গিটারকফিনে শায়িত ব্লুজের বেদনা ও বিদ্রোহ || প্রবর রিপন

গিটারকফিনে শায়িত ব্লুজের বেদনা ও বিদ্রোহ || প্রবর রিপন

আইয়ুব বাচ্চুর সাথে আমার কখনো দেখা করতে যাওয়া হয়নি; আজ যখন প্রথম দেখা করতে গেলাম, দেখা হলো তার লাশের সাথে। কী ভয়ানক শীতল চোখ! যেন সমুদ্রের নিচে ডুবে-থাকা শ্যাওলাধরা এক গিটার, যা আর বাজাতে পারবে না কেউ। গিটারকফিনে যেন শুয়ে আছে এক গিটার!

আমার মাথায় এই যে ব্লুজের কালো ভূত, এটা তো সেই-ই শৈশবে ঢুকিয়েছিল মাথায়। সেই পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট ক্যাসেটপ্লেয়ারের ভেতর থেকে যেন আমাকে বলত, “শোনো, যে যা বলুক, আর আমি যে-দেশেরই হই না কেন, যা-ই হোক না কেন আমার ঐতিহ্য, ব্লুজ বয়ে চলেছে আমার নাড়িতে, আমার রক্তে। আর যদি ঐতিহ্যের কথা তোমরা বলো, আমি ফিরে যাব সেই আফ্রিকায়, আমার নিয়ান্ডার্থাল সহোদরদের কাছে, যারা দাস হয়ে পরে তাদের অফুরন্ত বেদনায় গেয়েছিল আফ্রো-অ্যামেরিকান ব্লুজ, সে-বেদনা তো আমাদেরও, এমনকি এই ধুরন্ধর কলোনিয়াল বাস্তবতাতেও। দাসের মুক্তির জন্য দাসেদের হৃদয়ের গান ছাড়া আমি আর কি গান গাইতে পারি? এই যে সংস্কৃতির ধ্বজাধারীরা, ব্লুজকে তোমরা যদি বলো অ্যামেরিকান মিউজিক, দূর পাশ্চাত্যের কলোনিয়াল মিউজিক, তাহলে আমি তো বলব এটা আমার কাছে টমাস আলভা এডিসনের আবিষ্কৃত সেই বিদ্যুতের মতো, যা দিয়ে এই বাংলার অন্ধকারে জ্বালিয়েছি আলো।”

কী ভয়ানক ঠাণ্ডা শীতল সেই চোখ! সে-চোখ কি শীতল হয়েছে উপেক্ষায়, অপমানে, গ্লানিতে? পুরো জীবন ধরে এত পরিশ্রম শেষে এদেশ কাউকে উপেক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক; তা কি সে জানত না? অবশ্যই জানত, কিন্তু বিশ্বাস করতে চায়নি, কেননা সে তো জানত, অজস্র রাতের পরিশ্রম শেষে এক বোবা গিটার কীভাবে গেয়ে ওঠে স্বাপ্নিক গিটারিস্টের হাতে, কীভাবে গিটার ফিরিয়ে দেয় তার প্রতিবিন্দু ঘামের পুরষ্কার।

আরে, এদেশের মানুষ কি গিটার নাকি, যার ছয়তার একসাথে নেচে ওঠে — একটা তারের সাথে আরেকটা তারের কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাড়াই!!!

হায় বিনোদনজগৎ আর তার ব্যবসায়ীরা! একেকজন শিল্পীকে ধরবে তারপর রক্তচোষার মতো সব রক্ত চুষে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে নর্দমায়, আর ছুটবে নতুন কোনো শিল্পীর দিকে, তাদের বাজার টিকিয়ে রাখতে, আর বলবে নয়া বাজার এই নয়া মাল চায়!!

হায় হনুমানের দল, শিল্প কি একটা দশকের ব্যাপার? শুনেছি ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে মোৎজার্ট। কোথায় গেল তোর হাল-আমলের জাস্টিন বিবার!!!

এত পরিশ্রম করে যারা এমন এক অচল দেশে সৃষ্টি করল পৃথিবীর অন্যতম সেরা রক্ মিউজিকজগৎ, তাদের কি দিলে তোমরা? ফেসবুকে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, টিভিতে হৈ-হুল্লোড় আর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে একটু শোক প্রকাশ করলেই দায় মিটে গেল!?

এত পরিশ্রম শেষে এমন উপেক্ষা দিলে, হাসিঠাট্টা করলে তাকে নিয়ে; তার ফলে সৃষ্টি হলো যে মানসিক অবসাদ, এত দ্রুত তার হৃদযন্ত্র থেমে যাবার পেছনে তার কি কোনো ভূমিকা নেই!!!

মনে করে দেখো আজম খান, লাকী আখন্দ — আরও অনেকের কথা, তাদের সাথে কি করেছিলে!

এমনই কি চলতে থাকবে, কতদিন কতরাত কতসময়!!!!?????????

রাষ্ট্রীয় কোনোকিছুতে আমার বিশ্বাস নেই, সত্যি আমি আর তেমন কিছু আশাও করি না এই দেশের কাছে; — কিন্তু যেহেতু দেশের পরবর্তী প্রজন্ম এর মাধ্যমে জানবে , কিভাবে যার যা প্রাপ্য তা-ই ফিরিয়ে দিতে হয় আর তা ফিরিয়ে দিলেই তুমি পেতে পারো তোমারও প্রাপ্য। তাই আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার দাবি করেছি, — মানুষ জানুক একটা গিটারের রাজনীতি, কীভাবে তা আপাতদৃষ্টে ভিন্ন ভিন্ন মগজকে দাঁড় করায় এক মাস্তুলে, আর সেই মাস্তুল যে পৃথিবীর মুক্তির জাহাজের মাস্তুল; — যে-জাহাজ চলেছে দিগন্তে শেকল-দিয়ে-বাঁধা সূর্যের দিকে সূর্যকেই মুক্ত করতে। কিন্তু কি হলো?

আহ্! ভুলতে পারছি না সমুদ্রের তলে ডুবে থাকা সেই ঠাণ্ডা শীতল শ্যাওলাধরা গিটার; কফিন থেকে ভয়ানক বিস্ফারিত চোখের মতো যা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, যারা আমরা এখনো বেঁচে আছি তার মৃতদেহ ঘিরে।

কাউকে ভালোবাসলে সেটা জানাতে হয় তার মৃত্যুর আগে, তাকেই বলে ভালোবাসা; — তাতে হয়তো বেড়ে যায় তার আয়ু, আর সেটা যেহেতু পারলাম না, মৃত্যুর পরে প্রায়শ্চিত্তে আর কৃপণ থেকো না ধরণী!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you