চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৫ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৫ || শেখ লুৎফর

মৃত্যুবিনাশী প্রেম
যে-হৃদয় অকৃত্রিম ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে, যার আত্মার জমিন প্লাবিত হয়েছে অবিনাশী প্রেমের অমৃত সুধায়, তার কাছে এই ধুলামাটির সংসারই তো স্বর্গ। তাই তো নিঃস্ব, ভূমিহীন মালেকের অষ্টপ্রহর আনন্দে কাটে। দুনিয়ার যেদিকে তাকায় শুধু ভালোলাগা আর ভালোলাগা। আজ তার ফালানির সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা। তাই সে মাছ ধরতে না গিয়ে সারাটা সকাল আলসেমি করেছে। নাস্তার পরে তার শরীরটা ঘুমে বিছানায় ঢলে পড়ে। চৈত্র মাসের শেষ। বাতাসে জংলিফুলের গন্ধ, গরম আর বিরহকাতর কোকিলের কুহু, কুহু…। মালেকও বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে ডাকে কুহু, কুহু…। অর্থাৎ ফালানি, ফালানি…।

ফালানি শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে মালেকের বুক যেন বিধাতার আসমানের মতো বড় হয়ে যায়। উঁচু হয়ে যায়। কালাই পাথারের টলটলা পানির মতো ঢেউ খেলায়।

মাটির দেওয়ালের ছোট্টতর খুপরিটা দিয়ে তার ছোট্ট ঘরটায় হু হু করে বাতাস ঢুকছে। দড়িতে ঝুলানো লুঙ্গি গামছা একটু একটু দুলছে। মালেক উপুত হয়ে শুয়ে শিথানের বালিশটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ফালানির লম্বাটে গড়নের সুন্দর মুখটা মনে করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তার হা-করা মুখের কষ বেয়ে লালার চিকন একটা স্রোত বালিশে এসে জমতে জমতে এখন একটা রূপার চাকতি। সুরুজ গড়িয়ে পড়েছে মড়লপাড়ার বাঁশঝাড়ের মাথায়। ফট্টিফোর ডাউন ট্রেন ঝমঝম শব্দে হিলারপুল পেরিয়ে গেলে মালেকের ঘুম ভেঙে যায়। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলে প্রথমেই তার চোখ পড়ে বালিশের লালায়। ছোট্ট, শক্ত আর তেলচিটে বালিশটায় এইরকম অনেকগুলা গোল গোল দাগ আছে। সে গামছা দিয়ে মুখটা মুছে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। পশ্চিমের দরজা দিয়ে সোনার পাতের মতো ঘরে সেঁধিয়ে পড়েছে শেষ বিকালের লাল রোদ। সে বাইরে বেরিয়ে আসে। টেকের একমাত্র কড়ুই গাছটা শীতে সব পাতাটাতা ঝেড়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন গাছে সবুজ পাতায় পাতায় নবযৌবনের বাহার, আনন্দের শিহরণ।

মালেক আধুলির চে একটু বড় একটা আয়না হাতে নিয়ে অনেক যত্ন করে গালে সাবান ঘষে, সখিন করে দাড়ি কাটে। ক্ষার দিয়ে খুব ঘষাঘষি করে গোসল সারতে সারতে বিলপারের ঘাটেই বেলা ডুবে যায়। আজ ফালানির সাথে তার অভিসার গমন। একমাত্র ভালো শার্টটা ভাঁজ করে রেখেছিল বালিশের নিচে। সেটা গায়ে দিতে দিতে সে গানে টান দেয় :

অ সুখের ময়না রে,
ঘাটে তারে দেখলাম সোনার পাখি,
পরান আমার ক্যামনে বাইন্ধ্যা রাখি…

বেরোবার মুখে মালেক থমকে দাঁড়ায়; অভিসার গমনে কস্তরির সুবাস চাই। কিচ্ছার আলমাছ কুমার মৃগনাভির সুবাসে সুবাসিত হয়ে, ঘোড়ায় চড়ে অভিসারে যায়। এই কথা মনে হতেই মালেক আতরের খোঁজে আবার ঘরে ঢোকে। গত ঈদের সময় চারআনা দিয়ে সে একশিশি আতর কিনেছিল। আতরটার যা সুবাস! একটু দিলেই ঘরের বাতাসটাতাস সুঘ্রাণে ভরে ওঠে। আজ সে অভিসার গমনে যাবে। পরিস্তানের বানেছা পরী আজ কসকো সাবান দিয়ে গোসল করবে। বিকালে চুলে মাখবে সুগন্ধিভরা কদুর তেল। খোঁপা বাঁধবে। পুরুষের একজীবনে একটা নারীর হৃদয় পাওয়া মানে একটা রাজ্য পাওয়ার শামিল। এইসব যুক্তিতে এসে গরিব মালেক, মাছশিকারি মালেক, রাতের রঙ্গমঞ্চে পালাগানের গ্যাপে গ্যাপে ‘নাইড়া’ নামক জোকারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক হাসানোর ওস্তাদ মালেক জানে, সে যদি আগে মরে যায় তবে ফালানি তার জন্য সারাজীবন গোপনে গোপনে কাঁদবে। আর যদি ফালানি মরে?

মালেক বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তার স্বর্গের ভুবন চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সে আর কোনোদিন কোনো নারীর কাছে ভিড়বে না, কাউকে আর এই হৃদয়টা দিবে না। কীভাবে দিবে? হৃদয় নামক পৃথিবীটা কী রোজ রোজ হাটবাজারের গলিতে গলিতে তেল-নুনের মতো বিকিসিকি হয়?

ফালানির সাথে দেখা করতে যাওয়াটাকে জীবনেও মালেক কামনাসর্বস্ব লুচ্চামি ভাবে না। মনের সাথে মন, হিয়ার সাথে হিয়া মিললে হয় পিরিতি। তাই তাদের পালাগানের ভাষায় মালেক ফালানির সাথে দেখা হওয়াটাকে ‘অভিসার গমন’ বলে ভাবতে ভালোবাসে। যেদিন ফালানির কাছে যাওয়ার কথা থাকে সেদিন বিলপারের ঘাটে গোসল করতে করতে মালেক একা একাই গলাছেড়ে ডায়ালগ দেয়, পরিস্তানের বানেছা পরী, তুমি কেড়ে নিয়েছ আমার দু’চোখের ঘুম, হরণ করেছ হৃদয়ের শান্তি। তোমাকে দেখার পর থেকে মৃত্যু আমার পায়ের কাছে সারাক্ষণ হা-করে বসে থাকে। একটু ভালোবাসা দাও। আমি তোমার প্রেমের দোহাই দিয়ে, নিষ্ঠুর মৃত্যুকে আমার দরজা থেকে তাড়িয়ে দেব সুন্দরী…

ঘরের দেওয়ালের এক চিপা থেকে আতরের শিশিটা নিয়ে সে আবার বাইরে আসে। উঁচু করে চোখের সামনে নিয়ে দেখে সামান্য একফোঁটা আছে। খুব সাবধানে আতরের সবশেষ ফোঁটাটা আঙুলে নিয়ে দুই কানের লতিতে আর গোঁফে ঘষে ঘষে লাগায়। তাবাদে আতরের শিশিটা রাখতে গিয়ে চৌকির পায়ার কাছে সাদা কী-একটা দেখে সে চমকে ওঠে। এইমাত্র বেলা ডুবল। তাই ঘরের আবছা অন্ধকারে বিশেষ কিছু মালুমে আসছে না। তবে তেলেঙ্গাঘুড্ডির লেজের মতো লম্বা আর সাদা জিনিসটা চৌকির পায়ার কাছে আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে পড়ে আছে! তার পাশেই ছোট একটা গর্ত! মালেক অনেকদিন ধরে ঘর ঝাড়ু দেয় না। বৃষ্টি না থাকলে সে বাইরে রান্না করে, বাইরে বসেই খায়। ঘরটা শুধু তার ঘুমের জন্য। ঘুম না থাকলে মালেকের জীবনে ঘরের কোনো দরকার ছিল না।

মালেক তাড়াতাড়ি কুপিবাতি বের করে। ম্যাচের জ্বলন্ত কাঠিটা সহ ডান হাতটা একটু একটু কাঁপছে। সাদা খোলসটার ওপর বড় বড় আঁইশের নিখুঁত জলছাপ। চওড়া মাথায় লাল-কালোয় মেশা গরুর ক্ষুরের ছাপ। আড়াই-তিন হাত লম্বা সাপের খোলসটার দিকে মালেক পাথরচোখে তাকিয়ে থাকে। তাবাদে বিড়বিড় করে বলে, — একটা গোক্ষুর সাপ হিথানে লইয়া আমি সারাটা শীত কাটাইলাম!

এই বলতে বলতে সে গর্তটার মুখে কোদাল চালায়। অনেকক্ষণ কোপাকোপির পর বৈষ্ণবীর গলার মালার মতো একছড়া সাপের ডিম বেরিয়ে আসে। পাকা জামের মতো বড় আর নরম ডিমগুলা একটার সাথে আরেকটা জটলাগানো। নীলচে রঙের ডিমের ছড়াটা মালেক হাতে নিয়ে বিলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর কোদালের ঘাড়া দিয়ে পিটিয়ে গর্তটর্ত ভরাট করে বেরোতে বেরোতে বাইরে জমজমাট রাত। ঝিঁঝিরা বেশুমার ডাকছে। বিলের পানিতে হাজারেবিজারে ক্যাটর ক্যাটর করে ডাকছে ছোট ছোট পানিব্যাঙ। ভয়-জাগানো থমথমা বিষুরির থলির দিক থেকে গরম বাতাস আসছে। মালেক হাঁটতে শুরু করে। বুকের ভেতর একটা অজানা অস্বস্তি, একটু ভয় আর অভিসার গমনের উত্তেজনা। সে আবার গানে টান দেয়, — ও সুখের ময়না রে…

এক গান বারবার গাইতে গাইতে মালেক আঙ্কুরের দোকানের কাছে এসে থামে। কলুবাড়ির দিক থেকে তেলের ঘানির কেড়কেড়ানির শব্দ আসছে। মড়লপাড়ার জংলায় একপাল হিয়াল চেঁচিয়ে ওঠে। টিমটিমা হারিকেনের লাল আলোতে আঙ্কুরের দোকানের সামনে, ভিতরে আরো অনেকগুলা মুখ দেখা যায়। মালেক দরজা থেকে একটু দূরে অন্ধকারের দিকে পিঠ দিয়ে বসে। পনে-আটটার সময় বিবিসির বাংলা সংবাদ হবে। আঙ্কুরের রেডিও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে, দেশের বিষয়ে কী কথা বলে তা শুনতে এখন গ্রামের লোকজন সন্ধ্যার পর দল বেঁধে চলে আসে।

দেশের অবস্থা এখন খুব গরম, খুব খারাপ। বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের রাজা হতে দিচ্ছে না। সারাদেশে হাটে-ঘাটে-মাঠে এক কথা, বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো…

মালেক বাজারে মাছ বেচতে গিয়ে গত কয়দিন ধরে এইসব গরম গরম কথা শুনছে। শেষ-হয়ে-আসা বিড়িটা সে পায়ের নিচে চেপে ধরে নিভিয়ে ফেলে। অভিসার গমনের দিন মালেক একদম নিশ্চুপ থাকে। আবিজাবি আলাপে মন যায় না। মনের মাঝে পালাগানের রঙ্গমঞ্চের মতো চলতে থাকে নানান আয়োজন, অস্থিরতা। ঘাটুদলের অন্য সকলের মতো মালেকেরও মনখারাপ। শিক্ষিত মানুষ আর ছাত্রদের দেখাদেখি এখন সব মানুষ দেশ নিয়ে চিন্তিত। মানুষ সারাদিন পাটক্ষেতের কামে ব্যস্ত থাকে। সন্ধ্যায় একটু নিপিত্তি পেলে সবাই রেডিয়োওয়ালাদের বাড়িতে গিয়ে ভিড় করে। দেশে কোনো রঙ্গতামশা নাই, ঘাটুদলের বায়না নাই, কেউ আর তাদের গফুর বাদশা গানের প্রশংসা করে না। খালি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, দেশ নিয়ে সব মানুষের মাতামাতি। কী আজব কাণ্ড!

মালেক হাঁটতে হাঁটতে জালছিঁড়া বিলের কাছে চলে আসে। জালছিঁড়া বিলের পরে টানমলা বিল। তারপর নামামলা বিল। শুকনা বিলের পাড় ধরে সে হাঁটতে থাকে।

লোকে বলে ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। মালেকের সেই দশা। মাথায় সবসময় মাছ ধরার ফিকির। বোরোক্ষেতের মাঝে মাঝে বড় বড় খাদ। ফাল্গুন-চৈতে খরার সময় খাদের পানিতে জমিনে সেচ দেওয়া হয়। তাছাড়া খাদে মাছও থাকে হাজারেবিজারে। এইসব খাদ থেকে মালেক প্রতিবছর বিচিত্র কৌশলে বড় বড় মাছ চুরি করে ধরে নিয়ে যায়। মালিকরা জিন্দিগিতেও টের পায় না। এখন মালেক খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলছে। গরম পড়ছে। এতদিন যারা গর্তের গভীরে ঘুমিয়েছিল এখন একজন-দুইজন করে সবাই ফিরে আসছে। মালেক এইসবে ভয় পায় না। সে বলে, — গরিব মরে না; কোনোমতে চৌখ দুইডা বন্ধ কইরা খালি একটা টানা মারে।

নামামলা বিলে মানু মিয়ার ভরা খাদটার কাছে এসে মালেক থমকে দাঁড়ায়। খাদের মাছগুলা খালি কপকপ করছে। পাশের খাদটা গফুর মড়লের। আজ দুপুরে খাদ সেচে মড়লের পুত মাছ ধরে নিয়ে গেছে। তাই শুকনা ধানক্ষেতে জমে আছে একটু চ্যাগব্যাগা পানি। মালেক বাতর থেকে ক্ষেতে নেমে পড়ে। গফুর মড়লের খাদ আর মানু মিয়ার খাদের মাঝে একটামাত্র বাতর। গফুর মড়লের শুকনা খাদটার মুখ এখনো বাঁধা দেওয়া। মানু মিয়ার মাছ ভরা খাদের মুখও বাঁধা। খাদের পানি শুকিয়ে বিলের তলা থেকে আধহাত নিচে নেমে গেছে। মানু মিয়ার চারটা বিলে এগারোটা খাদ। এইটা বাড়ির পাশে বলে মাছ ধরে সব শেষে। সে মানু মিয়ার খাদের মুখটা সাফ করে দিতেই বিলের তলিতে জমে-থাকা সামান্য পানি হিলহিল করে খাদে নামতে শুরু করে। চড়চড় শব্দে ঝরে-পড়া ঘোলা পানির গন্ধে মানু মিয়ার মাছভরা খাদে একটা শিহরণ বয়ে যায়। মালেক বিলের তলি থেকে উঠে গিয়ে গফুর মড়লের শুকনা খাদের বাতরে বসে। কাদু-কালুরা এক উছিলায় অনেকদিন পর মানু মিয়ার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে এখন যেমন গরম গরম ডায়ালগ দিচ্ছে, তেমনি গত তিন মাস ধরে একটা খাদের সামান্য পানিতে চক্কর দিতে দিতে বিরক্ত মীনগণ বাইরে থেকে চুঁয়ে-পড়া পানির চড়চড় শব্দে, একবিল পানির আশায় মরিয়া হয়ে লাফ দেওয়া শুরু করে। মালেক বিড়িটায় দুইটা টান দিতে না দিতেই শুরু হয়ে যায় মৎস্যবৃষ্টি। বন্দিদশা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য শৈল, গজার আর মোটা মোটা টাকি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে লাফিয়ে পড়ছে পাশের শুকনা খাদটায়।

মালেক আর বসে না। অভিসার গমন শেষে বিলপারের ঘর থেকে সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে সে আবার আসবে। আপাতত পরিস্তানের বানেছা পরীর মুখটা মনে করতে করতে মালেক আরেকটা বিড়ি ধারায়। ঘনঘন কয়টা দম দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর সে বিলের বাতর থেকেই ঘন-অন্ধকারে ঢাকা জংলার উপর গাবগাছটার কিম্ভুত ছায়া দেখতে পায়। সেদিক থেকে আসা অচেনা জংলিফুলের গন্ধ ধরে ধরে সে এগিয়ে যায়। ফালানি আর তার মাঝে দূরত্বটা দ্রুত কমে আসছে। তার দু-কান গরম হয়ে উঠছে, নিশাচর প্রাণির মতো তার দুই চোখে ঝকমক করছে ফালানির ভালোবাসা।

বানেছা পরীকে পাওয়া গেল গাবতলায়। শুকনা পাতার ওপর লাল সুতা দিয়ে জবাফুল তোলা খেতা বিছিয়ে প্রিয়ের জন্য সে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। মালেকের আওয়াজ পেয়েই সে উঠে দাঁড়ায়। গতরে আজ খেতার বদলে রঙিন চাদর, চুলে কদুর তেলের কড়া আমন্ত্রণ। আলতো করে বাঁধা খোঁপার নিচে বানেছা পরীর মরাল গ্রীবায় ওম ওম আগুন।

মালেক ফালানিকে জড়িয়ে ধরে। পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডলেরর ফুটন্ত ম্যাগমার মতো তার শরীর খাঁ খাঁ করছে। সাপের মতো জড়াজড়ি করে তারা অনেকক্ষণ পরস্পরের মনের মাঝে মন, হিয়ার মাঝে হিয়া মাখামাখি করে, ভালোবাসাবাসি করে। তাবাদে মালেক চিকন ছায়াটাকে নিচে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

অনেকক্ষণ পরে মালেক হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসে। তার কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। ফালানি বুকের আঁচল দিয়ে মালেকের মুখের ঘাম মুছে দেয়, আঙুল চালিয়ে এলোমেলো বাবরিটা আঁচড়ে দেয়। তাবাদে প্রিয়ের বুকে মাথা রেখে ফালানি তৃপ্ত হৃদয়ের স্পন্দন শোনে। ঝিঁঝিরা বিরামহীন ডাকছে। মাথার উপর গাবগাছের জাফরিতে একটা বকপাখি কক্ কক্ করে ডেকে ওঠে। পাশের ঝোপ থেকে একটা বাচ্চা-খরগোশ দৌড়ে পালায়। মালেক উঠে পড়ে, — যাইগা, আজকোয়া অনেক কাম।

ফালানিও উঠে পড়ে, — আমারে কোলে লইয়া হেই ডায়লগটা একবার কৈবে, বানেছা পরীরে কোলে লইয়া গফুর বাদশা যেডা কয়।

মালেক মাথার চুলে একবার আঙুল চালায়, গোঁফে তা দেবার সময় আঙুলে আতরের গন্ধ পায়। তারপর একঝটকায় ফালানির ছিপছিপা দেহটা তার দুই হাতে উঠে আসে। মস্ত বড় খোঁপাটা খুলে গিয়ে চুলগুলা মালেকের পায়ের কাছে ঝুলতে থাকে। মুখটা মালেকের বুকের সাথে লেগে আছে। দু-হাতে সে মালেকের গলা জড়িয়ে ধরে। মালেক রঙ্গমঞ্চের এক কোনা থেকে ডায়ালগ দিয়ে সরতে সরতে উত্তরের ঝোপটার পাশে চলে যায়, — তোমার জন্য আমার বুকে সারারাত ভালোবাসার সমুদ্র গর্জায়, প্রেমের আগুন জ্বলে অগ্নিগিরির হুতাশন নিয়ে। তবু তুমি বারবার আমার বুকে বিরহের শেল মেরে কী করে পরিস্তানে পালিয়ে যাও প্রাণেশ্বরী?

পরিস্তানের বানেছা পরীকে মালেক বুকের কাছে আগলে ধরে আবার রঙ্গমঞ্চের অন্য পাশে সরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হিস্…স…স…

মালেকের মগজে কে যেন কুড়াল দিয়ে কোপ মারে। সে ওহঃ বলে টলতে টলতে শেষ বসন্তের পূর্ণিমার ফটফটা জোছনায় দেখে, পায়ের কাছে একটা উদ্ধত ফণা দুলছে। তার মাথায় গরুর ক্ষুরের ছাপ!

মালেক ধুপ্পুত করে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। তার পাশ থেকে আড়াই-তিন হাত লম্বা লিকলিকে একটা কালো-কায়া যমদূতের মতো এ্যাঁকেবেঁকে পাশের ঝোপটার দিকে ছুটে যায়। স্তম্ভিত ফালানি পাথরের মতো একতিল দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মালেকের পায়ের কাছে ধ্পাস করে বসে পড়ে ফরাৎ করে একটানে ছিঁড়ে ফেলে শাড়ির আঁচল। দ্রুতহাতে মালেকের হাঁটুর উপরে কশে একটা বাঁধন দেয়। মালেকের হালকা, ছোটখাটো শরীরটা ট্যাঁটার ঘা-খাওয়া বাইন মাছের মতো মুচড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে আসছে!

দেখতে দেখতে মালেকের দেহটা মাটির সাথে নেতিয়ে পড়ে। ফালানি দুই হাতে মালেককে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে; ঠাণ্ডা-পাত্থর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। ফালানি হাহাকার করে ওঠে, মালেক, মালেক…

ঘুমে মালেক চোখ মেলতে পারছে না। শীতে সারাটা শরীর কুঁকড়া হয়ে বুকের সাথে মিশে যেতে চাইছে। ফালানি মালেকের মুখে হাত দিয়ে দেখে, দুই কষে ফেনা। সে আবার ডুকরে ওঠে, — মালেক! অ মালেক! ঘুমাইছ না আমার ভাই…।

ছিপছিপা শরীরের বাঘিনীর মতো ফালানি সবল হাতে ছোটখাটো মালেকের অবশ শরীরটা একঝটকায় কাঁধে তুলে বিলপার ধরে ছুটতে থাকে। মালেকের ঘর থেকে দুই-তিনশ হাত দূরে মাগীকুদ্দুর ঘর। মালেকের মুখের ফেনায় ফালানির পিঠ ভিজে যাচ্ছে। শীতল শরীরটা যেন আরো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে! ফালানি দৌড়ের মাঝেই বারবার মালেক মিনতি করে, — অ  মালেক? মালেক রে…,আমার ভাই রে…, ভাই… তুই ঘুমাইছ না।

ফালানির তালু শুকিয়ে কাঠ। চাঁদের ঝাপসা আলোয় ডর-ভয়-কান্না ভুলে সে বিলপার দিয়ে উন্মাদিনীর মতো ছুটতে থাকে।

মাগীকুদ্দুর উঠানে হালকা কুয়াশা আর ফিনফিনা জোছনার গড়াগড়ি। ফালানি মালেকের অচেতন দেহটা মাগীকুদ্দুর ঘরের দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রেখে কাতরে ওঠে, — কুদ্দু, কুদ্দু রে…

মেয়েলোকের মতো মাগীকুদ্দুর ঘুম খুব পাতলা। দ্বিতীয় ডাকেই সে উঠে বসেছিল। তার দরজায় বেটিমানুষের গলা! অবিশ্বাস্য। তবু সে কান পাতে। তৃতীয় ডাকেই সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামে, — ক্যাডা?
— আমি ফালানি, মালেকরে হাফে কামুড় মারছে…।

ফালানি বুকফাঁটা আর্তনাদে মাগীকুদ্দুর দরজার চৌকাঠে ভেঙে পড়ে। শেষের শব্দটা নারীর বাঁধভাঙা কান্নার ঢেউয়ে অলহমের কাছেই মিছমার হয়ে যায়।

মাগীকুদ্দু কপাট খুলে লাফিয়ে বাইরে পড়ে। তাবাদে ফালানির পাথাইল কোলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা মালেকের শিথানে বসে, — মালেক! অ মালেক?

সাড়া নাই, শব্দ নাই মালেকের মাথাটা জড়িয়ে ধরে মাগীকুদ্দু চিৎকার দিয়ে আছড়ে পড়ে, — তোমরা দেখলা-না-গ… আমার ভাইধন মালেক আর নাই…

মাগীকুদ্দুর এক চিৎকারেই অহাকালু সহ কাদু-কালুরা ছুটে আসে। মাগীকুদ্দু তাদেরকে দেখে, মাটি চাপড়াতে চাপড়াতে আরো জোরে জোরে রোদন পাড়ে, আমার ভাইধন মালেকরে সপ্প দংশন করছে রে… তোমরা ওঝা আনো রে…

তাদের আজন্ম অন্ধকারসহা চোখ খুব সহজেই তাদের চিরদুশমন আমজাদ ঢালীর ছোটবউ ফালানিকে চিনে ফেলে। তারা একসাথে ঘাটুদল করে। তাই তাদের মাঝে গোপন বলতে কিছু নাই। ফালানি মালেকের কী হয়? এখন সে কেন এখানে? কোথায় মালেককে সাপে কেটেছে? কিছুই বলতে হয় না। উপস্থিত সবাই একপলকে সবই বুঝে ফেলেছে। তাবাদে মমতাকাতর রাজারূপী কাদু গম্ভীর গলায় বলে, — আমরা আছি; বউ তুমি তোমার বাড়িত যাও।
ফালানি ডুকরে ওঠে, — না। আমার বাড়িঘর শেষ অইয়া গ্যাছে।
— অনেক মানুষ আইব, ঝামেলা অইব।
— আউক।

রাজারূপী কাদু একটুক্ষণ কী যেন ভাবে। তারপর মিনতির সুরে বলে, — ত্যা কুদ্দুর ঘরে গ্যায়া ঝাঁপটা বন্ধ কৈরা বও।

মাগীকুদ্দুর বুকে আঁচলের মতো করে রাখা গামছা মাটিতে খসে পড়েছে, লম্বা, রুক্ষ চুলগুলা ছড়িয়ে পড়েছে পাগলির মতো। সে রোদনের মাঝেই ফালানির কোল থেকে মালেকের নিস্তেজ দেহটা নিজের কোলে নিয়ে নেয়। ফালানি ছেঁড়া আঁচলটা মাথায় তুলে, আমজাদ ঢালীর বাড়ির দিকে না গিয়ে মাগীকুদ্দুর খুপড়ি-ঘরটায় গিয়ে ভেতর থেকে সে ঝাঁপটা বন্ধ করে দেয়।

অহাকালু ঘোড়ামোবারককে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসে। তার হাতে একটা নিবু নিবু হারিকেন। মাঝ উঠানে একটা চাটাই বিছিয়ে মালেককে শোয়ানো হয়। তার সামনে হারিকেন ধরে অহাকালু দাঁড়িয়ে থাকে। ঘোড়ামোবারক নিবিষ্ট হয়ে পায়ের ক্ষত পরীক্ষা করে। আশপাশের পাঁচ গ্রামে সে একমাত্র ওঝা। ব্লেড দিয়ে হালকা করে চিরে ফেলার মতো মালেকের পায়ে সমান্তরাল দুইটা আঁচড়। পাশ দিয়ে গড়িয়ে-পড়া দুইফোঁটা রক্তের দাগ। ঘোড়ামোবারক রাজার ফরমান হাতে ঘোষকের মতো জোরে জোরে কয়, — গোক্ষুর হাফে কামুড় দিছে!

ঘোড়ামোবারকের কথায় রাজারূপী কাদু চমকে ওঠে। মাগীকুদ্দু আবার রোদন দিয়ে আছড়ে পড়ে, — ঘোড়া… ঘোড়া রে…, আমার মালেকরে তুই বাছা…

মাগীকুদ্দুর কথায় রাজা গামছার কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছে। তার পাশে দানবকালু, অহাকালু সবাই নীরবে চোখ মুছছে। মালেকের হাঁটুর উপরে বেটিমানুষের নতুন শাড়ির আঁচল দিয়ে বাঁধা একটা বাঁধন!

ঘোড়ামোবারক বদনা থেকে উঠানে একটু পানি ঢালে। ভেজা মাটিতে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে মন্ত্র পড়ে সামনের মাটিতে ফুঁ দেয়। তাবাদে ভেজা মাটির রস দিয়ে মালেকের হাঁটুর নিচে ও উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরো দুইটা বাঁধন দেয়। এবার সে হাঁটুতে বাঁধা কাপড়ের গেরোটা খুলে ফেলে। ছেঁড়া কাপড়টা দামি একটা নতুন শাড়ির আঁচল!

ঘোড়ামোবারক একতিল আনমনা হয়। তারপর সে বদনা হাতে রোগীর পৈথান থেকে সাত-আট হাত দক্ষিণে গিয়ে বসে। উঠানের মাটিতে পানি ঢেলে, সেই পানির উপর হাত ঘুরাতে ঘুরাতে জোরে জোরে বলতে থাকে, — এই অঞ্চল… চঞ্চল… যেই নালের বিষ, সেই নালে চল…

ঘোড়ামোবারকের মন্ত্রপড়া ডান হাতটা চরকির মতো ঘুরতে ঘুরতে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে আসে অচেতন মালেকের কাছে। ‘এই অঞ্চল, চঞ্চল’ … হাতটা গিয়ে মালেকের মাথায় পড়ে। অর্থাৎ সাপের বিষ এখন রোগীর মাথায় থির হয়ে বসেছে। মানে রোগীর অবস্থা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। হাঁটুতে বিষ থাকলে এক মন্ত্র। বুকে কিংবা পিঠে থাকলে আরেক মন্ত্র। আর যদি মাথায় থাকে তবে রোগীর অবস্থা যেমন চরমে, তেমনি মন্ত্রও হবে চরম অশ্লীল।

পরপর তিনবার পরীক্ষার ফল একই দেখে ঘোড়ামোবারক ডাক দিয়ে উপস্থিত সবাইকে হুকুম দেয়, — পুরুষলোক কোমরের গামছা খুইল্ল্যা ফালাও। মেয়েলোক চুলের খোঁপা, আঁচলের গিরা ছাইড়্যা দ্যাও।

তাবাদে ঘোড়ামোবারক লাফ দিয়ে সুরে সুরে গর্জে ওঠে :

পৈদ্ম্যাকানি গাঙ্গের ঘাটে,
করতে গেছিল গোসল রে,
তার মাঙ্গের মাইধ্যে হিঙ্গে মারছে গালা রে…

ঘোড়ামোবারক মালেকের অচেতন দেহটার চারদিকে নেচে নেচে, ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র পড়ছে :

পৈদ্মাকানি বনে গেছিল,
ফুলের গন্ধ লইতে রে,
ফুলের দেখা পাইল না সে,
বাঘের দেখা পাইল রে

বাঘে তারে একলা পাইয়া,
মনের মতো চুদল রে…

অহাকালুর মুখে খবর পেয়ে রাতের অন্ধকারেই খেলা হনহন করে দক্ষিণের দিকে চলে গেছিল। শেষরাতে হাঁটু পর্যন্ত ধুলা আর চোখমুখভরা কষ্টের কালি নিয়ে সে ফিরে আসে। সাথে কাঁচা-পাকা বাবরি চুলের একজন ওঝা। মাগীকুদ্দুর ছোট বাড়িটা উপচে পড়ছে মানুষে। লোকটার চুল-দাড়ি আর বাবরির গাম্ভীর্য দেখে মানুষের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। একজন বলে, — এইডা হইল এক নম্বর ওঝা।

সবাই পিছনের দিকে সরে গিয়ে উঠান খালি করে দেয়। ঘোড়ামোবারক বদনার পানি দিয়ে হাত ধুয়ে উঠে আসে। রাত হলে পিঠে ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে কোপ-খাওয়া দাগের নিচে একটা কঠিন ব্যথা দূরন্ত বিজলির মতো ঘনঘন ঝিলিক মারে। শরীর থেকে অনেক রক্ত গ্যাছে, অনেক ভোগান্তি গ্যাছে জানের ওপর দিয়ে। আগের শক্তি আর নাই। সে টলতে টলতে ভিড় থেকে বেরিয়ে আসে।

নতুন ওঝা এসে প্রথমেই রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করে মুখ কালো করে ফেলে। তারপর পানিপড়া দিয়ে রোগীর উদ্দেশ্যে ‘হাত চালান’ করে। একলাফে হাত গিয়ে পড়ে মালেকের মাথায়। এবার ওঝা মন্ত্রপড়ে গ্লাসের পানিতে একটা তাবিজ ফেলে দেয়। পানিতে ঘুরতে ঘুরতে তাবিজ লেখা কাগজটা গিয়ে একেবারে গ্লাসের তলিতে বসে!

লোকটা খেলার কাছে ফিরে আসে, — রোগী আর নাই, কামুড় মারার দশ মিনিটের মইদ্যে রোগী শেষ অইয়া গ্যাছে।

মাগীকুদ্দুর বিলাপে সারা বিলপার ভার হয়ে ওঠে। সে মালেকের শিথানে বসে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করছে, — মালেক, আমার পরানের ভাই মালেক, তুই কিবায় আমগরে থৈয়্যা একলা একলা চইলা গ্যালে রে…

কাদু-কালু চোখ মুছতে মুছতে খেলার কাছে চলে আসে। গোপন রোদনে রোদনে খেলা দুইচোখ লাল কুক্কা করে ফেলেছে। কান্নাভাঙা গলায় সে বলে, — আমি যাই। লাশের লাইগ্যা কাফন আনতে অইব। তোমরা কব্বরটা রেডি করো।

অহাকালু জলভরা চোখে মালেকের শিথানে গিয়ে বসে, — আমারে তুই মাফ কৈরা দ্যাইছ রে ভাই, ভাই রে…

বলতে বলতে অহাকালু ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে। পরী মালেকের শিথানে বসে জারে জারে কাঁদছে।

সন্ধ্যায় মালেককে কবর দিয়ে বিলপারের কান্দা থেকে সবাই ফিরে আসে। বসন্তের শেষ পূর্ণিমার চাঁদ যেন মালেকের শোকে গলে গলে পড়তে চাইছে! মাগীকুদ্দুর উঠানে ফিনফিনা জোছনা আর হালকা কুয়াশার ঘোর মাতম। বাতাসে জংলিফুলের গন্ধ আর গরম। গ্রামের সবাই যার যার বাড়ি চলে গেছে। মাগীকুদ্দুর উঠানে শুধু মালেকের স্বজনেরা। ফালানি দরজার ঝাঁপ ঠেলে বেরিয়ে আসে। উঠানের উত্তর কোনায় খেলার সাথে মাগীকুদ্দু আর কাদু-কালুরা বসে বিড়ি টানছে। তারা সবাই নির্বাক। সবাই বোবা পশুর মতো এক অবোধ বিষণ্ণ ভালোবাসায়, বেদনায় অসার শরীরে পরস্পরের গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। ফালানিকে দেখে তাদের মাঝ থেকে কাদু উঠে আসে, — বউ, অহন তুমি কই যাইবা?

ঘাটুদলের মাঝে কাদু-কালুরা ভাই ভাই। এতকাল মালেক সেই ভাইদের একজন ছিল। তাই রাজারূপী কাদু রাজার মতো দিলভরা দয়া-দরদে প্রায় কেঁদে ফেলে। অভ্যস্ত হাতে ফালানি মাথায় ছেঁড়া আঁচলটা তুলে দেয়, — যাইতে ত অইবই।

উদ্বেগে রাজার গলা কেঁপে ওঠে, — হুনছি আমজদ রামদা লইয়া বইয়া রইছে।

ফালানি বেদনার হাসি হাসে, — কী যে কৈন ভাইছাব! হাসু ডাকাইতের ছোডু মেয়ে ফালানি কেউর রামদাও ডরায় না।

কাদু আমতা আমতা করে। হিলার পুলে ঝুম্মুর ঝুম্মুর শব্দ তুলে একটা ট্রেন ছুটে যায়। ট্রেনের চাকার শব্দে ফালানির শরীরটা কেঁপে ওঠে। সে জানে, কলঙ্কিনী ফালানির জন্য দুনিয়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আর খোলা থাকলেই কী! মালেক ছাড়া তার গোটা পৃথিবীটাই তো কবর।

ফালানি শুকনা বিলপারের পথ ধরে সোজা পুবদিকে হাঁটে। চাঁদের আলোতে যতক্ষণ ফালানির ছিপছিপা দেহটা দেখা যায় ততক্ষণ কাদু-কালুরা সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বিলপারের কান্দায় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। কায়াটা কুয়াশার অতলে হারিয়ে যেতেই মাগীকুদ্দু ভুস করে দম ছাড়ে :

আহা রে পিরিতি,
কী নিদারুণ তোমার রীতি।

পরেরদিন দুপুরের পর গ্রামে গ্রামে রটে যায়, দ্যাখতে ফালানির মতন একটা বেটিমানুষ হিলার পুলের কাছে রেলে কাটা পড়েছে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: