লোকায়ত ধর্ম-দর্শনের ক্ষেত্রে বাউল মতবাদ উদার মানবতাবাদী ধর্মমত। এটি বাঙালির নিজস্ব এক তত্ত্বদর্শন। বাউল ধর্ম ও সাধনা সমন্বয়বাদী সাধনা। বাউল সাধক-কবিদের গানগুলো সাহিত্যের এক উর্বর ক্ষেত্র। বাউলদের তত্ত্ব-সাধনা ও সংগীতের প্রভাবে বাংলা সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে, হচ্ছে — বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যেও বাউল প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সাহিত্যের মূল পদবাচ্য মানুষ। কলাকৈবল্যবাদীদের নন্দনলোকের তত্ত্বে বাউলতত্ত্ব মাপজোক করা যায় না। বাউলরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মে জাতপাত, ভেদ-বিভেদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন মানুষকে।
সম্প্রতি কবি সুমন বনিক সম্পাদিত সাহিত্যের ছোটকাগজ অগ্নিশিখা পড়লাম। অগ্নিশিখার এ সংখ্যাটি করা হয়েছে বাউল, মরমি-মারফতি ও লোকধারার সংগীত সাধনার নানা তত্ত্বতালাশ, লোককবি ও তাঁদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে। বিশেষ ক্রোড়পত্রের নাম দেওয়া হয়েছে ‘লোকমহাজন’ সংখ্যা। সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে ঋদ্ধ একটি কাজ। অত্যন্ত পরিশ্রমী কাজ করেছেন সম্পাদক। অবক্ষয়ের এ সময়ে বাউল মানবতাবাদ, সহনশীলতা ও সমন্বয় সাধনার মহৎ দিকগুলোর চর্চা ও চর্যার বিকল্প নেই। বাউল মতবাদ মানুষকে সর্বজনীন মানবিক মহামিলনের আহ্বান জানায়। বাউল মতবাদের গভীরতা, ব্যাপ্তি এতই বেশি যে মানবমুক্তির নানা মত-পথ একই মিলনমোহনায় এসে মানবের জয়গান গেয়েছে। আর এজন্য এ মতাদর্শ অনেক সমাজসংস্কারক ও বিদ্বজ্জনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন রায়ের ‘ব্রাহ্ম সংগীত’ গ্রন্থে সমকালীন বাউলপ্রভাব পড়েছে। লালনের সমকালীন কবি ও সংগীতজ্ঞ বিহারীলালের কাব্য-গানে বৈষ্ণব পদাবলি ও বাউল প্রভাব লক্ষণীয়। বউলদের ‘মনের মানুষ তত্ত্ব’ কবি ও সহিত্যিকদের ভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে।
লালন শাহ ও কাঙ্গাল হরিনাথের সময়ে মীর মোশাররফ হোসেন মূলত গদ্যশিল্পী হলেও ‘সংগীত লহরী’ নামক একটি গ্রন্থে বাউল গানও লিখেছেন। তিনি কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের গানের প্রশংসা করে বলেন — “ফিকির চাঁদে, আজব চাঁদে, রশিক চাঁদে সব মেতেছে / কোথা আর পাগলা কানাই, লালন গোসাঁই / সব সাঁই এতে হার মেনেছে।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে এসে বাউল-ফকিরদের সান্নিধ্য পেয়ে, বাউল মতাদর্শে এবং বাউল গান ও সুরে অভিভূত হয়েছেন। বাউলদর্শনে তিনি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
বাউল গানের প্রভাব বাংলা সহিত্যে অপরিসীম। বাংলার নিভৃত পল্লিতে এখনো অনেক লোককবি, মরমি সাধক নীরবে তাঁদের সাধনকর্ম করে যাচ্ছেন। এদের অনেকেরই খোঁজখবর, সাধনচর্চা আমাদের জানার বাইরে। কবি সুমন বনিক তাঁর অগ্নিশিখার ‘লোকমহাজন’ সংখ্যায় গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোকচক্ষুর আড়ালে নীরবে-নিভৃতে সাধনভজনকারী সেসব বাউল-পির-ফকির, লোককবি ও চারণদের সংকেতগূঢ় ভাষার নিগূঢ় সাধনার কথা তুলে ধরেছেন। বাউল-ফকিরদের সাধনভজনের তত্ত্বতালাশ, মরমের ভাব ও দর্শন, লোকমহাজন : সৃষ্টি ও নির্মাণ, মরমির সঙ্গ, বাউল ফকিরের ডেরায়, মরমের স্মৃতিগদ্য … ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে অগ্নিশিখার লোকমহাজন সংখ্যায়।
অগ্নিশিখার এ প্রয়াস মহৎ ও ব্যাপক। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে বাউল সাধনপদ্ধতির রয়েছে ভিন্নতা। বাউলদের সাধনপদ্ধতির পাশাপাশি অঞ্চলভেদে বেশ-বাসও আলাদা। কোনো কোনো বাউল সম্প্রদায় গেরুয়া-হলুদ পোশাক আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় সাদা পোশাক পরিধান করে থাকেন। এদের কেউ কেউ বাউলধর্মমতে দীক্ষিত সংসারহীন সন্ন্যাসী বাউল, কেউ কেউ আবার গৃহী বাউল। এ বিষয়টি আহমেদ স্বপন মাহমুদের ‘বাংলার ভাব ও মরম’ শিরোনামের লেখায় উঠে এসেছে — “বাউল গানের ক্ষেত্রে নানা মত ও পথ বিদ্যমান থাকলেও, নানা রেওয়াজ থাকলেও কিছুকিছু ক্ষেত্রে তার চর্চা ও আচরণের মিল রয়েছে। আবার অঞ্চল ভেদেও পার্থক্য রয়েছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সিলেট অঞ্চলের বাউল গানের সাথে কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গানের বিস্তর তফাত। লালন সাঁইকে যে-অর্থে বা তত্ত্বে আমরা বাউল বলি, একই অর্থে রশিদ উদ্দিন খাঁ, শাহ আবদুল করিমকে বলি না। কিন্তু তারাও বাউল সাধক হিসেবে পরিচিত ও খ্যাতিমান। বাউল সাধনার রীতির ক্ষেত্রেও কিছু পার্থক্য আছে। কুষ্টিয়া রাজশাহী অঞ্চলে গুরুদীক্ষার রীতি নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুর্শিদ-দীক্ষা আকারে হাজির।” প্রাবন্ধিক স্বপন নাথের ‘হাসন রাজা গাইছে গান হাতে তালি দিয়া’ শিরোনামের লেখায়ও এ-বিষটির আলোকপাত রয়েছে।
বাউল মতবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে লোকগবেষক সাইমন জাকারিয়ার। বাউলদের জীবন ও কর্ম নিয়ে নানাবিধ পর্যালোচনার এক যুগপৎ সম্মিলন ঘটেছে লেখাটিতে। মকদ্দস আলম উদাসী ও তাঁর গান নিয়ে লিখেছেন কবি মোস্তাক আহমাদ দীন। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের লোকগীতি’ সংকলনের পর্যালোচনাধর্মী লেখা রয়েছে লোকগবেষক সুমনকুমার দাশের। আমাদের লোকধারাচর্চা ও পূর্ববাংলার লোকমানস জানতে লেখাটির গুরুত্ব অপরিসীম। ‘লোকায়ত সাধনা ও লোকসাধক মনমোহন দত্তের গান’ নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ শেখ সাদী, ‘জারিয়াল দারোগ আলী ও তাঁর গান’ নিয়ে লিখেছেন বঙ্গ রাখাল, ‘রাধারমণ, কবিআত্মা ও কাব্যশিল্প’ বিষয়ক মূল্যবান প্রবন্ধ রয়েছে কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের। ‘লোকগীতিকার তাজউদ্দিনের চারটি গান ও তত্ত্বভাবনা’ নিয়ে লিখেছেন আজির হাসিব। সঞ্জয় সরকার লিখেছেন বাউল উকিল মুন্সির জীবনধারা ও গান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। লোকগবেষক আহমদ সিরাজ ফকির ইয়াসিন শাহের গান ও তাঁর সাধনতত্ত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। মরমি কবি জালাল উদ্দীন খাঁ নিয়ে লিখেছেন গোলাম মোরশেদ খান। আবিদ ফায়সাল তাঁর লেখায় বাউলকবি কামালউদ্দিনের বাউলজীবনের গল্প ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ভালো বিশ্লেষণ করেছেন।
মরমি কবি নূর মোহাম্মদ : তাঁর ‘মিফতাহুল মারিফত’ থেকে নির্বাচিত গান — লিখেছেন গবেষক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। প্রবন্ধে নূর মোহাম্মদের জীবন-সাধন ও গানগুলোর উপর গভীর আলোকপাত রয়েছে। সুধী পাঠকের দৃষ্টিপাতের জন্য এখানে নূর মোহাম্মদের একটি গানের অংশ উপস্থিত করা হলো —
মাবুদ কি মুখের কথায় মিলে, মাবুদ কি সহজ কথায় মিলে
প্রেমতরঙ্গে মত্ত হইয়ে ভক্তি ভাবে না ডাকিলে।।
ছিপেতে মুতি আছে থাকে সে পানির নিচে
শুকনায় বসে কে পাইয়াছে পাবে না তায় ডুব না দিলে।।
যে যেমন ডাকে তারে, আছে সে তত দূরে
কাবা কৌছন হইতে ধারে, ভাবুকে পায় ধ্যান করিলে।।
আঠারই ছিপারায় সুরে নূর অঙ্কিত তায়
কী কলে মাবুদ পাওয়া যায়, ভেদমর্ম পাবে দেখিলে।।
ভেদমর্ম বুঝিতে ভাই, কামিল মুর্শিদ চাই
তবু হাসিল হবে নাই দয়ালের কৃপা না হলে।।
ওহে মাবুদ নিরঞ্জন, হইল না আমার মিলন
নূরের বাঞ্ছা কর পূরণ পাইমু তোমায় কী কৌশলে।।
বাউল আবদুল করিমের সমসাময়িক ও সমঘারানার এক লোককবি ছিলেন সুনামগঞ্জের শাহারপাড়া গ্রামের তৌরিস মিয়া। তিনি শিক্ষিত ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। ‘তৌরিসসংগীতে সমকাল’ শিরোনামে হোসনে আরা কামালীর লেখায় লোকবাউল তৌরিস মিয়ার গানের সমকালীন সমাজ ও জীবনবাস্তবতার নানা চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় জগন্নাথপুর-দিরাই-শাল্লার প্রার্থী আব্দুস সামাদ আজাদের পক্ষে পূর্ববাংলার মানুষের সহযাত্রী ছিলেন তৌরিস মিয়া। গান লেখেন —
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দেখি
ধনীর পায়ের তলে রে —
তৌরিস কয় আমার ডাকে
আজকাল ঘুম যাক ভাঙ্গিয়া
যুক্তফ্রন্টের নৌকায় এসে উঠো দলে দলে
জুলুমকারী সরকারের দল ডুবাও নায়ের তলে রে
তৌরিস মিয়ার একটি জনপ্রিয় গান ‘উঠলো রে লন্ডনের জ্বর’। গানটিতে গত শতকের সিলেটের জনমানস, সমাজবাস্তবতা ফুটে উঠেছে —
উঠলো রে লন্ডনের জ্বর
ভিটাবাড়ি বিক্রি কর
তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর
দিন গইয়া যায়
…
মোল্লামুনসি পাসপোর্ট করে
লন্ডনি ভূত উঠলো ঘাড়ে
ফটো তুলতে যাইয়া বেটায়
দাড়ি মুন্ডায়
…
শাহারপাড়ার আমিন মিয়া
করাচি সাহেব বনিয়া
পাসপোর্ট পারমিট আনিয়া
দেখাইলেন সবায়
লোকে দেখে দেওয়ানা হইল
কন্ট্রল দরে টাকা দিলো
হায় রে কন্ট্রলের পাসপোর্ট
ঘুমাইছে ঢাকায়…
…
কহে পাগলা তৌরিস মিয়া
সত্য সব ঘটনা নিয়া
দেশের তালে তাল ধরিয়া
গান একটা বানায় রে…
অগ্নিশিখায় আরো কিছু প্রবন্ধ পত্রস্থ হয়েছে। সবগুলো লেখাই আলাদা আলাদা রসরূপে ভরপুর। ঋদ্ধ। বাঙলি লোকধারার চর্চার পরম্পরাগত সাযুজ্যের জন্য এমন লেখা নির্বাচন সম্পাদকের সচেতনতার পরিচয় দেয়। লোকমহাজন সংখ্যাটি কেবল বাউলসাহিত্যে সীমাবদ্ধ না-থেকে বাংলার লোককবি, মরমি সাধক, বৈষ্ণব যোগী, পির-ফকির, সাধক-সন্ন্যাসীদের সাধনভজন, জীবনাচার এবং তাঁদের অমূল্য ভাবসম্পদকে নানাজনের লেখার মাধ্যমে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। লোকবাংলার নিভৃত পল্লিতে পড়ে-থাকা অনালোচিত অবহেলিত অনেক পদকর্তার সৃষ্টিকর্ম দুই মলাটের ভেতর সন্নিবেশিত ও সম্পাদনার ফলে আমরা বৃহৎ বাংলার ভাবসাধনার নতুন নতুন খোঁজখবর পাই।
সম্পাদক হয়তো সচেতনভাবে এ সংখ্যাটির নাম দিয়েছেন ‘লোকমহাজন’। বিষয়বৈচিত্র্যে নামটি যথার্থ হয়েছে। কেননা, বাউল-বৈষ্ণব-সুফি-চারণ-লোককবি সহ নানা ঘরানার সাধনতত্ত্ব, তাঁদের সৃষ্টিকর্ম ও জীবনের নানা কথামালারও সমাবেশ ঘটেছে এতে। অনেক লোককবির সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। আমরা এর থেকে তাঁদের ভাবজগতের রহস্যাবৃত, নিগূঢ় অনেক গহিন কথাবার্তার সন্ধান পাই। কথাসাহিত্যিক শেখ লুৎফর কর্তৃক নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গৃহী বাউল ফারুক শাহ বলেন, “বংশরক্ষার জন্য বিয়ে করতে হবে। সন্তান পাওয়ার পর স্ত্রী আর স্ত্রী থাকে না। সে হয়ে যায় বিশ্বজনীন। তাঁর মাঝেই লুকিয়ে আছে সাধনার ক্ষেত্র। আর বীর্য ক্ষয় না। এখন থেকেই মণি রক্ষা পরম ধর্ম। খামাখা স্ত্রী-সহবাস কঠিন পাপ। এক ফোঁটা মণির মাঝে হাজারে-হাজার প্রাণ। এই নরহত্যার দায় কে নেবে?” গান বিষয়ে হাদিস-দলিল সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক শাহ বলেন, “ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর ‘কিমিয়ায়ে সাআদাত’ বা ‘সৌভাগ্যের পরশমণি’ কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডে একটা অনুচ্ছেদে সংগীত বৈধ কি অবৈধ বিষয়ে কিছু স্পষ্ট কথা বলেছেন। তিনি বলেন, লোহা এবং পাথরের মাঝে যেমন আগুন আছে তেমনই মানুষের আত্মার মাঝে একটা গুপ্তধন আল্লাহ রেখেছেন। লোহা-পাথরে ঘষা লাগলে আগুন জ্বলে। মিষ্টি সুর শুনলে মানুষের হৃদয় আলোড়িত হয়। তিনি বলেছেন, ঈদের দিন কিংবা কোনো আনন্দের দিন গান বৈধ। তিনি মুর্শিদের শানে গানকে বলেছেন মধু আর কাম-উত্তেজক বা খারাপ গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, কোনো এক ঈদোপলক্ষ্যে মসজিদে নববিতে হাবশিগণ খেলতামাশা করছিল। তখন রাসুলে পাক (সা.) আমাকে বললেন, তুমি খেলতামাশা দেখবে? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে হাত প্রসারিত করলেন আর আমি তাঁর বাহুতে থুতনি রেখে তামাশা দেখছি। একটু পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আরও দেখবে? আমি বললাম, হ্যাঁ। এইভাবে তিনি আমার কাছে তিনবার হ্যাঁ উত্তর পাওয়ার পর আমাকে মসজিদে নববিতে নিয়ে গিয়ে হাবশিদের বললেন, তোমরা উত্তমরূপে নৃত্য করো। কাজটা হারাম হলে তিনি কখনো হাবশিদেরকে এই নির্দেশ দিতেন না।” সুমন শিকদারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খোরসেদ আলম বয়াতি বলেন, “গান করলেই ধর্ম হয়। ধৃ ধাতু হতে ধর্মের উৎপত্তি, যে-ধাতু সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই দিয়েছেন। যেটা আমরা মায়ের কাছ থেকে পাই মাতার রজ, আর পিতার বীর্যের সমন্বয়েই জন্ম। আমাদের এই ধাতু রক্ষার সাধনা করাই ধর্ম।” নেত্রকোণার কোর্টস্টেশনে বসে বসে বাউলসাধক আব্দুল হাকিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি সরোজ মোস্তফা। আব্দুল হাকিমের একজীবনের সারাৎসার তুলে ধরেছেন তাঁর এই কথোপকথনের মাধ্যমে। বাউলজীবনের অনেক গহিন কথাবার্তা জানিয়েছেন তিনি আমাদেরকে। এক প্রশ্নের জবাবে বাউল আব্দুল হাকিম বলেন, “বাউলের কোনো আক্ষেপ থাকে না। আক্ষেপ নিয়ে বাউল হওয়া যায় না। বাউলেরে আপনেরা একা ভাবেন। বাউল একা না। সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়েই আমি হাঁটছি। আমার হাঁটায় ভুল নাই। আমার বুকে আমার মুর্শিদ। যার মুর্শিদ আছে তার আক্ষেপ নাই।” সরোজ মোস্তফার অন্য এক প্রশ্ন ছিল, ‘এই যে সংসারের ভেতর থেকে বাউল হইতে চাইছেন, বাউল কি হইতে পারছেন? মন কি সংসারের মায়া-মোহ ত্যাগ করতে পারছে? এই যে আপনি বাউল সমিতি করেন? বাউলদের কি সমাজ নেবে কোনোদিন? আপনার কাছে যারা আসেন তারা কি বাউল হইতে আসেন, না শুধু গান শিখতে আসেন?’ এর উত্তরে আব্দুল হাকিম বলেন, “পরমকে পাওয়ার এই সাধনা মোটেও সহজ না। সাধু জালাল খাঁ সাহেব বলেছেন, ‘ভাবের কথা কইতে গেলে না আছে তাঁর শেষ / পুত্র-কন্যার মাঝেই থাকো হইয়্যা নিরুদ্দেশ।’ পুত্র-কন্যার মাঝে আমি নিরুদ্দেশ হয়েই ছিলাম। গৃহী বাউলরা হইলেন পরমহংস। সংসারে সাঁতরাইলেও শরীর ভেজান না। সংসারের চাওয়া-পাওয়া-মায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন। আমি চেষ্টা করে গেছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরোপুরি পারছি, এই কথা বলার শক্তি আমার নাই। পুরোপুরি পারছি, এই কথা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি তো গরির মানুষ, জমিতে কাম করতে হইছে। ঘরে ভাত না থাকলে মানুষের কাছে হাত পাতলে মানুষ টিটকারি মারত। আমার কাছে ঘর ‘দহনদয়িতা’। বাউল হইলে আপনেরে কত কথা শুনতে হইবো। বাউলজ্ঞানে নিজেকে শুদ্ধ করতে পারছি কি না ঠিক কইতে পারব না। চেষ্টা করে গেছি। কতটা পারছি, এইটার হিসাবের কোনো খাতা নাই। বাউলের তত্ত্বজ্ঞান যার উপরেই বসছে, সে-ই আলোকিত হয়ে গেছে। তার কোনো অহঙ্কার নাই, হিংসা নাই, লোভ নাই। সীমার মাঝে, সংসারের মাঝে সে কমপক্ষে একজন নিখুঁত বাবুই হইতে পারছে। আমার বাউল সমিতিও বাউলের প্রচার। এই যে লেভেলক্রসিং বাজারে সমিতির ঘর করছি, এইটাও সহজ ছিল না। আমি লালন, হাসন রাজা কিংবা জালাল খাঁ না। আমার এত ক্ষমতা নাই। আমি একটা জেনারেশনের কানে-মনে ভাবের কথা পৌঁছে দিতে চাইছি। কিন্তু পারছি কই? কেউ বাউল হইতে চায় না। বাউলের গানটা গাইতে চায়। গানটা বুঝতে চায় না, মনে বসাইতে চায় না, শুধু গানটা গাইতে চায়। এই জীবনে কমপক্ষে হাজার খানেক ছাত্র আমার কাছে আইছে। কিন্তু সবাই ছাত্রই থাকল। কেউ বাউল হইল না। সবাই গানের উপরের সুরটায় ভেসে গেল। ভেতরের সুরটার সন্ধান করল না। এখনকার শিল্পীরা গানের তালিম নিয়েই টেলিভিশনের বাকশের ভেতরে ঢুকে যায়। আমি প্রত্যেকের মনটা বুঝি। গান শিখাই। শিখাতে শিখাতে কিছু কথা তাদের দিলে রাখতে চাই। দিল্ থেকে ওরা যদি একদিন বাউল হইতে চায়, তবেই আমার শান্তি।” লেখক সোমব্রত সরকার বাউল-পির-ফকিরের ডেরায় ডেরায় ঘুরে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। অগ্নিশিখায় ‘সিন্ধুপারের বন্ধু যে জন’ শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধের এক জায়গায় পির জলীল বাবাকে তিনি বলছেন-, ‘বাবা, ফকিরেরা যে রঙিন কাপড়ের টুকরো জোড়া জোব্বা পরেন, গায়েও ওই ধরনের চাদর জড়ান, এর মানেটা কী?’ উত্তরে পিরবাবা বলছেন, “সত্তরটি রঙের টুকরো জুড়ে ফকিরি জামা বানানো চলে। এ হলো বাবা, সত্যের অনুভূতির তালি। ওতে একবিন্দু মিথ্যে মেশানো যে নেই।” কেমন গূঢ় কথা, ভাবুন তো!
অগ্নিশিখার এ সংখ্যায় লোকধারার সাধক-বাউল-ফকির-লোককবিদের কাছ থেকে সাধনতত্ত্বের অনেক গূঢ় ও রহস্যাবৃত কথাবার্তা উঠে এসেছে। এই যে সত্যের পূজারী, সত্যের সাধক লোকবাংলার মানবিক চারণ, এদের প্রতিভার প্রযত্ন প্রয়োজন এখন খুব বেশি। আমাদের সাহিত্যসংস্কৃতির ধারক এসব লোককবি ও তাঁদের সৃষ্টিসম্ভারকে সামনে নিয়ে আসা দরকার। এগুলো আমাদের মূল্যবান সম্পদ। আজকের সময় ও পরিস্থিতিতে উদার, অহিংস ও মানবতাবাদী দর্শনের বিকল্প নেই। দেশের গণ্ডি ছেড়ে বিদেশেও বাঙালির নিজস্ব এমন ভাবসম্পদের কদর কম নয়। বাউল ভাবাদর্শ নিয়ে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো বাংলার বাউল গানকে দি রিপ্রেজেনন্টিটিভ অব দি ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির তালিকাভূক্ত করেছে। আমরাও এগুলোর কদর দিতে পিছপা হব কেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন রচনায় বিশেষ করে সংগীতে বাউলগানের প্রভাব পড়েছে বেশি এবং এগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও হয়েছে সমাদৃত। বাউলছাঁচের রবীন্দ্রসংগীত রচনাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘রবীন্দ্রবাউলের রচনা’ বলে অভিহিত করেছেন। কেবল তা-ই নয়, বাউলসমাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘ফাল্গুনী’ নাটকের অভিনয়ে বৃদ্ধ বাউলের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করেছিলেন। নজরুলসাহিত্যেও বৈষ্ণব, বাউলভাবনা, মানবতাবাদ, সমন্বয় চেতনার প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। তিনি বাউলসুরে বাউলঢঙে গান রচনা করেছেন, সুরও দিয়েছেন — ‘মোরা ভাই বাউল চারণ / মানি না শাসন বারণ / জীবন মরণ মোদের অনুচর রে’। আমাদের কাব্যসাহিত্যেও বাউল ভাবাদর্শের প্রভাব রয়েছে।
বাংলার এই অমূল্য ভাবসম্পদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা দুটোই দেখিয়েছেন কবি সুমন বনিক। সম্পাদকের সাথে কথা বলে জেনেছি, তিনি ‘লোকমহাজন-দুই’ করবেন এবং ইতোমধ্যেই সে-লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সিলেট অঞ্চলে মরমি সাধনা ও লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। অনেকে এখনো মিডিয়ার আড়ালে দূর গ্রামে বসে সৃষ্টিসাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে ‘মরমী লোকগীতি’ নামে অনামিকা সিনহার (কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার) একটি বই পড়লাম। সাধনা রানী সূত্রধর (বানিয়াচং, হবিগঞ্জ) তাঁর রচিত ও সুর-করা কিছু গান অডিও রেকর্ড করে আমাকে পাঠিয়েছেন। এক সকাল শুরু করলাম গানগুলো শুনে শুনে। আমাকে দারুণভাবে মোহিত করেছে। অনামিকার ‘মরমী লোকগীতি’-র কদর কোনো অংশেই কম নয়। আমার জানামতে, ইউসুফ সাঁই (কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার) ইসলামি গজল ও মারেফতি গান লেখেন এবং নিজে সুর করে গান করেন। বিভিন্ন আসরে-মজলিশে তাঁর গান শ্রোতাকে মুগ্ধ করে থাকে। শাহ উস্তার উদ্দীন আহমেদ (রাজনগর, মৌলভীবাজার)। তিনিও বাউলগান রচনা ও গান করে থাকেন। উস্তার উদ্দীনের গান তাঁর শিষ্য এসডি শান্ত-র কণ্ঠে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। এ-রকম অনেকেই এখনো হয়তো মিডিয়ার অন্তরালে থেকে (বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জের ভাটি এলাকায়) মরমের চর্চা করে যাচ্ছেন, আমরা যাদের ভাবসম্পদের সাথে পরিচিত হতে পারিনি — অগ্নিশিখার চলমান উদ্যোগের সাথে তাদেরও কেউ কেউ সহযাত্রী হবেন এ-আশা থাকল। মরমি ও আধ্যাত্মিক গানের পাশাপাশি সিলেটের জারিগান, সারিগান, ঘাটুগান, মালজোড়াগান, পল্লিগান ইত্যাদি লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশাল ভাণ্ডারকে এ-অঞ্চলের ছোটোকাগজগুলো সম্মান জানাবে। একজন লিট্লম্যাগকর্মী হিসেবে এ দায় আমিও অনুভব করি। জয়তু অগ্নিশিখা।
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS