সাতটায় একটা ‘টক’ আছে, কিন্তু তারো আগে কিছু কাজ গোছানোরও বাকি আছে, তাই বেরোই একটু আগেই। আবার পথের আগা-মাথা জ্যামও আছে। দেড়টায় বেরিয়ে পড়ি, ঠিক সময়মতন শাহবাগ, ধরা যাক দু’একটা বাস এবার। বৃষ্টির ছাট বাড়াতে পিজির ওষুধের দোকানগুলার সামনের পথে আশ্রয় নিলাম, বৃষ্টি খানিক খানিক বাড়ে। দুইটা প্যারাসিটামল কিনে মনে হয় যাই আজিজে, অন্তত দুই-একটা বই দেখতে দেখতে বৃষ্টি চলে যাবে। আজিজে গিয়ে এক দোকানে পানি চাইলাম, কয় পানি নাই। আরেক দোকানে পানি দিয়ে ২টা ট্যাবলেট ক্যোঁৎ করে গিলার আগেই একটা চায়ের কথা বলে রাখলাম। চা খাওয়ার পরেও দেখি বৃষ্টি কমে না। ইতিউতি ঘোরাফেরা করার চেষ্টা করি, কিন্তু কাপড়ের বাজারে আমার কোনোদিন ভাল লাগে নাই। আমি অই আজিজের নিচতলায় প্রথম লেনে যে সিডির দোকানটা আছে অইটার দিকে যাই, দেখি নতুন কি ওরা পাইরেট করল। কী জানি দোকানটার নাম! আমার মনে নাই। অনেককিছুই মনে থাকে না কোনো কারণ ছাড়াই।
দোকানি হাসি দিয়ে বলল, ভিতরে চলে আসেন। আমি অই কাউন্টার অতিক্রম করে ভিতরে চলে যাই ব্যাগটা রেখে, পাইরেটেড সিডিগুলি দেখি। উত্তর ভারতীয় ধ্রুপদের কালেকশনটা তাদের ভালোই। একসময় তাদের কাছে নিয়মিতই যাইতে হইত। তখন আমার ইন্টারনেটের গতির অবস্থা ছিল বেহাল, আর আমার আশেপাশের মানুষজন তখন এইসব শুনত না, এখনো যে তারা শোনে তাও ঠিক নয়, কিন্তু এখন দেখি আমার আশেপাশের লোকজন এইসব শুনে তার মানে আমি আমার আশপাশ পাল্টাইসি মনে হয়। যা-ই হোক খুঁজতে খুঁজতে দেখি আনন্দ শঙ্করের একটা ৪ সিডির কম্পাইলেশন। অনেক আগে, ‘লাইট মাই ফায়ার’-এর কাভার শুনসিলাম। তখন কেন জানি মনে হইত, ‘ডোরস্’-এর চাইতেও আনন্দ শঙ্করের কাভারটা আরো ভয়ঙ্কর। মনে হইল, পকেটের টাকায় একটা সিডি তো কুলাবেই। ঝটফট কিনি, বৃষ্টি তখনো ধরে আসে না। কেনা সিডিটাই বাজাতে বলি। প্রথমটার নাম ‘কলিকাতার পথেপ্রান্তরে’!
বাজানোর সাথে সাথেই সত্তুরের ইলেক্ট্রিক আওয়াজ মগজের তারগুলোতে বেইজ হয়ে বাজতে থাকে। ছবি খুঁজতে থাকে, মাথাটা যেন তখন গ্যুগল, সত্তুরের কলকাতা সত্তুরের রঘু রাই! নাহ্, মেলে না, আনন্দ শঙ্কর অনেক রঙিন, কিন্তু রঘুর মতনই ‘নির্ধারনী মুহূর্তের’ খেলা। অথবা রঘুবীর সিং। কী জানি কিন্তু অই সকল পথের উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা অই সকল রগরগে কারবার শরীরের পেশিগুলোকে উন্মাদের মতন নাচিয়ে দেয়। অই যে হিপিরা আসছে। অই যে সত্তুরের দশক মুক্তির দশক, অই যে রেড লাইটের লকলকে জিব্বা , অই যে অ্যাম্বাসেডরে মুখ ঢেকে চলে যায় খুনিদের বাবা-মা। বৃষ্টি আরো বাড়তে থাকে। আমি মিশে যাই আনন্দে।
পশ্চিমের সংগীত বর্ণনা করে। কিন্তু অই রক-অ্যান্ড-রোলের পরের যামানা আর তা করে না। কেমন যেন একটা ভাব অথবা আরো অনেক মানসিক অথবা বিমূর্তি নিয়ে তার আড্ডাখানা, আর চরম অ্যানার্কিস্ট। আনন্দ বুঝে যান সব। অই অনুভূতি অথবা এক্সপ্রেশন আর তার নিজের মুনশিয়ানা, উত্তর ভারতীয় সেতারে, কী অদ্ভুত মিশে যায়। একে অপরে ফানা ফিল্লা।
আমার যাত্রা শুরু হয়, পেছনে। যে-যুগ আমি দেখি নাই। আমার চোখের সামনে বাইস্কোপ। পার্কাশন আর সেতার আর নানা নাম-জানা না-জানা কি কি জানি বাজে। ডিস্কো আসে, আসে গ্রুভ। চোখ জ্বলে ওঠে। আর খুব মনে হয়, বড় পাপ হে! এ পাপের সংগীত, পপেরও! এর মাঝে বাজে কঙ্গো, অশান্ত কঙ্গো কিংবা পাখোয়াজ, বেইযের সাথে সেতার। মাঝে মাঝে মনে হয় পূর্ব আর পশ্চিম মিলে এখন শিল্পীরা, সংগীতকারেরা যা করছে, তার পূর্বপুরুষ আনন্দ। মিসিং লিঙ্ক।
বাজারে আনন্দ নিয়ে তেমন কথা হতে শুনিনি, অথবা অন্য কোনো আড্ডায়। কিন্তু একটা লোক বিপরীত ভাঙা দরজা আর শার্শিটা ঠিকই মিলিয়ে দিলেন। বিটিভিতে নাটকের জন্য এমনি মিউজিক হতো মাঝে মাঝে। এখন আর হয় না। তখন হয়তো কেউ আনন্দ মেরেছে অথবা ঠিকই নিজের মতন খুঁজে পেয়েছিল রতন। সিডি আগাতে থাকে। সূত্রগুলো এলোমেলো ঝড়ের মতন। এখানে ওখানে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। এক সিডির পরে আরেকটা কিনে ফেলি, ভাবি এইমাসে তাহলে এক’শ টাকা শট।
সংগীতের নাম ‘বিপ্লব’। বিপ্লব কেমন! বল প্রয়োগের খেলা, শত্রু শত্রু খেলা। মাথার ওপারে শকুনের নিঃশ্বাস। আর সময় চলে তো একটা উল্কার সাথে। প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞা আছে। আছে অদম্য সাহস। আছে শোক, মৃত্যু এবং ধর্ষণ। জল্লাদের উল্লম্ফন। আর চরম প্রতিশোধ। আর অই যে অবসরে স্মৃতির কোণে সেই গুমরে মরার ভয়। চরম চলে তবলা। অই যে কুচকাওয়াজে আসে রোমের সেনা। সশস্ত্র, তিরের ফলায়, তলোয়ারে বিষ। দেবী আসেন। মা দুর্গা? ত্রাতা? নাকি সত্তুরের দশক সর্বহারার? প্রতিরোধ আসে, প্রবল প্রতিরোধ। সম্পূর্ণ বিপ্লব! মডার্নিস্ট!
এর মাঝে সত্যসাঁই বাবা আসেন। থাকেন হিপি, থাকেন হেনড্রিক্স, ডোরস্, ডিস্কো, জ্যাজ, মাঝে শোঁ শোঁ করে ঢুকে পরে দক্ষিণ ভারত। রঙটাই কেমন যেন! মরা, গভীর, কালো, খয়েরি। কিন্তু মখমলের ঝিলিক। কোথায় যেন একটা অপরাধের শুঁড়। অপরাধ নাকি পাপ! আমিই-বা সংগীতের কী বুঝি! মাতালের ল্যুসিড স্বপ্ন! পৃথিবীটা অতিপরাবাস্তবের খোলস। চ্যাপ্টারের পরে চ্যাপটার। মহাকাব্যের মতন ব্যাপ্তিও থাকে। দৃশ্যের অনুভূতি ভুট্টারই খৈ! বৃষ্টি ধরে আসে। আমার তাড়া থাকে। আধভেজা শরীর নিয়ে কোনো-এক রিকশাওয়ালার সাথে বাজে দরদাম করে ধীরে ধীরে চলে যাই।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪
লেখাটা আগে একবার ছাপা হয় ‘লাল জীপের ডায়েরী’ লিটারেরি সাইটে। লেখকের সঙ্গে সংযোগ না-থাকায় লালজীপের অন্যতম সঞ্চালক বিজয় আহমেদ এই রিপ্রিন্টের ব্যাপারে লেখককন্সেন্ট আদায়ে হেল্প করেছেন। — গানপার
… …
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS