আর্মিকাট || আহমদ মিনহাজ

আর্মিকাট || আহমদ মিনহাজ

চুল লম্বা রাখাটা আমার পছন্দ নয়। অস্বস্তি হয়। মাথা কুটকুট করে। মনে হয় মাথাভরতি উকুন কামড় দিচ্ছে। আমার চুল বাড়ন্ত স্বভাবের। কাটার পর বাড়তে সময় লাগে না। মাথা তখন ঘামতে থাকে। ফ্যান বা এসির নিচে বসলেও ঘামতে থাকার বেরামটা আমাকে ভোগায়। ঘামের সরু রেখা সুড়সুড় করে মাথা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশ্রী ব্যাপার! চুল লম্বা হতে শুরু করলে পড়িমড়ি করে তাই সেলুনে ছুটি।

নামিদামি সেলুন আমার পছন্দ নয়। ওরা মেশিন দিয়ে চুল কাটে। মেশিন ভালো লাগে না। শব্দটা বিরক্তিকর। মনে হয় কানের পাশে বোলতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দেখেছি দামি সেলুনে যারা চুল কাটে তারা কাজের চেয়ে কথা বেশি বলে। চুল কাটতে হবে মন দিয়ে। তারা সেটা করবে না। উলটো কোন হেয়ারকাটে আমাকে ভালো দেখাবে সেসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘনঘন চুল কাটার উৎপাত থেকে বাঁচতে আর্মিকাট আমার পছন্দের। দামি সেলুনে এই ছাটে চুল কাটানো মুশকিল। আর্মিকাট তারা ঠিকমতো দিতে জানে না। মেশিনে নানা আকৃতির চুল কাটার সুবিধা থাকে তবে সেগুলো এর উপযুক্ত নয়। ট্রিমার মেশিন দিয়ে যখন কাটে মনে হয় চুলগুলো খাবলা দিয়ে তুলে আনছে। কাঁচি দিয়ে পরে কাটছাট করলেও সেটা আর মনমতো হয় না।

দামি সেলুনে যারা চুল কাটে তারা হয়তো পেশাদার কিন্তু আমার কাছে তাদেরকে কখনো শিল্পী মনে হয়নি। সময় নিয়ে যত্ন করে কাটার বদলে তাড়াহুড়া করে শেষ করতে চায়। তাড়াহুড়ার কারণ না-বোঝার কিছু নয়। চুল কেটে যা আয়রোজগার হয় তারচেয়ে চুলে কলপ লাগানো, চুল স্ট্রেইট করা, ফেসিয়াল বা পেডিকিওর দিতে পারলে লাভ বেশি। আঙুলের খাটনিও কম হয়। তাদের এই চালবাজি ভালো লাগে না দেখে দামি সেলুন আমি এড়িয়ে চলি। কমদামি সেলুন অনেক ভালো। তারাও মেশিন দিয়ে কাটে তবে কাঁচি নিতে চাইলে না করে না। দশ-বিশ টাকা হয়তো বেশি চায়। আমার তাতে আপত্তি নেই। দক্ষ নাপিতের হাতে কাঁচি লক্ষ্মী মেয়ের মতো চলে। যখন কাটে মনে হয় মাথায় কেউ বিলি কেটে দিচ্ছে। আরামে চোখ বুজে আসতে চায়। চুলে কাঁচি চলার সময় রাজ্যের ঘুম তাই চোখে ভর করে। দুই চোখ বুজে মাথায় বিলি কাটার সুখ উপভোগ করি।

আজ শুক্কুরবার। ছুটির দিন। পাড়ার সস্তা সেলুনে লোকের ভিড় অন্য দিনগুলোর চেয়ে বেশি। শুক্রবারে ভিড় হবে জানা কথা, তবু না-এসে উপায় ছিল না। মাথার চুল বাড়তে-বাড়তে এখন কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। চুল কাটাতে যারা লাইন দিয়ে বসে আছে তারা আমার মতো খুঁতখুঁতে নয়। মেশিন দিয়ে কাটাতে আপত্তি করছে না। সেলুনের নাপিত আমার ম্যালা দিনের চেনা। মুখে হাসি টেনে বসতে ইশারা করে, ‘বসেন স্যার। সিরিয়াল শেষ হইতেই আপনারে ধরুম। আইজ কিন্তু বখশিশ বেশি দিতে হইব।’ আমি হেসে মাথা নাড়ি। কাস্টমারদের সবাই চুল কাটাতে নয়তো শেভ করতে এসেছে। পাড়ার সস্তা সেলুন। এখানে পেডিকিওর-মেনিকিওর ওসবের বালাই নেই। চুলে কলপ কিংবা মাথা-ঘাড় ম্যাসেজ করানো যায় অবশ্য। আমার দিকে তাকিয়ে এক ভদ্রলোক মুচকি হাসছেন। তিনি সম্ভবত আমাকে চেনেন। তাকে কি আগে কোথাও দেখেছি? চিনপরিচয় হয়েছে কোথাও? মনে পড়ছে না। ভদ্রলোককে পালটি হাসি ফেরত দিয়ে চোখ বুজে নাপিতের ডাকের অপেক্ষায় মোবাইল টিপতে থাকি।

ঘর জুড়ে মেশিনের ভোঁ ভোঁ গুঞ্জন। মাথা ঝিমঝিম করছে। দোকানি সিনেমার গান চালিয়েছে। ‘খাইরুন লো তোর লম্বা মাথার কেশ / চিরল দাঁতের হসি দিয়া পাগল করলি দেশ।’ গানটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেশ বিসর্জনের খেলা চলছে ঘরে। কোথাকার কোন খাইরুনের দিঘল কালো কেশের সঙ্গে সেলুনের এই কেশ বিসর্জনের কোনো মিল খুঁজে পাই না। বিরক্ত লাগছে। গানটি পরিবেশের সঙ্গে বেমানান। সেলুনওয়ালাকে ধমক দিতে ইচ্ছা করে। মুখ গম্ভীর করে তাকে শুধাই, ‘আর গান নাই?’ আমার কণ্ঠে বিরক্তি টের পেয়ে সেলুনওয়ালা মুচকি হেসে গান পালটায়। ‘চুল পাকিলে লোকে হয় না বুড়ো / আসল প্রেমের বয়স এই তো শুরু।’ গলাটা চেনাচেনা লাগছে। এন্ড্রু কিশোর হবে হয়তো।

গান শুনে সেলুনে হাসির তরঙ্গ ওঠে। ছোকরা বয়সী এক ছেলে রাগী স্বরে সেলুনওয়ালাকে ধমকায়, ‘দুর মিয়া। কী বাজাও! হিন্দি গান ছাড়তে পারো না?’ ছেলেটি সেলুনওয়ালার চেনা কাস্টমার। আমি তাকে চিনি। মাস্তান টাইপের রাজনীতি করে। পাড়ায় বেশ প্রতিপত্তি রয়েছে তার। সেলুনে তাকে প্রায়ই আসতে দেখি। শেভিং ক্রিমের ফেনায় ভরতি গালে রেজর চলার ক্ষণে চোখ বুজে হিন্দি সিনেমার গানে ঠোঁট মিলাতে দেখেছি বহুবার।

ছেলেটিকে তুষ্ট করতে সেলুনওয়ালা বিব্রত মুখ করে হাসে, ‘কোনটা দিমু তাইলে? তেরে ছোটি ছোটি বাল / তেরি হার মোলাকাত  লাগাই তাইলে?’ সেলুনওয়ালার কথায় ছেলেটি বিরক্ত হয়ে মাথা ঝাঁকায়, ‘দুর মিয়া, ওইটা বাল  না, বাত্ … বাত্। বাত্  মানে হইতেসে কথা। তেরি ছোটি ছোটি বাত্। আমির খানের ফিল্ম। অনেক হুনছি। অন্যটা লাগাও।’ ছেলেটির কথায় সায় দিয়ে সেলুনঘরে হিন্দি বাজতে শুরু করে।

আমার মাথা বেজায় কুটকুট করছে। নাপিত বেটা বদের হাড্ডি। তখন থেকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে! হিন্দি গানের তরঙ্গ বেশ জোরেশোরে বইছে এখন। গলায় দরদ ঢেলে গায়ক গাইছে, ‘জারা তসবির সে তু নিকালকে সামনে আ / মেরি মেহবুবা / মেরি তাকদির সে তু মাচালকে সামনে আ / মেরি মেহবুবা।’ গানটি পরিচিত। প্রচুর বাজতে শুনেছি। ‘পরদেশ’ ছবির গান হবে। কুমার শানু গেয়েছিল আর শাহরুখ খান ছিল নায়ক। কুমার শানুর সঙ্গে চুল কাটার মেশিন মিলেমিশে সেলুনঘরটি গমগম করছে। পুরোনো দিনের একটা গান মগজে গুনগুন আসে যায়। ছেলেবেলায় রাস্তাঘাটে শুনেছি। মোহাম্মদ রফি গানটি গেয়েছিল, ‘তেরি জুলফো সে জুদাই তো নাহি মাগি থি / কয়েদ মাগি থি, রিহাই তো নাহি মাগি থি।’ প্রিয়তমার কেশ থেকে নায়ক নিজেকে জুদা মানে আলগা করতে চাইছে না। দিঘল কেশ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। নিজেকে প্রিয়তমার কেশে কয়েদ রাখতে চাইছে বেচারা।

রোমান্টিক গানটির কথা ভাবতেই চুলে কুটকুটানি শুরু হয়। একসময় আমার চুল বেশ লম্বা ছিল। যাকে পছন্দ করতাম সে চাইত আমি চুল লম্বা রাখি। জীবনে এই একজনকে পেয়েছিলাম যে মনে করত লম্বা চুলে আমাকে ভালো লাগে দেখতে। সে পছন্দ করলেও আমার কিন্তু সমস্যা হতো। তার সঙ্গে গল্প করার সময় চুলে কুটকুটানি টের পেতাম। মেহবুবার সঙ্গে সারাক্ষণ মাথা চুলকে কথা বলা সুখকর নয়। হতে পারে তার সামনে নার্ভাস হওয়ার কারণে ওটা ঘটত। আমার দশা দেখে মুচকি হেসে রফির গানটি গাইত তখন। নিজের চুল নিয়ে যে-লোক বিব্রত তার পক্ষে প্রেমের খেলায় জেতা কঠিন। মেহবুবা একদিন হুট করে উবে গেল জীবন থেকে। যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে সেই লোক সিনেমার নায়কের মতো দেখতে। জাফর ইকবালের কার্বনকপি ছিল সে। সালমান শাহ বাদে জাফর ইকবালের মতো সুদর্শন ও ফ্যাশনসচেতন নায়ক আমি দুটি দেখিনি।

আজ শুক্কুরবার। সেলুনে চুল কাটাতে এসে পুরোনো কথা মনে পড়ায় বুকের বাম পাশটা খচ করে ওঠে। মনে-মনে সেলুনওয়ালার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করি। মাথায় লাখো উকুন কুটকুট করে কামড়ায়। তাড়া দিতে যাব এমন সময় দেখি বেটা আমায় ডাকছে, ‘আসেন স্যার। এইখানে বসেন।’ যাক, অবশেষে চুলের সঙ্গে জুদা হওয়ার সময় ঘনিয়েছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই আমাকে গাউনবন্দি করে ফেলে সে। মাথায় কাঁচির শব্দ টের পাচ্ছি। আরামে চোখ বুজে আসে।

সেলুন এখন মোটামুটি খদ্দেরশূন্য। জুমআর আজান দিতে বেশি দেরি নেই। চুলদাড়ির পরিচর্যা শেষে দ্রুত পায়ে সবাই ঘরে ফিরেছে। সেলুনওয়ালা লোকটা বকবক করতে ভালোবাসে। চোখ ঘুমে ঢুলঢুল হলেও তার বকরবকর শুনতে বাধ্য আমি, ‘আপনের চুল কাটন মেলা সময়ের কাম স্যার। খালি আর্মিকাট দিলে তো অইব না, মিল কইরা দিতে হবে। ইস! খুশকি দিয়া মাথা ভরাইয়া ফেলসেন। শ্যাম্পু দিব স্যার?’ উত্তরে মাথা নেড়ে হাসি, ‘ওসব পরে হবে। আগে ভালো করে ছাটো।’ দুজনের মধ্যে এইসব কথাবার্তা নতুন নয়। যতবার কাটাতে আসি গৎবাঁধা কথাগুলো সে বলে যায় আর আমিও তাকে একই উত্তর করি। আমার কথা শুনে সে এখন একগাল হাসছে। এটা জানা কথা সে হাসবে। হাসতে-হাসতে আরেকদফা বকবক করবে, ‘ঠিক বলসেন স্যার। আপনে চোখ বুইজা ঘুমান। এত বছর ধরে আপনেরে কাটতেসি। কেমনে কী সেইটা আমি সব জানি।’

সেলুনঘরে পিনপতন নীরবতা। আমিই শেষ কাস্টমার। জুমআর সময় নজদিক হওয়ার কারণে কেউ আর আসবে বলে মনে হচ্ছে না। কাস্টমার একে-একে চলে যাওয়ার পর সেলুনওয়ালা গান বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার চালায়। কাঁচির ছন্দে তাল দিয়ে হিন্দি গান বেজে ওঠে, ‘পরদেশি পরদেশি যানা নাহি / মুজে ছোড়কে, মুজে ছোড়কে।’ আমির খান আর কারিশমা কাপুরের প্রথম দিকের ছবি। দারুণ হিট করেছিল ছবিটা। ঘুমে ঢুলুঢুল চোখে গানটির সঙ্গে তাল মেলাই, ‘পরদেশি মেরি ইয়ারা / মুজে না রুলানা / তুম ইয়াদ রাখনা / কাহি ভুল নাহি জানা।’

কাঁচি হাতে সেলুনওয়ালার কারিগরি পুরোদমে চলছে। তার দক্ষ হাতের জাদুতে আমার লম্বা চুল ছাটাই হয়ে মাথাকে কদম ফুলের আকার নিতে দেখে মন শান্তিতে ভরে ওঠে। আর্মিকাটকে অনেকে কদমছাট নামেও ডাকে। ইংরেজিতে সেভ কাট। কদমফুলের রেণুগুলোকে হাতের আঙুল দিয়ে ধরা যায় না। কদমছাট সেরকম। হাতের আঙুল চুলের নাগাল পাবে না।

কদমছাট মনে করতেই বাবাকে মনে পড়ছে। লম্বা চুল রাখার শখ ছিল তার। লম্বা চুলে তাকে কাজী নজরুল ইসলাম লাগত। বাবা তা-বলে কাজী নজরুল ছিল না। নজরুলের মতো চুল রাখলেও বিদ্রোহী  কবিতা লিখে বিখ্যাত হওয়ার প্রতিভা তার ছিল না। পাড়ায় মাঝারি সাইজের একখানা মুদি দোকানের মালিক ছিল সে। বাকিসাকি নিয়ে কাস্টমারের সঙ্গে সারাদিন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করতে বেলা বয়ে যেত। বাবরি দোলানো চুলের বাহার বাদ দিলে নজরুলের সঙ্গে তার কোনো মিল ও লেনদেন ছিল না। লোকজন তবু তাকে ভুল করে নজরুল ভেবে চমকে উঠত আর আমরা বাচ্চাকাচ্চারা সেটা দেখে মজা পেতাম।

চুলের ব্যাপারে বাবা ভীষণ শৌখিন ছিল। মাঝেমধ্যে পনিটেল করে অবাধ্য চুলকে নিয়মে বেঁধে দোকানে গিয়ে বসত। পনিটেলে কিছুদিন স্থির থাকার পর পুনরায় নজরুলে ফিরে যেত। এটা কেন করত জানি না। চুলের ব্যাপরটা ছাড় দিলে মোটের ওপর সাধাসিধে জীবন ছিল তার। কাস্টমারের সঙ্গে বাকিবাট্টা নিয়ে ভ্যাজর-ভ্যাজর করত ঠিকই কিন্তু মায়ের ওপর তাকে কখনো হম্বিতম্বি করতে দেখিনি। আমার সঙ্গেও না। বাড়িতে ঢোকার পর একদম বদলে যেত সে। শান্ত বাছুরের মতো এ-ঘর থেকে ও-ঘরে পায়চারি করে বেড়াত লোকটা। আমাদের সঙ্গে দুটো-একটা কথা চলত এই ফাঁকে। খাওয়ার পাট চুকেবুকে গেলে সটান বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখতাম। নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যেত তখন।

বাবা আর বেঁচে নেই। পরম নিশ্চিত জীবন কাটিয়ে কবরে শুয়ে পড়েছে। একবার, শুধু একবার তাকে মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছিলাম। হাতের ছাতা গুঁটিয়ে যখন ঘরে ঢুকছে আমি এবং মা দুজনেই তাকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। একদম চেনা যাচ্ছিল না তাকে। মাথাভরতি বাবরি চুলের বাহার উধাও! আগাগোড়া মোড়ানো কদমছাট! মুখটা ওদিকে বর্ষার থমথমে মেঘ! মা আস্তে করে তার কাঁধে হাত রেখেছিল, ‘কী হইসে? চুলের কী অবস্থা করসেন! শরীর খারাপ?’ বাবাকে জীবনে প্রথম হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছিলাম। একটা কথা বারবার বলছিল, ‘বোঝেে না, কী হইসে? দেখো নাই সকালে কারা রাস্তায় নামছিল?’

আমার তখন মনে পড়ে, স্কুলে যাওয়ার পথে সাইরেন বাজিয়ে জলপাই রঙের ট্যাংক রাস্তায় ছুটোছুটি করতে দেখেছি। কদমছাট চুলের জওয়ানরা মেশিনগান তাক করে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল সেখানে। স্কুলে আজ কোনো ক্লাস হয়নি। হেডস্যার সবাইকে বাড়ি চলে যেতে বলছিলেন। ঘটনার মাস খানেক পর বাবা বিছানা নিয়েছিল। হঠাৎ একদিন বুকের ব্যথা উঠে মারাও গেল। তার চুল ততদিনে লম্বা হতে শুরু করেছিল। বিছানায় পড়ে-থাকা বাবাকে দেখে মনে হতো কাজী নজরুল ইসলাম শুয়ে আছেন। বাকশক্তি হারানোর পর নজরুল বিড়বিড় করে কীসব বলতেন। মারা যাওয়ার আগে বাবাকে অবিকল সেটা করতে দেখেছি। কী বলছে বোঝা কঠিন ছিল। শব্দগুলো ধরা যেত না। আর্মিকাট  কথাটি আমি কেবল উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। যা-ই হোক, বাবা আর নেই। হেজেমরে ‍ভূত হয়েছে কবরে। মারা যাওয়ার আগে আমাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেনি, আর্মিকাট  শব্দটি ছাড়া। আমার মাথায় ওটা এখন কুটকুট করে কামড়ায়।

সেলুনওয়ালা এফএম রেডিও চালু করল এইমাত্র। তার হাতে কাঁচির বদলে ক্ষুর দেখতে পাচ্ছি। আমার ঘাড়ে ক্ষুরের কারিকুরি চলছে। রেডিওতে গান বাজছিল, ‘সূর্য ডাকে আমার চোখে চুল শুকাতে আসোনা।’ গানের কথাগুলো আজব টাইপের! গানটি মনে হয় আগে শুনেছি কোথাও! মনে করার চেষ্টায় চোখ ঘুমে ঢুলুঢুল হয়ে আসে। আচ্ছা, এটা কি কোনো গান? নাকি বিজ্ঞাপন? সেলুনওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। সেলুনঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর…, আমি টের পাই তার হাতের চকচকে ক্ষুরটি আমার ঘাড়ের চামড়া কেটে গভীরে ঢুকে যাচ্ছে।


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: