রবি ঠাকুরের দল (৫) || অশীন দাশগুপ্ত

রবি ঠাকুরের দল (৫) || অশীন দাশগুপ্ত

আপনারা জানেন গোরা মাঝেমধ্যে সিংহনাদ করতে ভালোবাসত। এজন্য উপন্যাসটিতে যাঁদের যাঁদের অসুবিধা ঘটেছে তার মধ্যে হারানবাবু অন্যতম। তাঁর কথা তুললুম কারণ হারানবাবু একদা দেশের নিন্দা করেছিলেন। হয়তো এমনকিছু বলেননি। দেশনিন্দা আপনি-আমি সকলেই করে থাকি। ইংরেজরা যেমন আবহাওয়া নিয়ে আলোচনা করে, আমরা দেশনিন্দা করি। গোরা এই ব্যাপারটা বুঝত না। হারানবাবুর দেশনিন্দা শুনে সিংহনাদ বস্তুটা যথাসাধ্য রুদ্ধ করে সে বলেছিল : “এই যদি সত্যই আপনার মত হয় তবে আপনি আরামে এই টেবিলে বসে বসে পাউরুটি চিবোচ্ছেন কোন লজ্জায়।” দুর্ভাগ্যবশত সে-সময় হারানবাবু পাউরুটি চিবোচ্ছিলেন। গোরার অভিযোগের এই অংশটুকু অকাট্য। কিন্তু এইখানেই সে চুপ করেনি। যতদূর মনে পড়ে যোগ করেছিল : “হয় বাঙালি-চরিত্রের কলঙ্ক মোচন করুন, নয় গলায় দড়ি দিয়ে মরুন গে।” গোরা ভেবে দেখেনি যে, তার এই উপদেশ অনুসরণ করলে সমাজে আত্মহত্যার সংখ্যা সমূহ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমরাও ভেবে দেখছি না গোরার সিংহনাদের পিছনে জোরালো যুক্তি আছে। রবি ঠাকুরের দল বলতে যে-ধরনের লোক বুঝছি তাঁদের একটা চরিত্র-লক্ষণ যে তাঁরা শুধুমাত্র নিজের কাজটুকু করে সন্তুষ্ট নন, অতিরিক্ত কিছু করেন। এমন লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কারণ আপনার-আমার মধ্যে দেশনিন্দার অভ্যাসটা বাড়ছে। এর জন্য দুটি জিনিস দায়ী। দুটির একটিকেও গোরা দেখেনি। আমরা দেখছি এবং ভুগছি। এর প্রথমটি হলো : জীবনযুদ্ধ আজ বড় কঠিন। এই যুদ্ধে পর্যুদস্ত পদাতিক দেশনিন্দায় কিছুটা ক্ষোভ মোচন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু অভ্যাসটা ছোঁয়াচে। আরামে রুটি চিবোতে চিবোতে দেশনিন্দা করার মতো লোকেরও অভাব নেই। এঁরা যখন বলেন জীবনযুদ্ধ এখন এমনই কঠিন যে, অতিরিক্তটুকু করার আর উপায় নেই, তখন মন সায় দেয় না। দ্বিতীয় কারণটি আরও মারাত্মক বলে মনে করি। এই কারণটি আসলে একটি যুক্তি বা বক্তব্য। বক্তব্যটি এ-ই যে অতিরিক্ত কিছু করার কোনও প্রয়োজন নেই। সমাজ আসলে একটা প্রথা। সমাজ যদি পাল্টাতে হয় প্রথাটা বুঝে প্রথাটা পাল্টাতে হবে। প্রথা যদি না পাল্টায় কে অতিরিক্ত কী করছে সেকথা নিরর্থক। ভারতীয় মনুষ্যত্বের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক এই বক্তব্য। এর ফলে কোনও প্রথা আজ পর্যন্ত পাল্টায়নি। বরঞ্চ মানুষের কাজের ইচ্ছা কমেছে। রবীন্দ্রনাথ দুর্দিনে যার যেটুকু গান গেয়ে উঠতে বলে গিয়েছেন। রবি ঠাকুরের দল আর-যা-ই করুক, হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এটুকু আশা করা যায়।

নিজের কাজ ছাড়াও দেশের কাজ করার এই ঝোঁকটা রবি ঠাকুরের দলটির একটি চরিত্র-লক্ষণ। কিন্তু গোরা উপন্যাসে দেশভক্তির বক্তব্যটুকু শুধুমাত্র গোরার বজ্রগর্জনেই থেমে নেই। অনেক শান্তভাবে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই বক্তব্য অন্য লোকের জবানিতে বলেছেন। গোরার এই বক্তব্য বিষয়ে কিছু মন্তব্য শুনুন। কথাগুলি সুচরিতার মনে রবীন্দ্রনাথ বসিয়েছেন : “সাধারণত আমাদের লোকেরা স্বজাতি ও স্বদেশের আলোচনায় কিছু-না-কিছু মুরুব্বিয়ানা ফলাইয়া থাকে। তাহাকে গভীরভাবে সত্যভাবে বিশ্বাস করে না। এইজন্য মুখে কবিত্ব করিবার বেলায় দেশের সম্বন্ধে যাহাই বলুক, দেশের প্রতি তাহাদের ভরসা নাই। কিন্তু গোরা তাহার স্বদেশের সমস্ত দুঃখদুর্গতি দুর্বলতা ভেদ করিয়াও একটা মহৎ সত্যপদার্থকে প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে পাইত – সেইজন্য দেশের দারিদ্র্যকে কিছুমাত্র অস্বীকার না করিয়াও সে দেশের প্রতি এমন একটি বলিষ্ঠ শ্রদ্ধা স্থাপন করিয়াছিল। দেশের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি এমন তাহার অবিচলিত বিশ্বাস ছিল যে, তাহার কাছে আসিলে, তাহার দ্বিধাবিহীন দেশভক্তির বাণী শুনিলে সংশয়ীকে হার মানিতে হইত।”

গোরার এই দেশপ্রেমের মধ্যে দুটি জিনিস ছিল। দেশের কী দোষ গোরা ভালো করেই জানত। তা সত্ত্বেও দেশকে গোরা শ্রদ্ধা করতে পারত। তার দেশপ্রেমের মূলেই থাকত এই শ্রদ্ধা। সংশোধন সে-ই করতে পারে যে প্রথমে ভালোবাসে। অবজ্ঞায় সংস্কার চলে না। স্বীকার করতে বাধে না এই বস্তু হিন্দু-গোরা নয়; এ বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ।

চলবে

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you