সাবদার সিদ্দিকী : উত্তর-দশকে অনিবার্য জীবনবেদের অগ্রিম পাঠ-ইশারা || আহমদ মিনহাজ

সাবদার সিদ্দিকী : উত্তর-দশকে অনিবার্য জীবনবেদের অগ্রিম পাঠ-ইশারা || আহমদ মিনহাজ

ত্রিশ পরবর্তী অর্ধশতক জুড়ে সময় ও পরিপার্শ্বের যেসব উৎসারণ বাংলাদেশের কবিতায় মুদ্রিত হয়েছে তার থেকে আশির মধ্যভাগের পার্থক্যটি উপলব্ধি করতে না-পারলে নব্বইয়ে সংঘটিত বাঁকবদলের চরিত্র বোঝা কঠিন হয়। অগ্রজ দশকগুলো থেকে পৃথক মোড় নিলেও আশির মধ্যভাগ নব্বইয়ের সূচনায় দৃশ্যমান খোলসে নিজেকে গুটিয়ে রাখেনি। পরিপার্শ্বে নিজের সংযুক্তি পাঠের প্রবণতায় মোটের ওপর ভিন্ন পথে কবিরা মোড় নিতে যাচ্ছিলেন। সত্তর দশকের অন্তে পৌঁছে সাবদার সিদ্দিকী আক্ষেপ করেছিলেন ব্যক্তিসত্তায় জায়মান বিচ্ছিন্নতাবোধকে সংবেদি ভাষা দিতে সক্ষম কবিতা কেউ লিখছে না :—

চঞ্চল কিছু কিলবিল শব্দের কুটিল
কুটিরশিল্প কবিতা এখন
বাগানে সঙ্গমরত প্রফুল্ল প্রজাপতি
অথচ কেউ—
যাত্রাপথ থেকে মুছে যাচ্ছে নদী
কেউ লিখছে না
কীটকে ফুল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না

আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে
অস্থিমজ্জালিঙ্গপা আমাদের এই জন্ম
জননতন্ত্র প্রজনন অথচ লিখল না কেউ…

শুধু হাই তুলে তুড়ি মেরে
হামাগুড়ি কাটিয়ে দিচ্ছে কাল
লৌহসংস্কৃতির ক্রীতদাসেরা
শৃঙ্খলিত এরা মাংসে মজ্জায়
মুখোশজীবী এক নির্বাক সম্প্রদায়
রাষ্ট্রীয় পরিবহনে প্রত্যহ ফিরে যায় নির্ধারিত সিমেন্ট কৌটায়, মমি শয্যায়।
(পা)

শৈশবের শহর কলকাতা ‘সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মতো নিস্পৃহ…’ জীবনচর্যার প্রতীক রূপে কবির অনুভবে ধরা দিয়েছিল। স্বভাব বোহেমিয়ান কবি রাইফেল জমা দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে যখন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে তখন এই ভেবে অস্বস্তি হচ্ছিল মানুষ ও পরিপার্শ্বের বিজড়নগাথাকে একত্রে গেঁথে তোলার অনুভব কেন যেন বোধে গতিশীল করা যাচ্ছে না! বাংলা কবিতায় ভাষাটি প্রত্যক্ষ নয় যার সাহায্যে ব্যক্তির সঙ্গে সমগ্রের সংযোগ ও বিচ্ছেদের মনঃস্তত্ত্ব বুঝে নেওয়া যায়। দশকি পালাবদলের ফাঁকফোকর গলে চুঁইয়ে পড়া অযুত অনুষঙ্গে কবির ভ্রমণ কেমন হতে পারে এই ভাবনা সাবদারকে আশির গোড়ায় ভাবিয়ে তুলেছিল। নিজেকে শুনিয়ে কবি যেন প্রশ্ন রাখছিলেন :— ‘নাম নিয়ে খেলা করি / নামের গান গাই /নামের গভীরে ভিড়ে কচিৎ হারাই / ঐ নাম থেকে কতদূর এলাম / রসনায় রসনায় রাষ্ট্র এই নাম / নাম নিয়ে খেলা করি / নামগান গাই / নাম ছেড়ে কচিৎ হারাই।’ (দ্রষ্টব্য : নামগান-২৪)।

নামসমস্যার সরস ধাঁধায় ডুবে উত্তর দশকে অনিবার্য জীবনবেদের গতিবিধি সাবদার পড়তে পেরেছিলেন, যেখানে পা রাখার পর কম্পিউটারযুগে উত্তীর্ণ মানুষের মনে এই বোধ জন্ম নিবে মহাশূন্যকে করায়ত্ত করা গেলেও মানুষের সঙ্গে মানুষের ‘ব্যবধানগত মহাশূন্যতা’ রোধ করার উপায় কারো জানা থাকবে না। গেরিলা ও সন্ন্যাসী রূপে কবি এক ‘কম্পাসহীন কলম্বাস’! নিজের দিঙনির্ণয়ে ভাবনাটি আগামী দিনগুলোয় তাকে ভোগাবে :—

অন্যের জন্য বেঁচে
থাকি নাকি
নিজের জন্য বাঁচা
খাঁচার জন্য
পাখি
নাকি
পাখির জন্য খাঁচা।
(সোচ)

মুক্তিযুদ্ধফেরত সাবদার সিদ্দিকী সত্তর থেকে আশির মধ্যভাগ অতিক্রমের ক্ষণে ভালোই টের পাচ্ছিলেন গেরিলা ও সন্ন্যাসীকে অভিন্ন নিয়তি দানকারী সময়টি অনিবার্য হতে চলেছে। মানুষের স্বকীয়তাবোধে অগুন্তি স্বকীয়তাগ্রাসী উপকরণের প্রভাব আত্মিক শুশ্রুষার হাহাকারকে আরো ঘনীভূত করে তুলবে সে আর অনুমান না-করলেও চলে! আত্মিক শূন্যতায় আক্রান্ত ব্যক্তির নিজেকে মহার্ঘ ও উপহাস্য রূপে উপস্থাপনের পুরোনো প্রথাকে প্রযুক্তি অভিনব উপায়ে নতুন ভাষা দিতে যাচ্ছে এবং বিষয়টি আশির মধ্যভাগে পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল। সাবদারের অনুবর্তী শোয়েব শাদাব, বিষ্ণু বিশ্বাস ও কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কবিতায় আত্মিক শুশ্রুষার ক্ষুধা তখন কেবল দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ব্যক্তিক নির্বেদ থেকে আরোগ্য লাভের বৃংহন শোনা গেল শোয়েব শাদাবের ‘অশেষ প্রস্তরযুগ’-এ লিপিবদ্ধ পঙক্তিমালায় :—

ডুবে মরি শৌও শৌও শূন্যতায় সত্তার বৃংহন!
রক্তে পড়েছে ঢুকে বিসংবাদী বজ্রকীট, এই তৃষ্ণা!

খাই চক্ষু খাই হৃৎপিণ্ড, কাঁচা কাঁচা, জন্মেই আমি আত্মভূক
ঐ আসে ঝাঁকে ঝাঁকে সংখ্যাতীত লাল পিপীলিকা…
(অযনীপৃথিবী)

সহস্রাব্দ ধরে মানুষের চেতনায় অঙ্কুরিত নিষ্পাপ সৌন্দর্যের অতিকল্পনায় আস্থাশীল কবি লিখেছিলেন, ‘স্ফটিক জলের নিচে যাইনি তো তেড়ে — ছদ্মবেশে / সোনালি মাছের লোভে যাইনি কখনও / মরুভূমি পিপাসায় কাতর থেকেও / নদীকেই গিলবো বলে বাড়াইনি মুখ।’ (দ্রষ্টব্য : চিতাকাঠ)। নিষ্পাপ নিরাসক্তিতে ডুবে থাকার ঘোর ইতিহাসের ফেরে বহু আগে ভেঙে গিয়েছে জেনেও সেখানে অটল থাকার জেদ অন্তরাত্মাকে ফাঁপা হাহাকারে বিদীর্ণ করে আর এই চাপ সামলাতে না পেরে সত্তা উদভ্রান্ত আক্রোশে আত্মবিধ্বংসী হওয়ার পথ বেছে নেয়। মুকুরে নিজের মুখ যখন দেখে নিজেকে অচেনা লাগে তার! এখনো নিষ্পাপ কিংবা নিষ্পাপ হয়তো নয় তবু তাকে পাপী ভাবতে রুচি হয় না এমন মুখ মুকুরে ভেসে ওঠে না, পরিবর্তে কামকুটিল মুখচ্ছবিরা সেখানে আসে আর যায়! কবি শোয়েব শাদাব অগত্যা উদগ্র কামেচ্ছায় ভরা সেই মুকুরে ডাকিনী-যোগিনীর সঙ্গে রতিমিলনে দুর্নিবার মুখগুলোকে বিচরণ করতে দেখেন। তাঁর মনে আশা এতে করে আত্মা যদি শান্তি পায় :—

হাড়ে হাড়ে মজ্জায় শীতের কী কাঁপুনি
চুমুকে রক্ত খায় নারীরূপী বাঘিনী

স্নানাগারে রাতভর স্নান করে ডাকিনী
জলের শব্দ শুনে আমি কি গো ডাকিনি?
(অযোনিজ)

কবির মস্তিষ্কের নিউরণকণায় জায়মান বোধ অগত্যা নব্বইয়ের প্রাকক্ষণে ভ্রমাবেশ বৈকল্যর (schizophrenic delusion) সর্পিল পিচ্ছিলতায় মানুষের পতন ও রকমারি বিভ্রমাবেশ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আত্মিক শুশ্রুষার তাড়নায় হন্যে হওয়ার আভাস দিয়ে যায়। ব্যক্তি আমির এতদিনের চেনা আদলে নতুন বিপর্যয়ের সূচনা আশির মধ্যভাগে ক্রমশ অবারিত হয়ে উঠছিল আর ওদিকে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান প্রমুখরা পরিহাসের ভিতর দিয়ে একে কবিতায় জারিত করে নিচ্ছিলেন। নব্বই পরবর্তী শূন্য দশকের কবিতায় এর প্রভাব পড়েছিল বৈকি।


আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: