ফিরছিলুম এগারোটা চল্লিশের লোকালে।
শহরতলি থেকে কলকাতায় ফেরার ওটাই বোধহয় শেষ ট্রেন। শীতের রাত। বেশ জাপটে ঠাণ্ডা পড়েছে। কামরায় গুটিকতক লোক। স্টেশনগুলি আরও নির্জন। ট্রেনের না দাঁড়ালেও চলত কেননা যাত্রীদের ওঠা-নামা নেই। আমাদের কামরার কেউ কলকাতার আগে নামছে বলে মনে হয় না। ছোট একটা অচেনা স্টেশন থেকে উঠল সেই হকার। পরনে খয়েরি প্যান্ট, নীল ফুলহাতা সোয়েটার, মাথায় মাঙ্কি-ক্যাপ, রোল করা। হাতে বইয়ের বান্ডিল। ‘পড়েছেন কেউ আপনারা’ চিৎকার করে সে জাগিয়ে তোলে অর্ধসুপ্ত আমাদের। ‘পড়েছেন ফুলবালা রায়ের লেটেস্ট …’ ট্রেন ততক্ষণে একটা ব্রিজ পার হচ্ছে। প্রচণ্ড শব্দে যুবকটির গলা প্রায় ঢেকে যায়। কিন্তু মাঝের বেঞ্চে শুয়ে থাকা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক উঠে বসেন। বলেন ‘দেখি … দেখি …’ ।
এ খেলাটা অবশ্য আমরা সবাই জানি নাকি? দলেরই একজন, যাত্রী সেজে বসে থাকে। সেই ঘুঘু কেনে প্রথম ধূপকাঠির বান্ডিল, তালা ও চাবি, চিরুনি ও মানিব্যাগ। যাতে অন্যরাও কিনতে শুরু করে। কিন্তু আজ বাতাস যেন উল্টোভাবে বইছে। ছেলেটির পুস্তক-সংগ্রহের প্রথম বইটি সে-রাত্রে ঐ কামরায় আমিই কিনে বসি। নাম — ‘ভূতের মস্তানী’। দাম — দু-টাকা পঞ্চাশ পয়সা। মলাটে রঙিন, ঝাপসা ছবি। ভিতরে অজস্র ছাপার ভুল।
কিন্তু কী সব গল্প!
সুতরাং আমি আরও গুটিকতক বই বিনা দ্বিধায় কিনে ফেলি — ‘ভূতের পাল্লায়’, ‘ভূতের জলসাঘর’, ‘জাহাজে আজব খুন’, ‘বৌয়ের হাতে শাশুড়ি খুন’ (এটি কবিতায়, অর্থাৎ পয়ারে)।
তাহলে আসল কথাটা বলা যাক। এগুলি আমার অষ্টআশির পড়া সেরা বই।
বইগুলিকে আমি একত্রে একটি বই হিসেবে ধরছি। এদের মধ্যে প্রচুর মিল। বটতলার বইয়ে-বইয়ে যেমন এক আত্মীয়গ্রন্থি ছড়িয়ে থাকে — তা সে ‘পাক প্রণালী’ হোক, বা ‘সহজ সাঁওতালি শিক্ষা’ হোক। সেসব অবশ্য ওপরের মিল।
ফুলবালা রায়ের আড়াই টাকা মূল্যের সাহিত্যসৃষ্টির ভেতরে থাকে শ্রেণি-বৈষম্যের গল্প, খিদেয় মরে-যাওয়া মানুষের কাহিনি, যাদের গায়ের পচা গন্ধে রায়বাহাদুরের নাতির অন্নপ্রাশন পণ্ড হয়ে যায় আর কি —
স্যাঁৎ করে ভিখারির হাতদুটো প্রকাণ্ড লম্বা ও হাড়ের কঙ্কালে পরিণত হয়ে। দু-হাতে রায়-সাহেব ও দত্ত-সাহেবের ঘাড় ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিচ্ছে; দুজনের কপালে কপালে সজোরে ঠোকাঠুকি করছে, আর অদ্ভুতভাবে নাকি-সুরে বলছে ‘ন্যাঁস্টি! নাঁ? ন্যাঁস্টি! আঁগে মঁনের ন্যাঁস্টি দূঁর কর। গঁরিব ভিঁখারিকে এঁক টুকরো খাঁদ্য দিঁতে আঁতে ঘাঁ লাঁগে! রুখতেঁ পাঁরলি নেঁ? অতগুঁলো খাঁবার উঁড়ে গেল উঁধাও হঁয়ে? মিঁসেসরা সঁব কোঁথায় গেঁল? সাঁহাঁয্য কঁরল না একটুও! … (ভূতের পাল্লায়)
এই হচ্ছে সাহিত্যের আন্ডারগ্রোথ। জঙ্গলের প্রাণদায়িনী আগাছা। ঘেঁটু ফুল আর বাবলার কাঁটা। এসব বই ট্রেনে বিক্রি হয়, ফুটপাতে পাবেন, মেলায় মিলবে। তবে বইমেলায় নয়। যারা এগুলো নিজেদের উপার্জিত সামান্য মাইনে বা উপরি থেকে কিনে থাকে — তাদের অনেকেই যুক্তাক্ষর ভালোমতো পড়তে পারে না।
তবু তারা এসব বই কেনে কেননা এগুলিতে মানুষের টান-ভালোবাসার গল্প থাকে, পিতামাতার স্নেহের কাহিনি থাকে, মস্তানের বীরত্বের বর্ণনা থাকে।
প্রেম থাকে, তবে সামান্য — অত্যাচারের কথা থাকে, তবে আড়ালে তার সূর্য হাসে।
আর এই সমস্ত ভূতের কীর্তি। সেই অপার রহস্যময় ছায়াচ্ছন্ন মানুষের পুরাণ যারা আমাদের পাশে পাশে ঘোরে — কিন্তু সহজে দেখা দেয় না।
অনেকটা ভিখিরিদেরই মতো। কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় — কে জানে।
লেখকের ‘গদ্যসংগ্রহ ১’ থেকে গৃহীত।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS