ম্যাজিশিয়্যানের জন্মদিন ও অন্যান্য

ম্যাজিশিয়্যানের জন্মদিন ও অন্যান্য

তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই আমাদের কৈশোরের ম্যাজিশিয়্যান। কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণবেলারও? অনেকের ক্ষেত্রে, অধিকাংশ তরুণবয়স-পারানোদের ক্ষেত্রে, এ-ও সত্য। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ দেহ রাখলেন ছয় বছর হয়ে গেল। ১৯ জুলাই ২০১২ খ্রিস্টাব্দে দেহহীন হুমায়ূনের অনন্তযাত্রা। ষাটোর্ধ্ব বয়সে তাঁর এই প্রস্থানদৃশ্য, কোথাও যেন তবু খুব হাহাকারের মতো, উনার ইন্তেকালের পরে পেপারে-টেলিভিশনে যে মাসজোড়া মাতম চলেছিল সেই কারণেই নয় শুধু। ‘বড় বেদনার মতো’ চোখে ভেসে এল নওল পাঠক হিশেবে সেই দিনগুলোতে একাদিক্রমে হুমায়ূনপ্রণীত কাহিনি পাঠকালীন আমাদের ঝাপসা-প্রায় স্মৃতি। কিংবা ঝাপসাও নয় ঠিক, জ্বলজ্বলে, হীরেদ্যুতিকীর্ণ। ছোট্ট করে বলে রাখি এখানে যে, আর-দশপনেরো জনপ্রিয় পথুয়া সাহিত্যিকের সঙ্গে হুমায়ূনের তফাৎ ও তাৎপর্য স্পষ্ট ছিল সবসময়। সেই স্পষ্ট তফাৎ ও তাৎপর্যটুকু তো অবগুণ্ঠিত, অগোচরে রয়ে গেল আমাদের আজও। কোনো সমালোচক, কোনো আলোচনাশাসক, আজোবধি এই দিকটাতে দৃষ্টি দিলেন না। তারা তা দেবেন বলেও ভরসা পাই না। তাঁর কোনো সমালোচক ছিলও না প্রকৃত প্রস্তাবে, ছিল একঢল স্তাবক ও নিন্দুক শুধু। তিনি নিজেও তো দায়ী ছিলেন এই পরিস্থিতির জন্য, হুমায়ূনের দিনযাপনচিত্র তো আমরা মিডিয়াবাহিত দেখে আসছি ইন-ডিটেইলস্ গত দুইদশক ধরে, অনুমান করতে বেগ হয় না যে তিনি বিদূষকবেষ্টনী প্রেফার করতেন। হয়তো দরকারও ছিল এসবের, এই বিদূষকবেষ্টিত থাকবার, নইলে এখানে চামচিকে ঠেকাতে যেয়ে স্ট্যামিনা খোয়াতে হতো তাঁরে। যেন অনেকটা আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী অবস্থা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। তাঁর প্রস্থানোত্তর সর্বত্র হুমায়ূনবন্দনা আর হুমায়ূনশোক প্রমাণ করে যে, এই ক্ষুদ্রঋণজর্জর সজোরে-গরিব-করে-রাখা দেশের সাক্ষর-অনক্ষর নির্বিশেষ মানুষেরা কাহিনিকিসসা-নাটকপালা-বাংলাসাহিত্য কতটা ভালোবাসে। হুমায়ূনহীন পৃথিবীর প্রথম হপ্তাদশদিন জুড়ে বাংলাদেশের সর্ববিধ গণমাধ্যম ছিল হুমায়ূনময়। এইটা আদৌ অভাবিত ও অস্বাভাবিক ছিল না তাঁর ক্ষেত্রে, — একটা জাতিকে একটানা তিরিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে নাক্ষত্রিক আনন্দে-বেদনায় ভরিয়ে রেখেছিলেন যিনি। কিন্তু বক্ষ্যমাণ এই নিবন্ধ কোনোভাবেই লিট্যারারি ক্রিটিক নয়, আদৌ হুমায়ূনরচনাশৈলীর মূল্যাঙ্কন নয়, সেই ক্রিটিক ও মূল্যসংযোজনী নিবন্ধপ্রবন্ধাদি নিশ্চয় লিখিত হবে একদিন। এই রচনার অভিপ্রায় বরং, বলা যায়, সেলিব্রেইটিং লাইফ উইথ হুমায়ূন আহমেদ।

গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে বেড়ে-ওঠা আজকের গায়েগতরে-যুবা মানসিকভাবে-বুড়ো প্রত্যেকের একটা করে ব্যক্তিগত হুমায়ূন যেমন আছে, তেমনি আছে একেকটা পারিবারিক হুমায়ূন। যৌথস্মৃতিজাত হুমায়ূন। সপরিবার সানন্দ পড়ার মতো রচয়িতা ও রচনাপত্র দুনিয়ার অন্যান্য ভূখণ্ডে বিস্তর থাকলেও বাংলায়/বাংলাদেশে এক হুমায়ূন ছাড়া হারিকেন জ্বালাইয়া খুঁজলেও দোসরা রাইটারের পাত্তা পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগত হুমায়ূন নয়, পারিবারিক হুমায়ূন। মোদ্দা কথা, আমাদের হুমায়ূন। মানে, আমাদের ভাইবোনকাজিন-কলকাকলিত যৌথ উনোনের একান্নবর্তী পারিবারিক হুমায়ূন, — আমাদের পাড়াতো বন্ধুদোস্ত ও সহপাঠীদের হুমায়ূন, আমাদের আউটবই পড়াপড়ি ও বিটিভিনাটক দেখাদেখির দিনগুলোর হুমায়ূন। এইধারা আরও কিছু খুচরো কথা ও স্মৃতির বিক্ষেপ নিয়ে গড়ে-ওঠা আমাদের হুমায়ূন, অত্যন্ত অপরিকল্পিত কয়েকটা বাক্যালাপে এই নিবন্ধ, অথবা আমার হুমায়ূন।

খুবই ব্যক্তিগত জগতের হুমায়ূন। ওই যেমন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-নজরুল নিয়ে লেখা হয়ে থাকে আমার রবীন্দ্রনাথআমার জীবনানন্দ … ইত্যাদি, ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনপড়ুয়া পাঠক-লেখক লিখে থাকেন এইধারা রচনা। আজকাল আমার শঙ্খআমার শক্তিআমার সুনীলও লেখা হচ্ছে — এই সিরিজপ্রবাহক জয় গোস্বামীর চটিপুস্তিকাগুলো পড়েছি। কিন্তু অবিকল ওইরকম তো লিখতে পারব না, পারলে তো খুব কাজের কাজ হতো, গাড়ি কিছুটা ধাক্কাঠেলায় ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে এলোমেলো গতিতে চলবে। এই নিবন্ধে। এবং অনিয়মিত ও খোঁড়া আলাপেই। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসই নিয়মিত নয় আমার ও আমাদের জীবিকাযাপনের জান্তব প্রতিক্রিয়া আর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায়, বলে কিনা লেখায় নিয়মানুবর্তিতা! গরিবের আবার রেস্পিরেটোরি সিস্টেম আর ব্লাড সার্কুলেশন!

হুমায়ূনসাহিত্য লইয়া লেখার একটা চাল্লু ও সবচেয়ে এস্ট্যাব্লিশড দস্তুর হলো, প্রথমে ঝেড়ে গালিগালাজ করে নেয়া। না-হলে লেখা হালে তো পানি পাবেই না, পাঠক লেখাটা-যে হুমায়ূনরচনা নিয়া তা বুঝতেই পারবে না। স্বাভাবিক। যে-দেশে ও যে-ক্ষেত্রে যেমন। যস্মিন দেশে যদাচারকার্য। তবে এই জায়গায় একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো, সময় ও সমাজটা এখন যতটা-না আমার ও আমাদের, তারচেয়ে বেশি আমার ও আমাদের সন্তানদের। আমি যেমন হুমায়ূন পড়ে বেড়ে উঠেছি, তেমনি আমার মেয়ে এখন হুমায়ূন পড়ে এমনকি ক্লাস্-এক্স্যাম ভুলে! আমার মেয়ে মানে, আমার সহকর্মীর মেয়ে, আমাদের ছেলেমেয়েরা। যেমন, ধরা যাক, নুদরাত নাওফা ফিমা। হাইস্কুলপড়ুয়া। নাওয়াখাওয়া আর নানাদেশি আইডল দেখা ভুলে যায় নতুন হুমায়ূন পেলে। কিংবা আমাদের ছেলেদের মধ্যে যেমন প্রতীক বৈদ্য, উচ্চমাধ্যমিকপড়ুয়া, পাঁড় হুমায়ূনপাঠক। ফলে, মুশকিলটা এখানেই যে, লেখা জাতে তোলার অনায়াস কৌশল হলো বুঝে-না-বুঝে গিমিক তথা আন্দু বকাবাদ্যি — কিন্তু এসব করে এই নতুনদিনের সন্তানদের সময় ও সমাজে শান্তিতে গৃহবাস হবে না আশঙ্কা করি, তাই ব্র্যাভো রচয়িতা হওয়ার রাস্তাটা আপোসে ছেড়ে সহজ মানুষের সহুজে স্মৃতিচারণের লাইন নিলাম। আবার এ-ও ভাবলাম যে, এছাড়া আমার তো কোনো উপায়ও নাই। নিজের গড়নকালটাকে, ছেলেবেলাটাকে, নিজের টুটাফাটা লেখাপড়ার শুরুসময়টাকে তো অস্বীকার করতে পারি না ভায়া! আর-যা-ই-হোক, কৈশোর-তারুণ্যের সেই দিনগুলোর সঙ্গে তো বেইমানি করতে পারি না। তা যদি করি, তো মহাপাতকী ক্রিয়াকাণ্ড হবে সেটা। যা-হোক, প্রচারতেল্লাই পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এক আনিসুল হক মশাইকে দেখেছি অকপট স্বীকারোক্তি দিতে যে তিনি বেড়ে উঠেছেন হুমায়ূনকাহিনির চিনচিনে ব্যথা ও কথার ঘোরলাগা হাওয়ায়। আনিসুলের দুই-তিনটা বইয়ের থেকে দৈবচয়িত কয়েকপ্যারা পড়ে দেখেছি যে উনি আসলে হুমায়ূনটাও রপ্ত/হজম করতে পারেন নাই ঠিকমতো, করতে পারলে এত গোবরল্যাজে বেহাল হতেন না মার্কেটে। ব্যাপারটা তাহলে এই আমার ক্ষেত্রেই কেবল নয়! সেইটাই। চরৈবেতি।

কিছুদিন আগে যেই ঈদ গেল, রোজাঈদ, লোক্যাল পত্রিকাবিক্রেতাদের ছাউনিতে গেছিলাম একটা মার্কেটসার্ভে করবার উমিদ নিয়া। ছাব্বিশ নাম্বার রোজারাইতেও উনাদের বেচাবিকি আঙুলে গুনে দেখার জোখা কিছু হয় নাই জানাইলেন। কারণটা কি? তিনজনকে একই জিজ্ঞাসা আলাদা-আলাদাভাবে করে একই রিপ্লাই পেয়েছি বিরক্ত ও হতাশ কণ্ঠস্ফুরিত, হুমায়ূনমৃত্যুর পরে ঈদসংখ্যা পাঠকে কেনে না। বাজারে যেসব ঈদসংখ্যা আসে সেগুলো সবই বিজ্ঞাপনে ভরা, কাহিনি নাই, জ্ঞানের কথাবার্তাও নাই। কি আছে তাইলে? তেরো থেকে সতেরো উপন্যাসলেখকের নাম ও সংখ্যা আছে বিজ্ঞাপনাচ্ছাদিত মলাটের রঙঢঙা ম্যাগাজিনে। কেনা তো দূর, হাতাইয়াও দেখে না পাঠকে। এই কারণেই ঈদমৌসুমের বাড়তি সংসারখর্চা আর্ন করতে পেপারবিক্রেতারা এই সিজনে পেপারটেবিলে জামাজুতা বেচতে শুরু করেছেন গত কয়েক বছর ধরে। এই চিত্রটা স্বচক্ষেই দেখলাম। অনেকদিন বাদে চেনা জায়গায় গেছি, কিছু খাতিরতোয়াজও জুটে গেল নসিবে সেই সুবাদে। একপেয়ালা কার্টেসি টি পান করে থ্যাঙ্কয়্যু টোনে আরও কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে ডেরায় ফিরলাম।

নদী পারানোর সময় মাথায় এল কথাটা, বাংলাদেশে এত ‘কবিসাহিত্যিক’, কয়েক লক্ষ তো হবেই, কোটিও হতে পারে কয়েক, এরা কেউই কি লিখছে না? খালি ‘কবিসাহিত্য’ করে বেড়াচ্ছে সবাই? কিন্তু সকলেই লিখছে তো দেখতে পাই রোজ। সত্যিই কি এইগুলা পাঠকে হাতাইয়াও দেখে না? পাঠকের পেটে না-যেয়ে লেখাগুলো কই যায়? পিঁপড়ার পেটে? একটা গায়েবি রিপ্লাই এল : মহাকালে!

আমি চিন্তামুক্ত নদী পার হলাম।

রচনা :  জাহেদ আহমদ

… …

 

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you