যুগ যুগ জিয়ে রহ প্রেম
মানু মিয়া চেয়ে দেখে পশ্চিমপাশের আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দলের সব-ক’টা আমজদ ঢালীকে নিয়ে ফাজলামি করছে। অবশ্য মাগীকুদ্দুর অভাবে আসরটা জমেও জমছে না। সে থাকলে দাঁতের ফাঁক দিয়ে চ্যারত করে থুতু ফেলে, পাছা দুলিয়ে সিলকি কাটত :
ঝিঙ্গাফুল ঝিঙ্গাফুল বৈকালেতে ফোটঅ,
খানকিমাগীর বত্তিশ পা রাইত হইলে উঠঅ।
মাগীকুদ্দু খেলার বাড়িতে। সে রান্নাবান্নায় খেলার মাকে জোগান দিবে। এই ফাঁকে ঘোড়ামোবারক তৈরি হয়ে ওঠে। সে গোপন সংবাদ নিয়ে ছুটে এসেছে রাজপ্রাসাদে। দায়িত্ববান কাশিদের (সংবাদবাহক) বেশে ছুটে এসে সে বলছে, — কুখাব নগরের রাক্ষসদের (নেওকা গ্রামের আমজদ ঢালীর ঘাটুদল) চোখে নিদ নাই জাহাঁপনা। রাক্ষস অধিপতি আমজাদ ঢালী খাঁচায় বন্দি পাখির মতো দিনরাত ছটফট করছে, বারবার শূন্যে তাকিয়ে উদাস হয়ে উঠছে তার চোখ-মুখ।
মালেক মহারানীর মতো ভঙ্গি করে চিকন গলায় জিজ্ঞেস করে, — কেন কী হয়েছে কাশিদ? চেমন নগরের মহারাজের (মানু) ভয়ে আমজাদ ঢালীর পাছার কাপড় কী ভিজে গেছে, খসে পড়েছে কী গোপন অঙ্গের কাপড়ও?
মালেকের বলার ঢং আর অঙ্গভঙ্গিতে দলের সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
মালেক বিয়ে করেনি। মনে হয় আর করবেও না। তার আড়ালে আড়ালে দলের অনেকেই এই বিষয়ে নানান মতবাদ প্রচার করে। যে যত কথাই বলুক মাগীকুদ্দুর এক কথা, — মালেকের মনে তিখ (দুঃখকষ্ট, অপমানের আঘাতে কোনো বিষয়ে কঠিন প্রতিজ্ঞা) আছে। মস্ত বড় তিখ!
মাগীকুদ্দু আর কিছু না বললেও সবাই বোঝে, দশ-বারো বছর আগে বাড়ি-ভিটার ভাগ নিয়ে ছোটভাইয়েরা মালেককে পিটিয়ে গতরের লও ঝরিয়েছিল। তাকে দেশের, দশের কাছে ছোট করে দিয়েছিল। তাবাদে সে রাগে-ঘিন্নায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সেই থেকে মালেক মানু মিয়ার বিলের কান্দায় কবুতরের খাঁচার মতো মাটির দেওয়ালের ছোট্ট একটা ঘর তুলে বসত করছে। পেশা মাছশিকার। রাত হলে বিলপারে বিলপারে মাছের ধান্দায় হাঁটে। তাই মালেককে বিয়ার কথা জিজ্ঞাস করলে হাসতে হাসতে বলে, — রাইতে মাছ ধইর্যা আইয়্যা দ্যাহাম, আমার বউ লইয়া মানু মিয়া ঘুমাইতাছে। মানু মিয়া হইল খাডি লুচ্চা। তার সামনে বউ কয়দিন ঠিক থাকব?
এদিকে মানু মিয়ার সামনে গাছের ছায়ায় বড় একটা চাটাই বিছিয়ে দিয়ে খেলা মানুকে কুর্নিশ করতে করতে বলছে, — বান্দার গোস্তাকি মাপ হয় জাহাঁপনা, অভাজনের এই দীন-আসন গ্রহণ করুন।
মানু মিয়া একটু মুচকি হাসে। তাবাদে তালগাছের মোথার মতো মস্ত শরীরটা আস্তে আস্তে ল্যাপচে পাটিতে বসে। উত্তরের জংলার পথ দিয়ে আঙ্কুরও আসছে। তার পেছনে জালু কলুর মাথায় তার হারমোনিয়ামটা। জালু-কলু কলু হলেও তেলের কারবারে সে নাই। বিষুধবার থেকে মঙ্গলবার এই ছয়দিন সে একটা পাতলা ছেনদা নিয়ে বিলের ডহরে ডহরে শাপলাপাতা তোলে। তাবাদে বিকালের আগেই শাপলাপাতার দুইমণ ওজনের বোঝাটা মাথায় নিয়ে ষাঁড়ের মতো দাবনা নাচাতে নাচাতে তিন-চার মাইল দূরের বাজারে গিয়ে হাজির হয়। দোকানদাররা শাপলাপাতা দিয়ে লবণ আর গুড়ের পোটলা বাঁধে। তাই জালু কলুকে বাজার বসার আগেই শাপলাপাতা দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতে হয়। এককুড়ি পাতার দাম দুইআনা। একটা টাকার মুখ দেখতে হলে জালু কলুকে এককলস ঘাম ঝরাতে হয়। তাবাদে বুধবারে কুলিগিরি করতে সে দশ মাইল দূরের বরমী বাজারে যায়। আজ সকাল সকাল বিলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েই দেখে আঙ্কুর তার দোকানের সামনে বসে আছে। হাতে বিড়ি। কাদু-কালুদের রঙ্গবাজ দলটা হাউঘাউ করতে করতে খেলার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আঙ্কুর তাকে দেখেই ডাক দিয়ে বলে, — এই জালু আমার হারমোনিডা ল। খেলার বাড়িত যাইয়াম।
একটাদিন নষ্ট মানে খাউন-পানি বাদে এক-দেড়টাকা লোকসান। জালু কলুর দুনামুনা দেখে আঙ্কুর জোশে ঘোষণা করে, — ওঁহু, তরে আমি মাগনা খাটাইতাম না। ল ল, তাড়াতাড়ি ল চাইর আনা পৈসা দ্যায়ামনে।
চারআনা পয়সা হলে গয়েশপুরের সাধনের হোটেলে পাঁচটা আটার রুটি আর বড় একচাক্কা গুড় পাবে সে। শাপলাপাতা বিকিসিকির পর খুব খিদা লাগে তার। এখন আঙ্কুরের এই উদার ঘোষণায় জালু কলু মোটা গোঁফের নিচে পিটপিট করে হাসে, — কী যে কও ভাই! তোমার লগে পৈসার হিসাব ক্যাডা করে।
কোমর-ধসা আশি বছরি বুড়া মানুষের মতো আঙ্কুর লাঠি ঠুকে ঠুকে আসছে। খেলা দৌড়ে গিয়ে আঙ্কুরের হাত ধরে, — গীতিকবি আঙ্কুর ভাইয়ের জয় হউক।
চাটাইয়ের আরেকপাশে আঙ্কুর তার লাঠিখানা রেখে কুঁজো হয়ে এমনভাবে বসে যেন ভুলেও মানু মিয়ার দিকে তার নজর না যায়। মানুকে সে দিলেমনে ঘেন্না করে। অপারগ না হলে কথা বলে না। তার বিচারে মানু মিয়া ইতর, চরিত্রহীন, লম্পট। দুর্বল চাষা আর কামলাদের সাথে কথা বলতেও মানুর হাই ওঠে। কিন্তু তালুকদারদের ছায়াটা দেখলেও সে কুকুরের মতো ল্যাজ নাড়াতে শুরু করে। সুযোগ পেলেই তালুকদার তালুকদার ভাব লয়। দলের কর্তাগিরি নিয়ে সে নাম করেছে। সেই দাপটে টিকেও আছে। না-হলে মড়লরা কবে তাকে তক্তা বানাত, কলুরা উচ্ছেদ করত লুচ্চামির মতো গুরুতর অপরাধে।
এখন দানবকালু নাচতে শুরু করেছে। মঞ্চে যেভাবে পিছনের দিকে হেলেপড়ে বিশাল দেহটা থ্যাবড়া থ্যাবড়া দুই পায়ের উপর দোলায় তেমনি করে নাচছে। এই বড় বড় দাঁত, গোল গোল লাল চোখ, এত্ত বড় বাবরি! সে কুখাব নগরের দৈত্যরাজ দানুকার্তিক। শিকাররত গফুর বাদশাকে অড়ং জংলা থেকে ধরে এনে বন্দি করে রেখেছে কুখাব নগরের বন্দিখানায়। এই বন্দিখানার দক্ষিণে এক অন্ধকার কুঠিতে বন্দি আছে পরীস্তানের বানেছাপরী। দৈত্যরাজ দানুকার্তিক তাকে পরীস্তান থেকে ধরে এনে বন্দি করে রেখেছে বিয়ে করার আশায়। সে জানে, গফুর বাদশা যদি দক্ষিণের বাগবাগিচায় ঘুরতে যায় তাহলে মুলাকাত হয়ে যাবে বানেছাপরীর সাথে। রাজপুত্রের রূপে মুগ্ধ হয়ে বানেছাপরী তাকে প্রেম নিবেদন করে ফেলবে। তাই এইমাত্র বন্দি হওয়া গফুর বাদশাকে সে নেচে নেচে নিষেধ করে দিচ্ছে :
দক্ষিণে যাইবা না তুমি রাজার কুমার
দক্ষিণেতে রাখা আছে প্রাণভোমরা আমার।
দক্ষিণেতে যদি তোমায় পাই,
তোমার মাথা চিবায়া চিবায়া খাই।
মানু মিয়া দানবকালুকে আড় নজরে দেখছে। মানুষটা দীঘে-ফাড়ে বিশাল। পরনে আড়াই টাকা দামের হাতিমার্কা লুঙ্গি। এইটাই বর্তমান বাজারে সবচে সস্তা। খাটো লুঙ্গিটা হাঁটুর কাছাকাছি কোনোমতে ঝুলছে। কাঁধে একটা ছিঁড়া ত্যানাত্যানা গামছা। কালো ছাইবর্ণ দানবকালুর গতরটা বিলপারের আন্দা-কান্দার মতো এ্যাবড়াথ্যাবড়া। নাকটা এত চ্যাপ্টা যে তাকালে খালি ছিদ্র দুইটা চোখে পড়ে। তাই আধানেংটু দানবকালুর দিকে তাকালে এক ধরনের ডরভয় যে-কোনো মরদের বুক দুর্বল করে দেবে। কিন্তু এইসব হলে কী হবে মানুষটার মনটা বরোধানের ক্ষেতের মতন নরম। সবাই বলে, কালু সরল। সরল এবং বোকা। কিন্তু মানু মিয়া জানে দানবকালু কোনোটাই না। সে সব বোঝে। কিন্তু জীবন সম্পর্কে তার একটা কঠিন অবহেলা আছে। একদিন বাজার থেকে ফিরতি পথে কী এক প্রসঙ্গে মানু মিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে বলেছিল, — অত লাঠি আর মাটি দ্যায়া কী আইব? মইর্যা কব্বর গ্যালে কেউ পেশাব কৈরা জিগাইত না।
নাচ শেষে দানবকালু ডানদিকের আমতলায় বসে। বিড়িতে দুইটা টান দিতেই তার মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। চানমোন সাহার পুকুরপারের বিরাট শিমুলগাছ ছাড়িয়ে নজর চলে যায় অনেক দূরে। গাঙপারের এই বিশাল চৌহদ্দিটা সে দেখছে। এই মাটির মক্করই আলাদা। একদিকে ফসল বোনে, আরেকদিকে কাটে। যাকে বলে মা-ফাতেমার দেশ। এই গাঁওটা বাদে আমজাদ ঢালীদের গাঁ, কালুদের গাঁ এক কিসিমের। অবশ্য মানু আর মড়লদের কথা বাদ। কলুরাও বাতিলের খাতায়। তাদের চৈতকাতি, এক রীতি। ঘানিতে সরিষা ফালাও, আর তেল তোলো। তারপর গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বিক্রিবাট্টা শেষে বাজার করে সন্ধ্যায় ফিরে আসো। যেমন রুজি, তেমন আহার। অন্তত কাদু-কালুদের মতো উপাস থাকার সম্ভাবনা একআনাও নাই।
‘আনমনা কেন হে বীরশ্রেষ্ঠ! যুদ্ধ আসন্ন, আপনি অস্ত্র ধারণ না করলে বিপর্যয় অনিবার্য।’ —
খেলার সংলাপে কালুর হুঁশ ফিরে। সে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, — হে অর্বাচীন বালক, তুমি কী জানো না, কুখাব নগরের দৈত্যাধিপতি বিনা যুদ্ধে জল স্পর্শ করে না?
— বান্দার গোস্তাকি মাপ হয় জাহাঁপনা, জলপানের পূর্বে অন্ন গ্রহন করোন।
আশপাশের প্রবীণ-নবীন সকলের জোর করতালির দাপটে পাশের ঝোপ থেকে একটা বাচ্চা-বাঁদর ভয়ে দৌড়ে পালায়। দানবকালু চেয়ে দেখে খেলা তার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে এক-সানকি মুড়ি। পেঁয়াজ-মরিচ আর গাওয়া ঘিয়ে জবজবা করে মাখানো। সবাই যার যার সানকি নিয়ে ব্যস্ত। অহাকালুর মুখখানা মেশিনের মতো চলছে। দানবকালু আচান্নক হয়, লগির মতো হাড়গিলা মানুষটার পেটখানা পিঠের সাথে সবসময় লেগে থাকে। কামে গিয়ে গিরস্তের বাড়িতে খেতে বসলে, কম করে হলেও সেরখানেক চালের ভাত কয়েক খাবলায় তুলে ফেলে। কিন্তু চিমসা পেটখানা সেই আগের মতোই পিঠের সাথে লেগে থাকে!
অহাকালু এখন রাক্ষসের মতো গিলছে। ওর খাওয়ার ধরন আর ক্ষিধার বহর দেখে মমতায় দানবকালুর বুক চিনচিন করে, আবার কিছুটা ঘেন্নাও লাগে। পেটের জন্য নিজেকে কুকুরের কাতারে নিয়ে যেতে তার লজ্জা লাগে। সে তার নিজের শরীরের দিকে এক-নজর তাকিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দানবকালুর বাপ বুড়াকালে বড় উলট-পালট কথা বলত। মাঝে মাঝে বড় করে দম টেনে বলত, — আল্লার বুদ্ধি আর খাটাশের বুদ্ধি এক। দ্যাখচা, অত বড় জানডা আমারে বিনা যোগানে দ্যায়া দিলো! আত্তির (হাতি) মতন এই গতরের আহার কৈ, কাপড় কৈ?
চব্বিশ-পঁচিশজন চেতা-জোয়ান সারি বেঁধে বেগুনক্ষেতে সুলা দিতে নেমেছে। হাতের নিপুণ মাপে নিঃশব্দে চলছে কোদাল। মাটিতে কার্তিকের টান। না স্যাঁতসেঁতে, না ঢনঢনা। জো-লাগা মাটিতে কোদাল চালাতেই চ্যাল করে চালিবাঁধা ঘাস মোথা-মাথা সহ উঠে আসে, খিলধরা মাটি হয়ে ওঠে ঝুরঝুরে, নাকে লাগে কদমফুলের রেণুর মতো হালকা ঘ্রাণ। মাটির সে-ঘ্রাণ মানুষগুলার রক্তে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। ঘোড়ামোবারক রাজারূপী কাদুর পাশে। কাদুর কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। বুক-পিঠ-পেট আর ঘাড়ের টানটান পেশী রোদের জেল্লায় চকচক করছে। চাষের সাথে এদের জন্মান্তরের চিন-পরিচয়। কাজ পেলে এরা আপন-পর ভুলে যায়। ঘোড়ামোবারক দেখে, কাদুর চোখ দুইটাতে আচান্নক এক সুখ ছলছল করছে।
ঘোড়ামোবারকের কামটাম ভালো লাগে না। অপারগ হয়ে সে কাজে নামে। মাঝে মাঝে সারাদিন ঘুমায়। রাত হলে সিঁধকাটার শাবল হাতে ছলিম-জব্বরকে নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে। তার পাশেই মালেক। সে পিঠ সোজা করতে করতে বলে, — সুলাটা ষোলোআনা বাত পাইছে।
মালেক এই ফাঁকে পরীকেও এক-ঝলক দেখে নেয়। মালেকের পাশেই ঘোড়ামোবারক। তার নজরও পরীর দিকে। মালেক আর ঘোড়ামোবারকের মাঝে একটা মিল আছে। ঘাটু আর বেটিমানুষ এই দুই বিষয়ে তাদের চিন্তা প্রায় সমান সমান। ঘোড়ামোবারক বলে, — জমিনটা বড় জো হইছে।
মালেক পরীকে আরেক নজর দেখে বলে, — জোয়ান মাগীর মতন।
ঘোড়ামোবারকের বুকটা ছাৎ করে ওঠে। সে ফের পরীর দিকে আড়ে চায়। যেই ভাবা সেই কাজ। পরী আঙ্কুরের কোলে বসে আছে। পরীর পিঠভরা মেয়েদের মতো লম্বা চুল। আঙ্কুর সেই চুলে নাক লাগিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে! সে সাথে সাথে খোঁচা দিয়ে মালেকের জিনিসটা দেখায়। মালেকের বুকটা ঘিন্নায় জ্বলতে থাকে। এই একটা বিষয়ে সে আঙ্কুরকে একদম সহ্য করতে পারে না। তাই ফিসফিস করে ঘোড়াকে বলে, — আঙ্কুর মিঠা মিঠা কতা কৈয়্যা আর দুই কলম বিচ্ছেদ গান ল্যাইখ্যা পরীরে মজাইছে। আর পরীও খানকির মতন এক্কেবারে লুচ্চাডার কোলে উঠ্যায়া বইছে।
মালেক নিবিড় মনে কাজ করে। বেগুনক্ষেতের ধুলামাটিতে ফালানির হাসি হাসি মুখটা ভেসে থাকে। এই একটা বিষয়ে সে একটু কাতর। বাদবাকি পনোরোআনাই সে চৈতের শিমুলতুলার মতো। জীবন সম্পর্কে সে খুব আশাবাদী না। একটা দা-কুড়াল দেখে অনুমান করা যায় জিনিসটা কতদিন টিকবে। কিন্তু মানুষ? কালাই বিলে উজাই মাছ শিকারের সময় সে তার বাপের কাছেই ছিল। ফড়াৎ করে আকাশটা বিজলি মারে। তারপরেই আগুনের একটা বিশাল লুক্কা প্রচণ্ড শব্দে তার বাপের দিকে নেমে আসে। সাদা কটকটা সেই আলো দেখেই মালেক দুই হাতে দু-কান চেপে ধরে, চোখ বুজে পানিতে গড়িয়ে পড়েছিল। শেষবার সে দেখেছিল, তার বাপ ট্যাঁটা উঁচিয়ে কোলবালিশের মতো ডিমওয়ালা একটা বোয়াল মাছের পিছে ছুটছে। এক সেকেন্ড পরে দেখে তার বাবা কাত হয়ে পড়ে গেছে। ছ্যাঙ্গাপোড়া বেগুনের মতো দেহটা থেকে বিকট গন্ধ আর ধোঁয়া বেরোচ্ছে!
তাবাদে সে কত দেখেছে, জীবনে একমিনিটের ভরসা নাই। সাপে কাটছে, ফি বছর ঘুরে ঘুরে আসা কলেরা-বসন্তে মরছে, ঠাঠা পড়ে সোনার অঙ্গ তিলেকে ছাই হয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ খামাখাই ছটফট করে ঘামতে ঘামতে নীরব হয়ে যায়। এইসব বিবেচনায় জীবন নিয়ে মালেকের কোনো বিশেষ ভাবনা নাই। খেলাদের মতো খুব একটা উচ্ছ্বাসও নাই। সে চুপচাপ সবকিছু দেখে, ভাবে। কিন্তু নিজের মনের ভাবনা পারতপক্ষে কারো কাছে বলে না। সবাই যার যার ফিকিরে ছুটছে।
মালেকের কোনো পিছুটান নাই। মায়ের পেটের ভাইদের সে অপছন্দ করে। বাপের ভিটার জমি নিয়ে ওরা তাকে কুকুরের মতো পিটিয়েছিল। সেই ভয়াবহ স্মৃতি সে কখনো ভুলতে পারে না। তাই ঘিন্না-শরমে সব ফেলে নীরবে চলে এসেছে মানু মিয়ার বিলপারের কান্দায়। মাটির দেওয়ালের উপর তালপাতায় ছাওয়া ঘরটা মুরগির খোয়াড়ের মতো ছোট। এই ছোট্ট খোয়াড়টাই তার কাছে সবচে আপন। পুবের ছোট খিড়কিটার ঝাপ খুলতেই হু হু করে বাতাস আসে। কালাই পাথারের পরিষ্কার পানি রোদের আভায় ঝলমল করে। দলে দলে পাখি উড়ছে, নামছে। তিন মাইল পুবের রেলসড়কটাও সারাদিন উদাস ভঙ্গিতে পড়ে থাকে। সেখানে মাঝে মাঝে শব্দ তুলে ট্রেন চলে যায় :
ঝুক্কুর ঝুক্কুর মৈমনসিং
আইতে-যাইতে কতদিন
কালাই পাথারের চারপাশে দশটা গ্রাম। কেউ মরলে বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে বুকফাটা রোদন ভেসে আসে। হাউঘাউ, চিৎকার, লাঠালাঠি তাও বাতাসে কান পাতলে পষ্ট মালুম হয়। একটু অবসর পেলে বিলের উঁচু কান্দায় বসে সে বিড়ি টানে। দুনিয়াদারির এই রঙ্গমঞ্চে বসে সে দূরের ডহরে মাছের ঘাই শুনে মনে মনে শিকারের ছক কাটে। মানুষে তার বিশ্বাস কম। তাই সে মানুষ নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখে না। তার বিবেচনায় ভাগ্যের কাছে মানুষ নির্বিষ জলঢোঁড়া সাপের মতো। সামনে পাইলে খামাখাই দশে-বিশে পিটায়। শরীর, মাথা থেঁতলে বিলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ে। জন্মের পর থেকে সে এই-ই দেখে আসছে। এটাই নাকি মানবজনমের নিয়ম।
মালেক বিষণ্ণ ও গম্ভীর। মাঝে মাঝে মানু মিয়ার ওপর ক্ষ্যাপে গেলে ঘিন্না-করে সে ঘোড়ামোবারকের সাথে ফাজিলিতে মত্ত হয়। তাবাদে খোদার প্রতি তার বিশ্বাস আর দশজনেরচে একটুও কম না। খোদার ভয়ে পারতপক্ষে সে মসজিদের সামনে দিয়ে কোথাও যায় না। পাছে সে না-জেনে কোনো পাপ করে ফেলে। সে অনেকের মুখে শুনেছে, মসজিদে জিন থাকে। একবার তার ফজর চাচা নাকি নাপাক গতরে মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় জিন তাকে আছাড় মেরে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু মালেক আখড়ার মন্দিরকে একটুও ভয় পায় না। মন্দিরের সামনে যত ইচ্ছা হাসো, লাফাও, চিৎকার করে করে গলা ফাটাও তবু ভয়েরচে আনন্দের পাল্লা হেলে পড়বে। সে দলে থাকলেও তেমন কথা বলে না। মনে মনে আমোদে থাকে। সবাইকে মন দিয়ে পরখ করতে পাড়ে।
তাবাদে মালেক কথা দিয়ে মানুষকে বিচার করে। মানুষের মুখের কথা খুব শক্ত জিনিস। তাই সে মুখ খুলে কম। এতে কথার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। এইসব ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয়, সে ফালানিকে চরমভাবে ভালোবাসে। কেন এইরকম মনে হয় তা সে নিজেও বলতে পারে না। সবচে বড় কথা, মালেকের চেতনা অস্পষ্ট। সে জীবনে কী চায় তা একবারও ভেবে দেখেনি। তবু জিজ্ঞাসা করলে হেসে বলবে, সে বাঁচতে চায়, সুখ চায়। ভালোবাসার কথা বলবে না। বক্কিল মহাজনের মতো ওটা লুকিয়ে রাখবে। পকেটে খুঁজে-পাওয়া পুরানা বকুলফুলের মতো ফালানির স্মৃতির গন্ধে মাঝে মাঝে সে চমকে উঠবে। ফালানিকে নিয়ে ধরা পড়ার ভয়ে ভেতরে ভেতরে সে তটস্থ থাকে। তার জীবনের পরতে পরতে ফালানির চিক্কন শরীরের গন্ধ, চুলের গন্ধ। মাঝে মাঝে তার দমফোট লাগে। ভাবে, — সে-ও বুঝি কালাই পাথারের বোয়াল মাছ, বোকার মতো গপ করে বড়শিটা গিলে এখন হা করে লটকে আছে!
এইসব মালেকের চিন্তা। সে চিন্তা বলে না। বলে ছক। মাছশিকারের জন্য নীরব টাইমে সে যেমন করে মাটিতে ছক কেটে কেটে শিকারের ধান্ধা করে। তবু মালেক জানে না কিসের জন্য সে লম্বা সময় নিয়ে গোসল করে। বাংলা সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গতরের ময়লা তোলে। নিশিন্দার ডাল দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁতন করে। ফালানির চুলে হালকা একটা সুবাস আছে। মালেক প্রথমদিনেই ফালানির এই জিনিস টের পেয়েছিল। সেই থেকে নিজের অজান্তে তার চিন্তাচেতনার অনেকটা বদল ঘটে গেছে। ফালানির কথা ভাবতে ভাবতে মালেক সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বুকে একবার হাত বুলায়। এখানে যেন নীরবে নিরন্তর বয়ে চলেছে স্বর্গের সামসাদ নদী, যার আরেক নাম প্রেম। মালেক প্রেমের মাহাত্ম্য কীর্তন করতে করতে বিড়বিড় করে একটা ডায়ালগই দিয়ে বসে, — প্রেম তুমি অধমের শিরে আকবরের হীরক-তাজ। তোমার জন্য গরিবের হৃদয়ে পেতে রেখেছি শাহজাহানের মযূরসিংহাসন। তুমি যুগ যুগ জিয়ে রহ প্রেম!
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ ৯ || শেখ লুৎফর - July 8, 2022
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর - November 20, 2021
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৭ || শেখ লুৎফর - October 30, 2021
COMMENTS