কাফন, চৈত্র ও অশ্রুময় অন্তরালের বনবীথি || মিরাজ আহম্মদ  

কাফন, চৈত্র ও অশ্রুময় অন্তরালের বনবীথি || মিরাজ আহম্মদ  

যে গেছে বনমাঝে চৈত্রবিকেলে
যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবীথিতলে
বন জানে
অভিমানে
গেছে সে অবহেলে।

‘ছায়াপ্রাণ’ শব্দটি পুরা স্তবকে আলাদা একটা ভাব নিয়ে আসে। আমরা যতদূর জানি, ছায়ার নিজস্ব প্রাণশক্তি নেই; সেহেতু আমাদের প্রাণশক্তি খুঁজতে অবহেলার পিছনে লুকিয়ে থাকা অশ্রু-উৎপত্তির রহস্য খুঁজতে বনবীথিতলে যেতে হবে — যেখানে অভিমানেরা শতাব্দীকেও অতিক্রম করে চলে বন-অন্তরালে।

অভিমান ও অবহেলার মূল রহস্য খুঁজতে দ্বিতীয় স্তবকে চলে যাই —

আকাশে কেঁপেছে বাঁশিসুর
আঁচলে উড়েছে ময়ূর
চলে যাই বলেছিলে
চলে যাই মহুলতরুর বাহু ছুঁয়ে
যে গেছে অশ্রুময় বন-অন্তরালে।

প্রতিধ্বনিত বিষাদের সুর বারবার কেঁপে উঠছে অন্তর-আত্মার অন্তরালে, যার বিপুল প্রয়োগ-ব্যবহার বিষাদের বিশালতাকে আকৃষ্ট করেছে। ‘আঁচল’ এক শক্তিমান শব্দ ও শব্দাংশ বা তারচেয়েও বেশি কিছু, যা নারীর অহঙ্কার/আবেগ/প্রেম/ভালোবাসা ফুটিয়ে তোলে।

আমার মতে ‘আঁচল’ বললে সেই অংশটুকু বোঝায় যাতে নারীর শরীরে শাড়ি বা কাপড় পরার পরও কিছু অংশ বাকি থাকে। আর এই অংশ থেকেই শূন্যতার আবির্ভাব, যা শূন্য বাতাসে ভেসে বেড়ায় — আর এই শূন্যতাকে ভালোবেসেই আঁচলে উড়ে বেড়ায় ময়ূর। শূন্যতাপৃষ্ঠ আঁচলকে ঘিরেই আঁচলের মায়ায় ডেকে যাই। আর যা কোনো বিশ্বাসযোগ্য বাহু ছুঁয়ে চলে যেতে চায় — “বলেছিলে চলে যাই”।

বেশ কিছুদিন ধরে একটা মেয়েকে ভালো লাগত, যাকে বেশিরভাগ সময়ই চৈত্রের বিকাল জুড়ে দেখা হতো — সেই সময় আমি পুরা ‘চৈত্রের কাফন’ গানে মগ্ন ছিলাম — তখন তার উদ্দেশ্যে একটা বাক্য লিখেছিলাম — চৈত্রের হলুদ বিকালে চোখপাশ দিয়ে সে চলে যায় … । তখনই বুঝেছিলাম —

সে বুঝি শুয়ে আছে চৈত্রের হলুদ বিকালে
যেখানে চূর্ণ ফুল ঝরে তার আঁচলে
যেখানে চূর্ণ ফুল ঝরে তার কাফনে।

উপরের অংশটা গানের তৃতীয় স্তবক। তার ‘আঁচলে’ ও তার ‘কাফনে’ — সর্বশেষ শব্দটি বিয়োগের বিষাদ ডেকে যায়। কাফনে।

অনেকের ধারণা গানটার পিছনে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র রাজনৈতিক অবস্থা এবং রঞ্জন ঘোষালের ব্যক্তিগত প্রেম ও ভালোবাসা জড়িত থাকতে পারে। এইখানে সেসব মনে রেখে এবং ভুলে গিয়ে আমি বিষয়টা আমার একান্তই নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখার চেষ্টা করেছি। বিশ্লেষণের অভাব থাকলেও পঙক্তিগুলি নিয়া আমার অনুভূতি লিখতে গিয়ে ব্যঞ্জনাবিভূতি বিকৃত করার ইচ্ছা বা মনোভাব কোনোটাই ছিল না । ভালোলাগা ও ভালোবাসার নজরেই নিবন্ধটি লিখতে চেষ্টা চালিয়েছি। আর ব্যক্তিগত ভাবনা থেকেই ‘চৈত্রের কাফন’ নামে একসময় একটা কবিতা লিখতে চেয়েছি। কবিতাটায় মুশফিক আহমদ ভাইয়ের অবদান রয়েছে। তাই বিষাদকে ডেকে দিতে বলে উঠতে পারি — চৈত্র তো চলে গেল, তবু চৈত্রের কাফন থেকে যায়।

আমাদের সারাবছরই কাফনময়। আমাদের সারাবছরই চৈত্র। কাফন দিয়ে ঘিরে রাখা আমাদের মস্তিষ্ক সর্বশেষ বিয়োগের বিষাদ ডেকে যায় কাফনে। কাফনে কাফন — চৈত্রের কাফন। আমাদের শরীর একটা কাফন হয়ে ঘুরে বেড়ায় — আত্মার কাফন-কাফন স্রোতে ভেসে বেড়ায় — মহাশতাব্দী — অশ্রুময় অন্তরালে।

… …

মিরাজ আহম্মদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you