“জনগণের ধারণা আমাদের অঢেল টাকা। তারা এও মনে করেন আমরা বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকি। না ভাই আমাদেরও সংসার আছে, আমাদেরও বাচ্চা আছে — আমাদেরও একটা স্টমাক আছে।” — আইয়ুব বাচ্চু, ২০১৮ (মৃত্যুর কয়েকদিন আগের সাক্ষাৎকারে)
“শিল্পী মরলে শহিদ মিনারে বড় বড় ফুলের তোড়া দিয়া নিজেগো ফুডো খিঁচেন। আরে মিয়া ফুল না দিয়া হেই টেকা বাউল বাঁইচা থাকতে তার ফেডে খাওয়া দিলে কাজ হইতো অনেক বেশি — বাউল বাঁচত, গানও বাঁচত।” — কুদ্দুস বয়াতি, ২০১৩ (রহমান বয়াতির মৃত্যুর দিন একাত্তর টিভির সাক্ষাৎকারে)
১.
আজ কিছু বাজে কথা লিখতে ইচ্ছা হলো।
যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তারা অব্যশই জানেন আমি খুবই ‘বাজে মানুষ’। আমার অকৃত্রিম সত্য তথাপি বাজে কথা বলার অভ্যাস সেই বহু পুরনো। এসব বাজে কথা বলার কারণে আমার বহু জায়গায় দুয়ার রুদ্ধ, আমি নিষিদ্ধ, ও আমি রয়েছি কয়েক ডজন ‘অঘোষিত’ ব্ল্যাকলিস্টিতে।
কখনো আমাকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, কোনো জমকালো মিউজিক অ্যাওয়ার্ড নাইট, বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আয়োজিত ঈদে শিল্পীদের জন্য শুভেচ্ছা বিনিময় ও চা-চক্র সহ নাস্তা খাওয়ার অনুষ্ঠানে দেখবেন না।
অনেকে মনে করেন আমি হয়তো স্বেচ্ছায় এসব অনুষ্ঠানে যাই না।
কিন্তু রিয়ালিটি হলো ৪৪ বছরে বাংলাদেশের বহু শৈল্পিক অবদান আমার থাকা সত্ত্বেও — রাষ্ট্র, টিভিচ্যানেল ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আমাকে শিল্পীর স্বীকৃতি দেয়নি — তাই এইসব ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ অনুষ্ঠানে আমি আজ অব্দি আমন্ত্রণ পাইনি।
তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কোনো দুঃখ বা ক্ষোভ নেই । বহু আগেই মেনে নিয়েছি যে সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমি কোনো ‘ভাগ্যবান ব্রাহ্মণ’ নই। আমি অচ্ছুত, নমঃশুদ্র — ও এই ভাগ্য আমি আমার মাথার মুকুট বলে মেনে নিয়েছি। বলুন দেখি এই ভাগ্য ক’জনারই-বা জোটে?
২.
১৮/১৯ মাস করোনাকালীন শিল্পীদের লাইভ-এ নিয়ে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শোনার দেশি-বিদেশি রিকোয়েস্ট ও আড্ডার জন্যও একটাকা অফার করার মতো কলিজাওয়ালা মানুষ আমি অন্তত খুবই কম দেখেছি।
যেমন অস্ট্রেলিয়ার এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক গেল পহেলা বৈশাখে আমাকে ‘অফার’ করে বসলেন, — “মাকসুদ ভাই, আমাদের ফোরামে ৩০,০০০ লোক আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন”… আমি বললাম, — ভালো কথা, টাকা কত দিবেন?
উত্তরে বলল, “অমুক স্টার তমুক লিজেন্ড তো ‘ফ্রি’ করেছেন — তাই আপনিও যদি একটু …”
বিরক্ত হয়েই বললাম, একজন পেশাদারি শিল্পীকে কোন যুক্তিতে এই ভয়াল সময়ে যখন আমাদের আয়-রোজগারের সকল পথ বন্ধ — এ-ধরনের ‘অফার’ দেন?
এক অস্ট্রেলিয়ান ডলার করে ৩০,০০০ ডলার দিলেও তো আমি ৬ মাস ভালো থাকি — আর এক বাংলাদেশি টাকা করে ৩০,০০০ টাকা দিলেও তো আমি সামনের ১ মাস সসম্মান বাঁচতে পারি।
না, তা-ও দিলেন না — দিলেন একটা ‘টোপ’ — “ভাই, আমাদের অবস্থাও খারাপ — এই করোনা শেষ হলে আপনাকে ফের অস্ট্রেলিয়াতে ইনভাইট করব”।
আমার উত্তর শুনে মনে হলো বিব্রত হয়েছিলেন। “ঠিক আছে, ততদিনে যদি না-খেয়ে মরে না যাই তাহলে দিয়েন।”
৩.
ফেইসবুক-ইউটিউবে বাংলাদেশের অনেক শিল্পীর এক লক্ষ থেকে এক কোটি বা তারও অধিক ‘ফলোয়ার’ থাকাটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় না।
এসব গুণমুগ্ধ ফলোয়াররা শিল্পীর গান/ভিডিও ‘দেখার’ জন্য একপয়সাও খরচ করেন না এবং তাদের ফ্রি গানের হিড়িক ও নতুন গানের দাবিরও কোনো থামাথামি নেই।
কমেন্টবাক্স ‘ভূয়সী প্রশংসা’ ও প্রিয় শিল্পীর জন্য ‘বিনম্র শ্রদ্ধা’, ‘ভালোবাসা’ ও ‘লিজেন্ড’ তকমায় উপচে পড়ে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা কী করুণ — এসব তারা ভালো জেনেও না-জানার ভান করেন।
কিন্তু এসব ফলোয়ার যদি মাসিক এক বাংলাদেশি টাকা করেও চাঁদা দেন — আমাদের শিল্পীরা পৃথিবীর অন্য যে-কোনো দেশের শিল্পীদের ন্যায় “ধনী ও বিত্তবান” খুব সহজে হতে পারতেন।
দেশি শিল্পীরা গান রেকর্ডিং, ভিডিও খরচের জন্য বেনিয়া ‘বহুজাতিক’ রক্তচোষা স্পন্সরদের পিছুপিছু ঘুরতে হতো না — বছরে অনেক কন্সার্ট তারা নিজেরাই অর্গানাইজ করতে পারতেন।
নিদেনপক্ষে যার একলক্ষ ফলোয়ার সে যদি বছরে ১২ লক্ষ আয় করে তাহলে এই ১২ লক্ষ থেকে ১২ কোটি টাকা দিয়ে কী সৃষ্টি হতে পারে তা কি আমরা কেউ চিন্তা করি?
আমার শেষ কথা — আজকের করুণ বাস্তবতার যদি সমাধান শিল্পীরা নিজেরাই দিতে না পারেন, ইন দ্যাট কেইস্ আমাদের শিল্প, আমাদের গান যা ৫০ বছর ধরে আমরা নিজেরাই অকল্পনীয় ও অমানবিক পরিশ্রম দিয়ে দেশের মানুষকে শুধু নিঃস্বার্থে ভালোবেসে উপহার দিয়েছি — তা দ্রুত বিলীন হয়ে যাবে।
রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা অ্যাকাডেমি বা কপিরাইট বোর্ড — এনাদের কারো আমাদের দুঃখ বোঝার ক্ষমতা বা মাথাব্যথা নেই।
যদি বুঝতেন তারা ‘শিল্পী’ হতেন; — আমলা, রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী হতেন না; বহুজাতিকদের পা-চাটা দালালি করতেন না।
আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি ; ইতিহাস বলে, যারা শত্রুর দালালি করতেন ও এখনো করছেন তাদের ভাগ্য কিছু সময় ‘উজ্জ্বল’ থাকলেও তাদেরও একটা ‘এক্সপায়ারি ডেইট’ প্রকৃতি নির্ধারণ ঠিকই করে, করছে ও করবে।
আপনাদের দেশপ্রিয়তা ছাড়াও আছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা এবং আছে কোটি কোটি ফলোয়ার। কিন্তু এসব ফলোয়ার যারা সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়াতে যেসব কথাবার্তা আমাদের নিয়ে বলে, পামপট্টি দিয়ে মাথা নষ্ট করে, জন্মদিনে টাইমলাইন ফাটিয়ে ফেলে — তাতে কী কেউ আমরা মাইকেল জ্যাকসন বা ব্রিটনি স্পিয়ার্স বনে যাচ্ছি?
যদি বলেন ‘না’, আমি কি প্রশ্ন করতে পারি — “কেন না”?
আর শিল্পী মারা গেলে তাদের নিয়ে কি হয় — তা নতুন করে কিছু বলার আছে?
তাই শিল্পীদের কাছে আকুল অনুরোধ — স্বেচ্ছায় মানসিক দাসত্ব বরণ করবেন না।
পল্লবী, ৫ অক্টোবর ২০২১, ঢাকা
- Are we ready for Khilafa E Bangal? || Mac Haque - September 5, 2024
- সিজনাল মায়াকান্না ও আমাদের প্রতিবাদের ফ্যাশনেবল কালচার || মাকসুদুল হক - October 22, 2021
- স্মর্তব্য ১৭৭১ || মাকসুদুল হক - October 20, 2021
COMMENTS