‘মেঘদল’-এর কথা বলার জন্য আমাকে একটু পেছনে তাকাতে হবে। সেইটা ২০০৬ সালের কথা। আমি তখন পুরোদমে ছাত্র ইউনিয়ন ময়মনসিংহ জেলা কমিটিতে রাজনীতি করি। সেই সময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ফেব্রুয়ারিতে। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে ময়মনসিংহ থেকে সদলবলে ঢাকায় আসলাম। উদ্বোধনী দিনে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছাত্র ইউনিয়নের আমন্ত্রিত ব্যান্ড ‘চিৎকার’ আর ‘মেঘদল’। দুইটা ব্যান্ডের গান আমি সেবারই প্রথম শুনি। চিৎকারের কয়েকটা চমৎকার গান শোনার পর (যার মাঝে একটা ছিল ‘হাট্টিমাটিমটিম লইয়া গবেষণা চালাইছে’) মেঘদল মঞ্চে দাঁড়ায়। সেই আমার মেঘদলকে চেনার শুরু। যা এখনও ধারাবাহিক।
সেইবার মেঘদল ‘ওঁম’, ‘ক্রুসেড’ সহ চার-কি পাঁচটি গান গায়। বায়োস্কোপের নেশা আমার যেমন ছাড়ে না, তেমনি চেপে বসে মেঘদলের গানের নেশাও। সম্মেলন শেষে ময়মনসিংহে গিয়ে দেখি মেঘদলের অডিওঅ্যালবাম কেউ সেখানে নেয় নাই। নিবেই কিভাবে? তারা তো আর জনপ্রিয় ব্যান্ড না। কিন্তু মেঘদলের গান এইভাবে না শুনে কেমনে দিন কাটাই? তাই ঢাকা থেকে মেঘদলের অডিওসিডি কিনে ময়মনসিংহে নেয়া হলো। বন্ধুরা যেই-কয়টা কপির চেষ্টা করছিলাম, ততগুলো পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল মাত্র এক কপি। আর তাই পালা করে কম্পিউটারে কপি করা। তারপর সবার মুখস্থ।
ময়মনসিংহে পরিচিত না হলেও ‘মেঘদল’ ঢাকায় মোটামোটি পপুলার। হুট করে একদিন দেখি অতনু (অতনু তিয়াস) তাদের নিয়া ইত্তেফাকে একটা ফিচারও লিখল। বাহ্ চমৎকার তো! আর কই যায়। সে-বছরই আমি রাজনীতি থেকে সরাসরি সরে আসি। কিন্তু মেঘদলের সাথে সম্পর্কটা ছাড়া হয়নি। বরং বেড়েছেই বলা যায়। এইবার নিজেকে প্রশ্ন করি। আসলেই কি বেড়েছে? যদি বেড়েই থাকে তবে বলো দেখি, মেঘদল কি?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কি মূখ্য বিষয় কি না জানি না। তবে এ জানি মেঘদল আমাদের রোদের চিঠি, অথবা বনসাই বনের মালি। কারণ, এই যে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে বেদনারহিত অনুভূতির দেয়াল — এর সীমানা কোনটা আমরা জানি না। জানি কখনও উসাইন বোল্টের মতো, কখনো ম্যারাথনের প্রতিযোগিদের মতো দৌড়াইতেছি কেবল। এই দৌড়ের মধ্যে চুপচাপ যে হাওয়াবাতাস আসে, মনে সাহস আর অনুপ্রেরণাও যোগায় — সেইটা মেঘদলের গান।
রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঐদিন ঐ মঞ্চে যেই লাইনআপ ছিল এখন বোধহয় সেই লাইনআপ হুবহু নাই। সেদিন নগরের অতিথি আমি ভার্সিটির রাস্তায় নিজের জুতা পশ্চাদ্দেশের নিচে দিয়া বসে পড়ছিলাম। গান শুনছিলাম সম্ভবত চারটা কি পাঁচটা। তার মধ্যে ‘ওঁম’, ‘চতুর্দিকে’, ‘ক্রুসেড’, ‘ব্যবচ্ছেদ’ গানগুলো ছিল মনে করতে পারি।
তারপর রিপিটেশনের কালে, একই গান বারবার বারবার শুনছি — ‘ওঁম’। কেন শুনছি এই প্রশ্ন করলে এখনো চুপ হয়ে যাই। মনে হয়, কার কাছে দিব এই উত্তর? সে কি গান শুনছিল না সুর? নাকি কিছুটা হাওয়ায় ভেসে-আসা একটা চরকির মতো কথাবার্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল? আমার নিজের কাছে প্রশ্নগুলোরই উত্তর মেলে না। অন্যকে কিভাবে উত্তর দেই!!!
‘ওঁম’ গানটা আমি নানান ধরনের মানুষকে শুনাইছি। একবার এক মুর্শিদিভক্ত কবিরাজরে শুনাইছিলাম। গান শুনে তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরলেন। বললেন, তুমি এমন সুন্দর গান কই পাইলা? তার চোখে মানুষের মুক্তির যে আনন্দ সেই আনন্দ দেখছিলাম। সত্যি বলছি, সেই মুক্তির আনন্দ অনেকদিন কারো চোখে দেখি না। সব পরাজিত যোদ্ধা দেখি। চোখের সামনে সব ক্লান্ত বিমর্ষ আর বিদঘুটে অন্ধকারময় খিলখিল হাসি। ঐদিন, ঐ মুর্শিদিভক্ত তার ভাবনার ধর্ম-অধর্মের বিশাল লেকচার শুনাইছিল। তর্ক হইছিল তার সাথে, হইছিল আলোচনা। ভাবনার বিষয় বিস্তৃত হয়ে আর গানে ছিল না। ছিল ধর্ম আর মানুষে। দীর্ঘ সেই সংলাপ শেষে আমরা যখন সমাপ্তির পর্দা টানি, তখন আমরা একমত হইছিলাম এই চিন্তায় যে, মানুষ যে এত ধর্ম-ধর্ম করে — ধর্মেরও উচিত কিছু মানুষ-মানুষ করা। কিন্তু ঐ ধর্মই তো বায়বীয়। আমরা কেমনে তার ছায়া মাড়াই? আমাদের দুনিয়ার হাওয়াবাতাসে বাড়তে বাড়তে আমাদের চাইতে বড় হয়ে যায় ধর্ম। কেমন বড়? তার কোনও আকার আয়তনের কথা আমরা বলতেই পারি না। তারে না যায় ধরা, না যায় ছোঁয়া।
এবার অন্য সুরে তাকাই, অন্য কথায়-সংগীতে। আসলেই ধর্ম বলে কি কিছু আছে কি না, সেই প্রশ্নের চাইতে তখন আমাদের চিন্তা খেলা করে জগৎসংসার নিয়ে। মনে প্রশ্ন জাগে ‘মানুষের কজন ভগবান, কজনে ভাগ্য লেখে — কজনে জীবন সামলান?’ এই প্রশ্ন আর উত্তরের খেলা খেলতে গিয়ে আমরা হাওয়ার মতো অদৃশ্য কিছু উত্তরও তাদের কাছ থেকে পাই। তারা বলে দিয়ে যায়, ‘আকাশে উড়ছে বোমারু ভগবান, মানুষ ধ্বংসে যিনি গণতন্ত্র এনে দেন।’ কিন্তু এই উত্তরে আমাদের স্বস্তি মেলে না। আমরা অস্বস্তি নিয়ে দৌড়ে উঠে বসি নিজ নিজ গন্তব্যের লোকাল বাসে। ফেরা আর না-ফেরার এক অস্পৃশ্য প্রতিবন্ধকতাও আমাদের সঙ্গে বাসে উঠে পড়ে। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তি পায় আমাদের, ভুলে যাই বিষাদময় রাত্রিদিনের কথা। তন্দ্রাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরে। আধো ঘুম আধো জাগ্রত জগৎ থেকে অন্য এক জগতের দিকে হাঁটি আর তারাও কিনা বলে আমারই কথা, আমাদেরই কথা —
আমি হেঁটে যাই মেঘের কাছে
আমি হেঁটে যাই
হেঁটে যাই
প্রশ্বাসে ছুঁয়েছি আকাশ
দুঃখ ছুঁয়ে যায় বাতাসে বাতাসে
আমি হেঁটে যাই
আমার সকল পাপ ক্ষমা করে দিও তুমি মেঘ…
এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরে আমাদের। গলা ভিজে আসে পাপবোধে। বাড়ি ফেরার পথ ভুলে যাই। মনে পড়ে সুদূরে প্রতীক্ষায়-দাঁড়িয়ে-থাকা এক অবয়ব। কে সেই শান্তির দূত? যে অবয়বের চেয়ে বেশিকিছু নয়, অথবা নেই তারে ছুঁয়ে যাওয়ার কোনো ছুঁতো। কেবল বুকের ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে বলে উঠি … ‘ভালোবাসা হইয়ো তুমি পরজনমে’। কিন্তু তা হয় না। বরং ডানা মেলে অন্য এক ভুবনে, উড়ে যায় নিশিপাখির মতো, খুব করে ভুলে যাওয়া এক পাখির ডানার মতো উড়ে যায়। হারিয়ে যায়, বিভ্রান্ত পথিকের মতো অচেনা শহরে। সেই শহর কোথায়? কোন পথে ছুটলে সেই পথের সন্ধান মিলবে? আদৌ মিলবে কি না, তা জানা নেই। থাকবে কি করে? নাগরিক কবিয়ালকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি ‘চেনা অচেনা আলো আঁধারে, চলতি পথে কোনও বাসের ভিড়ে।’ অথচ প্রায় প্রতিরাতেই আমাদের শৈশব কান্না করে নগরীর নোনাধরা দেয়ালে। দূরে কোথাও আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, আকাশে আলোছায়ার খেলায় ভুলে যাই টানাপোড়েনের আলু-বেগুনের দাম আর লোকাল বাসের ভাড়া। মনে মনে খেলা করে মৃত বিপ্লবের আত্মা — কান্নার বৃষ্টি নামে শহরে আর —
আমার শহর খুব সহজে একলা পাখির মতো ভিজতে থাকে
কেউ জানে না কোন তীব্র স্লোগান, মুখর হতে এই শহরে
জানি, স্লোগানমুখর সময়ের গল্প আমাদের ভুরি-ভুরি। কিন্তু এই যে বন্ধ্যাকাল, ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ নেই। নেই মানুষের ডাকে মানুষের সাড়া দেয়ার মতো ব্যক্তিত্ব। একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি মানবিকতাবোধের গোপন চিঠি। এমন সময়ে যারা সমাজে সবচেয়ে বেশি দায় বোধ করে, প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মী তারাই। যদিও সমাজে তার কর্মের প্রভাব আসে খুব ধীরে, কিন্তু স্থায়ী হয় সেইটাই। এই দায়বোধটার অনেকটাই গ্রহণ করে ‘মেঘদল’। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাষায় তাদের চেতনার প্রকাশটাই অনেক সময় হয়ে ওঠে সমাজের বেদনার ভাষা। এমন পরিস্থিতির কথাও কিন্তু তারা তাদের গানেই বলে দিয়েছে আরও বহু আগে।
অস্থিরতায়, নিমগ্নতায় পুড়ছে স্বদেশ পুড়ছে সবাই
তবু রুখে দাঁড়াই আমরা!
ঘুরে দাঁড়াই আমরা!! ফিরে দাঁড়াই!!!
এই হলো শিল্পীর দায়বোধ। যা এড়িয়ে গেলে তাকে আর শিল্পী ভাবতে পারি না আমি। আসলে আমি ভাবতে চাইও না। এই বিষয় নিয়ে অনেকের সাথে অনেক তর্ক আর আলোচনা হয় — হয়েছে। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্র বদলায়নি। হয়তো মেঘদলও আমার মতো ভাবে না, কিন্তু আমি তাদের কাজে নিজের ভাবনার ছায়া পাই। যা তাদেরকে নিজের মতো ভাবতে সহায়তা করে।
মেঘদল আসলে গোপন এক আশ্রয়ের নাম। যখন নিজের সাথে নিজের লড়াই করার প্রয়োজন, তখন অন্তর্গত অনুপ্রেরণা হিসেবে মেঘদল আসে। এই আশ্রয়ের অনুভূতি প্রকাশে বোদলেয়ারের আশ্রয় ছাড়া উপায় নেই; তাই সেই ভাষাতেই বলি —
আমি ভালোবাসি মেঘ … চলিষ্ণু মেঘ … ঐ উঁচুতে … ঐ উঁচুতে
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
‘লাল জীপের ডায়েরী’ ওয়েবপত্রে লেখাটা আগে একবার ছাপা হয়। লেখকের অনুমতি নিয়া গানপারে পুনরাপ্লোড করা গেল। — গানপার
… …
- বাতাসের মতো মোহময় || ইলিয়াস কমল - November 25, 2024
- বন্ধুর বই || ইলিয়াস কমল - November 22, 2024
- কেন কমার্শিয়াল ছবি নিয়মিত দেখি - October 8, 2024
COMMENTS