শিবলী মোকতাদির : পরিহাসপ্রিয় পরিব্রাজকের ঘরবাহির || আহমদ মিনহাজ

শিবলী মোকতাদির : পরিহাসপ্রিয় পরিব্রাজকের ঘরবাহির || আহমদ মিনহাজ

নব্বইয়ের কবিদের অনেকেই আজও অন্তরালনিবাসী পরাভাষা সৃষ্টির তাগিদে সময়প্রবাহে নিজেকে সঞ্চালিত রেখেছেন। সামাজিক পরিধিতে বিদ্যমান কোলাহলে অবগাহনে বাধ্য হলেও এই পরাভাষায় সৃষ্ট কবিতা ব্যক্তির বিবরমুখী বৃত্তে প্রবেশের স্মৃতি মনে করায়। ব্যক্তিকে নিরালা অনুভবের প্রান্তে ক্রমাগত ঠেলে নিয়ে চলা সময় এখানে কুয়াশাচাদরে ঢাকা সন্ধ্যাভাষার স্মারক। এ হলো সেই নিরালা যেখানে গমনের পর নিজেকে দলছুট ভাবা ছাড়া দ্বিতীয় অনুভব মনে স্থিরতা পায় না। নব্বইয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ কবি এই বর্গে পড়েন এবং ইচ্ছে থাকলেও সকলকে নিয়ে পৃথক আলোচনায় বিস্তারিত হওয়া সম্ভব নয়। সুদীর্ঘ তালিকা থেকে উজ্জ্বলতর কিছু নামকে যদি প্রাসঙ্গিক করা যায় সেক্ষেত্রে শিবলী মোকতাদিরকে দিয়ে আলোচনাটি শুরু করা যায় হয়তো।

কবিতা যদি ভাষার খেলা হয়ে থাকে, ছন্দ ও ছন্দভগ্নতায় কামিয়াবির স্মারক গণ্য হয়, অন্ত্যমিল ও আধা-ভাঙা অন্ত্যমিলের বাহারে পরিপার্শ্বে সচল জীবনবেদ নিয়ে কবির জাগলিং রূপে তাকে ভাবা যায়, তবে এই কবি সেখানে পৃথকভাবে উচ্চারিত হওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক। পরিহাসদীপ্ত নয়ন মেলে চারপাশ নিরিখন ও নিরীক্ষা-কুশল বয়ানে নিজের পর্যবেক্ষণকে ভাষা দিতে পটু শিবলী মোকতাদিরের কবিতা নব্বইয়ের জন্য বিশেষ প্রাপ্তি বৈকি!

ওগো বায়ু, মাতাল মৌসুমী ওগো পলাতক;
সেথা আমি অস্ত্রবিনা, ইতিহাসে শূন্য-সেনা
কী দিয়ে রচিব ঘটনা — যদি না বাঁকের ব্যঞ্জনা
পথিকের গুণে ধেয়ে আসে ফের;।
(সমগ্র রচনাবলী)


খতিয়ানখনণ্ড বগলে চেপে চলেছো কোথায় — হে বিদ্রুপ,
হে অন্ধকুমার; তৎপর এখনই
আমি তো জানি, যত হস্তের প্রসারিত অভিমান
কী করে যুক্ত করেছো সেথা; ফন্দি ও ফাত্নার রসায়নে।
(খতিয়ানখণ্ড)


রাজা ব্যক্তিনগত, নিরোধক, প্রজা ও প্রথায় বিভাজিত
ফিকে যে প্রেমিক, তুমি তার মৌলিক সংক্রান্ত
রাজা সিদ্ধান্তের, শোকে ও সংকেতে, রাগে প্রজ্জ্বলিত।
লঘু সমর্থনে, আঁধারে রঙিন, ইতিহাসে যুগে যুগে
রাজা নির্বাচনে, গ্রহণে-বর্জনে, কাহিনিকেন্দ্রিক দৃশ্যে নিবেদিত
দিবসের সমাগমে মাত্র নিচু মদে বিনীত বাঁকের বিশেষণে
রাজা মনোনীত, প্রাচীন-প্রবীণ, চিরদিন আর নিদ্রাহত।
(রাজা ব্যক্তিগত)

শিবলী মোকতাদিরকে পড়তে আরাম তাঁর ছন্দব্যঞ্জনায়, ভাঙা অন্ত্যমিলের চকিত ঝিলিকে, তৎসম ও অর্ধ-তৎসম শব্দ ব্যবহারের চপল বিন্যাসে, এবং এইসব মিলেঝুলে তাঁর ভাষাঅঙ্গ পয়ার ও গদ্যছন্দের সঙ্গে তাল দিয়ে স্বতন্ত্র বাঁকে মোড় নিয়ে নেয় শেষতক। পথ চলতে-চলতে মানুষ দেখার চাক্ষিক তৃষা শিবলীর সহজাত বলে মনে হয়, যার অনুরণন তাঁর কবিতায় অবারিত ছকে আসে-যায়। শব্দগুলো জিগ্স পাজলের মতো ঠাসাঠাসি জায়গা করে নিলেও কবিতার ছন্দ, চিত্রকল্প এবং অর্থযোগে বিশেষ গোলযোগ কিন্তু ঘটে না :—

জানি, তবু তুমি ফুলের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
বলিষ্ঠ ও স্বতন্ত্র পাপড়ির প্রত্যাশিত দুঃখ, শোক
জরা ও যন্ত্রণার আবেদন বয়ে আনবে।
আমার চোখ উঠবে ভিজে।

বাতাস বইবে তখনই হঠাৎ বেহুদা বসন্তের
ঝরে পড়বে পালক। স্থিরচিত্রে গজিয়ে উঠবে
দুরভিসন্ধির বল্লম হাতে জলে-স্থলে অসংখ্য প্রজাপতি
কতিপয় কীট ও পরাশ্রয়ী দুরাচার।
(ঝলক)


দুরন্ত বাটুলের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি
একা, আরোপিত অঞ্চলে।
হাস্য-হাহাকার সবকিছু স্তব্ধ  করে দিয়ে;
বৃষ্টি হচ্ছে খুব, এলেঙ্গার পরিবেশ পরিচিতিতে।
(বাটুল)


ধুলো কিংবা তুলো-বাণিজ্যে লাভ হবে কোনটি?
এই নিয়ে আশায় আক্রান্ত ভাববাদী বিয়ে না করা লোকটি
নানান চিন্তা ও কাজের তৎপরতায়, বিবিধ ব্যথায়
প্রচণ্ড রৌদ্রে, ঝড়ে, বিফল বজ্রপাতে
আহাম্মকের মতো বসে আছে ঘাসের কার্পেটে মৃদুমন্দ প্রভাতে।
(বালিকা বিদ্যালয়)

পরিব্রাজক সত্তা শিবলীর কবিতাকে অতীত ও বর্তমানে আন্তঃসংযোগ স্থাপনের প্রণোদনা দিয়ে যায়। পঙক্তিরা সেখানে একে অন্যের সঙ্গে বৈপরীত্য রচনা করে অগ্রসর হলেও অন্তে এসে ঐকতানে মোড় নেয়। কবির  ‘ব্যক্তি আমি’ সরাসরি ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে না। নিজের কবিতায় শিবলীর ভূমিকা যেন-বা দর্শকের। তাঁর কাজ হলো সেই ভাষ্যটি তুলে ধরা যেটি ঘটনার পর্যবেক্ষণ থেকে উপযুক্ত দৃশ্য উঠিয়ে আনার সামর্থ্য রাখে। পর্যবেক্ষণের ক্ষণে দর্শকের মনে কৌতুক ও পরিহাস এসে ভিড় করে এবং সেগুলো পরিবেশন করতে যেয়ে কবি নিজেকে এর অংশীদার করে তোলেন; যদিও শিবলীর কবিতায় ‘ব্যক্তি আমি’ কর্তৃক প্রদানকৃত এই ধারাবিবরণী অবিরত পিছলে গিয়ে ব্যক্তিসমগ্রয় রূপান্তরিত হয়। রস-পরিহাসের ছলে সময় থেকে সময়ান্তরে নিজের সত্তাকে ট্রান্সমিট ও ওমিট করার বাহাদুরির কারণে এই কবিবর পাঠ ও শ্রুতির পক্ষে সুখকর আবেদন সৃষ্টি করেন কবিতায়।


নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: