রবি ঠাকুরের দল || অশীন দাশগুপ্ত

রবি ঠাকুরের দল || অশীন দাশগুপ্ত

বাঙালি মাত্রেই অবগত আছেন যে রবি ঠাকুরের একটি দল ছিল, অন্তত শেষের কবিতায় ছিল, এবং সেই দলটির সঙ্গে নিবারণ চক্রবর্তীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। যতদূর মনে পড়ছে রবি ঠাকুর কবি হিসাবে কিছু দীর্ঘজীবী, এ ব্যাপারে নিবারণ চক্রবর্তীর আপত্তি ছিল। রবি ঠাকুরের কবিতা বড়ই ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান করত, ভবিষ্যতের জোর এই কবিতায় ফুটত না, এই রকম একটা আপত্তিও নিবারণ চক্রবর্তীর ছিল। রবি ঠাকুরের দল অমিত-র সঙ্গে কথায় পারত না। আপনাদের মনে থাকতে পারে, শেষের কবিতায় যেমন লাবণ্য রবিবাবুর কবিতার খাতা পেয়েছিল, অমিত অধিকার করেছিল বা আবিষ্কার করেছিল নিবারণ চক্রবর্তীকে। অমিত-র সঙ্গে কথায় পারত না বলে রবি ঠাকুরের দল তাকে শাসাত। আপনাকে-আমাকে যে শাসানি আজ শুনতে হয় (লাশ ফেলে দেবো … ইত্যাদি) তেমন নয়, একটা উপযুক্ত প্রত্যুত্তরের শাসানি। সেই প্রত্যুত্তর কোনোদিন অমিত ওরফে নিবারণ চক্রবর্তী পেলো কি না বলতে পারব না। শেষের কবিতাটুকু পড়লে উদাস মনে ভাবি, এটাই বুঝি রবীন্দ্রনাথের উত্তর। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিবারণ চক্রবর্তী নামক অনাগত বিধাতাকে তুলে নিয়েছেন। রবি ঠাকুরের দলটির মধ্যেই শেষ পর্যন্ত নিবারণ চক্রবর্তীর জায়গা হয়েছিল বলেই মনে হয়।

রবি ঠাকুরের এই দলটি আজও আছেন, এমন ভরসা রাখি। লাশ-ফেলে-দেওয়ার মধ্যে নয়, অগণিত শান্ত, ভদ্র ও নিরীহ বাঙালির মধ্যে এই দলটি ছড়িয়ে আছে। এই জীবনের মধ্যেই আবার ক্রমে ক্রমে নতুন মানুষের জায়গা হচ্ছে। এটা যে একটা ধারা। জীবন কাটানোর একটা উপায়। নতুন মানুষের ভিড় এই জীবন যদি সইতে না পারে, তাহলে এই দল শেষ হয়ে যাবে। সে-সম্ভাবনা দেখি না। এই শান্ত জীবনের মধ্যেই অসম্ভব একটা জোর রয়েছে। সেই জোর কথা বলে না। কিন্তু নিরীহ জীবনযাপনের পথ তৈরি করে। সন্তানসন্ততি যেন স্বপ্নে থাকে, তার জন্য বিনা আড়ম্বরে জীবন দিয়ে যায়। এই নিরীহ জীবনটাকে শক্ত করা, তাকে সুন্দর করে তোলা সব বড় মানুষেরই কাজ। রবি ঠাকুর এই কাজই করে গিয়েছেন।

নিরীহ জীবনের জোরটা কোথায় সে-কথা প্রথম বোঝা দরকার, পরে অন্য কথায় যাব। তবে এই প্রসঙ্গে কথা উঠবেই যে রবি ঠাকুর আর রবি ঠাকুরের দল তফাৎ করব কি করে। এই দুটো কথা সেরে নিই। আপনারা জানেন, রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে বলে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। বইটি আমাদের সকলেরই পড়া; এখনও আদর করে পড়ি। মনে করুন এই উপন্যাসের নিখিলেশ চরিত্রটি লেখকের পছন্দ। এমন হতেই পারে যে রবীন্দ্রনাথ নিজে যে-গুণগুলি ভালোবাসতেন সেগুলি নিখিলেশের মধ্যে জড়ো করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যা মন্দবাসতেন সেগুলি, বা তার অনেকগুলি, সন্দীপের মধ্যে ভিড় করে। নিখিলেশের জোরটা ত্যাগের, সন্দীপের জোরটা ভোগের। রবীন্দ্রনাথ লিখতেন ভালো। তাই সন্দীপের উপর যতই রাগ করুন, মানুষটাকে যতই গালমন্দ করুন, সন্দীপের যেখানে জোর রবীন্দ্রনাথ সেখানে খাঁটি। একটু পরে গোরা সম্পর্কেও এ-কথা বলব; মতটা পছন্দ না হলেও সুন্দর করে, জোর করে বলতে এই মানুষটির আটকায় না। তাই বোধ করি আজও ঘরে বাইরে আদর করে পড়ি।

রবি ঠাকুরের দলের কথা বলতে নিখিলেশের কথাই বেশি করে বলা ভালো। কিন্তু সন্দীপকে উপেক্ষা করাটা ভুল হবে। সন্দীপ যখন বলে : “যেটুকু আমার ভাগে এসে পড়েছে সেইটুকুই আমার, এ-কথা অক্ষমেরা বলে আর দুর্বলেরা শোনে। যা আমি কেড়ে নিতে পারি সেইটেই যথার্থ আমার এই হলো সমস্ত জগতের শিক্ষা”, তখন ভাবি এই বাম ঠাকুরের দলটিও ছোট নয়। কারা দলে ভারী বলা শক্ত। ভোগের জোরটা সংসারে স্বীকৃত। নেপোলিয়ন অস্টারলিটজ রণক্ষেত্রে কিছু ত্যাগের মহিমা প্রয়োগ করেছিলেন বলে মনে হয় না। হিটলারের মতো অমানুষও প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু জেদ ছাড়েননি। এ-কথা অবশ্য ঠিক যে, রবিবাবু রাগ করে সন্দীপকে শেষ পর্যন্ত দেশছাড়া করেন আর নিখিলেশকে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে দেন। সন্দীপ বলে যে-চরিত্রটি পালিয়ে গেল তার সম্পর্কে আমাদের যুক্তি মাথা ঘামায় না। অমঙ্গল কিন্তু পালায় না। সন্দীপ নেই, ঘরে বাইরের শেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তো রয়েছে। তারই বিরুদ্ধে নিখিলেশের নিত্য সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম বিভিন্ন চেহারায় আজও চলেছে। সে-জন্যই রবি ঠাকুরের দলটিকে বোঝা দরকার।

চলবে

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you