রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্রসংকলন ‘ছিন্নপত্রাবলি’ পড়ার সময় খেয়াল করেছিলাম ব্যাপারটা। তারপর পারস্যযাত্রী-জাভাযাত্রী-জাপানযাত্রী প্রভৃতি ডায়রিতেও লক্ষ করেছি, কিংবা তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’, কিংবা আত্মস্মৃতি-জীবনস্মৃতি ইত্যাদিতে, ছেলেবেলা স্মৃতিচারণায়। ব্যাপারটা হলো, রবীন্দ্রনাথ কখন কী পড়ছেন না-পড়ছেন, কোন বইটা পড়লেন এবং পড়ে ইমিডিয়েটলি কি মনে করলেন, কোন বই পড়তে মন চাইছে ঠাকুরের কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না বাজার চষে, কোন বইটা পড়ে মেজাজ সপ্তমে গেল চড়ে ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো কথাটথা নাই। কিন্তু থাকাটা স্বাভাবিক ছিল না? তা, ঠাকুর সারাটা জীবন যতকিছু রচনা করে গেছেন, সবই তো তাঁর পাঠজাত দ্রব্য, নয় কি? বিলকুল সহি বাত; তবে এত সহি রিপ্লাই ইন-দিস্-রিগার্ড অভিপ্রেত নয়। কেন নয়? সেই কথাই তো কইছি, প্রিয়তমে! দ্যাখো বাপু, রবীন্দ্রনাথের বঙ্কিমবিবেচনা, আই মিন বঙ্কিমচন্দ্র পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া, মাইকেলবধ অথবা মেঘনাদপাঠের বিবরণী, অল্পবয়স অথবা বুজুর্গ উমর যা-ই হোক অনেক লেখা লিখেছেন তিনি ঠাকুরবাড়ির অন্দর থেকে ছেপে বেরোনো পত্রিকায় কিংবা বাইরের সাময়িকপত্রাদিতে, সেসব তো পঠনপাঠননির্ভর বুকরিভিয়্যু টাইপের অনেক লেখানুলেখায় ঋদ্ধ, সবই তো গুরুদেব একলা সামলেছেন হে! জ্বে, সে-ও আচ্ছা। তারপর ধরো গিয়া তোমার ওই, কি বলে, সেই যে, মেঘদূতম তথা কালিদাসপাঠান্তর অথবা আরও-আরও সংস্কৃত শ্লোককাব্য পড়ার পর সেইসব অনুবাদ ও সেসব বিষয়ে লেখা রচনা একাধারে, এন্তার বিদ্যাপতি অনুসৃজন, বিহারীলাল প্রমুখ নিয়া আলাপালোচনা, তারপর তোমার ছন্দ বিষয়ক তর্কবিতর্ক জিন্দেগিভর, এইসবই তো তাঁর পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়ামালা। তা, বিলক্ষণ। অথবা ঠাকুরের আজীবনের লেখাপত্রে উপনিষদের সুর তো তাঁর উপনিষদপাঠের ইন্টার্প্রিটেশন। রোম্যান্তিক ইংরিজি কবিতাপাঠের নজির তিনি তো অগোচর রাখেন নাই, বিস্তর অনুবাদ করেছেন, বিভিন্ন ভাবে ও ভঙ্গিতে ইনভেস্ট করেছেন সেসব অভিজ্ঞতা নিজের লেখায়। এটেসেট্রা। আমি এতটা গভীরতলে যাচ্ছি না, আমি চাইছি উপরিতলের তল্লাশি। দিনলিপি-স্মৃতিকথা ইত্যাদিতে এইসব ব্যাপার থাকা স্বাভাবিক ছিল, মনে হয়, রবীন্দ্রনাথে যা নাই প্রায়। এর পেছনের কারণ, পঠনাভিজ্ঞতার বিবরণ ডায়রিতে না-থাকার কারণ, অনুসন্ধান করছি না এখানে। কেবল বলতে চাইছি অনুপস্থিতির কথাটা। মার্জিনে মন্তব্যাকারে এসব প্রেজেন্স অভিপ্রেতই ছিল। নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে গেলে একটা বিপদ হবে এমন যে, বেশিরভাগ বক্তব্য হয়ে পড়বে সম্ভাব্য কারণ অথবা পশ্চাৎপট, আভিপ্রায়িক তথা অভিপ্রায়-অনুসন্ধানমূলক, বইপাঠোত্তর অ্যাক্নোলেজ না-করার পেছনে রবীন্দ্রনাথের কি ইন্টেনশন কাজ করে থাকতে পারে, একটা বই পড়ে রবি কেন সেইটে এন্ডোর্স করেন নাই সে-মর্মে একটা আন্দাজ। কোনো কাজের পেছনে একজনার অভিপ্রায় কি ছিল না-ছিল তা সার্চ করা উচিত কি অনুচিত, সেইটা আগে মীমাংসা করে নিতে হয়। সেইদিকে এখন না-যাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ননফিকশন্যাল রাইটিংস্ পড়ে যেইটা মনে হয় যে, তিনি ফ্রম দ্য বিগিনিং বুঝিবা জানতেন যে এসব অচিরেই ছাপা হবে। একটা চিঠি লিখতে গেলেও তিনি নিশ্চয় সে-বিষয়টা, ছাপাযোগ্য করে তোলানোর বিষয়টা, মাথা থেকে ঝাড়তে পারতেন না। আপনি ছিন্নপত্র ইত্যাদি পড়তে গেলে দেখবেন, অথবা তাঁর ডায়রি কি মুসাফিরকালীন/সফরকালীন চিঠিগুলো, সবই যেন গোছানো সুসজ্জিত-সুচিন্তিত রবিরচনা, সাহিত্যকর্ম যাকে বলে। এর ফলে অসতর্ক অভিযানের যে-একটা চার্ম, অপরিকল্পনার যে-একটা উদ্ভাস ও উল্লাস, সেইটা পাওয়া যায় না। আমি অ্যাট্-লিস্ট এই ব্যাপারটা মিস্ করি রবীন্দ্রনাথের জর্নালধর্মী লেখাগুলো পড়তে যেয়ে। এ-বিষয়ে বারান্তরে বাড়ায়া বলার বাসনা রাখি।
লেখা / জাহেদ আহমদ
… …
- মধ্যনগরে বঙ্গাব্দবরণ ১৪৩২ || বিমান তালুকদার - April 18, 2025
- অতি সাধারণ ঋণ বা ন্যানো ক্রেডিট || হুমায়ূন আকাশ - April 17, 2025
- গাজায় মৃত শিশুর ভর্ৎসনা || মোহাম্মদ জায়েদ আলী - April 12, 2025
COMMENTS