বাংলাদেশ, ব্যান্ডসংগীত ও আইয়ুব বাচ্চু || সত্যজিৎ সিংহ

বাংলাদেশ, ব্যান্ডসংগীত ও আইয়ুব বাচ্চু || সত্যজিৎ সিংহ

তারা বলে, “অবশ্যই শাস্ত্রীয় সংগীত জানতে হবে। যারা সারেগামা জানে না, তারা আবার কিসের শিল্পী। লেখক হতে চাইলে প্রচুর পরিমাণে বই পড়তে হবে। মঞ্চনাটক না করলে তুমি অভিনয়ে টিকতেই পারবে না”। বছর ষোলো-সতেরোর কোনো তরুণ যদি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো হেয়ারকাট করে তারা তখন ছিছি করে উঠবে। আড়ালে গিয়ে পৃথিবীর সমস্ত হতাশা মাথায় চাপিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেব লবে, “ছেলেটা পুরাপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। দ্যাখো না, কেমন বিশ্রীভাবে চুল ছেঁটেছে! এদেশে জমিদারি শাসন বৃটিশ শাসন পাকিস্তানি শাসন সামরিক শাসন …  সময়ের কত পরিবর্তন হলো, কিন্তু মানুষগুলির সেই উপনইবেশিক মানসিকতার কোনো চেঞ্জ আসলো না।

সম্ভবত ২০০৫/২০০৬ সালের ঘটনা ছিল। সে-সময়ের টিভিঅভিনেত্রী শ্রাবন্তী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অভিনয় শেখার জন্য একমাত্র মঞ্চনাটকই জরুরি নয়। বাপ রে বাপ, তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রাবন্তীর উপর কত বিষোদাগার করা হলো! ঢাকার বর্ষীয়ান অভিনেত্রী থেকে শুরু করে মফস্বলের মার্ক্সবাদী গানের মাস্টার — শ্রাবন্তীকে নিয়ে কত কচলাকচলি করল!

২.
ক্ল্যাসিক মানেই অন্যরকম, এটা সর্বোত্তম। আর বাকিগুলো খাল্লিবাল্লি, মানে প্রায় আবর্জনা। এই নীতিটি খুব বেশি মানতেন বুদ্ধদেব বসু। উনার কাছে বিষয়টা ছিল এ-রকম, যেমন নরনারীর মিলনকালে স্তনে হাত দেয়া যাবে না। কেবল প্রেমিকার ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে দাও। স্তনে হাত দেয়া মানে অসভ্যতা করা। বেশি ক্লাস খুঁজতে গিয়ে আজ দেখো বসুবাবু কোন মড়ার চিপায় ঠেসে আছেন। আর সে-সময়ের অসভ্য অশিক্ষিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সমরেশ বসু কোথায় পৌঁছেছেন। যারা সেদিন বলেছিলেন মঞ্চনাটকই অভিনয়ের জরুরি মাধ্যম, আজ এইসময়ে তাদেরই একজন শ্রীমান জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলতে বাধ্য হয়েছেন, অভিনয়ের জন্য মঞ্চই একমাত্র জরুরি মাধ্যম নয়। টিভিতে কাজ করেও ভালো অভিনেতা হওয়া যায়।

“লেখক হতে গেলে প্রচুর বইপড়া জরুরি” — এটা একদম বানোয়াট কথা। পৃথিবীতে বহু বড় লেখক আছেন যারা কেবল সারাজীবনে ওই কয়েকটি বইই নাড়াচাড়া করেছেন। কত পণ্ডিত তো পড়তে পড়তে লাইব্রেরির সমস্ত বই ধ্বংস করে ফেলেছে, কিন্তু একপাতা লিখতে বলো, গরুর মতো ড্যাবড্যাব করে আশপাশ তাকাবে আর কলম কামড়াবে। লেকিন লেখা আর হবে না।

৩.
এদেশের ব্যান্ডগানগুলোকে এরা কখনো স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের চোখে কেবল সারেগামা থাকলেই সংগীত হবে। এদের সাথে লড়াই করে করে আজকের আইয়ুব বাচ্চু আর জেমসরা তৈরি হয়েছেন। তারা কোত্থেকে একটা শব্দ খুঁজে পেয়েছে, সেটা হলো  ‘চিরকালীন’। চিরকালীন শব্দটা একটা অবৈজ্ঞানিক এবং কল্পনাপ্রসূত আমদানি। প্রত্যেক সৃষ্টিই তার সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে। এখন মান্না দে আর জগন্ময় মিত্রের গান শুনলে চোখে ক্লান্তি চলে আসে। কিন্তু তারা সেটা আপনাকে চাপিয়ে দেবে। আপনি আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনলে আপনাকে তারা বলবে ক্ষ্যাত। আপনি যদি বলেন জ্যাক লন্ডনের কথা, তারা ঠোঁটে তাচ্ছিল্য এনে বলবে জ্যাক লন্ডন তো বাসড্রাইভার। সে কি তলস্তয়ের মতো ক্ল্যাসিক নাকি!

৪.
ঠিক উপরের বর্ণিত বাস্তবতায়, এই হযবরল অর্থোডক্স সামাজিক ও সাংগীতিক কূপমণ্ডূকতায়, আইয়ুব বাচ্চু লড়ে গেছেন তার গলা ও গিটার দিয়ে, এবি ও তার জেনারেশনের সতীর্থ রকমিউজিশিয়্যানরা বাংলায় একটা আগন্তুক সংগীতঘরানা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। শস্য কতটা ফলেছে এই বিচারমূলক তর্কে লিপ্ত হবার আগে যেন লড়াইটা স্বীকার করি সকলে। দেখব তখনই যে এই লড়াইয়ের চিহ্ন নয়া বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। কেবল মিউজিকেই নয়, ব্যান্ডম্যুভমেন্টের ইমপ্রিন্ট বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং সমাজের সর্বত্র বহুধাবিস্তৃত ছড়িয়েছে। এবির প্রয়াণে এই হিসাবনিকাশ করার তাগিদটা আমরা নানাভাবেই বোধ করব আজ এবং আগামী দিনগুলোতে।

এবি এবং তার সময়ের মিউজিশিয়্যানরা বাংলাদেশের অগ্রসরণে যে-অবদান রেখেছেন, বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে-প্রভাব রেখেছেন তাদের মিউজিকের মাধ্যমে, এই স্বীকৃতি জীবদ্দশায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে না-পেলেও গত তিনদশকের শ্রোতাদের কাছ থেকে পেয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চুর অতি অকালে এই প্রস্থান যেন বাংলাদেশের মিউজিক অ্যারিনায় নিরীক্ষানিষ্ঠ সংগীতজীবীদের উদ্যমী ও অনুপ্রাণিত করে, এইটুকুই আপাতত চাওয়া।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you