প্রেম ও দীর্ঘশ্বাসের গল্প
মাঝরাতে আঙ্কুর ভাইয়ের ঘুমটা দুম করে ভেঙে গেলে সে বেজার মনে বিছানায় গড়াগড়ি খায় আর ভাবে : খোদার মক্কর, নসিবের চক্কর। তা না-হলে সে কেন মায়ের পেট থেকে এমন একটা কোঁকড়ামোকড়া পশুর মতন গতর নিয়ে এই হার্মাদের সংসারে আসবে? মুচড়ে ভেঙে-ফেলা চোর-ছেঁচড়ের হাড্ডির মতো তার নড়বড়ে দু-খানা পা। পায়ের উপর যে গতরখানা সেটাও কেন আর দশজনের মতো সোজা না? তাবাদে এই-যে আঙ্কুর ভাইয়ের শিরদাঁড়াটা ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে হয়ে গেছে উটের পিঠ! ফলে তার তামান গতরটাই ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। এতসব জটিলতার জন্যই বিকলাঙ্গ আঙ্কুর ভাই এই পঁচিশ বছরে এসেও সংসারের কোনো কাজে আসা তো দূরে থাক বিছানায় আরাম করে যে একটু ঘুমাবে তারও জো নাই। তাই ভরাট ঘুমটা একবার ভেঙে গেলে তা জোড়াতালি দিতে দিতে বাকি রাতটাই কাবার হয়ে যায়। আর মাঝ থেকে চিত-কাইতের জটিলতায় আচুদা গতরটা নিয়ে আঙ্কুর বিছানায় হুদাহুদি ছটফট করে মরে।
মনের কষ্টে আঙ্কুর তার কুঁজো পিঠের উপর ভর রেখে পা দুইটা উঁচুতে তুলে, দুই হাত ও শরীরের অন্য সব অঙ্গের নানান কৌশল খাটিয়ে বাম থেকে ডান কাতে যায়। এই অনাহক পেরেশানিতে শরীরটা ঘেমে ওঠে। সাথে নিজের প্রতি নিজের ঘিন্নাও বাড়ে। তাই সে নিজেকে ভুলে থাকতে চায়, ঘুমিয়ে পড়তে চায়। শরীরটা যে দিয়েছে, ঝলমলা দিনটাকে যে রাত বানায়, রাতটাকে যে আবার দিন করে দেয় তার কাছে সে একটু ঘুম চায়, শান্তি চায়। চৈত মাসের ফাটা বিলের তলা যেমন বৃষ্টি চায়, আঙ্কুর ভাই তেমন করে মনে মনে একটু ভালোবাসাও চায়! সে বড় দরদের কাঙাল, ভালোবাসার কাঙাল। এই ভালোবাসা রৌশনের। কলুপড়ার বুড়া খৈল্ল্যাকলুর তিন নম্বর বৌ রৌশন। করবী ফুলের মতো নরম আর হলুদ রৌশন বড় তেঁতো, বড় নিষ্ঠুর।
আঙ্কুর ভাই বিছানায় লেপটে থেকে ঘুমের বাহানা করে যাতে একটু আগের ঘুমটা আবার ফিরে আসে। কিন্তু ঘুমের বদলে বাইরে থেকে আসে মেয়েদের চিটকি-বিটকির মতন একটা বাতুনি শব্দ। বিশ্বরহস্যের মতন প্রকৃতির বুক থেকে উঠে আসা শব্দটা যেন আঙ্কুরের মগজের মধ্যে বসে যেতে চাইছে! সে কান খাড়া করে বিছানায় পড়ে থাকে। বুকটা ঢিপঢিপ করে। আর তখন সে টের পায়, পশ্চিমের খালের পানির কলকলানির সাথে কলুপাড়ার তেলের ঘানির কেড়ড়…কেড় শব্দ মিলেমিশে সৃষ্টি হয়েছে এমন এক আজব ভাষা।
আঙ্কুর তার খাপছাড়া দেহটা নিয়ে খেজুরপাতার পাটিতে মরার মতো পড়ে থাকে। বাইরে থেকে আসা শব্দের উসকানিতে তার রগে রগে, রক্তে রক্তে কামনা জাগে। দেহটা যতই বিকলাঙ্গ হোক, আজব আর খাপছাড়া হোক তবু সে নারীর নরম শরীরের পরশ চায়, ওম চায়। তাই সে এখন কামনার ফাঁদে আটকাপড়া একটা বেকুব ছাড়া কিচ্ছু না। ‘বেকুব!…বেকুব!’ করে চিৎকার দিতে দিতে আঙ্কুর শিথানের জানালাটা একটানে খুলে ফেলে। মুহূর্তে বিধাতার দুনিয়াটা তার চোখের সামনে ঝলমল করে ওঠে। কেঁপে ওঠে আকাশে-ঝুলে-থাকা আষাঢ়ের পূর্ণিমা চাঁদটা। জোছনার ভালোবাসায় দুনিয়াটা ভেসে যাচ্ছে! তারই ছিঁটেফোঁটা করুণা জানালা দিয়ে এসে আঙ্কুর ভাইয়ের ছেঁড়া-নোংরা বালিশটার ওপর হামলে পড়ে। এই দৈব পরশে সে আচান্নক হয়, হৃদয়টা তছনছ হয় দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে।
স্তব্ধ আঙ্কুরের সুন্দর চোখ দুইটা বোবা পশুর মতো অন্ধকারেও জ্বলছে। গিঁট-গাট্টা আর চাগিয়ে-ওঠা নীল নীল রগ ভর্তি তার দূর্বল হাতদুইটা নিজের অজান্তে বালিশের দিকে এগিয়ে যায়। আর মুহূর্তেই যেন বালিশের সেই অলৌকিক দ্যূতিটুকু একটা পাপিষ্ঠ স্পর্শে মিলিয়ে যায়। তাই বালিশটা এখন সব ঐশ্বর্য হারিয়ে একটা মরা বকপাখির মতো লাগছে। হঠাৎ আঙ্কুর তার হাতদুইটা টেনে আনতেই দূর্গন্ধভরা তেলচিটে বালিশটার বুক আবার জোছনায় ঝলমল করে ওঠে। এই মাটির দুনিয়াতে আসার আগেই বিধাতা তাকে নিয়ে বড় হেলাফেলা করেছে। এখন প্রকৃতিও বুঝি খেলছে?
আঙ্কুর ভাই বেজার মনে বিছানার পাশে ফেলে রাখা লাঠিটা হাতে লয়। পাছা ঘষটে ঘষটে গিয়ে দরজাটা খুলে। জানা-অজানা কীটপতঙ্গের কিট কিট, ট্যাঁ ট্যাঁ আর খালের দিক থেকে অগুন্তি ব্যাঙের ক্যাটর ক্যাটর ডাকের সাথে চাঁদের রোশনিভরা দুনিয়াটা আঙ্কুরের চোখের সামনে নেচে ওঠে। সে দরজার চৌকাঠে বসে একটা বিড়ি ধরায়। চোখে পড়ে পশ্চিমের ভরা খালটা। আগরাতের ঠাসা বৃষ্টিতে মরা খালটা এখন খৈল্ল্যাকলুর তিন নম্বর বউটার মতো গা-গতরে রমরমা।
কলুবেটার বাঁজা বউটাকে মাথায় নিয়ে আঙ্কুর রোজ রোজ ঘুমাতে যায় এবং মাথায় নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। গত চার বছর ধরে এ-ই হলো আঙ্কুরের বিধি। গেছেকাল বিকালেও রৌশন তার দোকানে নুন কিনতে এসেছিল, যাকে খৈল্ল্যাকলুর বাড়ির লোকজন রসুন বলে ডাকে। রসুনের ডাগর-ডাঁশা শরীরটা মাটির দেয়ালের এই ছোট্ট গহ্বরে ঝিলঝিল করছিল।
ডানপাশে ঈদগাহ, বাঁ-পাশে খাল। মাঝখানে মাটির দেওয়ালের উপর আঙ্কুরের ছোট দোকানঘর। ঘর তো নয় ঠিক যেন কবরের খোন্দল। এই খোন্দলের আদিম অন্ধকারে ডুবে থাকা দেহটা এখন তার নিজের কাছেই গুয়ের নোড়ার মতো লাগছে।
সামনের সোজা দু-পায়ে পথ আর ছোট্ট-সবুজ মাঠ পেরিয়ে বিশাল কলুপাড়া। উত্তর-দক্ষিণমুখো পোয়া-মাইল লম্বা কলুপাড়াটার বাঁ-বাজু ঘেঁষা খাল আর ডানবাজুতে কালাইবিলের পাথার। তিন মাইল চওড়া কালাইপাথারের পুববাজুতে রেলসড়ক। বিলের মাঝখানটায় চৈত মাসেও একবুক পানি টলটল করে। সেই বিশাল ডহরটাকে লোকে বলে ‘বিষুরির থলি’ অর্থাৎ সেখানে নাকি বিষ হজমকারী জিনের বসতি। হিন্দুরা কয় বিষহরি দেবতার থলি। তাবাদে এখন যেখানে আঙ্কুর বসে আছে এই ঈদগার চাতাল আর জুম্মাঘরটা হলো মড়লপাড়া আর কলুপাড়ার মাঝে। দুইপাড়ায় মিলে আট-দশজন বুড়া নামাজি। বাতে তাদের কারো কারো পা অচল। কারো চোখে ছানি পড়েছে। কেউ কেউ কানে কম শোনে। তাদের কাছে দুনিয়াটা বোবা, ত্যাব্দামারা আর ঝাপসা। একটু হাঁটলেই বুড়াদের বুকে হাঁফ ওঠে। তাই মরণের ভয়ে শুক্কুরবারে জুম্মাতে এসে তারা এই চাতালে মুখোমুখি বসে। তেল যেমন পানির সাথে মিশ খায় না তেমনি একদিকে কলুরা আরদিকে মড়লরা। কলুরা মড়লদেরকে মনে মনে ঘিন্না করে। কারণ মড়লদের জমিজামা আছে, টাকাপয়সা আছে, তিনবেলা গরম গরম ভাতও জোটে। মড়লরাও অনেকটা প্রকাশ্যেই কলুদেরকে ঘিন্না করে। সুযোগ পেলেই নাক সিঁটকায়, কুলনির পুত বলে গালি দেয়। তবু শুক্কুরবারে জুম্মার নামাজে এসে আল্লার ঘর সামনে নিয়ে ফরজ নামাজ আর খুতবার আগের লাম্বা সময়টা তারা সামনাসামনি বসে হেনতেন আলাপ করে কাটায়।
আঙ্কুরের ভাবনার মাঝেই কালাইয়ের পাথার আর বিষুরির থলি পেরিয়ে ট্রেনের হুঁইসাল ভেসে আসে। উত্তরবঙ্গ মেইল ফরচুঙ্গি পুলে গমগম বাজনা বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ট্রেনের শব্দে সে চমকায়। তাবাদে সে নিশ্চিত হয়, এখন রাত বারোটা হবে। তার নাক বরাবর উত্তরের কলুপাড়ার গা-গতরে এই চনমনে পূর্ণিমাতেও যেন জমাট কালো অন্ধকার জড়িয়ে আছে। এই খাল আর কালাইয়ের পাথারের সমান্তরাল উত্তরে যেমন কলুপাড়া তেমনি দক্ষিণে মণ্ডলপাড়া। অর্থাৎ আঙ্কুরের বাপের মতো জোদ্দার আর ঘাগু মড়লদের বসতি।
আজকাল আঙ্কুর আর নিজেকে মড়লপাড়ার কেউ একজন মনে করে না।
‘আল্লার মাইর
দুনিয়ার বাইর’
আঙ্কুরের ছোটভাইয়েরা বাপের সাথে মাঠে লাঙল ঠেলে, বাজার-হাটে ধান-পাট বেচে, সংসারের তক্কে-তক্কে তাল মিলিয়ে ছোটে। আর সে? তার কোঁকড়ামোকড়া বুকটায় যৌবন নামক জোয়ারের বার্তা নিয়ে গশগশা কয়টা লোম গজিয়েছে। কর্কশ আর দীর্ঘ লোম কয়টা কটমট চোখে হারামি সংসারটার দিকে যেন দিনমান তাকিয়ে থাকে।
বিড়ি টানতে টানতে আঙ্কুর খক্কর খক্কর কাশে। কাশির সাথে একদলা কফ এলে সে ফুচুত করে ছুঁড়ে মারে ঐ শুমারহীন তারাভরা আকাশপানে। ওখানেই যেন একচোখা একটা নিষ্ঠুর আঙ্কুরকে দেখছে আর সে-ও যেন খুব পষ্ট চোখে তাকে দেখছে, যার অবহেলায় তার এই আজগুবি শরীরটা দিনে দিনে আরো অসহ্য হয়ে উঠছে। বিড়ির কড়া ধোঁয়া আঙ্কুরের মগজ সাফ করে দিলে তার অনুভব হয়, পেশাবে তলপেটটা টনটন করছে। সে লাঠিতে ভর দিয়ে ওঠে। কোমরধ্বসা বুড়োর মতো লাঠিসমেত আঙ্কুর পশ্চিমদিকের খালপারে এসে দাঁড়ায়। চারপাশে ধবধবে জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে মাটির দুনিয়া। রঙ্গের দুনিয়া আর চাঁদের দুনিয়ার মাঝে একটা বন্যপশুর মতো শীতল ক্রোধ আর আবিল ঘিন্নায় কেঁপে কেঁপে আঙ্কুর প্রচণ্ড বেগে মুততে থাকে — দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুততে থাকে এই মনে যেন সে তামাম দুনিয়াটার মুখেই মুততেছে।
দিনের মতন ফটফটা জোছনায় আঙ্কুর দোকানের দিকে হাঁটে। তার আগে আগে নিজের কদাকার ছায়াটা হাঁটে। হাতের লাঠিসমেত নিজের কায়াটা আঙ্কুরের নিজের চোখেই একটা কুৎসিত জন্তুর মতো লাগে। আর ঠিক তক্ষণি একটা তীক্ষ্ণ বিবেচনা বুঝি হৈ হৈ করে তাকে জানিয়ে দেয়, রৌশনের জন্য মরণব্যাধির মতো যে আগ্রাসী কামনা তার বুকে দিনে দিনে হেমালি-পর্বত হয়ে উঠেছে, আসলে সে ওই রৌশনের একটা নখের যোগ্যও না! এই শেলসম বাস্তব বোধ আঙ্কুরের হৃদয়টা থেঁতলে দিলে সে হাতের লাঠি ফেলে দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে। কারণ দিনে দিনে কয়েকটা বছর পেরিয়ে যে রৌশন প্রাণপ্রদীপের মতো তার জীবনের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল আজ তা এক নিমেষেই যেন স্পর্শাতীত কোনো দ্বীপের মতো তার কাছে অসাধ্য-অসাধ্য লাগছে।
আঙ্কুরের বুকফাটা রোদনের জল আবেগের অন্ধ চোখ ধুয়েমুছে দিলে বুকটা হালকা হয়ে আসে। তখন গত শুক্কুরবারের দুপুরটা তার পষ্ট মনে পড়ে : সেদিন বাইরে ছিল ঝলমলা রোদ। আউশ ধানের ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝিরিঝিরি হাওয়ার মাতন। দক্ষিণের বাঁশঝাড়ে একটা বিরহী ঘুঘুর লম্বা লম্বা রোদন। ঠিক এমনি সময়ে গুটিগুটি পায়ে রৌশন এসে দোকানে ঢোকে। তার আগুনভরা শরীরের পসর আর রিনরিনে গলার আওয়াজ দোকানের ঝাপসা বধিরতাকে মুহূর্তে মুখর করে তোলে, — একটা বাংলা সাবান দে।
কলুবাড়ির গোপাটে পা দিতেই রৌশনকে আঙ্কুর দেখেছিল। দোকানের খোলা দরজা দিয়ে সে কলুদের ওই খাঁ খাঁ শূন্য গোপাট্টার দিকে রোজ রোজ সকাল থেকেই কাউয়ার মতো তাকিয়ে থাকে। তলে তলে বুকটাও ওমানো আগুনে পোড়ে। মাঝে মাঝে একটা নিষ্ঠুর পিপাসা আঙ্কুরের কণ্ঠনালীটাকে খাবলে ধরে। আঙ্কুর জানে না এই আত্মদহনের পরিণাম কী। রিপুর এই পীড়ন কেন থেকে থেকে প্রাণঘাতী আজাজিলের মতো তার বুকে চেপে বসে! সে রৌশনের কথায় চমকে ওঠে বিনীত ভঙ্গিতে সামনের দিকে কাতর চোখ তুলে। আর ঠিক তখনি তার আচান্নক সুন্দর চোখে জেগে ওঠে তীব্র প্রেম, কামনার আগুন। লা-জবান পশুর মতো আর্তনাদের ভঙ্গিতে সে রৌশনের দিকে তাকিয়েই থাকে। কিন্তু ষাটোর্ধ্ব খৈল্ল্যাকলুর অতৃপ্ত যুবতী বউ সেই আগুনকে দেখেও দেখে না।
রৌশন ভোররাতে তেলের ঘানির জোয়ালে কাঁধ দিয়েছিল। নাস্তা খাওয়ার সময় মেজো-সতিনের সাথে কলহও হয়েছিল একদফা। তাবাদে স্বামী নামক বুড়ো হাবড়াটাও তাকে একচোট হামকিধামকি দিয়েছে। করেছে বাপ তুলে গালিগালাজ। তাই আজ রসুন আঙ্কুরকেই পাল্টা ধমক দেয়, — কানে যায় না, একটা বাংলা সাবান দে।
— ভাওজে গ, (ভাবী গো) খালি বাংলা ক্যা, লগে একখান কসকোও নেও।
জীবনে এই প্রথম কোনো নারীকে একটা কসকো সাবানের ছলে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আঙ্কুর শরীর-মনে ম্যালেরিয়া জ্বরে পুড়তে থাকে। পুড়তে পুড়তে কাঠের কঠিন তাকে কসকো নামের একবুক ভালোবাসা খোঁজে। কিন্তু চিকনচাকন কামিনীর সংবঙা মন এত সহজে ধরা না-দিয়ে বাতুনি পথে চম্পট দেয়, — কসকো দ্যায়া কি অইব? কলুর পুত দেখলে হাড় গুড়া কৈরা দিব।
রৌশনের এই বাতুনি কথায় আঙ্কুর সাহস পায়। একটু যেন আশকারাও পায়। তাই সে শরীরের সব প্রেম-কাম একটানে গলায় তুলে ফিসফিস করে বলে, — ক্যান দেখব? একখান কসকো তা-ও লুকায়া রাখতারবে না?
এই কথা বলতে বলতেই আঙ্কুর তার সামনে দাঁড়ানো নিয়তিটাকে ভিখারীর চোখে আরেক নজর দেখে। কারণ সে এতদিনে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে যে, তার জন্য নিষাদের মৃত্যুবান এরই হাতে। যদিও নিস্তারহীন তেলের ঘানি টেনে টেনে আর তার সাথে মাঝেমধ্যে খৈল্ল্যাকলুর পাকা হাতের কিল-থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে রৌশনের ধারালো কামনা কিছুটা ত্যাবদা মেরে আছে। তবু নুন-পেঁয়াজ কেনার জন্য সে যতবার তার সামনে এসে দাঁড়ায় ততবারই রৌশন আঙ্কুরের সুন্দর চোখদুইটাতে না নিচের দিকে কী-একটা তালাশ করে। কারণ গ্রামের ত্যান্দর বউ-ঝিরা নিঃসঙ্গ, বিকলাঙ্গ আঙ্কুরের মনের খবর না-রাখলেও তার নিন্মাঙ্গটার আকার-প্রকার নিয়ে হাসাহাসি করে। তাই অতৃপ্তির আগুনে পোড়া রৌশন দোকানে এলেই তার চোখদুইটা আড়ে আড়ে আঙ্কুরের সেই বিশেষ অঙ্গটার তালাশে থাকে।
আঙ্কুর যখন কসকো নেবার জন্য ফের রৌশনকে তাগদা দেয় ততক্ষণে সে ভেতরে ভেতরে গলে-মজে কাঁই-হয়ে-যাওয়া নিজেকে সামলে নিয়ে ফুঁসে ওঠে, — তর কসকো আমি নিতাম ক্যা?
আঙ্কুরও বসন্তের কোকিলের মতো করুণ-কাতর গলায় রৌশনকে পিরিতির ছবক দেয়, — আমি কী তর পর?
— আপন-পরের কতা ক্যা? বাংলা চাইছি, বাংলা দেউক।
— বাংলার লগে একখান কসকোর দোষ কী?
— কসকোর দোষ না; দোষ মাইনশ্যের।
আঙ্কুর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। এই মানুষটাই তার সুখ-শান্তি লোপাট করেছে আর এখন কিনা সব বুঝেও না-বোঝার ভান করে! সে অবাক চোখে রৌশনকে দেখতে দেখতে যেন রোদনভরা গলায় জিগায়, — তাইলে আমি দোষী! এই আঙ্কুর দোষী?
আঙ্কুরের সুন্দর চোখের তারায় বিরাট একটা প্রশ্ন ঝকঝক করে জ্বলছে। তিরের মতো চোখা সেই জিজ্ঞাসাময় আগুনের দিকে তাকিয়ে রৌশন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়তে চায় কিন্তু সহজে হাল ছাড়ে না, — অত আলাপের কাম কী? মর্জি হইলে বাংলা সাবানডা দেউক, নাইলে অহন যাই।
রৌশনের খোমার দেখে আঙ্কুরের বুকটা গাছ থেকে পড়া পাকা তালের মতো ধপ্পত করে ওঠে, — খুব ত্যাজ বুঝি?
আঙ্কুর রৌশনের নজরে নজর গেঁথে বাংলা সাবানের বড় চাক্কাটা এগিয়ে দিতে দিতে কয় :
‘দিস ইজ কাচা মরিচ,
দিলে দিছ, না-দিলে না দিছ।’
আঙ্কুরের এই আজগুবি ভাষণে রৌশন ঝনঝন করে ওঠে, — এ্যাঁহ্ আমার পণ্ডিত রে! তর ইংরাজি লইয়া তুই বইয়া থাক। আমারে আর ইংরাজি দ্যায়া খুঁসটাইছ না।
মাঠের ঘাসে আছড়ে পড়া আঙ্কুর হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠে বসে। আগুনের শিষের মতো তার বুকের মাঝে কী-যেন একটা পসর দিয়ে জেগে উঠতে চাইছে! সে লাঠিতে ভর দিয়ে নুয়ে নুয়ে দোকানে ঢোকে। বুকের অতল অন্ধকার থেকে রেনু রেনু আলোর পসরের মতো জেগে উঠছে একটা অস্পষ্ট বোধ। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ম্যাচ খোঁচায়। বাতি ধরায়। কুপিবাতির লাল আলোতে মাটির দেওয়ালের ছোট্ট দোকানকোঠায় আলো ও অন্ধকার জড়াজড়ি করে দপদপায়। লাফালাফি করে। সেই আলোতে দেখা যায় তার শিথানদিকের দেওয়ালে, কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কোট-টাইপরা তরুণ বঙ্গবন্ধুর ছবি। আঙ্কুর ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। যখন তার মরে যেতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে পাশের খালের পানিতে গড়িয়ে পড়ে হারিয়ে যেতে, তখন সে তরুণ মুজিবভাইয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার দম পায়, হাবিজাবি স্বপ্ন দেখে।
আঙ্কুর পাছা ঘষটে ঘষটে ছবির সামনে থেকে সরে আসে। তার বালিশের পাশে শো শো করে টু-ব্যান্ড ফিলিপস রেডিওটা এখনো চলছে। সন্ধ্যারাতে বিবিসির খবর শুনতে শুনতে হঠাৎ সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই এখন আঙ্কুর রেডিওটা বন্ধ করে। তাবাদে টের পায় তার বুকের অতল থেকে আবার উঁকি দিচ্ছে রেনু রেনু আলোর পসর। এবার আরো পষ্ট ও চিত্রকল্পমুখর। সে এই গ্রামের ঘাটুদলের গীতিকবি এবং বিচ্ছেদগানের জোগানদাতা। অভিজ্ঞতায় সে জানে, একটু পরেই এই আলো তার গলায় বিচ্ছেগানের বাণী হয়ে জেগে উঠবে। তাই সে কাঁপা কাঁপা অস্থির হাতে ঝটপট খাতা-কলম বের করে এবং আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে টান দিতেই তার সারা মগজ জুড়ে রৌশনের হাসি-হাসি মুখটা ভেসে উঠলে সে চোখ বন্ধ করে গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করে :
পিরিতি কী জানো বন্ধু, বন্ধু রে
বুকে যখন আগুন জ্বলে,
ভালোবাসা আশার তরী
ভেসে যায় নয়নজলে,
পিরিতি কি জানো বন্ধু, বন্ধু রে…
প্রচ্ছদব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী আব্দুশ শাকুর শাহ
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ ৯ || শেখ লুৎফর - July 8, 2022
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর - November 20, 2021
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৭ || শেখ লুৎফর - October 30, 2021
COMMENTS