উৎপলকুমার ও সন্ধেবেলার শ্রাবণঝরা বাজার

উৎপলকুমার ও সন্ধেবেলার শ্রাবণঝরা বাজার

ভোরবেলার রৌদ্রে বসা বাজারের ইমেইজ্ দেখায়েছিলেন উৎপল, বহুকাল আগে, অতি লিরিক্যাল্ অথচ অবিস্মরণীয় সংক্রামক অন্ত্যমিলের এক কবিতায়। সেখানে শুরুতেই বৃষ্টি হয়েছিল, পয়লা লাইনেই, ‘মন মানে না বৃষ্টি হলো এত’ উৎপলকৌমার্য লহমায় দেখায়ে দেয় আজও। ‘স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি’ ছিলে ওই-সময় এবং নিশ্চয় আজও রয়েছ অবিকল। যদিও ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’, তারপরও ‘মন মানে না’ ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর এক-সময় বৃষ্টি ধরে এসেছিল। উঠেছিল রোদ্দুর ঝলমলা। বাঁকানো রঙধনুও কি? ঠিক মনে নাই। কিন্তু, যদ্দুর ইয়াদ হয়, উৎপলের বৃষ্টিটা আর্লি মর্নিঙের; কাজেই রঙধনু ওঠানো হয়নি নিশ্চয়। কিংবা হতেও পারে, কবিতায়, কতকিছুই তো হয় এবং হতেও পারে আল্লার দুনিয়ায়। ইয়াদ নাই পুঙ্খানুপুঙ্খ পুরাটা, কারণ কালিদাস পণ্ডিতের ধাঁধা আর ইন্ডিয়ান বাংলা কবিতা বাল্যকালে শেষ পড়েছিনু। কবিতারাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পরে না-হলেও অচিরে এইসব পড়ার পানে আর প্রাণ যায় না আগেকার ন্যায়। দেশের মাকুন্দা কবিদের কারো কারো উচ্ছ্বাসোচ্ছ্বল পঙক্তিমীনের খলবল দেখে নিয়মিত মনে পড়ে একদা এক অধ্যায় ছিল বটে ইন্ডিয়ান বাংলা কবিতার!

এরপরও, বলতে দ্বিধা নাই, সহসা ডালপালা উথলিয়া লাইনঘাট মনে পড়ে সেই ধূসর কৈশোরের। মনে পড়ে, ‘তাদের জয় শঙ্কাহীন এত — / মন মানে না সহজ কোনো জলে / চিরদিনের নদী চলুক, পাখি — / একটি নৌকো পারাপারের ছলে’ … এবং, মনে তো পড়েই, ‘আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল / স্পর্শ করি জলের অধিকারে’ … ইত্যাদি। বিশেষত মনে পড়ে ‘এখন এক ঢেউ-দোলানো ফুলে / ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে / স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি / যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকে’ … সে যেন ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়ে চলে’ … হ্যাঁ, এইভাবেই জড়ানোমোড়ানো। মনে পড়ে, থেকে-থেকেই ইয়াদ হয়, কিন্তু কেন অতশত মনে পড়ে তা বাপু বলতে পারিনে।

যেমন বৃষ্টি হয় বাড়িফেরা রাস্তায়। গাওদিয়া এবং অন্যান্য শত-শত সমস্ত গঞ্জঘাটে ননস্টপ বৃষ্টি হয় গেহে ফেরার পথে। এদেশে এই জিনিশ প্রভূত পরিমাণে হয় বটে। এদেশে বৃষ্টি হয় বলেই ভুলিয়া থাকা যায় ন্যাক্কারজনক নাগরিক নাট্যফষ্টিনস্টি। কাচারি থেকে ফেরাকালে কেরানির চোখে একের পরে এক ধরা দেয় রাস্তাহাট, সন্ধ্যাবাজার, বৃষ্টিভিজা মার্কেট। সকলেই রাস্তার উপরে এসে বসা। আনাজপাতি ভিজছে। ক্রেতার মাথায় বৃষ্টিকুচি থিতু হবার আগেই চুল ঝেড়ে নিচ্ছে কেয়ার্ফুলি। নিউম্যুনিয়া না-হয় যেন, সতর্ক খদ্দের। বিক্রেতার মাথায় ভারী পলিথিনের শিট জড়ানো। কচুডগা আর লতির গায়ে রেইন্ লেগে নাদুসনুদুস দেখাতেছে তাদিগেরে। লেবুর ঝাকাভর্তি বৃষ্টিপানির স্ফটিক। নধর গতরের পটলগুলো, ধুন্দুল আর ঝিঙাগুলো, মাইরি বলচি মাসিমা! বাজার পেরোতে যেয়ে জিন্-চাপানো ঘোড়ার গতিও মন্থর হয়া আসে। মাথার ওপর বৃষ্টি ঝরে, বেদম ব্যাকুল বৃষ্টি ঝরে চক্ষুর কোটরে এবং বাহিরে চোখের দু-ধারে, একাধারে এই বৃষ্টিরা যায় শ্রাবণ ধরিয়া আশ্বিন এবং কার্তিক-আগনপারে।

এরপরও ভুলি কী করে যে এই বাজার ‘চিরদিনের নদী’ এবং পাখির, চিরবৃষ্টির, চিরপারাপারের! উৎপলের বাজারটা আচানক একটিমাত্র দিনের, এক হঠাৎ সকালবেলার, রৌদ্রে-বসা আর্লিমর্ন রেলব্রিজতলাকার। ‘স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল, / অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার, / তোমার গ্রামে রেলব্রিজের তলে / ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।’ মোরে কইতে কথা দাও, দোস্ত, দোহাই দোষতুরুটি ধরিও না! আমাদের বাজার বৃষ্টিতে বসা, আর্দ্র সব্জি-আনাজপাতি আর নিকারির থালিভরা মাছের উদাম গতর, আমাদের রোজ এই বাজারেই দিনাবসান সন্ধ্যাসামা মাগ্রেবের আজান। সমজিয়া লও ষড়ঋতুর সুপ্রসিদ্ধ উপকথারাজপাট। এই নদীজল, বৃষ্টিকোহল, মহাসড়কের ঢালু বেয়ে নেমে খেয়াপারের ঘাট …


প্রচ্ছদে ব্যবহৃত প্রতিকৃতি / হিরণ মিত্র ।। লেখা / জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you