নূরুল হকের দুটো অপ্রকাশিত কবিতা || সংগ্রহ ও ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা

নূরুল হকের দুটো অপ্রকাশিত কবিতা || সংগ্রহ ও ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা

খুব চুপচাপ, নিরবিলি অন্তর্মুখী এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন কবি নূরুল হক। আমাদের কালের সবচেয়ে নির্জন এবং সময়ের চেয়ে অগ্রসর কবি হয়ে সমাজ-জাগ্রত মানুষের হৈচৈ থেকে দূরে এক স্বভাব-নির্জনতায় কোনো-এক গানের কলি গাইতে গাইতে আপন খেয়ালে হাঁটতেন তিনি। যেন নিজেকে জানতেন তিনি। তাই নিজেতে নিজেই একাকার; নিজের সত্তার অভিভুখী। যেন মেঘ, বৃষ্টি, জল, নদী, জাম্বুরাফুলের সুবাস সহ পৃথবীর সবার দিকেই তাকিয়ে একটা স্নিগ্ধ ও পবিত্র হাসিতে মিশে যেতেন। কোথাও ভেঙে পড়া নেই; সর্বত্র যুক্ত হওয়া। সবাইকে নিয়ে, সবার পাশে থেকে একটা আশাবাদ ও ভালোবাসার রেণু ছড়িয়ে দেয়াই ছিল কবির কাজ।

চেহারাতেও প্রাজ্ঞতা আর স্থৈর্যের ছোঁয়া ছিল। শৈশবের কোনো-এক নির্জনতায় বাংলার লোকাচারে মোমবাতি হাতে তিনি মসজিদে মানত করে এসেছিলেন। কী মানত করেছিলেন? যেন বাউল হতে পারেন, যেন সরল জীবনের সারলিক গায়েন হতে পারেন। আমার মনে হয়, আল্লাহ পুরোপুরি কবির মানত কবুল করেছেন। তাই জীবনের কোথাও অহম এবং লোভযাপন ছিল না তাঁর। বইপত্তর পড়তেন প্রচুর কিন্তু বইপাখি হয়ে কোথাও কখনো জ্ঞানের বহর দেখাতেন না। তাঁর জীবনের কোথাও পাণ্ডিত্যের হাফিজিপনা ছিল না; প্রঞ্জার দীপ্তি ও আদরে তিনি নরম করে কথা বলতেন। ছিলেন, পৃথিবীর আয়ুর মতো নির্ভার। এক-রকম স্বভাবকবিত্বও ছিল তাঁর ভেতরে। মাঝে মাঝে মনে হতো বাংলার ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটা বেদনা-মথিত নদী। আবার কখনো কখনো হঠাৎ ফূর্তিতে আমলকিপাতার মতো হেসে উঠতেন। কাউকে আহত-নিহত করার কোনো প্রেরণাতেই কবি ছিলেন না। আড্ডা দিতেন কিন্তু আড্ডার নায়ক হতে চাইতেন না।

জগতের প্রতিষ্ঠার দিকে না তাকিয়ে শুধু কবিতার ভাষায় মগ্ন থেকেছেন। একটা লাঠি হাতে শেষ দিনগুলোতে তিনি এমনভাবে হাঁটতেন যেন প্রকৃতির ভাষা রপ্ত করতে করতে প্রকৃতিতেই মিশে গেছেন। আমের মুকুলে কিংবা বরইপাতার ফাঁকে যে-রোদ চুপ করে আছে নূরুল হক সে-ভাষাও বুঝতে পারতেন। বাংলা কবিতায় তিনি সহজ ভাষায় প্রকৃতি ও জীবনের নিত্যতাকে শাশ্বত অভিজ্ঞানে ঢেলে দিয়েছেন। যে-মায়ার মৃত্যু নেই, যে চিন্তা ও ছবি অবিনশ্বর — সেই অন্তরঙ্গ আলোমাখা পথে উজ্জ্বল হয়ে আছে নূরুল হকের কবিতা।

কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির ভাষার দিকে তাকিয়ে তিনি হাঁটতে হাঁটতে কবিতার দিকেই মিশে যেতেন। আমি তাঁর সহচর হয়ে দেখেছি, এইসব অনুভব তিনি হয়তো আর কোথাও লিখেননি। যেন প্রকৃতির বাগান থেকে জন্ম নেয়া কবিতা প্রকৃতির বাগানেই রেখে আসতেন। অনেক সময়ই কবির সাথে কলম-কাগজ থাকত না। জানি না, স্মৃতির ভেতরে কতক্ষণ জেগে থাকত সেইসব পঙক্তি। হঠাৎ হঠাৎ চেয়ে নিয়ে সামান্য কাগজের টুকরোতেও লিখতেন তিনি। যে-কথাগুলো বলছি তার একটা সত্যতা হাজির করছি এখানে।

কবি ও লেখক শাহ মোহাম্মদ আব্দুল বাকীর খাতায় ২০০৯ সালের আড্ডার কোনো মুহূর্তে কবি তাৎক্ষণিক লিখে দেন দুটি কবিতা। তাকে যেভাবে চিনি, তাতে মনে হয় পঙক্তিগুলো হয়তো গুনগুন করে আওড়াচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ মগ্নতায় ওর থেকে খাতাটি নিয়ে ছোট্ট কবিতা দুটো লিখেছেন। এ-প্রসঙ্গে শাহ মোহাম্মদ আব্দুল বাকী বলছেন, ‘খুব সম্ভব ২০০৯ সালেই হবে — নূরুল হক স্যারের সাথে শাহবাগের জাতীয় গণগ্রন্থাগার চত্বরে প্রায়ই দেখা হতো। স্যারের কবিতা শোনার পর বের হওয়ার পথে ডানপাশের লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে স্যার বললেন, কই, তোমার কবিতা তো শোনাইলা না — এই বলে আমার হাতে থাকা ডায়রির দুয়েকটা লেখা পড়ে, আমার ডায়রিতেই লিখতে শুরু করলেন। যতদূর মনে পড়ে, আমার সাথে কবিতার চরণবিন্যাস আলোচনা করতে করতে দাঁড়িয়েই লিখছিলেন। কিন্তু আমি জানি না, নিচের এই কবিতাদুটো তিনি তাঁর পূর্বরচিত কোনো কবিতা মুখস্থ থেকে লিখছিলেন, নাকি একেবারে নতুন কোনো কবিতা লিখেছিলেন।’

আমি জানি, ‘যদি না’ এবং ‘ধ্যান’ নামের এই কবিতাদুটো কবি কোনো কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেননি। সম্ভবত কবির কাছেও এই কবিতাদুটোর কোনো লিখিত রূপ নেই। বাকীর ডায়রিতে যদি তিনি না-লিখতেন তবে এই কবিতাদুটোও হয়তো হারিয়ে যেত। ছোট ছোট খুচরো কাগজে লেখা কবির এমন অনেক কবিতাই হয়তো মাটিতে মুছে গেছে। শাহ মোহাম্মদ আব্দুল বাকীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রকৃত অনুজ সহচর হয়ে অমূল্য সম্পদটি তিনি রক্ষা করেছেন।

আমাদের মূর্খতাকে মাড়িয়ে বাংলা কবিতার এই মহৎ পুরুষ বালালীর পৈত্রিক মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন। আমরা সবাই অনন্ত ঘুমে যাব। যাবার আগে আসুন কবি নূরুল হকের লেখা কবিতা ও অক্ষরগুলো দেখি।

যদি না
কলিজা ও ফুসফুস
.                 ঝরে পড়বে
হৃৎপিণ্ডের কোনো টুকরোও
আর
.     ফিরবে না ঘরে,

যদি না তোমার
যদি না তোমার ছায়া
.                    ঢেকে রাখে
পোড়া অঙ্গ
         আমার গলন।

.

ধ্যান
তোমার জীবনই যেন একটি ধ্যান,
পদ্মাসনে স্থাপিত এক নিঝুম ভঙ্গি।

দুরান্তের কোনো ঝরাপাতা
.                     একাকী জেগে আছো
নির্জনে
.       কোন্ অচেনা খেলায়,

যেন ছায়া দিয়ে
.             ভরা বাতাস দিয়ে

আলোয় প্রকাশ করতে চাচ্ছে
                          আগাম কোনো বীজকে,

যাতে হৃদয় তোমার
.               ক্রমে হয়ে ওঠে
.                              প্রাণীজগতের

জিরোবার,
         জিরোবার
একটুখানি ঠাঁই।

দ্রষ্টব্য / সরোজ মোস্তফা এই কবিতাদুটো সংগ্রহ ও তথ্যানুষঙ্গ সম্বলিত ভূমিকাটি লিখেছেন। প্রয়াত কবির জীবদ্দশায় বেরোনো ‘কবিতাসমগ্র’ (২০২০, চৈতন্য প্রকাশনী) সম্পাদনার কাজটুকু সম্পূর্ণ নেপথ্যে থেকে সরোজ মোস্তফা করেছেন এবং সেজন্যে ক্রেডিট/প্রিন্টার্স লাইনে ক্লেইম রাখেন নাই। এই ব্যাপারটায় যে-আদব দেখানো হলো অগ্রজ কবিকে সেইটা নোটিস করার মতো। বই বেরোনোর পরে নূরুল হক তাঁর বিরল একটা লাইভ কথিকায় (সম্ভবত সরকার আমিনের সঙ্গে) এই ইনফোগুলা আমাদেরে দিয়েছিলেন। অবশ্য কবিতাসমগ্রের প্রবেশক ভূমিকাভাষ্য অগ্রজ কবিরই অনুরোধে লিখেছিলেন সরোজ মোস্তফা (যে কথা আগে বলতে হবে)। বাড়তি তথ্য যোগ করা যায় এইটুকুই যে কবি নূরুল হকের একটি বই গেল-বইমেলায় বেরোনোর কথা ছিল, ঘোষণাও প্রকাশ্যে এসেছিল, অনিবার্য কারণে সেইটা তাঁর জীবদ্দশায় হতে পারল না। আর যন্ত্রস্থ সেই বইটিও (‘শাশ্বতের অন্তরালে’) গোছগাছ ও প্রকাশোদ্যোগের নেপথ্যে রয়েছেন সরোজ মোস্তফা। — গানপার


নূরুল হক : মৃত্যু ও মূল্যায়ন
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you