চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৬ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৬ || শেখ লুৎফর

উদয়ের কালে


পালাশেষে আমোদের গপসপ আর বিচ্ছেদগানের করুণ সুরে সুরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, বিশ-পঁচিশজনের ঘাটুদলটা মাঠের মাঝখানে একটা পুরানাকালের জামগাছের তলে এসে দাঁড়ায়। তাদের চারপাশে, ক্ষেতে ক্ষেতে ধানের শীষ বেরোতে শুরু করা বিশাল মাঠ। তাই শেষরাতের আশ্বিনি বাতাসে ক্ষীরের মতো মিঠা সুবাস। পুব-পশ্চিমমুখো মাটির একটা চিকন সড়ক উত্তর-দক্ষিণমুখো আরেকটা চওড়া সড়কের সাথে এখানে এসে মিলিত হয়েছে। সেই নির্জন চৌমাথায় জামগাছটার মেলে-ধরা ডালপালার থিকথিকে অন্ধকারের নিচে, কাদু-কালুরা এখন যার যার ঠোঁটে জ্বলন্ত বিড়ি নিয়ে, হাউঘাউ আলাপে আলাপে মঞ্চের উত্তেজনা কিছুটা থিতিয়ে নিতে চাইছে। দানবকালু তার বিশাল দেহ আর বাবরিখানা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সিজিল-মিসিল করে একটা বিড়ি ধরায়। অন্যপাশ থেকে মাঝারি চেহারার শক্তপোক্ত শরীরের রাজারূপী কাদু, কালুর দিকে না তাকিয়ে ডানহাতটা এগিয়ে দিয়ে বলে, — উজিরে আলা, চেমন নগরের রাজাধিরাজ আজ কেন দেবতার ভোগ থেকে বঞ্চিত?

গফুরবাদশা গানের মঞ্চে কালুদানবের চরিত্র করে। তার মুখে থাকে দৈত্যের মুখোশ, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকে চটের আলখাল্লায়। তাই সকলে তাকে দানবকালু ডাকে। দাবনকালু তার বিশাল বাবরিটা ছড়িয়ে, বুড়ো আঙুলের নখের মতো বড় বড় দাঁতগুলা কেলিয়ে, সঙ্গীসাথি দানবদের নিয়ে যখন সে মঞ্চে দানবীয় নৃত্য করতে করতে হুঙ্কার দেয় :

হাঁউ-মাঁউ,
মানুষের গন্ধ পাঁও,
ধরে ধরে খাঁও।

তখন দর্শকসারিতে বসে থাকা ছোট ছোট শিশু ও বালকেরা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপে। কেউ কেউ ভেক্ করে চিৎকার দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে পালায়। কিন্তু এখন সেই দানবকালু শিশুর মতো নরম ভঙ্গিতে একটা মমতাজ বিড়ি রাজারূপী কাদুর দিকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু পাশ থেকে দলের কর্তা মানাউল্লা ওরফে মানু মিয়া কালুর দেওয়া বিড়িখানা দুজনের অজান্তেই নিয়ে নেয়। আর কাদু, যে সকল কাজ ও কথায় রাজকীয় আচরণই ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসে, কারণ বছরের পর বছর সে-তো প্রতিটা পালাতেই রাজার পাঠ নেয়। রাজারূপী কাদু তার পোক্ত দেহের মানানসই উচ্চতায় একটা রাজকীয় ভাব খেলিয়ে, ভরাট ও গম্ভীর গলায় বলে, — একখানা বিড়ি দিতে এত বিলম্ব কেন হে বান্দা?

বুড়ো জামগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে খেলা সবই দেখছিল। রাজারূপী কাদু বিড়ি না পেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে দেখে সে তার কাঁধের ঘোড়াটা (গফুর বাদশা যে-ঘোড়ায় চড়ে হরিণ শিকারে যায় এবং যেটি বাঁশ আর সালু কাপড়ে তৈরি) রেখে, নিজের প্যাকেট থেকে একটা মমতাজ বিড়ি নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে, বাঁ হাতখানা পেটের কাছে রেখে, বিড়িসমেত ডানহাত দিয়ে কুর্নিশ করতে করতে কাদুর দিকে এগিয়ে আসে, — জো হুকুম তো কাজ জাঁহাপনা, এই নিন আপনার মমতাজ।

কাদু একহাতে বিড়িটা খেলার হাত থেকে রাজসিক আদবে তুলে নিতে নিতে অন্য হাতটা বান্দার অবনত মস্তকে রেখে, দিলদরাজ রাজার মতোই খেলাকে আর্শীবাদ করে, — বেঁচে থাকো বৎসে!

এবার খেলা সোজা দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটে একখানা বিড়ি গুঁজে দিয়ে ম্যাচের বাকশে শলাই ঠোকে। হঠাৎ ফচ করে জ্বলে-ওঠা আলোতে দেখা যায় ঘোড়ামোবারকের দেহ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের গফুর বাদশা। ষোলো-সতেরো বছরের এই উঠতি তরুণের গায়ে এখন জরির জামার পরিবর্তে রঙচটা শার্ট-লুঙ্গি। আর খেলার পাশে পরী। পরীর সাধারণ বেশেই তার গায়ের ফর্শা রঙের সাথে নাক-মুখ-চোখের তরতরে ভঙ্গিতে এক অসাধারণ মোহঘোর সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে আঙ্কুরের লেখা বিচ্ছেদ গানটা অসীম দরদে গেয়ে সে শেষ করলেও গানের কথার রেশ যেন এই কিশোরের দেহ-মনে এখনো লেগে আছে। হয়ত-বা তাই তার চোখে-মুখে এখনো এক ব্যর্থ প্রেমিকের করুণ আর্তি ঝিলঝিল করছে। দলের শেষদিকে একটা চটের বস্তার ওপর বসে-বসে ঝিমুনির মাঝেই কামনালুব্ধ চোখে মালেক পরীকে দেখছে। সে এই দলের পোশাকাশাকের বস্তাটা সামলে রাখে আর পালাগানের বিরতির সময় মাঝে-মধ্যে ‘নাইড়্যা’ নামের জোকারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হাসিয়ে মারে। গেঁয়ো-গোঁয়ার-অশিক্ষিত শিল্পীপ্রাণ এই দলটার যে-কয়জন খুব গোপনে পরীকে নারীর মতো রাতের বিছানায় কামনা করে, তাদের মধ্যে মালেকও একজন।

দলের প্রতি নিষ্ঠা আছে, সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরদমাখা ভালোবাসা আছে আর দরকারমতো টাকাও ঢালে তাই ভেতরে ভেতরে কর্তার চেও দলের মাঝে খেলার কর্তালি অনেক বেশি। যদিও পরিশ্রম আর রাতজাগা ক্লান্তি তাদের ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে আছে তবু তারা প্রত্যেকেই ভেতরে ভেতরে আজ ফুর্তিতে টং হয়ে আছে। কেননা এই প্রথম তারা ‘গফুর বাদশা’ পালাটা সফলভাবে মঞ্চস্থ করে ফিরছে। দলের সবাই মনে মনে আশা রাখে, আজকের এই সাফল্যের রেশ ধরে তাদের দলের সুনাম আশপাশের দশগ্রামে আতরের সুবাসের মতো ছড়িয়ে পড়বে। বায়না আসবে ঘনঘন।

যদিও এই অঞ্চলে আরো কয়টা ঘাটুদল আছে এবং বেশ-কয়টা দল এর আগে কয়বার গফুর বাদশা পালাটা গেয়েছে কিন্তু কেউই তাদের মতো আসর মাত করতে পারেনি। পরী কিংবা গফুর বাদশা যতবার বিচ্ছেদ গেয়েছে ততবারই দুই-একটাকা বখশিশও পেয়েছে। বিশেষ করে পরীর সুর আর আঙ্কুরের লেখা বিচ্ছেদগানের কথায় মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। বলশালী মোবারক খাঁ বাঁশ আর সালু কাপড়ের খাপ-খোড়ল গতরে চেপে, পঙ্খিরাজ ঘোড়া সেজে, গফুর বাদশাকে পিঠে নিয়ে মঞ্চে যে-খেল দেখিয়েছে আর বিশালদেহী দানবকালু তার সঙ্গী-সাথি দানবদের নিয়ে ‘অড়ংজংলা’ থেকে শিকাররত গফুর বাদশাকে ধরতে গিয়ে যে তুমুল নৃত্য দেখিয়েছে তার তুলনা বিরল। আর সেইসব নিখুঁত দৃশ্যগুলার দিলকাড়া শৈলী এখনো তাদের চাষাড়ো বুকের শিল্পীহৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে উথলে উঠছে।

সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে-থাকা ফসলের মাঠের শেষে শেষরাতের চাঁদ উঁকি দেয়। তার টকটকে উজ্জ্বল আভা গ্রামের মাথার উপর ঢলে পড়লে সেই তীর্যক লালটে রেখায় দেখা যায় বিশাল মাঠে ধানের শীষে গশগশ আওয়াজ তুলে শেষরাতের ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। জামতলার অন্ধকারে ভূতের মতো বসে যারা মৌজে বিড়ি টানছে আর আগরাতে গাওয়া পালাটা মানুষের কাছে কেমন সমাদর পেয়েছে, তারই টুকিটাকি নিয়ে জোশভরা গলায় কেউ কেউ নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে।

মালেক দলের সাজপোশাকের বস্তার উপর বসে একমিনিটের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাবাদে অহাকালুর হাউহাউ হাসিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে অন্ধকারে ধড়ফড়িয়ে জেগে ওঠে। অহাকালু জোশে বিড়িতে একটা লম্বা দম দেয়। বিড়ির লাল আলোতে অহার রাক্ষস-রাক্ষস মুখটা দেখে মালেকের রাগ হয়। বড়শি দিয়ে মাছশিকার তার পেশা এবং নেশা। অধিকাংশ সময় সে জোতদারদের বিলের বড় বড় খাদ-ডুবাতে চুরি করে ছিপ ফালে। এই ছিপ ফেলাতে নানান কৌশল আছে। চিকন কৌশলে কারিন্দা না হলে মাছ তো মিলবেই না তাবাদে ডুবার মালিকের হাতেও পড়তে হবে ধরা। তাই মালেক হেকমত ছাড়া এক-কদমও ফেলে না। বোধকরি সেই চেতনা থেকেই অহাকালুর হাসিটাকে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত করতেই মালেক পরীর গাওয়া বিখ্যাত একটা বিচ্ছেদে টান দেয় :

আমি কার সাথে ঘর বাঁধিব
ও ভিনদেশী রাজার কুমার,
না দেখিলাম মমতাজমহল
না শুনিলাম আনারকলির বিরহরোদন…

এতেই অহাকালুর লম্বাটে মুখটা নষ্ট চোখের গর্তের মতো থিকথিকে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়।

দলের কর্তা মানু মিয়া এর মাঝেই বসে বসে একঘুম দিয়ে ফেলেছে। মালেকের গানের টানে হাঁটুতে রাখা থুতনিটা তুলে আর মনে মনে ভাবে :

শালার ঘোড়া পাদলে কি হবে?
গফরগাঁও যেতেই হবে।

মানু মিয়ার হয়েছে সেই দশা। ঘুমিয়ে পড়লে কি হবে, কর্তাগিরি তোমাকে করতেই হবে। তার শত্রুর কোনো শেষ নাই। ঘাটুদল ছেড়ে দিলে লুচ্চামিও ছাড়তে হবে। কর্তাগিরি না থাকলে তার হাতে লাঠিও থাকবে না। গ্রামের কেউ তাকে মানবে না। সে ঘাটুদলের কর্তা। তার হুকুমে কাদু-কালুরা সহ পঁচিশ-তিরিশটা তাগড়া জোয়ান উঠবস করে। দরকার পড়লে লাঠি-বল্লম চালায়। ঘাটুদলের লোকদের মুখে শুনে শুনে এখন সবাই তাকে কর্তা বলে ডাকে। ডাকে না শুধু তালুকদাররা। তারা মাঠের পর মাঠ ফসলি জমির মালিক। পাটমোকামে বড় বড় পাটগুদামের মালিক। শহরে-বাজারে হামেশা চলাচল করে। ইস্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছে। মানু মিয়া দশটা দলের কর্তা হলেও তালুকদাররা তাকে কর্তা বলে ডাকবে না। যদি দল হাতে না থাকে তবে মড়লরা খামাখা কয়দিন বাদে বাদে ঝগড়া বাঁধিয়ে তাকে কুকুরঠেঙানি দিবে। তাই বাপের পুত মানু মিয়া ঘুমে ধরলে কী হবে, তোমাকে কর্তালি করতেই হবে। এইসব বিবেচনা করতে করতে হঠাৎ মানু মিয়া মোষের মতো ভুস করে দম ফেলে বলে, — ঘাডুদলে অত সুখ! আগে জানলে ড্যানা হিতান দ্যায়া ঘুমাইতাম ত্যাও বিয়া করতাম না।

রাজারূপী কাদুর কাছে এখন বিড়িটার স্বাদ অমৃতসমান। তাই সে মানু মিয়ার কথায় কান দেয় না। দলের সবাই জানে, মানু সবখানে স্বার্থ খোঁজে। তার সব কথাতেই ভেলকি থাকে। তাই দলের কর্তার এই আলাপে কেউই কান দেয় না।

বিড়ির প্রত্যেকটা টানের সাথে রস-লালায় রাজারূপী কাদুর মুখগহ্বরে তৃপ্তির আজব ঢেঁকুর। এতক্ষণ সে বিড়ি নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিল যে অন্যদের আবেগ-উচ্ছ্বাসে শরিক হবার মতো ভাষা জবানে আসেনি। (কাদুর বিড়ি টানার ভঙ্গিটাও দেখার মতো। সে দুই-আঙুলের মাঝে বিড়িটা গুঁজে দিয়ে মুঠি ধরে ওস…ওস… করে এমন দম দেয় যেন বিড়ি নয় ভুক-তিড়াসী লোকটা সুগন্ধভরা বতক-চালের গরম গরম জাউ হাপুৎহুপুৎ গিলছে।)

কাঁধের গামছা দিয়ে রাজারূপী কাদু এবার মুখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। ডুবুডুবু চাঁদের আবছা আলোয় দেখে, জামগাছের বিরাট কাণ্ডে শেখ মুজিবের ছবিওয়ালা সাদা-কালো একটা পোস্টার। গত কয়দিন যাবৎ এই পোস্টারটা সবাই দেখছে। কলেজের ছাত্ররা এই-রকম শত শত পোস্টার প্রত্যেক বাড়ির মাটির দেওয়ালে দেওয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে। হাতে হাতে দিয়ে গেছে নির্বাচনী হ্যান্ডবিল। কাদু নজর করে দেখে, কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ের বন্ধু বঙ্গবন্ধুর ছবির নিচে নৌকা প্রতীক। শেষরাতের মিহি কুয়াশায় শেখসাহেবের মুখটা বুঝি একটু ভেজা ভেজা ! রাজরূপী কাদু সবার অলক্ষে তার গামছা দিয়ে মুজিবভাইয়ের মুখটা আলতো করে মুছে দেয়। তাবাদে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ছবিটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখে, পোস্টারের ভেতর থেকে শেখসাহেব যেন তার দিকে তাকিয়ে একটু একটু হাসছে!

এবার মঞ্চের রাজা কাদুর মাথায় বুদ্ধিটা চিড়িক করে চাগিয়ে ওঠে। সে মাথার চুলে বারকয় আঙুল চালিয়ে বিরাট বাবরিটা সিজিল করে নেয়। তাবাদে ছেঁড়া জামার কলারটা টেনেটুনে ঠিক করে মেঘ-গম্ভীর গলায় ডায়ালগটা শুরু করবার সময় তার চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর মুখটা আচমকা ভেসে ওঠে। আর সে বলতে শুরু করে, — বাংলার কোটি কোটি দুঃখী হৃদয়ের বন্ধু…।

কাদু দিব্যি দেখে, মানু মিয়ার মস্ত আর ভারী গতরটা কেঁপে উঠেছে! সে চমকে গিয়ে থেমে যায়। মানু মিয়া শেখসাহেবকে পছন্দ করে না। কাদু-কালুদের পেটে তিন বেলা দানাপানি জুটুক এটা মানু কস্মিনকালেও চায় না। তাই শেখসাহেবের জয়বাংলার হুঙ্কারে মানু মিয়ারা আজ বড় তটস্থ। রাজারূপী কাদু একটু মুচকি হেসে আবার প্রথম থেকে শুরু করে, — হে সম্মানীত বীর ও শিল্পীগণ…।

কাদু ফের ধিরিক ধরে। ভাবে। সে ‘শিল্পী’ শব্দটা তাদের পালামাস্টার বিকাশবাবুর কাছ থেকে আজ নতুন শিখেছে। আজকের পালাটা এত ভালো হয়েছে যে, ফেরার পথে বিকাশবাবু অভিনয় বিষয়ে অনেক লম্বা লম্বা গপ্প করছিল। সেই গপ্পে শিক্ষিত বিকাশ ‘শিল্পী’ শব্দটা বারবার বলতেছিল। তাই নিজের অজান্তে তার চোখ বিকাশের দিকে চলে যায়। তাবাদে পলকের মাঝে রাজা আবার নিজের বক্তব্যে চলে আসে : হে সন্মানীত বীর ও শিল্পীগণ, এই জংবাজির দুনিয়ায় আজ আমরা আখড়ার রঙ্গমঞ্চে যে ইজ্জত ও যশ পেয়েছি, আমার বিশ্বাস, তা দলের কেউই জীবনে ভুলবে না। এই গৌরবের পিছনে আমাদের সকলের কঠিন মেহনত আছে। আছে খাঁটি শিল্পীর প্রেম। তাই আমি চেমন-নগর রাজ্যের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলকে জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ। সেইসাথে বিশেষভাবে অভিবাদন জানাই পরীস্থানের রাজকুমারী বানেছাপরী আর যুবরাজ গফুর বাদশাকেও।

রাজার এই রাজকীয় সম্ভাষণে খেলা, পরী, গফুর বাদশা সহ দলের অধিকাংশ তরুণরা উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে রাজাকে অভিবাদন জানায়।

এক কোণায় চুপ করে বসে আছে মাগীকুদ্দু (গফুর বাদশার পালাতে সে রানীর পাঠ করে)। পঁয়ত্রিশ বছরের ছোটখাটো, কলহপ্রিয়, সন্দেহপ্রবণ, মাগী টাইপের কুদ্দু হাতের বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে লাফিয়ে ওঠে : অধমের গোস্তাকি মাপ হয় আলামপনা, অন্দরমহলের কথা দরবারে দাঁড়িয়ে বলতে আমার লজ্জা করছে জাহাঁপনা…। তবু বলতে হয়। আপনি নিশ্চয়ই আবগত আছেন, মেকাপের সময় গ্রিনরুমে আমার বুনি নিয়া বিরাট এক ষড়যন্ত্র হয়ে গেছে। চেমন নগরের অমিত ক্ষমতাধর রাজন্যের কাছে আমি সেই লাঞ্ছনার বিচারপ্রার্থী।

মেকাপের সময় রানীর স্তন নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথায় দলের সকলের মাঝে একটা টানটান উত্তেজনা দেখা দেয়। ওদিকে ঘোড়ামোবারক যে কিনা তার পিঠে গফুর বাদশাকে নিয়ে চার হাত-পায়ে চলমান শরীরের ভর রেখে সত্যিই একটা চতুষ্পদী ঘোড়ার মতো মঞ্চ দাবিয়ে ছোটে। এখন সে দলের মাঝ থেকে রাজার দিকে কুর্নিশ করতে করতে এগিয়ে এসে বলে, — জাহাঁপনার আদেশ হলে আমি সত্য কথা কহিতে চাই।

রাজারূপী কাদু ডানদিকের একটু ফাঁকা স্থানে সরে এসে তার ছেঁড়া ও মলিন জামাটার কলার ঠিকঠাক করে, মাথাটা সোজা করে দাঁড়িয়ে বলে, — হে বিশ্বস্ত অনুচর, তুমি বিলক্ষণ নির্ভয়ে সত্যি বলবে।

হয়-হয় ভোরের এই আশ্চর্য আলো-আঁধারির বিরল মুহূর্তে ‘বিলক্ষণ’ শব্দটা বলতে পেরে কাদুর মন একদিকে যেমন খুশি হয়ে ওঠে তেমনি শব্দটার সঠিক প্রয়োগ হলো কি না এই সন্দেহে ভীতও হয়। আর সেজন্যই সে সতর্ক চোখে সন্ধান করে প্রমটার কাম পালামাস্টারকে। কারণ সে নিশ্চিত যে, শব্দটার ভুল প্রয়োগ ঘটে থাকলে বিকাশবাবু ধমকে উঠবেন। কিন্তু যখন সে দেখল চারপাশে দাঁড়ানো-বসা পালাপাগল মানুষগুলার সাথে বিকাশবাবুও চকচকে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে তখন তার চেতানো বুকের গরম রক্ত ঝিক করে লাফিয়ে ওঠে। আর ঘোড়ামোবারক তার ছিপছিপে গতরটা আবছা আলোয় কুর্নিশের ভঙ্গিতে দেড়পাক দিয়ে রাজার সামনে এসে দাঁড়ায়, — বান্দার গোস্তাকি মাপ হয় জাহাঁপনা। ষড়যন্ত্র নয় হুজুরে আলা, বস্তার ছিঁড়া কোণা দিয়া রানীর একজোড়া বুনির একখানা কৈ-জানি পড়ে গেছিল।

রাজারূপী কাদু আর তার বান্দা ঘোড়ামোবারকের চারপাশ থেকে বৃষ্টির মতো হাততালি পড়তে থাকে আর তার শব্দে জেগে ওঠে চারপাশের ভারী বাতাস। জেগে ওঠে শিশিরভেজা ফসলের বিশাল মাঠ আর আদ্যিকালের জামগাছটার ডালপালার কুঠরে কুঠরে ঝিমুতে থাকা পৈখপাখালিরাও।

গতকাল সন্ধ্যায় গ্রিনরুমে সকলের মেকাপ শেষ শুধু রানীই বাকি। মঞ্চে বন্দনার দল পাঠাবার জন্য আয়োজকরা বারবার এসে তাগদা দিচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ মাঠে গমগম করে কথা বলছে। আর ততক্ষণে ভিড়ের মাঝে বারবার জোর গলায় হাঁকডাক উঠছে। এমনি এক চরম মুহূর্তে দেখা গেল রানীর স্তনজোড়ার একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিস্তর সাজ-সরঞ্জামের মাঝে নারিকেলের একজোড়া মালাইচাকির একটি হয়তো-বা কোথায় ছিটকে পড়ে গেছে কিন্তু মাগীকুদ্দুর সন্দেহপ্রবঙণ মন এটাকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলতেই পছন্দ করে। কারণ রানীর পাঠ করতে গিয়ে তাকে প্রায়ই ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটা বলতে হয় আর এভাবেই সে যেন এই গালভরা শব্দটার প্রেমে পড়ে গেছে। তাই তার স্তনজোড়ার একটা না পেয়ে সে কোনোকিছু না-বুঝেই চেঁচিয়ে উঠেছিল, — আমার একটা বুনি কৈ? এ যে দেখছি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র!

তখন খেলা পাশের দাসবাড়িতে ছুটে যায়। সেখান থেকে অবিকল আরেকখানা মালাইচাকি এনে, ব্রার মধ্যে ভরে, মাগীকুদ্দুর বুকে টাইট করে বেঁধে দিলে, নিজের উদ্ধত বুকের দিকে তাকিয়ে রানীর গলায় যেন পানি ফিরে আসে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you