ছেলেবেলায় হস্তাক্ষর সুন্দর করার দৈনন্দিন রুটিন-প্র্যাক্টিসের কথা মনে পড়ে। প্রতিদিন লিখতাম পাতার-পর-পাতা, সাধারণত দৈনিক খবরকাগজের কলামগুলোর নির্বাচিত অংশ কপি করে যেতাম ঘাড় গুঁজে, টাস্কটা করতে দিতেন আমাদের ছোটচাচা, যাকে আমরা ডাকতাম এবং আজও ডাকি কাকা বলে। একই ঘাটে জল খেত বাঘে ও মহিষে, ঘেডি গুঁজে, উবু হয়ে, কাকার ভয়ে। এবং আমরা ভাইবোন গর্দনা নামায়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ ক্রন্দনসমেত নকল করে যেতাম তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতার ‘গাছপাথর’ ও ‘সত্যদর্শী’ ইত্যাদি শিরোনামের আদিকালিক কলামগুলো। মধ্যে মধ্যে যেত দৈনিক সংবাদও। দৈনিক বাংলাও।
ক্রন্দন, কেননা বাধ্য করা হতো ওই লেখালেখির কাজে, তখন জানালার গরাদ গলিয়ে আসছে ছাড়াবাড়ির ভিটে থেকে খেলা ও খেলোয়াড়দের বিবিধ শোর। সকলেই সমবয়সী খেলোয়াড়, প্রতিভাবান, এবং ভাগ্যবান, তাদের কারো বাড়িতেই কাকাত্রাস ছিল না। যার ফলে, এই-রকম আরও কিছু সঙ্গত কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হবার সুবাদে, সেই ছেলেবেলা থেকেই লেখার কাজটা আমার কাছে দুনিয়ার দুশমন একটা কাজ। খুব বাধ্য না-হলে অ্যাপ্লিক্যাশন ইত্যাদিও আমি চাইতাম আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বা এই-রকম কেউ লিখে দিয়ে যাক। ব্যাপারটা এইভাবেই চলে আসছে যা-হোক।
বড় হয়ে বেশকিছু বন্ধু জুটে যায় যারা লেখক, লেখালেখি করেন, অনেকদিন তাদের সঙ্গে একটেবিলে বসে আড্ডা দিয়েছি এবং চা-পানি ইত্যাদি খেয়েছি। কিন্তু একটা সময় তারা আমাকে লেখক বানাবার চেষ্টা শুরু করলে পরে আমি তাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করি। স্ট্র্যাটেজিক রিফিউজ, ফলে বন্ধুত্ব অটুট, বলা যায় একপ্রকার কৌশলগত প্রত্যাহার করে নেয়া নিজেকে, একধরনের ডিপ্লোম্যাটিক উইথড্রয়াল। লেখালেখির প্রতি এই আবাল্য ভীতি দিন-কে-দিন বেড়েছে বৈ কমেনি, উৎস সেই কাকাত্রাস। তবে এইটা ঠিক, কিছুকাল আমি খুব ধুমিয়ে দস্তখত তথা স্বাক্ষর মকশো করতে লেগেছিলাম, তখন আমাকে বলা হয়েছিল বড় হয়ে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হব এবং তথায় ক্যাপিট্যাল একটাই : নিজের নাম নানান মানের কাগুজে নোটে স্বাক্ষর করা। যার সিগ্নেচার যত শার্প তার গভর্নর হবার চান্স তত উচ্চ। তখনও শেখশির সম্বলিত সহস্র টাকার নোট বাজারের কল্পনাতেও ছিল না অবশ্য, তখনও অর্ধসহস্র তথা পাঁচশ টাকার মুদ্রাই বাজারে সর্বোচ্চ। তখনও কল্পনাতে ছিল না যে একদা এক যুগ অবতীর্ণ হবে যবে ফেসবুক নামীয় এক বিষয় পয়দা হবে এবং যথায় একধারসে নোট লিখে যাওয়া যাবে নিশীথে-দিবসে মনের হরষে। এই হলো, সংক্ষেপে, পরিস্থিতির বিবরণ।
ঘটনাটা হলো, আগে এত লিখে যেতে পারতাম পাতার-পর-পাতা, হাতের লেখার হোমটাস্ক, উইথ ছিঁচকান্না, তা আজকাল কান্নাও নাই লেখাও উধাও, কেন! দুই-তিনলাইন নোটের বেশি ইদানীং লিখতে কেন পারি না আর, ভাবলাম, ইনভেস্টিগেট করে দেখা দরকার। তখন, তৎকালে, অনায়াস লিখে যেতে পারতাম দুনিয়ার যাবতীয় অহেতুকতা নিয়ে — কেমন করে পারতাম! এর একটা উত্তর পেয়েছি ইদানীং খুঁজে। এবং, মনে হয়, এইটা আদৌ ফেলনা কারণ নয়। ইন-ফ্যাক্ট, লেখার লক্ষ্য অথবা গন্তব্য — যে-কোনো লেখার, হোক-না তা চিঠি কি চির্কুট অথবা খাটোছোট্ট কমেন্ট — পাঠক। লেখার সময় সেই শ্রীমতী কি শ্রীমানের, সম্ভাব্য ওই পাঠকের, মুখাবয়ব অনুপ্রেরণা হিশেবে কাজ করে লেখকচিত্তে, যার ফলে তরতরিয়ে লিখে যাওয়া যায়। এবং সেই সম্ভাব্য পাঠক ও সম্ভাব্য লেখকের মধ্যে কাজ করে এক বোঝাপোড়া; বোঝাপড়া উভয় তরফের যুক্তিশৃঙ্খলা, রুচি ও বোধানুভবের।
কোথাও-না-কোথাও দরকারি বিবেচিত হবে, অন্তত পঠিত হবে — এই সেই কারণ, যে-কারণে লেখাটার একটা নিদেনপাক্ষিক মান বা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়ায়ে যায় শেষমেশ। এই স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তি উভয় তরফের বোঝাপড়া, তাই ভাবের বিনিময় চলে, কোনো অন্তরায় বা ছেদ পড়ে না, বাধা বা বেগ পেতে হয় না এজন্যেই। সেই বোঝাপড়াটা কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হলে ভাববিনিময়ের মান ও পরিমাণ তথা কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটি যায় নেমে। এই লেখক হতে পারেন একজন মহাকাব্যকার বা নিদেন পত্ররচয়িতা, এই পাঠক হতে পারেন সাকুল্যে একজন অথবা আপামর জনসাধারণ।
মোদ্দা কথা, পাঠকের মুখ সামনে রেখে এবং অথবা পেছনে রেখে লেখা আগায়ে নেওয়া। বা পাঠকাশ্রয়ে লেখায় লেখায় লেখকের এগিয়ে যাওয়া। আর পাঠকমুখ দেখতে হলে চাই প্রকাশ। কোনো-না-কোনোভাবে, একজনের কাছে হলেও অন্তত, প্রকাশটা জরুরি। প্রকাশ ছাড়া প্রসব তো হতে পারে না। আর প্রসব মাত্রই প্রকাশের পথ খোঁজে। না-পেলে প্রসব বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা অপুষ্ট দুবলাপাতলা আঁতুড়েই মারা যায়। রৌদ্রালোক ও দখিনহাওয়া দরকার তো, মানবশিশুর, রচনারও। শর্তগুলো ফ্যুলফিল না-হলে ব্যাহত হয় বিকাশ ও প্রসব। বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। এইসব, ভাবতে ভাবতে, দেখি মেলা যায় ভেঙে, বেলা ভাটি লয়।
লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩
… …
- রিপ্রিন্ট রিফ্রেশিং - November 7, 2025
- কোচবিহার ও আব্বাসউদ্দীন - November 7, 2025
- দেবেশ রায়ের ফ্যাসিবাদের বিত্তান্ত - November 6, 2025

COMMENTS