মায়াময় গ্রামের নিস্তব্ধ রাতে কোনো-এক কার্তিকের ভরা পূর্ণিমা। বাঁশ কিংবা হিজলের পাতা বেয়ে ঝরে-পড়া চন্দ্রগর্ভা একআকাশ জ্যোৎস্নার হাতছানি আমাকে দেয় হাজার মনুষ্যের আরাধিত অমরাবতীর তীরে রূপকথার স্বর্গনগরীর সৌন্দর্য। আমি অনুভব করি ধরণীর চেয়ে নাহি কিছু মোহময়। আমি চন্দ্রগ্রস্ত হই, আঁজলা ভরে মহুয়ার মতো আকণ্ঠ আস্বাদন করে চলি উন্মত্ত-যৌবনা জ্যোৎস্নার সান্নিধ্য। ধীরে ধীরে মোহাবেশ থেকে হয়ে যাই মাতাল। বাঁধা পড়ি কার্তিকের রাতে নগ্নপায়ে চুপিচুপি ঝরে-পড়া জ্যোৎস্নাস্নাত ভরাপূর্নিমার প্রেমে আজন্ম।
আমাদের ছেলেবেলায় কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমা ছিল শত রজনীর মধ্যে আরাধ্য এক রজনী — যে-রজনীতে থাকত না সন্ধ্যায় পড়তে বসার তাগিদ, থাকত না সন্ধ্যা গলিয়ে রাত হয়ে গেলেও ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য মায়ের কঠোর আদেশ। শেষ আশ্বিন অথবা কার্তিকের প্রারম্ভে এই কোজাগরী পূর্ণিমায় আকাশপ্রদীপের মতো জেগে থাকতাম আমরা সারারাত। শাসনহীন এই চাঁদনী রাত ছিল চুরির রাত — যে-রাতে ফল চুরি করলে মিলত পুণ্যি, ছিল চিড়ে-নারকেল আর গুড়ের মিশ্রণে অমৃতময় নাড়ু, ছিল লুচি আর সুজির হালুয়া, ছিল খিচুড়ি-লাবড়া, ছিল আড্ডা, ছিল হৈহুল্লোড় … ছিল অদম্য শৈশব।
এই রাতে বাগানের ফল চুরি করলে নাকি অনেক পুণ্য হয়। আশেপাশের হিন্দুবাড়ির লোকজন আগে থেকেই পাহারা বসিয়ে রাখতেন আমাদের মতো পুণ্যান্বেষী চোরদের হাত থেকে বাগানের ফল রক্ষা করতে। আর মায়েরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন প্রেমান্বেষী অর্বাচীন প্রেমিকের দিকে। তবুও একচুমুকের দৃষ্টিবিনিময়ে মোক্ষলাভ করত দুর্দম প্রেমিক। সারারাত জাগরণ আর হরিনামসংকীর্ত্তন শেষে ভোররাতের লাল সূর্যের সাথে কাঁসার থালার মতো চাঁদের মিলন তৈরি করত পৃথিবী আর অমরাবতীর এক মৈত্রীবন্ধনের।
দিন বদলেছে। এখন আর হয়তো কেউই লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাত জাগে না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিড়া আর নারলেকের অদ্ভুত মিশ্রণে তৈরি নাড়ু খেয়ে অদ্ভুত আনন্দে ঢেঁকুর তোলে না। বাতাবিলেবু (জাম্বুরা) অথবা ডাব চুরি করে লাভ করে না চরম আনন্দ। শত বাধা উপেক্ষা করে কৈশোরপ্রেমের মানুষটির দিকে দৃষ্টিবিনিময় করে তুমুল উত্তেজনায় আন্দোলিত হয় না আপাদমস্তক। আমরা আসলে ধীরে ধীরে যান্ত্রিক থেকে অতিযান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। নষ্ট হচ্ছে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সামাজিক মূল্যবোধ। নানা ধরনের বৈরিতা কেড়ে নিচ্ছে বর্তমান শৈশব আর কৈশোরগুলোকে।
আজকের বেশিরভাগ শিশু বড় হচ্ছে কৈশোর এবং শৈশববিহীন এক সময়ের মধ্য দিয়ে; যাদের থাকবে না স্মৃতিচারণা করার মতো কোনো শৈশব কিংবা কৈশোর। আমি আচ্ছন্ন হই, ধীরে ধীরে এক অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে। একটি শিশুর শৈশবের আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করতে আমরা কি আসলেই কোনো ভূমিকা রাখছি? চন্দ্রাহত এই আমার অনুভবে একটি ছোট গ্রাম, সর্পিল ছন্দে এঁকেবেঁকে বহে যাওয়া দেওরভাগা নদী আর তার কূল ঘেঁষে একই ছন্দে বুড়ো অজগরের মতো একটি রাস্তা। রাস্তার একদম শেষমাথায় নদীর কূল ঘেঁষে একটি মাঠ আর মাঠের ঠিক উত্তরকোনায় একটা ছোট টিলা হাজারকোটি ভরাপূর্নিমা পার করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদারের মতো গ্রাম, মানুষ, মাঠ, নদী, রাস্তা আর প্রকৃতিকে রক্ষার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
স্বার্থপরের মতো শুধুই নিজের কথা বলে চললাম, কিন্তু জ্যোৎস্নাপ্রেমে আচ্ছাদিত ধরণীর কথা যে না-বললেই নয়। প্রতিপদের দিনান্তে জন্ম-নেওয়া চন্দ্রগর্ভা দস্যিমেয়ে একচিলতে জ্যোৎস্না ধীরে ধীরে পূর্ণ যৌবনবতী হয় ভরাপূর্নিমায়। প্রেমান্ধ বামুন ধরণী হাজারকোটি বছর হাতছানি দিয়ে ডেকে গেল তাকে প্রতিটি পূর্ণিমারাতে। কিন্তু মায়াবতী দস্যিমেয়ে জ্যোৎস্না ফিরেও তাকাল না। শুধু তার মহুয়ার আবেশে লক্ষকোটিবার দগ্ধ করে গেল ধরণীকে পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমান্তর। হায়! জ্যোৎস্নাহত ধরণী তবু না ছাড়িল আশা, না ছাড়িল চাতক প্রেমের আবেশ। জীবনানন্দের নির্মোহ প্রেমের কবিতার খাতা বুকে চেপে সঞ্চিল সাহস সমুদয় … হায় প্রেম ভালোবাসিতে যে জানে …
… …
ছবিকৃতজ্ঞতা : মারুফ অমিত স্টিশন
- দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী - October 5, 2019
- ঠাকুরবন্দনা || অসীম চক্রবর্তী - August 9, 2019
- জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী - August 1, 2019
COMMENTS