, আমাকে ঠিকঠাক জানতে হবে, আমার কাজটা কি? ধরা যাক, আমি ডাক্তারিবিদ্যার বিনিময়ে জীবিকা চালাই। নিজের পেশাগত দোস্তপ্রতিম অথবা রাইভ্যালদের সঙ্গে আড্ডা পেটালে সেইটা কি আমার ঈপ্সিত ‘কাজের আড্ডা’ হবে? না। সমানবৃত্তির, সমশ্রেণির, সমভাবনার জনসমষ্টির মধ্যে আড্ডাই বিনোদনের আড্ডা। মানে, এই আড্ডায় যিনি পার্টিসিপেইট করছেন তিনি নিজের ইগো স্যাটিস্ফাই করতে ব্যতিব্যস্ত রইছেন আগাগোড়া জান্তে কি অজান্তে। স্যাটিস্ফাই করতে ব্যর্থ হলে ক্ষেপে কাঁই হচ্ছেন। কাজেই নিজে ডাক্তার হলে পেশার বাইরে অন্যান্য পেশাগোষ্ঠীর সঙ্গে আপনে আড্ডা দিলে পরে সেই আড্ডায় প্রাপ্ত রসদ আপনি চিকিৎসাকাজে ব্যয় করতে পারবেন। তদ্রুপ আপনার কাজ যদি হয় লেখা, আপনে লেখক হন যদি ইভেন্ মনে-মনেও, তাহলে আপনি আড্ডা দেবেন চায়ের দোকানি কি খির্সাপাতি আমের বেপারির সনে। এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ইগোক্ল্যাশ হবার আশঙ্কা নাই প্রায় বা থাকলেও অত্যন্ত নগণ্য। উভয় পক্ষই নিজেকে শেয়ার করতে স্পেস্ পাবেন এবং উয়িথ ডিগ্নিটি অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি। ফিরে এসে আপনি অর্জিত অভিজ্ঞতা আপনার কাজে তথা লেখায় ইনভেস্ট করতে পারবেন। এবং ভাইস্-ভার্সা। আপনার বৃত্ত বড় হবে। বেঁচে থাকার অন্য অর্থ এইটাই। সিগ্নিফিক্যান্ট মিনিং। বৃত্ত বড় করে চলা; শ্বাস যদ্দিন শেষ না-হয় তদ্দিন পরিধি বাড়িয়ে যাওয়া আপন বৃত্তের; — বৃত্ত অভিজ্ঞতার, মুক্তির, মায়ার। নেটওয়ার্কের বৃত্ত।

সমমনাদের মধ্যে, সমশ্রেণির মধ্যে, একই বৃত্তচৈতন্যের লোকসকলের মধ্যে আড্ডা ব্যাপারটা যে কেমন দানবিক আর সভ্যতানাশী হতে পারে, এর নজির আমরা দেখছি রোজ ভার্চ্যুয়াল্ আড্ডা-হানাহানিগুলোতে। এখানে অংশ নিয়া আমি নিজেকে দেখাতে চাই শুধু, শো-অফ/শো-আপ শুধু; অপরের দিকে — যে আমার পর নয় সেই অ-পরের দিকে — দৃষ্টি নিবদ্ধ করি না। নার্সিসিস্ট ‘আমার’ মুহুর্মুহু বোধন ঘটাই আমি সোশ্যাল্ স্পেসগুলোতে। এবং শুধু নিজের অহং তৃপ্ত করিয়া যাই। বিকট ইগোসেন্ট্রিক্ একটা জাতি হিশেবে আমাদের আয়ুক্ষয় হচ্ছে দ্রুত। দশক চলে গেছে ফেসবুক ইত্যাদি হানাহানির, পঞ্চাশোর্ধ্ব বাংলাদেশী লেখকদের একজনকেও আমি দেখি না যার একটা কাজ আছে যেইটা আমি হাতে নিতে পারি কিংবা আমার সমীহ আদায় করে নেয়। গত দশ বছরেই গিয়েছে এদের প্রাইম্ টাইম্, গেছে ঝগড়ায় ঝগড়ায়, গেছে নিজেদেরে যৌবনদীপ্র তরুণ গালাগালিশীর্ষ ‘ভাষাবিদ’ প্রমাণিতে। এরা আর পারবে না। সাধন হয় না সময় গেলে। একটা জেনারেশন গত হয়েছে যাদের পরিচয় করিয়ে দেবার মতো কোনো চিহ্ন নাই, আরেকটা প্রজন্ম প্রায় যেতে বসেছে যেই প্রজন্মে সম্ভবত আমি নিজেকেও কাউন্ট করব যাদের এখনও বড় কোনো ফলক অর্জিত হয় নাই এবং জোর আশঙ্কা হবেও না, — আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা এইটা, প্রামাণ্য কোনো প্যারাগ্র্যাফ ফাঁদতে পারব না, — আমি জানি না লাইনে-দাঁড়ানো পরের কয় প্রজন্ম একইভাবে ভেস্তে যেতে বসেছে।

যে-দুটো প্রজন্ম উল্লেখ করলাম, এরা আমাদের ইগোয়িস্টিক আড্ডার বলী। যদি নিজের বৃত্তের বাইরের সনে সংযোগ রইত, শস্য ফলত অল্পায়াসে এমনিতেই। বিড়ির দোকানির সনে লেখকের আড্ডা থেকে লেখক/কবিসাহিত্যিকেরা লাভবান হতেন, বিড়িবিক্রেতাও হতো। উভয়ের মধ্যে ব্যাটাগিরি দেখানোর কিছু নাই বলেই সম্পর্কটুকু উন্মুক্ত, অনাবিল, ও উদার তাদের মধ্যকার আদানপ্রদান। অন্যদিকে সমশ্রেণির আড্ডায় পিঠ ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ চুলকানিই সার, নতুবা কারবালার ন্যায় নিরম্বু জঙ্গে বেবাক ছারখার। মহাভারতের একটা উক্তি আমি সবসময় মনে রাখি, বলা হচ্ছে যে, সমানবৃত্তির লোকেদের মধ্যে কেবল ঈর্ষার সম্পর্কই বিরাজ করতে পারে। হ্যাঁ, আমাদের লেখকেরা সারাক্ষণ এই একটা সম্পর্কই নির্মাণ করেন এবং ভাঙেন ফের গড়েন। ঈর্ষা সংক্রামক। এর থেকে অসূয়া, বিদ্বেষ, বিদ্রুপ, ক্লিন্ন ঘেন্না আস্তে আস্তে স্প্রেড করে লেখকের গোটা লোকালয়ে। আমাদের পঁয়তাল্লিশ/পঞ্চান্ন বচ্ছরের রগড়ারগড়ির অসুখ আজ ক্রনিক হতে হতে ফেটে যেতে লেগেছে দেহকাণ্ড সমাজরাষ্ট্রের।

ঘটনা ঘটে একেকটা, আর তার অব্যবহিত পরক্ষণেই আমরা একেকজন ইউরেকা-মাস্তিতে বলে উঠি, দ্যাখো, বলেছিলাম না! আমি তো বলেইছিলাম হবে এমনটা, আমি তো অনেক আগেই জানতাম, আমি তো সংকটের আসল সুরত নিয়া আপনাদেরে সাবধান করেইছিলাম, কিন্তু আপনারা আমারে কানে নেন নাই। লাও হালুয়া, ঠ্যালা সামলাও দেখি এইবার! … ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অপস্ফূর্তির এহেন পণ্ডিতি, এহেন সবজান্তা ঘোষণা, আমাদের ক্রাইসিস্ আরও ঘনীভূত করে বৈ কমাইতে তো দেখি না।

ঢাকায় মিলিট্যান্ট অ্যাটাক অ্যান্ড অ্যাসাসিন্ ঘটনাটাই ভাবা যাক। মহোৎসব লাগায়ে দিলাম ব্যাপারটারে জেনারালাইজেশনের চূড়ান্ত করে এক্কেরে ফেলনা বানিয়ে তুলতে। কেউ বলে, এইটা বাংলাদেশের আপামর মুসলমানের মদতপুষ্ট হত্যানুষ্ঠান। কেউ বলে, এই হিংসা পারিবারিক পর্যায়ে ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষা দেয়া হয় শিশু মুসলমানদেরে। কেউ বলে, ইসলামের পেটে এই ব্যামো গোড়া হইতেই বিরাজিছে। কেউ বলে, এই হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডই ইসলামের অনুমোদন পেয়ে এসেছে একদম শুরু হইতে এ-যাবৎ। কেউ বলে, এইসব আদতে কুর্বানি ঈদের সময় গণহারে গরুখুনের একটা এক্সটেনশন্ মাত্র। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলেও ঘটনাপুঞ্জ হ্রস্ব ও লঘুকরণের হেন হোতাদের কথাক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করা সেন্সিবল্ যে-কারো পক্ষেই রীতিমতো শক্তিক্ষয় ছাড়া আর-কিছুই নয়। এরা সেই ক্রিয়াপটু বুদ্ধিবিপথগামী বীরের দঙ্গল, যারা এই কিছুদিন আগে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মুক্তিকামনার অভিলক্ষ্য কম্যুনিজমের কাউন্টারপার্ট হিশেবে কনভেনশন্যাল্ রিলিজিয়ন ব্যাপারটাকে খাড়া করিয়ে দিতে সফল হয়েছিল এবং কম্যুনিজমের চিরপশ্চাদপসরণ ঘটাতে পেরেছিল। দৈত্য বলুন অথবা দরবেশ, — কনভেনশন্যাল্ রিলিজিয়ন ব্যাপারটা আপনার বিবেচনায় এই দুইয়ের একটা তো অবশ্যই — ধর্ম ও ধর্মাবতারদিগেরে চ্যালেঞ্জ করার তরিকা আলগ এবং উহা চালানো সক্কলের কম্ম নয়। ব্যাপারটা যখনই হিস্টিরিয়ায় গিয়েছে, তখনই জিতেছে রিলিজিয়ন, হেরেছে মানুষ তথা মানবের অগ্রযাত্রা। আদ্দিকাল থেকে এই জিনিশটা আমাদের দেখা। কারে যেয়ে বুঝাইবেন আপনি, এবং, নিজেই কী বোঝেন বিষয়টা আগাগোড়া? আর দেখবেন যে, প্রথাবর্তী রিলিজিয়নের সঙ্গে ম্যাস্ পিওপলেরে মারদাঙ্গায় লাগিয়ে দিয়ে চার্চওয়ালারা, মসজিদওয়ালারা, মন্দিরওয়ালারা, প্যাগোডাওয়ালারা, রাজ্যপর্ষদওয়ালারা চিরদিনই নিজেদের কামিয়াবি হাসিল্ করেছে। এই ট্র্যাপে পা দিয়া আজিকার তরুণ পতঙ্গ থেকে প্রৌঢ় পঙ্গপাল যেইভাবে নিজেদেরে অপচয়িত করছে, খেলায় রেফ্রিরও দরকার পড়ছে না। সামাজিক সমর্থন ও প্রতিবাদভঙ্গি বিনিময়ের এই যুগে কে যে বিপ্লব করছে, কে প্রতিবিপ্লব, কে জঙ্গি কে শিবসেনা বজ্রংদল ইস্কন বোঝা দায়। বিনিথ অ্যান্ড বিয়ন্ড বাইনারি ওপোজিশন্স বর্তমান বাঁচামরার এই বিলাসিতায় নিজের সিদ্ধান্তে ফতুর হলেও সই, কিন্তু অন্য কোনো মহানুভবের আহ্বানে এমনকি বিলিয়নিয়্যর হতে যাওয়াও বোকামি। কিন্তু কথা আজকাল শুরু করে যেন শেষ করতে চাই না আমরা। আশ্চর্য! ‘মুক্তক্রীড়া’ বলবেন এইটেকে? পোস্টমডার্নের ফ্রি-প্লে? এইধারা ভানভঙ্গিভনিতা হইতে রহম্ করো মাবুদ!

রাজ্যির নীতিকথা নিয়া আমরা আলাপ শুরু করেছিলাম। শিরোনামে সেইটা — রাজ্যিনীতিকথা আওয়াজটা — আমরা খালি-চোখেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কথাবার্তা কামের-কাম একটাও তো করা যাইল না দেখছি। কি করে সেইটা — কাজের কথা কওয়াটা — আজকে সম্ভব বলেন? “মগজে কার্ফিয়্যু / নিষেধ বেরোনো / ভাবনা নিয়ে একা / রাস্তা পেরোনো” — কবীর সুমনের এই লিরিকোক্ত পরিস্থিতি কি বিরাজিছে হেথা? বালাই ষাট! এই পিতৃভূমি চিরগণতন্ত্রের। হেথায় আমাদিগেরেই মানায়। আমরা যারা মিমিক করি, গিমিক ও গিটকিরি দিয়া গানের গতর ভরিয়ে তুলি তিনকলি মিউজিকের মাথায়-পাছায়, আমাদেরেই মানায় নিরোবংশী পিতপিতিয়ে যাওয়া। তাছাড়া, আপনার ভিতরে ব্লাডপাম্পিং মেশিন কি দুইটা? আপনার পঞ্জরাস্থির নিচে ফুসফুস কি দুইজোড়া? আপনার গর্দানের আগায় নারকেলঠালুই কি দুইটা? আপনার গুহ্যদরোজা আছে কি বিকল্প টায়ারের মতো মজুদ পশ্চাদ্দেশলগ্ন দুইখানা? নাইলে কেম্নে বলেন সাহসিবেন প্রশাসন ও পলিসি নিয়া বার্তালাপে?

বেকার, সবকুচ বেকার, সাচমুচ ইয়ার! সিন্স লাস্ট টেন ইয়ার্স তোমার সমস্ত তৎপরতাই আসলে শ্যালকের আব্দার। ফুকো পড়েছ, হয়তো-বা, পাওয়ারস্ট্রাকচার বোঝো নাই। কিংবা জানো না পাওয়ারস্ট্রাকচারে কেম্নে করতে হয় হ্যামার। অথবা জানো সবই, বোঝো সবই, কিন্তু সেয়ানার স্বভাবে এড়িয়ে যাও সত্যিকারের সংঘর্ষ। যদ্দিন প্রফিট মার্জিন মোটা থাকে, চেয়ারটা পাওয়া যায় চাঙ্গে উঠে বসে চেঁচাইবার, তদ্দিন আব্দারেই চালানো। অক্যুপাই করার প্রশ্নে স্রেফ তোমার দুলাভাই পাওয়ারস্ট্রাকচার ছাড়া বাকি সবকিছুতেই তুমি বিলকুল আগুয়ান এবং ঘরোয়া আসরে চ্যাম্পিয়্যন। তুমি লিখছ কবিতা, বাহ্! আমাদের মুক্তি, দিরং নাই আর, আলোয় আলোয়, এই আঁধারে …

জাহেদ আহমদ ২০১৬

COMMENTS

error: