জন্তুসভ্যতা || আহমদ মিনহাজ

জন্তুসভ্যতা || আহমদ মিনহাজ

অতিমারি পরবর্তী বিশ্বে সিনেদর্শকের পর্দায় সহিংসতা চাখার লিপ্সা নতুন বাঁক নিতে যাচ্ছে। সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার মাসালামুভি অ্যানিম্যাল দেখে সেরকমটাই মনে হলো। বঙ্গা একালের পরশুরাম। সহিংসতার কুঠার হাতে দর্শককে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন,—সিনেমা দেখতে বসে লজিক-ফজিকের তোয়াক্কা করা যাবে না। পর্দায় সে যা দেখছে ভারতীয় মশলা সিনেমায় সেটা অনেকদিন ধরে নিখোঁজ। সন্দীপ বঙ্গা যুগের নতুন সওদাগর। কী করলে সিনেমা বাজার পাবে সেটা ভালো বোঝেন। এমন একখান ছবি বানিয়েছেন, দেখতে বসে দর্শক একদিকে সমানে গাল পাড়ছে আর অন্যদিকে চেখে দেখার লোভে গাঁটের পয়সা খর্চায় ইতস্তত করছে না! দর্শককে দোটানায় রেখে ছবি দেখতে বাধ্য করার ইকোনমিক্স অর্জুন রেড্ডি রিলিজের দিন থেকে মগজে স্ক্যান করে নিয়েছেন এই নির্মাতা। ছবির ফ্রেমে রাষ্ট্রকে উহ্য করতে তাঁকে তাই গাড্ডায় পড়তে হয়নি! হ্যাঁ জনাব, অ্যানিম্যাল-এ রাষ্ট্র নেই। মশলা সিনেমার অকাট্য ট্রেডমার্ক পুলিশকে কোথাও খুঁজে পাওয়ার নয়। আইন-আদালত সেখানে নিষ্ক্রিয়। পৌরুষ অপ্রতিরোধ্য। নারীর ওপর পুরুষের এবং পুরুষের ওপর নারীর বাসনা ও অধিকার অপ্রমত্ত। চিরাচরিত ভারতীয় সমাজের দেখা মিলছে কিন্তু এটাকে মহিমান্বিত করার সনাতন প্রথা তিনি গোনায় ধরেননি। দেখতে বসে ছবির বিশেষ এই দিকগুলো সবার আগে নজর কাড়ে।

সে নাহয় হলো। ছবির গল্পটি কেমন? সোজাসাপটা উত্তর,—গতানুগতিক। ক্লিশে গল্প ফেঁদে দর্শকের গাঁটের পয়সা খসানো সহজ কর্ম নয়। এই ধাঁচের গল্প দর্শককে গেলানোর জন্য নির্মাতারা সচরাচর যেসব অঙ্ক কষে থাকেন অ্যানিম্যাল সেগুলোকে আমলে নেয়নি। পরিচিত ছক বিলোপ নয়তো অগ্রাহ্য করে ছবিটি তিনি পর্দায় মুক্তি দিয়েছেন। দর্শকের একাংশ যে-কারণে বেজায় হোঁচট খেয়েছে। সমাজমাধ্যমে একে উদ্ভট, যুক্তিহীন ও এলোমেলো বলে গাল পাড়ার এইটে হচ্ছে বড়ো কারণ। ছবির গল্পটি দর্শকের অজানা ঠেকছে না অথচ পর্দায় দেখতে বসে হিসাব মিলছে না। কীসের মধ্যে কী ভেবে অনেকে তাই বিরক্ত হয়েছেন। চেনা গল্পছক দর্শককে চটজলদি ঠার করতে না দিয়ে সমাজমাধ্যমে হাইপ উঠানোর খেলা সন্দীপের মারণাস্ত্র। বক্স অফিসে ঝড় তুলতে চালাকিটা কাজে দিয়েছে। বিব্রত-বিড়ম্বিত দর্শককে হলে টেনে ছবি হিট করানোর ইকোনমিক্স, মানতেই হচ্ছে, ব্যতিক্রম ছিল।

ইকোনমিক্সটি বুঝতে ছবির কাহিনি আরেকটু ভেঙে বলা যাক। সম্পত্তি ও ব্যবসার ভাগ নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে বিজনেস টাইকুন বলবীর ওরফে অনিল কাপুরকে খতম করার মিশনে নামে শত্রুপক্ষ। বাপভক্ত ছেলে রণবিজয় ওরফে রণবীর কাপুর বলবীরের আচমকা গুলি খাওয়ার শোধ তুলতে খুনখারাবির যজ্ঞে নামে। প্রকাশ্য দিবালোকে একের-পর-এক খুনের মচ্ছব শুরু হয়। আগার তুজে হো গায়া কুছ সারি দুনিয়া জ্বালা দেঙ্গে-র নাম করে অকাতরে মানুষ মারছে অথচ কেউ তাকে আটকাচ্ছে না! আটকানোর সকল পথ ছবি থেকে ভ্যানিশ করেছেন সন্দীপ। দূরবীন দিয়ে খুঁজে পাওয়ার নয়। পুলিশ নেই চারিধার। জেল-হাজত-আদালতের দেখা মিলছে না ত্রিসীমানায়। আজব ব্যাপারটি দর্শককে খেপিয়ে তুলতে যথেষ্ট। তার ওপর পর্দা জুড়ে সারাক্ষণ রণবিজয়ের আলফা মেল বা উগ্র পৌরুষসুলভ বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড তাদেরকে সইতে হচ্ছে। কারো সাধ্য নেই ব্যাটাকে থামায়। শোধ তোলার নামে খুনখারাবির নৈতিক দায় নিয়ে একটি বাক্য খর্চা করছে না কেউ! দর্শককে অপ্রস্তুত বিড়ম্বিত করতে আর কী লাগে!

মাটিতে আছড়ানোর মতলবে দর্শককে ভুলিয়ে-ভালিয়ে হলে ঢুকিয়েছেন পরিচালক;—বিশ্রী এই অনুভূতির চক্করে যারা পড়েছেন তাদের পক্ষে ছবিটিকে ডিজাস্টার ছাড়া অন্যকিছু ভাবা কঠিন। উনাদের ক্ষোভ মিথ্যে নয়, তবে চেনা গল্পের অতিচেনা ছকগুলোকে অফসেট করার খেলাটি এখানে সন্দীপের আপার হ্যান্ড ছিল। অনেকে মানতে চাইবে না তবু একথা সত্য,—মশলা সিনেমা বানানোর স্বীকৃত সংবিধান থেকে অ্যানিম্যাল নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ওই সংবিধানে যত তরিকার দেখা মিলবে তার কোনোটিকে গুরুত্ব দিয়ে পোছার ঠেকা অনুভব করেনি নির্মাতা। এর সংক্রাম থেকে নিজেকে আলগ রাখতে গল্প বলার ছকে এনেছেন ভিন্নতা। ভিন্নতার ধরন নিয়ে তর্ক থাকতে পারে কিন্তু এর প্রভাব ও সফলতাকে খারিজ করা বেশ কঠিন।

ছবি দেখে নিজের নৈতিক খেদে মলম লাগানোর আশায় ভূবর্ষে দর্শক সিনেমাহলে ঢোকে। মারপিটের সিন এলে সিটি ও তালিয়া বাজায়। রোমান্সে পুলকিত হয়। খুল্লামখুল্লা আইটেম সঙ শুরু হলে নাচতে দ্বিধা করে না। কমিক দৃশ্যে হল গুলজার করে হাসে। বিচ্ছেদ-বিরহ, দূরত্ব কিংবা ভুল বোঝাবুঝির সিনে আসু মুছে ঘনঘন নতুবা বিষাদে ভারী হয়ে আসে তাদের বুক। মশলা ছবির অকাট্য এইসব উপকরণ দর্শককে উপহার দিতে অ্যানিম্যাল কঞ্জুসি করেছে। রোমান্স-সেক্স-ন্যুডিটি, কমেডি বা অ্যাকশন সিনের সবটাই সেখানে উগ্র পৌরুষকে সার্থক করতে প্রাণপণ খেটেছে। খাটনির মধ্যে চড়া সুরের ভাবাবেগ ও অকারণ ক্যাওস ছাড়া সিংহভাগ দর্শক দ্বিতীয় সারবস্তু খুঁজে পাননি। ওদিকে সারবস্তুহীন ছবিটি দেখতে বসে চড়া লয়ের ওইসব ভাবাবেগ ও ক্যাওসের পর্দাসম্মোহন ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা তাদের পক্ষে সহজ হয়নি। সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে অত্যাচারটি তারা সহ্য করেছে। দর্শকের ইমোশনকে নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে ওঠার নয়া ফন্দি যেন খুঁজে নিয়েছে এই ছবি! বলিপাড়ার বাঘা-বাঘা মশহুর ডিরেক্টর অদ্য যে-ফন্দি বের করতে হেদিয়ে মরছেন! মশলা সিনেমার রন্ধন পদ্ধতি বিবেচনায় নিলে অস্ট্রেলিয়ায় বসে ফিল্মবিদ্যায় হাত পাকানো ও পরে বাপের জায়গাজমি বেচে অর্জুন রেড্ডি বাজারে ছাড়ার হ্যাডম দেখানো বঙ্গার রেসিপিটা এ-মুহূর্তে ইউনিক।

মাঙ্গায় ভর দিয়ে চলা জাপানি ছবির ভাষা আর ফরাসি গাসপার ন্যুই কিংবা ইতালি থেকে মার্কিনদেশে চালান কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর ছবিতে ক্যাওসের ব্যাপক সংহতি দেখে দর্শক মুগ্ধ হয়। ক্যাওস নিয়ে দু-চার ডজন বুলি কপচানোর খেলায় ফিল্ম ক্রিটিককে বেগ পেতে হয় না। সাহিত্যলগ্ন থাকার আবেশ অটুট থাকে মনে। সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার ছবিতে ওসবের বালাই নেই। কুছ না থাকাটা কি তবে বেমানান হলো? বদখত বলে ছবিটিকে মার্ক করা উচিত? প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠাস করে দেওয়া মুশকিল। কিন্তু হ্যাঁ, মোদিজির ভারতবর্ষে চাড্ডি মানে ওই লেংটিই সার! ওটা ছাড়া কিছু বাকি পড়ে নেই। বিজেপি, আরএসএস, হিন্দুত্ববাদের আস্ফালন, ভোটারের মন জিততে রামমন্দির, আলফা মেলসুলভ পালোয়ানি…এগুলো এক লহমায় দেখে নিলে সন্দীপকে গালাগাল করার যুক্তি থাকে না। সমাজ তলে-তলে চাড্ডি হওয়ার খোয়াবে বিভোর। গণমনে জান্তব খিদেকে অ্যানিম্যাল-এ ভাষা দিয়েছেন পরিচালক। এখানে তাঁর অপরাধ কোথায়? সমাজের গহিনতলে ঘাপটি মেরে থাকা বাসনাকে অ্যানক্যাশ করার কেরামতি মশলা সিনেমার পুঁজি। ওটা চিরকাল ছিল, আজো অবিকল। অঙ্কটি বঙ্গা অন্যছকে মিলিয়ে নিয়েছেন। তফাত যদি বলি তবে এটুকুই।


অ্যানিম্যাল
-র বয়ানে সক্রিয় লজিক বাস্তবের সঙ্গে ক্ষীণ সংযোগ রাখলেও একে সমীহ করেনি। সমাজের ওপরতলায় বসে যারা কলকাঠি নাড়ে তারা নিচতলায় যারা দিনাতিপাত করে তাদেরকে সমীহ করে বা গোনায় ধরে কিছু করে না। তারা যা করে সেটাকে এক্সপ্লয়টেশন বলাটাই যুক্তিসংগত হয়। বঙ্গার ক্ষেত্রে ফর্মুলাটি কাজে দিয়েছে। দর্শক কী চাইছে তার সমীহ না করে তিনি বরং উল্টোপথে হেঁটেছেন। নিজের চাহিদা জানান দিতে দর্শকঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন এই নির্মাতা। বুক এতটুকু কাঁপেনি! সন্দীপ বঙ্গা ডরপোক নয়;—দর্শকের কাছে বার্তাটি অর্জুন রেড্ডি রিলিজের দিন থেকে তিনি পৌঁছে দিতে পেরেছেন। ডিজাস্টার ঘটার শঙ্কায় দর্শক যা খেতে চাইবে সেইটা খাওয়ানোর ধাত,—আপসকামি খাসলতটি তাঁর মধ্যে নেই। সুতরাং যেসব কারণে অ্যানিম্যাল বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে, ছবিটির সিক্যুয়েল অ্যানিম্যাল পার্ক-এ সেটা রিপিট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বৈকি।

এখন ইয়াদ হচ্ছে না, নেটফ্লিক্সের কোনো একটি সিরিজে হবে, কান্ট্রি সিঙ্গার ডলি পার্টন দামি একখান উক্তি ঠুকেছিলেন। জীবনের গল্প ভানতে বসা গায়িকা সেখানে বলেছিলেন : কোনো পথ যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে নিজেই একটা বানিয়ে নাও। সন্দীপের ছবি বানানোর তরিকায় এটা চোখে পড়ে। নিজের পথ তিনি বানিয়ে নিয়েছেন। ফিল্ম ইকোনমিক্সের জায়গা থেকে চিন্তা করলে কাজটি কঠিন। বক্স অফিসে ডাব্বা মারার ভয়কে সকলেই কমবেশি তোয়াক্কা করে চলেন। নিজের ওপর আস্থা ভয় কাটিয়ে ওঠার একমাত্র নিয়ামক নয় সেখানে। বিনোদনবুভুক্ষু দর্শকঘাড়ে চাপার খায়েশ মিটাতে চাইলে যুগচাহিদাকে পড়তে জানা চাই। যিনি পড়তে জানেন তার সাকসেস অবধারিত। না জানলে মুসিবত। সে তিনি আমির খান কিংবা রাজকুমার হিরানী হলেও রক্ষে নেই। ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে বলা কঠিন, তবে সন্দীপ বঙ্গায় এই মুহূর্তে গুণটি বিদ্যমান। মশলা সিনেমা তৈরির যুগ-প্রাসঙ্গিক সারসূত্র রপ্ত ও নতুন পথ বানিয়ে নেওয়ার তাড়না বলিপাড়ায় ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছিল। বঙ্গা সেটি আবার ফেরত এনেছেন।

মনে রাখা ভালো, ওপরতলার দর্শক তাঁর টার্গেট নয়। অ্যানিম্যাল-র প্রতি পরতে যেসব রসদ তিনি গুঁজে দিয়েছেন, পর্দায় সেগুলোকে ব্যাকরণসিদ্ধ উপায়ে হাজির করতে হলে ছবির প্রোটাগনিস্ট রণবিজয়কে ওই তলায় ঠাঁই দেওয়া জরুরি ছিল। আলফা মেল-র বাতিকে ভুগছে এমন একটা লোক নিজের অভিলাষ পূরণ করতে পারে যখন ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচার ঘটানোর রসদ নিয়ে তাকে বিচলিত হতে হয় না। নিচেরতলায় বসে যে-দর্শক ছবিটি দেখছে, সন্দীপ বঙ্গার টার্গেট অডিয়েন্স, তার ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্য প্যারায় মোড় নিতে বাধ্য। বাস্তবে সেটাই হয়েছে। বঙ্গা যাকে ঘাড় ধরে ছবিটি গিলতে বাধ্য করলেন, বেচারামার্কা ওই দর্শকের জন্য অ্যানিম্যাল হচ্ছে আনোখা জগৎ। মজার ব্যাপার হলো সমাজমাধ্যমের কল্যাণে আনাখো কিছু দেখার বিপত্তি নিয়ে এন্তার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও ছবিটি দেখার লোভ সে সংবরণ করতে পারেনি। এর থেকে বেশ বোঝা গেল, নিজের পথ বানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধে নেমে গণদর্শককে নাকে দড়ি দিয়ে কীভাবে বেকুবের মতো ঘোরাতে হয় সেটা সন্দীপ রেড্ডির অজানা নয়। অ্যানিম্যাল নিয়ে শত কন্ট্রোভার্সির সবটাই যে-কারণে ছবিটির পক্ষে গিয়েছে। সিনেমাহল থেকে নেটফ্লিক্স অবধি তার বাণিজ্য সাফল্যে ছেদ না ঘটার এটা গণ্য কারণ।

ছবিটি তাই বলে যুক্তিহীন কিমাকার কোনো বস্তু নয়। পরিচালকের ওপর খাপ্পা দর্শকের একাংশ যেটি জোর গলায় আওরাতে কমতি রাখেননি। উনাদের আপত্তির জওয়াবে কথাটি বলতে হয়,—যুক্তিছক পরিচালকের নিজস্ব ছাঁচে ভালোভাবেই ঢালাই করা হয়েছে। দর্শককে সাড়ে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বাপ বলবীরের প্রতি ছেলে রণবিজয়ের অবসেশন ও সেটা নিয়ে মনোবিবাদের মামলায় ফাঁক-ফোকর বুঝে নির্মাতা বাদবাকি মশলা একে-একে যোগ করেছেন। মিশ্রণনৈপুণ্য অ্যানিম্যাল-র বাজার সাফল্যের বড়ো নিয়ামক। ছবিটির দিকে ভালো করে তাকালে সত্যটি অস্বীকার করা কঠিন।

বলিউড ধাঁচে বোনা বাস্তবতাকে অ্যানিম্যাল গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান কোনোটাই করেনি। পেছনের যুক্তিটি সেখানে অকাট্য,—অনেক হয়েছে ইয়ার! এসব আর নেওয়া যাচ্ছে না। নিতে গেলে আরেকটি প্যানপ্যানিমার্কা বলিউডি বাপ-ছেলের ভালোবাসা ও মিলনের গল্প দিয়ে ছবির ইতি টানতে হবে। দর্শক কত দেখবে এসব! তারচেয়ে আলফা মেল নিয়ে গণদর্শকের গোপন চুলকানি ও খোঁয়ারিকে জাগিয়ে তোলা যেতে পারে। পর্দায় ওটা দেখতে বেশ! বলিপাড়ায় বনতে থাকা কত না ছবিতে উগ্র পৌরুষ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে রাজত্ব করেছে। যুগবিচারে এখন অস্বাভাবিক লাগছে কিন্তু পর্দায় ফেরত আনতে পারলে বাজিমাতের চান্স ষোলআনা। ওপর ও নিচতলায় বিভক্ত সমাজটি মোটের ওপর আলফাই হতে চাইছে। পৌরাণিক কালে সে যেমন ছিল সেখানে ফেরত যাওয়ার বাসনা বিলুপ্ত হয়নি। পরশুরামের কুঠার সমাজদেহে নীরবে সক্রিয়। যুগের চক্করে কেবল কুঠারটি বের করা যাচ্ছে না। প্রগেসিভ সাজার অভিনয়টি করে যেতে হচ্ছে। ভিতরে গুহাকালের আদমসুরত রাগি জন্তুর মতো ফুঁসছে, বাইরে সভ্যসুরতটা দন্ত ব্যাদান করে হাসছে। এই কন্ট্রাডিকশন হচ্ছে অ্যানিম্যাল-র পুঁজি। এর ওপর ভর দিয়ে সন্দীপ রেড্ডি যুক্তিহীন আবেগের পারদকে ছবিতে দেদারসে উঠানামা করতে দিয়েছেন। যাকে, ব্যাপক বাকবিতণ্ডা শেষে গ্রহণ করার চেয়ে বাতিল করা মুশকিলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

মুশকিলের কারণটি বোধহয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। দূর কিংবা নিটক অতীতে উগ্র পৌরুষ নিয়ে যত ছবি বলিউড রিলিজ দিয়েছে সেখানে একে ন্যায্য বা জাস্টিফাই করার বিমার থেকে নির্মাতা নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। পরীক্ষায় বারবার ফেল মেরেছেন উনারা। অ্যানিম্যাল-এ সন্দীপ সেটা ঘটতে দেননি। রণবিজয়ের দেহে ভর করা আলফা মেল নিয়ে দর্শকরায়কে যে-কারণে ক্রমশ দ্বিধান্বিত হতে দেখছি। জাভেদ আখতারসহ বাদবাকি প্রগ্রেসিভ, যারা এর ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত, উনাদের আপত্তির জবাবে পাল্টা প্রশ্ন অনেকে তুলছেন,—রণবিজয়কে পরিচালক কি একবারের জন্য জাস্টিফাই করেছে কোথাও? একটা আলফা মেলকে পর্দায় রাজ করতে দিয়েছেন তিনি। অনুরাগ কাশ্যপ যেমন গ্যাংস অব ওয়াসেপুর-এ এন্তার খুনখারাবি নিবারণের চেষ্টা করেননি। ওগুলো ন্যায্য নাকি অনায্য হলো ইত্যাদি নৈতিক তর্কে মাথা ঢোকাননি একপল। সিনেনির্মাতার কাজ তো ওইটা নয়। তার কাজ হচ্ছে প্রজেকশন;—দেখানো যে, সমাজে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে এবং ঘটছে। বাহাদুর সাজতে গিয়ে কোনো একটা পক্ষ নিয়ে ফেলাটা কাজের নয়। প্রোপাগান্ডা মুভির বেলায় পক্ষ নিতেই হয় কিন্তু গ্যাংস অব ওয়াসেপুর-র মতো ছবিতে এটা সাজে না। এভাবে যদি ভাবা যায় তাহলে সন্দীপকে কামান দাগা অর্থহীন হয়ে পড়ে।


যে যা-ই বলুক, আলফা মেল নামক পারভার্ট ব্যাপারটি অ্যানিম্যালকে আদি অস্তক টেনে নিয়ে গেছে। ছবির পরতে-পরতে উপচে ওঠা আবেগের সবটাই সেখানে জন্তুসুলভ। যা কিছু প্রিয় তাকে সুরক্ষা দিতে জন্তুটি কাঠগোঁয়ার। প্রয়োজন হলে নির্দয় ও পাশবিক কিন্তু ভানসর্বস্ব বা অনুভূতিহীন মোটেও নয়। ছেলে রণবিজয়ের দেহে এরকম এক জন্তুকে নির্মাতা জাগিয়ে তুলেছেন। জীবন বিপন্ন করে হলেও প্রিয়জনের সুরক্ষায় যে নাকি পিছপা হবে না। রণবীর কাপুর, মানতেই হচ্ছে, সন্দীপের ভাবনা ও চাওয়াকে পর্দায় কড়ায়-গণ্ডায় মিটাতে কসুর করেননি। তাঁর চরিত্রানুগ অভিনয় ছবিটির প্রাণ। দর্শক এই রণবীরকে দেখার লোভে হলে যেতে বাধ্য। গত আটাশ বছরে হিরো থেকে জিরোতে নেমে যাওয়া লর্ড ববিকে দেখার জন্যও ছবিটির সামনে তাকে বসতেই হচ্ছে। ববি দেউলের ভিতরে অতিকায় অভিনয়সত্তা লুকিয়ে ছিল। অ্যানিম্যাল-এ সন্দীপ সেটা টেনে বের করেছেন। নতুন জীবন দিয়েছেন ফতুর হতে বসা এই অভিনয়শিল্পীকে।

সন্দীপ নিজে সাইকোথেরাপিস্ট। ওই বিদ্যায় ডিগ্রি আছে তাঁর। বিদ্যাটি অর্জুন রেড্ডির মতো এখানেও কাজে লাগিয়েছেন। অমানুষিক বন্দুকবাজির কারণে নিশ্চিত মরণের কিনারে চলে যাওয়া রণবিজয়ের জখম থেকে সেরে উঠার প্রক্রিয়া ও মানসিক আবেশকে পর্দায় যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো ছবির গল্পের সঙ্গে বেমানান ঠেকেনি। রণবীর কাপুরের অনবদ্য অভিনয় একে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সামাজিক অবস্থান, বড়োলোকের পোলা হিসেবে যথেচ্ছার করার শক্তি ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে পর্দাজুড়ে তার আজব কিসিমের কাণ্ডকারখানা আপনা থেকে যৌক্তিক হয়ে ওঠে।

সহিংসতা ও প্রতিশোধের খেলায় আবিল ছবিতে আবরার হকের জন্তুসুলভ এন্ট্রি ছবির প্লট বিবেচনায় লাগসই ছিল। তিন নাম্বার বিবি জয়া ওরফে তৃপ্তি দিমরিকে নিকাহ করে ঘরে তোলার আনুষ্ঠানিকতা চলছে। অ্যা ভেরি সুইট পার্সিয়ান সঙ জামাল কুদুর হুল্লোড়ে মাতোয়ারা সবাই। সুইট মোমেন্টে রণবিজয়ের হাতে ভাই আসরার খতম খাওয়ার সংবাদ জানতে পেরে আবরারের পাশবিক সত্তা জেগে ওঠে। সন্দেশদাতাকে তাৎক্ষণিক পরপারে পাঠানো তো আছেই, মেজাজ ঠাণ্ডা করতে নববধূ জয়াকে ওই মুহূর্তে ধর্ষণ করে আবরার। দৃশ্যটি জাপানি নির্মাতা সেইজুন সুজুকির কাল্ট ক্লাসিক ব্রান্ডেড টু কিলকে মনে করায়। পেশাদার খুনি হানাদা খুনখারাবি শেষে রমণীতে উপগত না হয়ে থাকত পারত না। জান্তব দেহমিলনে লিপ্ত হওয়ার ক্ষণে সেদ্ধ ভাতের গন্ধ নেওয়টা তার ভীষণ প্রিয় ছিল। ভাতের গন্ধ শুঁকে নিজের পুরুষত্বকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারটি অদ্ভুত বটে! সদ্য কাউকে খুন করার চাপ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেও কাজটি করত সে। নববধূ জয়ার ওপর আবরারের আচমকা উপগত হওয়া খানিকটা সেরকম।

ম্যারিটাল রেপ-র পাশবিক দৃশ্যটি নিয়ে নারী অধিকারে সংবেদনশীলরা গোস্বায় ফেটে পড়লেও উনাদের ক্ষোভ এক্ষেত্রে যৌক্তিক নয়। আন্ডার ওয়ার্ল্ডে বিচরণে অভ্যস্ত লোক আবরার। খুনখারাবিটা তার কাছে ডালভাত। এই লোকের রাগ-অনুরাগ-বিরাগ সভ্য-সুশীল সমাজের মাপে আঁটবে না। ভিতরের পাশবিক সত্তা কখন জেগে উঠবে, কী করতে কী করে বসবে, কাকে রাখতে কাকে মারবে ইত্যাদি আন্দাজ করা কঠিন। তার ওপর বলবীরকে নিকাশ করার মিশনে নেমে ভাই আসরার রণবিজয়ের হাতে খতম হয়েছে জেনে তার পক্ষে সুস্থির থাকা কঠিন ছিল। আবরারের চরিত্র দর্শককে এক লহমায় বুঝিয়ে দিতে বঙ্গা ভেবেচিন্তেই দৃশ্যটি সাজিয়েছেন।

ভিলেন হিসেবে মিনিট পনেরো পর্দাস্পেস পেয়েছেন ববি দেউল। তাতেই বাজিমাত। বলিউডের ছকে ভিলেনকে এখানে ব্যবহার করা হয়নি। কাস্টিং বুদ্ধিদীপ্ত। মুখোমুখি ডুয়াল ফাইটে রণবিজয়ের আবরারকে গলা কেটে খতম করার বীভৎস দৃশ্যটি সিনেমাটিক। অ্যানিম্যাল নিয়ে দর্শকআগ্রহ তুঙ্গে ওঠার নেপথ্যে এই সিনের ভূমিকা প্রবল ছিল। সমাপ্তিদৃশ্যে আবরারের ছোট ভাই কসাই আজিজকে চমক হিসেবে রেখে দিয়েছেন নির্মাতা। বলবীর পরিবারের ওপর শোধ তুলতে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে রণবিজয়ের বডি ডাবল কসাই অজিজের নিষ্ঠুরতার ঝিলিক দেখিয়ে ছবির অন্ত টেনেছেন। পাশবিক টুইস্টটি সিক্যুয়েলে কী আসতে চলেছে তার ইশারা দিয়ে যায়। সহিংসতায় সয়লাব এইসব উগ্রতাকে গল্পের পটভূমি ও চরিত্রের জায়গায় দাঁড়িয়ে বিচার করলে কিম্ভূত ভাবার সুযোগটি কমে আসে।

জাপানি সিনেজগতে সেইজুন সুজুকি, তাকাশি মিইকে, সিওন সোনো কিংবা তাকেশি কিতানোর ছবিতে সহিংসতাকে নান্দনিক করে তোলার একটি নীরব প্রবণতা চোখে পড়বে। সহিংসতাটা যারপরনাই সহিংসতায় বন্দি থাকে না। বেশ গীতল ও মজাদার ব্যাপার হয়ে ওঠে। সাংগীতিক মুহূর্ত পর্দায় জন্ম নেয়। সহিংসতার পারদকে যেটি প্রশমিত করে। বিষে বিষক্ষয় ঘটায়। দর্শককে যে-কারণে উনাদের ছবি দেখতে বসে গাড্ডায় পড়তে হয় না। তার স্নায়ুচাপ শিথিল হয়ে আসে। ট্যারান্টিনো এই কাজে এককাঠি সরেস। কিল বিল পার্ট ওয়ান ও টু-তে অতিরঞ্জিত সহিংসতাকে জাদুকির উপায়ে আবেদঘন করে তোলেন নির্মাতা। উনারা মায়েস্ত্রো। মাস্টার ফিল্মমেকার। ছবি বানানোর তরিকায় সন্দীপ বঙ্গার থেকে আলগ ঘরানার লোক। অ্যানিম্যাল-এ সংগতকারণে ওইসব জাদুকরি গীতলতা অনুপস্থিত থাকে।

পরশুরামের কুঠার হাতে সক্রিয় আবেগের বিস্ফার সন্দীপের ছবিকে নমনীয় হতে বাধা দিয়েছে। ছবির গ্রাফিক ভায়োলেন্সটা যে-কারণে আগাগোড়া রুক্ষ। গতিশীল ও জান্তব। জন্তু যেমন প্রতিপক্ষকে খতম করে, অনেকটা ওই ছকে সহিংসতাকে পর্দায় সক্রিয় হতে দিয়েছেন পরিচালক। জীবন ছাপিয়ে যাওয়া এইসব খুনখারাবিকে কেমন করে চটকদার চাটনি বানাতে হয় সে-বিদ্যায় সন্দীপ বঙ্গা চৌকস খেলোয়াড়। জানোয়ারসুলভ মেলোড্রামাটিকে যারা অগোছালো বলে নাকচ করেছেন, উনাদের বাকোয়াজির তুলনায় ছবিটি ঢের সুনির্মিত। ইনটেন্সের বিচারে শার্প মানতে আপত্তির কারণ থাকে না।


লিবিডো তাড়িত
বিস্ফার নয় বরং যৌথচেতনের (Collective Consciousness) পথ ধরে মানুষ যে-সংহতি অর্জন করেছে, সেইসঙ্গে আদিম বুভুক্ষাকে নিজমধ্যে বহন করছে নীরব, তার মনোবিশ্লেষণ অ্যানিম্যাল-র ক্ষেত্রে অবান্তর ছিল এমন নয়, তবে সন্দীপ সেটা করতে গেলে ছবিটির রসাতলগমন আটকানো মুশকিল হতো। ভদ্রলোক ওই ধাঁচে পড়েন না। তাঁর ইগো সমস্যা রয়েছে। ক্রিটিকদের মুখ বুজে হজম করাটা তাঁর ধাতে নেই। কবির সিং-এ নারীবিদ্বেষ ও সহিংসতা নিয়ে সমালোচকরা চেপে ধরলে বঙ্গার পাল্টি উত্তরে যথেষ্ট ঝাঁঝ ছিল। মুখের ওপর ঠাস করে বলে দিয়েছেন : ভায়োলেন্সের দেখেছেনটা কী? ওয়েট করেন, পরের ছবিতে ভায়েলেন্স কী সেইটা দেখাবো। অ্যানিম্যাল নিয়ে একই শোরগোল হচ্ছে দেখে আবার সেই সপাট জওয়াব : এইটা আর এমন কী! অ্যানিম্যাল পার্ক যখন রিলিজ হবে তখন ভায়োলেন্স কারে কয় বুঝবেন।

নিজেকে ডিফেন্ড করার পদ্ধতিটি সন্দীপের ইগোসমস্যা অথবা আলোচনায় থাকার কৌশল হতেও পারে, তবে কথা মিছে নয়, অ্যানিম্যাল তার নিজস্ব ফিলোসফির ওপর দাঁড়িয়ে যেভাবে আগাগোড়া এগিয়েছে সেখানে খুনখারাবির দৃশ্যগুলোকে যারা অনাবশ্যক ভাবছেন তাদের একবার হলেও ছবিটির দিকে ফিরে তাকানো উচিত। পাঠান বা জওয়ান-র চেয়ে অ্যানিম্যাল-এ দেখানো সহিংসতা অনেক বেশি সংহত ও সুনিপুণ। গল্পানুগ তো বটেই। ছবির দৈর্ঘ্য অনুপাতে সহিংসতার মেয়াদটি বেশ পরিমিত। মশলা সিনেমার চিরাচরিত উপকরণগুলোকে আটঘাট বেঁধে, আগেই বলেছি, অন্যছকে ব্যবহার করা হয়েছে। রোমান্স, নগ্নতা, দেহমিলন, বাপ-ছেলের মানসিক অবরোধ আর শ্রবণসুখকর গানগুলো মিলেঝুলে চড়া সুরে বাঁধাই ঐক্যবাদন হিসেবে ছবিটিকে দেখা যেতে পারে। আলফা মেলসুলভ কাজকারবারে বোঝাই থাকা সত্ত্বেও দেখতে মন্দ লাগে না। অকপট এই স্বীকারোক্তি না দিলে ভণ্ডামি হবে।

সমাজকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার মওকা হিসেবে সিনেমাকে যারা বিবেচনা করেন, ওইসব দর্শকের জন্য অ্যানিম্যাল অস্বস্তিকর। এর থেকে উনাদের কিছু শেখার কিংবা পাওয়ার নেই। উল্টো আতংকিত হওয়ার কারণ রয়েছে। অন্যদিকে যারা মনোজ বাজপেয়ির মতো ভাববেন, যারা এটা মেনে নিচ্ছেন,—সিনেমা সমাজকে পাল্টে দিতে পারে না, লোকজনের হেয়ার স্টাইলে বড়োজোর বদল ঘটাতে পারে;—মনোজের কথার সঙ্গে সহমত দর্শকের ছবিটি দেখে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। একটা মশলা সিনেমা, যেখানে গানগুলো সুশ্রাব্য আর বাদবাকি যা-কিছু অনাচার, তার সবটাই নিছক সাড়ে তিন ঘণ্টার খোঁয়ারি। সুতরাং একে নিয়ে অযথা উৎকণ্ঠিত হয়ে গেল গেল রব না তুললেও চলছে।

বলিউড সচরাচর যে-বাস্তবতাকে পর্দায় ভাষা দিতে অভ্যস্ত সেখানে নৈতিক বাহাদুরির ভান সময় বিশেষ বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। অ্যানিম্যাল ব্যতিক্রম। সমাজ ও তার ইতিকর্তব্য নিয়ে হল গরম করে তোলা ভাষণ ছবিতে নেই। একটি ডায়ালগ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সন্দীপের ছবি আপাদশির জন্তুসুলভ আবেগে ঠেকনা দিয়ে বানানো। প্রিয়জনকে বাঁচাতে একরোখা আলফা মেল কিংবা বিকারদুষ্ট ছেলের বখাটেপনায় স্থির থাকাটা নিজের ক্ষেত্রে স্বস্তিকর ভেবেছেন নির্মাতা। সুতরাং একথা বলা যায়, যেটা হলে সংগত মনে হতো, অ্যানিম্যাল তাই হয়েছে।


ছবিকে ঘিরে নারীবিদ্বেষের অভিযোগ ধোপে টিকে না। কাহিনী যেভাব সাজানো সেখানে বউ গীতাঞ্জলি ওরফে রশ্মিকার ওপর রণবিজয়ের পৌরুষপণাকে একবাক্যে মিসোজিনিস্ট বলে খারিজ করা কঠিন। দুজনের সম্পর্কের রসায়ন জটিল। বলবীর পরিবারের হাড়ির খবর নিতে চর হয়ে ঢোকা আবরার পত্নী জয়া ও রণবিজয়ের আকস্মিক সম্পর্কটি ছবির কনটেক্সট বিচারে খাপছাড়া লাগেনি। দুজনের দেহমলিন ও নগ্নতা যেভাবে দেখানো হয়েছে সেখানে বলিউড প্রণীত মশলা ছবির চিরাচরিত ছ্যাবলামি অনুপস্থিত ছিল। গতানুগতিক গল্পের দেহে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ও বহুরৈখিকতার ছড়াছড়ি প্রমাণ করে অ্যানিম্যাল-র স্ক্রিপ্ট তৈরিতে প্রচুর খাটনি ও সময় নিয়েছেন বঙ্গা। ছবির কাহিনিছক কেন উদ্ভট ও যুক্তিহীন নয় সেটা ধরিয়ে দিতে লীলাবতি লিলু নামে এক দর্শকের বক্তব্য বিবেচনা করা যেতে পারে। বিষয়টির ওপর বেশ ভালো আলোকপাত করেছেন। বাত সংক্ষেপ করতে উনার বক্তব্যের কিয়দংশ উদ্ধৃত করা বাঞ্ছনীয় মনে হচ্ছে। লীলাবতি লিখেছেন :

গীতাঞ্জলীকে আপত্তিজনক কথা বলা? একটা ছেলে, যে নিজেকে আলফা দাবী করে, যে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা শুরুই করেছে আদিকালে গুহায় বসবাস করা আদিমানব আর তাদের আলফা চুজ করা নিয়ে, যে ওই গল্পের ভেতর পোয়েট্রি জিনিসটাকে বিদ্রুপ করছে সরাসরি, সে গল্প শেষে ওই মেয়েকে কী পোয়েট্রি করে প্রপোজ করবে? তোমার চোখজোড়ায় ডুবে যাই? না। বরং সে তার স্বভাব অনুযায়ী তা বলবে, যা গুহাবাসীরা ভাবত।

—গীতাঞ্জলীর গলা টিপে ধরা? ওটা গ্লোরিফাইড সিন না।… এখানে কি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নরমালাইজ করা হয়েছে? যদি হয়, তবে ওটা একটা নির্দিষ্ট চরিত্রের কাঁধে রেখে করা হয়নি। ওই সিনের আগে গীতাঞ্জলী থাপ্পড় দিচ্ছিলো রণবিজয়কে, ওটাও নরমালাইজ করা হয়েছে। যদি ওটা না হয়, তাহলে এটাও না। আর যদি দুইটাই হাসব্যান্ড ওয়াইফ স্টুপিড ফাইট হয়, তাহলে আলাপ এখানে শেষ। আঙুল একজনের দিকে তুললে সমস্যা।

জয়াকে লিক মাই শু বলা রণবিজয় চরিত্রটার অনেক অনেক কম প্রকাশ করা জানোয়ারবৃত্তির অংশ। এটাকে সেলিব্রেট করা হয় নাই। এরচেয়ে তীব্র খোঁচা সে বরং গীতাঞ্জলিকে দিয়েছে। চিটিং করার পর সে বিদ্রুপ করতেছে তাকে— ‘তুমি আমায় এতগুলো মানুষ হত্যার জন্য ক্ষমা করেছ, অথচ একটা মেয়ের সাথে শোয়ার বিষয়টা ক্ষমা করতে পারছ না।’ …(সিনেমায় একটা নারী চরিত্রকে ‘লিক মাই শু’ বললে পুরো নারী জাতিকে অপদস্থ করা হয় না। হলে, আজ অবধি যত সিনেমা হয়েছে ‘অল মেন আর ডগস’ সেনটেন্সের আদলে, সবগুলোই ব্যানড হওয়ার কথা।)

দর্শকের বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, সমাজ ও কিতাবের ছকে ছবির স্ক্রিপ্ট সাজায়নি নির্মাতা। সুতরাং ওগুলো মাথায় পুরে ছবিটি দেখতে বসা অর্থহীন।


অ্যানিম্যাল
-এ সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গা দার্শনিকতা কপচানো থেকে শত হস্ত দূরে থেকেছেন। ওটা গদার-তারকোভস্কি-বার্গম্যানদের মতো মায়েস্ত্রোদের জন্য সহজাত। উনাদের পক্ষে মানানসই। সন্দীপের ক্ষেত্রে বাচালতা হতো বড়োজোর। ছবিতে দার্শনিকতা ঢুকলে সর্বনাশের বাকি থাকত না। এই সিনেভাষ্য জান্তব উপায়ে আবেগকে বের করে আনতে চেয়েছে। যেখানে ভালোবাসা, প্রতিশোধ, অভিযোগ, সহিংসতার সবটুকু এমনভাবে ঘটছে যাকে মাপতে যাওয়াটা অবান্তর। ভিতরে গিয়ে শুধু ধাক্কা দেয়। বড়ো কথা, সংলাপ ম্যাড়মেড়ে নয়, ধার আছে যথেষ্ট। ছবির মূল লক্ষ্য আলফা মেল-র বিকারগ্রস্ত ভালোবাসাকে তুলে ধরা। তার ভিতরকার সত্তা ও সততাকে বের করে আনা। দার্শনিক বুলি ও মনোবিশ্লেষণ প্রসূত ক্যামোফ্লেজে ধরা না দিয়েও অ্যানিম্যাল তার লক্ষ্য পূরণে ভালোই উতরে গিয়েছে।

বলিউডের জন্য সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার ছবিটি ধাক্কাই বটে! রোমান্স, অ্যাকশন আর কমিক রিলিফের পুরাতন ধাঁচকে সময়ের সাথে কীভাবে পাল্টাতে হয় সেটি রাজকুমার হিরানী ধরতে পারেননি। নামের প্রতি সুবিচার না করায় দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সমস্যায় জেরবার বলিউড অদ্য সাউথে ভর দিয়ে নিভু-নিভু সলতেকে উসকে দিতে চাইছে। তার মধ্যে আরেক দক্ষিণী সন্দীপ যে-গল্পটি বলার চেষ্টা করেছেন সেটি স্বাভাবিক নয়। প্রশ্নগুলো তথাপি উঠবে : অতিমারি উত্তর বিশ্বটি কি আদৌ স্বাভাবিক? আমাদের ভিতরের চাওয়া আর বাইরের অভিব্যক্তি মারিপূর্ব দিনকালের সঙ্গে কতখানি ঐক্য ধরে? আমরা কী হতে চাইছি আর তার প্রকাশ ঘটাচ্ছি কোন পথে? ভান কি সেখানে তীব্র নয়? বাস্তবে অনেককিছুর চাপে পিষ্ঠ হয়ে সহিংসতায় নামা সম্ভব নয় জেনে সিনেমার পর্দায় তাকে বাস্তব হতে দেখার ক্ষুধা কি ভিতরে সক্রিয় নয়? হিরোকে অ্যান্টি হিরো দেখার আবেশ কি আগের মতো আছে? ভিলেনের শ্যাডো রূপে তাকে দেখার বাসনা কি প্রকট হয়নি অদ্য?

এটা তো মিথ্যে নয়, ভিলেনের জায়গা নায়করা দখলে নিচ্ছে। পুরাতন ভিলেন সংকুচিত হয়ে আসছে তাকে ক্রমশ গিলতে থাকা অ্যান্টিসোশ্যাল উপাদানে বোঝাই হিরোগিরির চাপে। হিরোর মধ্যে রোমান্টিক আবেশ খোঁজা অনেকের কাছেই আজকাল একঘেয়ে লাগে। সমস্যাটি ধরতে পারায় শাহরুখের জওয়ান দেখতে দর্শক হলে ছুটে গিয়েছিল। ডানকিতে উল্টো পথ ধরলেন দেখে ছুড়ে ফেলতে দেরি করেনি। প্রশ্ন তোলাই যায় : ভালো ছবি দেখার ক্ষেত্রে সচেতন দর্শক স্বয়ং কতটা সচেতন? শৈল্পিক-নান্দনিক ছবির জন্য তারা মুখে ফেনা তুলছেন কিন্তু বিনোদনের নাম করে চটজলদি বেছে নিচ্ছেন রিলস। বিনোদিত হওয়ার হাপিত্যেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনকালেও কি এতটা তীব্র ছিল? মহাসমরের দিনে মন্দাবস্থায় নিপতিত লোকজন ফাঁক পেলে সিনেমাহলে ছুটত। উৎকণ্ঠা ও অবসাদ কাটাতে ওটা ছিল আয়ুধ। মারিপরবর্তী বিশ্বে আমরা গতিশীল ও জান্তব হয়েছি কিন্তু আমাদের দেহে মারিপূ্র্ব আবেগ আগের মতো কাজ করে না। যেখানে চরেফিরে খাচ্ছি, সমাজ নামধারী ওই স্পেসটাকে ভিতরে-ভিতরে প্রত্যাখ্যানের বাসনায় কি মরিয়া হয়ে উঠছি না ক্রমশ?

জিজ্ঞাসার উত্তর অ্যানিম্যাল-র কাছে জানতে চাওয়াটা অবান্তর। বড়োজোর এই অনুমানকে সত্য ভাবা যায়,—আমরা কমবেশি জন্তু হতে চাইছি। মনপ্রাণ দিয়ে চাইছি কিন্তু মুখ ফুটে সেটা ঘোষণা দিতে পারছি না। নিরঙ্কুশ প্রবৃত্তি দিয়ে, যুক্তির অতীত আবেগ দিয়ে, নিজেকে বিপন্ন করে হলেও জন্তুসুলভ ভালোবাসায় ফেরত যাওয়ার ক্ষুধা আমাদের দেহে সক্রিয় রয়েছে। সভ্যভব্য সুসংস্কৃত সাজার চাপে জড়ীভূত দেহকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুটি বেরিয়ে আসুক;—বাসনাটি হয়তো ভিতরে মাথা কুটে মরছে! ঘৃণা ও ভালোবাসাকে ভানভণিতাবিহীন আবেগ দিয়ে ছুঁতে পারার অভিজ্ঞতা যেহেতু আমাদের মধ্যে আর নিষ্কলুষ নয়। সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার সাড়ে তিন ঘণ্টার পাগলাটে বিনোদন দেখতে বসে কথাটি মনে ধাক্কা দিচ্ছে!


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
গানপারে ম্যুভিরিভিয়্যু

COMMENTS

error: