চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৪ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৪ || শেখ লুৎফর

এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম
৭ ডিসেম্বরের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের বিজয় উৎসবের পরেরদিন ঘুম থেকে উঠেই কাদু-কালুরা গিরস্তের বাড়িতে কামে যায়। মাগরেবের আজানের সময় জমি থেকে উঠে তাদেরকে ছুটতে হয় বাজারের দিকে। ধানমহালে কিংবা পাটমহালে গিয়ে ধরতে হয় গিরস্তকে। মাথায় চাল-ডাল, নুন-তেলের কঠিন হিসাব। তবু মনে থাকে বঙ্গবন্ধুর কথা। ফিরতি পথে ঘুটঘুটে আন্ধকারে বিড়ি টানতে টানতে আলাপ হয়, বঙ্গবন্ধু কি রাজা অইছে? — মাগীকুদ্দুর কাছ থেকে আধপোড়া বিড়িটা নিতে নিতে দানবকালু এইকথা জিগায়।

মানু মিয়ার মুখে চুনকালি লাগার পর থেকে সবসময় মাগীকুদ্দু মেজাজে থাকে। যদিও অনেকদিন ধরে কোনো বায়না নাই, রঙ্গমঞ্চ নাই, তবু তার কথাবার্তায় ডায়ালগের পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। তাই দানবকালুর প্রশ্নটা শুনে মাগীকুদ্দু খুশিতে এই মিশমিশা-কালো অন্ধকারেই একটা পাছা নাড়া দিয়ে বলে, — বান্দার গোস্তাকি মাপ হয় খোদাবন্দ, এই দাসী দূত মারফত সংবাদ পেয়েছে, এক সপ্তাহ পর বঙ্গবন্ধু চেমননগরের সিংহাসনে আরোহন করবেন।

খবরটা শুনে রাজারূপী কাদু আরামে শ্বাস লয়। অহাকালুর সাড়ে ছ ফুট লম্বা হাড়গিলা দেহটা চলার সময় মাথার ভারে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই সে পিঠ সোজা করে বলে, — দৌলতে আজম আপনার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক।

কাদু-কালুরা রাজনীতি বোঝে না। পেট বোঝে। একপেট ভাতের জন্য নিরীহ-চতুষ্পদী জন্তুর মতো অর্ধনগ্ন জীবনটা ক্ষয় করে। দূরারোগ্য ব্যাধির মতো দারিদ্র্যতার এই ক্ষয়কে জয় করার নেশা থেকেই হয়ত তারা শিল্পী। রাতের রঙ্গমঞ্চে উঠে, শিল্পের আলোয় গ্রামের দীনদুক্কী মানুষকে ভুলিয়ে রাখে, স্বপ্ন দেখায়। তাই মশা-ম্যালেরিয়া, কলেরা-বসন্ত, দুর্ভিক্ষ-বন্যা-সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, পরদেশি শাসকদের শোষণ-নির্যাতন কোনোকিছুই তাদেরকে হারিয়ে দিতে পারে না।

আজ কয়দিনে বঙ্গবন্ধুর সাহস আর শক্তির কথা শুনতে শুনতে অহাকালুর টাকালোভী ভীরু মনটাও বুঝি সাহসী হয়ে উঠেছে। তাবাদে হাছু কলুর হয়ে আঙ্কুরের লেখা আবেদনে গতকাল সন্ধ্যার পর দশ-বারোজন ছাত্রনেতা মানু মিয়ার বাড়িতে এসেছিল। ডেকে এনে ফরিয়াদি বাপ-বেটির আলাদা আলাদা জবানবন্দি নিয়েছে। তারপর মানু মিয়ার পালা। তার দিকে বিশজোড়া চোখ। মাথা ভরতি লম্বা লম্বা চুল, চিকন চিকন গোঁফওয়ালা ছাত্রদের কঠিন ঠোঁট দেখে মানু মিয়ার আত্মা শুকিয়ে কাঠ। শেখ মুজিব নির্বাচনে জিতেছে আজ এক মাস। এর মাঝে তিনবার চেষ্টা করেও সে ছোট তালুকদারের দেখা পায় না। তালুকদার নাকি শহরে গেছে। কাদু-কালুদের কাছ থেকে জমি হরণ, দলে বিভাজন সব একসূত্রে চলে এলে মানু মিয়া ছাত্রদের সামনে মাথা তোলে না। তাই ছাত্রদের দেওয়া রায় মোতাবেক সে ঘর থেকে নগদ চারশ তিরিশ টাকা এনে, ছাত্রদের সামনেই হাছু কলুর মেয়ের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। চলে যাওয়ার সময় ছাত্রনেতা মানু মিয়াকে বলে গেছে, আরেকবার এইরকম করলে গয়েরশপুর বাজারে নিয়ে সব মানুষের সামনে তার বিচার করবে।

আজ কাদু-কালুরা সাধন সাহার ক্ষেতে গোল আলু তোলার কাজ করছে। এক পাঁথি আলু বস্তায় ঢালতে ঢালতে বেজার মনে মাগীকুদ্দু বলে, — ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুরে চেমননগরের সিংহাসন দিতেছে না।

রাজারূপী কাদু একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, — ঘুরাওক। কয়দিন ঘুরাইব? হেইদিন হাইঞ্জা-সময় আঙ্কুরের রেডিয়োতে হুনলাম বঙ্গবন্ধু পেসিটাইন ইয়াহিয়া খানরে ডায়ালগ দ্যায়া ধমকাইতাছে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…

ইদানীং অহাকালুর কাথাবার্তায় বেশ সাহসের আভাস পাওয়া যায়। আগে সে সকলকে অবিশ্বাস করত, সন্দেহ করত ঘাটুদলের সাথী ভাইকেও। সে ছিল টাকা আর বিয়ে পাগল। কিন্তু গয়েশপুরে নির্বাচনী মিটিঙের পর থেকে তার যেন জন্মান্তর ঘটে গেছে। দেশের সব গরিবদরিব মানুষ বলাবলি করছে, বঙ্গবন্ধু রাজা হলে সব মানুষ সুখী হয়ে যাবে। সবাই পেট ভরে ভাত পাবে, পরনের কাপড় পাবে, রোগ-বলাইয়ে অষুধ পাবে। তাহলে নিশ্চয়ই অহাকালুও একটা বউ পাবে। তাই অহাকালু মনে মনে খুব আমুদে আছে। সে ঝাড়া দিয়ে হাত থেকে আলুক্ষেতের ধুলাবালি সাফ করে কোমরে হাত দেয়। বিড়ি বানানোর জন্য টিনের কৌটাটা বের করে বলে, — মানু মিয়া কিন্তুক ঘাডুদল লইয়া ইয়াহিয়া খানের লাহান অহনও প্যাঁচ খেলতাছে।

দানবকালুও কাজ থেকে উঠে দাঁড়ায়। জোরে জোরে দুইটা থাপা দিয়ে হাত সাফ করে অহাকালুর কৌটার দিকে হাত বাড়ায়। আজ আর কৃপণ অহাকালু দানবকালুকে নিষেধ করে না। এই থেকে বোঝা গেল, অহাকালুর বক্কিল মনটাতেও একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে!

দানবকালু বিড়িতে টান দিয়ে তার স্বভাবমতো নিরীহ ভঙ্গিতে বলে, — প্যাছেট্যাছে কাম অইত না। চোর-ডাকাইত দ্যায়া ঘাডুদল অয় না।

‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়’ সিলকিটা দিয়ে মাগীকুদ্দু বলে, — দ্যাহিস বঙ্গবন্ধু চেমননগরের রাজা হইলে মানু মিয়াগর কী দশা অয়।

অহাকালু বলে, — মানু মিয়ার খবর জানস?

মাগীকুদ্দু এবার চ্যারত করে থুতু ফালে, — মাইনশের মুহ হুনছি মানু মিয়ার পুটকি দ্যায়া লাল-নীল হুতা (সুতা) বার হইতাছে।

অহাকালু সারাজীবন দেখে এসেছে ‘ট্যাহাওয়ালার মউত নাই যদি না নেয় যমে’। কিন্তু এইবার মানু মিয়া টাকা দিয়েও রক্ষা পাইল না। ছাত্রনেতার হুকুমে, সবার সামনে তাকে কানে ধরে উঠবস করতে হয়েছে, ওয়াদা করতে হয়েছে জীবনে আর কোনোদিন সে পরনারী নষ্ট করবে না। তার বিবেচনায় দেশের ছাত্রদের মতো সৎ-সাহসী-শক্তিমান আর গরিবের জন্য এমন দরদি আর কেউ নাই। একটু খালি খবর দিলেই হইল। সেদিন নৌকার মিটিঙে অহাকালুর সাথেও সব ছাত্ররা একে একে মোসাফা করেছে। এখন অহাকালু হাত মুঠি করে দেখে, তার কব্জিতে  অনেক শক্তি। সেই শক্তি-সাহস থেকে সে দুম করে বলে ফেলে, — আমি গফুর বাদশারে যুক্তি দ্যায়া ঘোড়ামোবারকের ঘর থাইক্যা ভাগায়া আনাম। বাদশা না অইলে রঙ্গমঞ্চে গফুর বাদশা পালাটা জমত না।

অহাকালুর এই কথায় উপস্থিত সকলেই চমকে ওঠে। সত্যিই ত! একটা ঘাটুদলের জন্য যা যা দরকার খেলার সব আছে। খালি গফুর বাদশা নাই। গফুর বাদশা ঘোড়ামোবারকের ভক্ত ও চুরিবিদ্যার নবীন শিষ্য। তাকে যদি ছলে-বলে-কৌশলে হাত করা যায় তবে তারা আবার আগের মতো রঙ্গমঞ্চ মাত করতে পারবে।

সাধন সাহার বাড়ি থেকে আসা আলুভর্তা আর খেশারির ডাল দিয়ে কাদু-কালুরা দুপুরের খাবার শেষ করে। এই সময় বিড়ি টানতে টানতে খেলার উদয় হয়। অহাকালু হাতের বিড়িটা ফেলে কুর্নিশের ভঙ্গিতে খেলাকে অভিবাদন জানায়, — আসুন আসুন মুল্লুকে আজম। আপনার পদধূলিতে আজ চেমননগর ধন্য হলো।

খেলা মোটা বাতরে বসতে বসতে বলে, — চেমননগরের নির্যাতিত জনতার জন্য সুখবর আছে উজিরে আলা।

কাদু-কালুরা চমক খাওয়া চোখে খেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। এবার খেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, — কুখাবনগরের জুলুমবাজ, দাম্ভীক ইয়াহিয়া খান (মানু মিয়া) একটু আগে আমার কাছে শান্তির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠিয়েছিল। সে আমার সাথে আলোচনায় বসতে চায়। আমি তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি, চেমননগরের নির্যাতিত জনতা ছাড়া আমি একা কোনো প্রকার আলোচনায় বসতে পারি না।

দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য কামলা-কিষাণ সকলেই যার যার বাড়ি চলে গেছে। মাঠের বাতাসে পেকে ওঠা নানান রকম রবিশস্যের ঘ্রাণ। চকচকা আকাশ থেকে গলে গলে পড়ছে ওম ওম রোদ। রাজারূপী কাদু গামছা দিয়ে মুখটা মোছে। বাবরিটা একবার ছুঁয়ে দেখে। তাবাদে খুব দৃঢ় কিন্তু অনুচ্চ গলায় বলে, — চেমননগরের সাহসী, বীর সেনানায়ক, সাড়ে সাত কোটি জনতার পক্ষ থেকে আপনাকে অভিবাদন জানাই। হে আমার বিচক্ষণ সেনাপতি, মনে রাখবেন, ইতিহাস বলে, ভাঙা কাচ জোড়া লাগলেও ছিন্ন বিশ্বাস, ভালোবাসা কখনো জোড়া লাগে না।

অহাকালু, মাগীকুদ্দু সহ উপস্থিত সকলের জোর হাততালিতে মাঠের বাতাস বারবার আলোড়িত হয়।

এরই মাঝে খেলা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার শরীরের তরুণ রক্ত টগবগ করে ফুটছে; আজ কতদিন ধরে পালা নাই, আলোকিত রঙ্গমঞ্চ নাই। তাই সে মঞ্চের আদপেই বারবার মাথা নত করে রাজাকে কুর্নিশ করতে করতে ডায়ালগ দেয়, — গোস্তাকি মাফ করবেন খোদাবন্দ, আজ চেমননগরবাসীর চেয়ে সুখী আর কে মহারাজ? কুখাবনগরের রাক্ষসপতির (মানু মিয়া) কঠিন বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের সকলের মুখের হাসি, বুকের সাহস ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে মানুষের মতো বেঁচে থাকার সাধ ও স্বপ্ন। তাই এখন আমাদের সব চেয়ে জরুরি গোপন বৈঠক। মহারাজের আজ্ঞা হলে, আজ এই শুভক্ষণে আমরা একান্তে বসতে পারি।

রাজারূপী কাদু খুশি মনে, তৃপ্ত হৃদয়ে কাজে নেমে যায়। অর্থৎ সে খেলার প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। এখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা চলবে। তার দেখাদেখি সকলেই কাজে হাত লাগায়। খেলা গিয়ে তাদের পাশে বসে, — ঘোড়ামোবারক বেনেভিটায় বইয়া রইছে।
— ঘোড়ামোবারক অহন কৈত্তে আইছে? হে না একমাস ধইরা নিরুদ্দেশ।
দানবকালুর কথায় মাগীকুদ্দু চ্যারত করে থুতু ফালে, — হুনছি উজানে ডাকাতি করবার গ্যায়া পিঠে কোপ খাইয়া একমাস হাসপাতালে আছিন।
— চিগিসসার ট্যাহা পাইল কৈ?
এইকথা বলে খেলা রাজারূপী কাদুর দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকিয়ে থাকে।
— মানু মিয়া সব খরচ দিছে।

বলতে বলতে মাগীকুদ্দু খেলার হাত থেকে প্রায় শেষ হয়ে আসা বিড়িটা নিয়ে, তিন আঙুলে চিমটি দিয়ে ধরে, ওছু ওছু রবে খুব লম্বা একটা দম দেয়।

নেশার আমুদে মাগীকুদ্দুর বুকটা চিনচিন করে জ্বলছে। খেলা রাজার দিকে তাকিয়ে বলে, — তাইলে এইডাই কতা রইল। আলোচনা হইব পুবের সড়কের জামতলে।
— শুক্কুরবার, বাদ আছর।
রাজার এই কথায় খেলা মাগীকুদ্দুর দিকে তাকিয়ে বলে, — আলোচনায় যার যার বুদ্ধিমতো, দরকারমতো কথা কৈবে।
দানবকালু একটু ত্যাজের সাথেই বলে, — এইবার মানু মিয়ারে ছাই দ্যায়া ধরাম; দ্যাহি ক্যামনে পিছলাইয়া যায়।

দানবকালুর মুখে বীরের বাণী শুনে আরামে, অহংকারে মাগীকুদ্দুর মনটা ভরে যায়। সে আড়চোখে দানবকালুর বাবরি সহ বিরাট মাথাটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এই না হইল পুরুষের কথা!

জামতলার সড়কের দুই পাশে হাঁটু-সমান পাটক্ষেত। আলোচনা শুরু হওয়ার বেশ আগে সড়কের ঢালগড়ানের নিচে দুই দলই যার যার অস্ত্রশস্ত্র মজুত করে রাখে। যদি তর্কাতর্কি শুরু হয়। তর্কাতর্কিটা যদি লাঠালাঠিতে গিয়ে ঠেকে।

ভালোবাসার একটু একটু পলি জমে বহু-বছরে বিশ্বাসের যে ভিত গড়ে উঠেছিল তা ধসে যাওয়ার পর আর কেউই কারো উপর আস্থা রাখতে পারছে না।

আলোচনাটালোচনা আর কী। বরাবরের মতো আমজাদ ঢালীকে নিয়ে মাগীকুদ্দু খুব রঙ-তামশা করে। দুম হাসাহাসির সাথে কাশি আর বিড়ি টানা চলে অনেকক্ষণ। মানু মিয়া আসার সময় আঙ্কুরের দোকান থেকে এক প্যাকেট রমনা সিগারেট এনেছিল সেটা শেষ হলে, আঙ্কুর কোমরের কশি থেকে একবান্ডিল মমতাজ বিড়ি বের করে সবার সামনে রাখে।

কাদুর কথাই ঠিক; ভাঙা কাচ জোড়া লাগে কিন্তু বিশ্বাস ভাঙলে জোড়া লাগে না। মানু মিয়া বসেছে সড়কের পুব দিকে। তার পেছনে ঘোড়ামোবারক সহ ছলিম-জব্বররা চারজন। খেলা বসেছে সড়কের পশ্চিম বাজুতে। তার সাথে কাদু-কালুরা চারজন। তাদের মাঝ দিয়ে পায়ে-চলা পথের সরু সাদা দাগটাকে উপস্থিত সবার কাছে অনেক চওড়া মনে হয়।

আঙ্কুরের বান্ডিলের শেষ বিড়িটা তুলে নিয়ে মানু মিয়া বলে, — তাইলে এইডাই কথা রইল, অহন থাইক্যা বায়না আইলে বায়না রাহাম।

মানু মিয়ার এই কথায় আজিলি-ফাজিলি আলাপ থেমে যায়। ঘোড়ামোবারক বিড়িতে লম্বা করে টান দেয়। মনে মনে বিচার করে, — এই দলের ক্যাডা তারে দা দ্যায়া কোপাইছে?

রাতের অন্ধকারে দেখা সেদিনের সেই ছায়াটাকে সে মনে করতে চেষ্টা করে। খুব বড়ও না ছোটও না। গয়েশপুরে যাওয়ার সময় মালেককে সে দেখে এসেছিল বড় বিলের ডহরে। অহাকালু ত সাত হাত লম্বা। লম্বা ত খেলাও। কাদু-কালু সন্দেহের অতীত। তাইলে ক্যাডা?

মানু মিয়ার এক প্রস্তাবে জামতলার নীরবতা লম্বা হয়। খেলা রাজারূপী কাদুর দিকে তাকায়। রাজা তাকায় মাগীকুদ্দুর দিকে। মাগীকুদ্দু গলা খাকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, — আমার কয়ডা কথা আছে।

কেউ টুঁ শব্দটা করে না। মানু মিয়া আচান্নক চোখে মাগীকুদ্দুর ওপরের ঠোঁটের তিলটা ঠাহর করে। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। তাই মাগীকুদ্দু মুখ খোলে, — বেশি না, আমার পাঁচ-ছয়ডা কতা :
১. জমিন ফিরায়া দিতে অইব।
২.আমগর খেড়ের খুব দরকার। আমরা খেড় দ্যায়া ঘরের বেড়া বান্দি, চাল ছাই, শীতের দিন খেড়ের বিছানাত ঘুমাই। আমরা ধানের মতন খেড়ের সমান সমান ভাগ চাই।
৩. আমরা ভাগিদারগর আলাদা বিছরা (বীজতলা) দিতে অইব। আফনের বিছরাত আমরা আর মাগনা খাটতাম না।
৪. ঘাডুদলের বিষয়ে আগের মতন একক সিদ্ধান্ত চলত না। আমগর সকলের মতামতে সিদ্ধান্ত নিতে অইব।
৫. আমরা সকলেই মানুষ, সকলেই স্বাধীন। দলের কেউ কেউরে চৌখ লাল কৈরা কতা কৈতে পারব না।
৬. ঘাডুদলের আয়-ব্যায়ের হিসাব পতিবছর কার্তিক মাসের পয়লা তারিখ সকলের সামনে পরিষ্কার বুঝায়া দিতে অইব।

আমগর এই কথা।

মাগীকুদ্দু বসে পড়তেই অহাকালু উঠে দাঁড়ায়। তার লগির মতো হাড়গিলা শরীরটার জোড়াজাড়া মটমট করে আওয়াজ দিয়ে যেন মানু মিয়াকে জানায়, — সে নির্ভীক। তার হাতে শতশত ছাত্রদের শক্তি।

একটু দূরে তালগাছের মোথার মতো মানু মিয়ার লোমশ আর খসখসা চামড়ার দেহটা। পিঠে শুয়রের লোম ভর্তি মানু মিয়া এক জীবনে কত নারীর দেহ ভোগ করেছে…। অথচ অহাকালু…। তার হৃদয়টা গুমরে ওঠে, নারীদেহের সুগন্ধ ভরা একবুক দম নেবার জন্য তার তিরিশ বছরের এই জীবনে সে একটা বেটিমানুষ পাইল না! রাগে-দুঃখে তার ভালো চোখটা দিয়ে আগুন বেরোতে থাকে। সে মানু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, — আমগর এই ছয়দফা আমরা দিছি, মানা না-মানা আফনের ইচ্ছা।

মাগীকুদ্দুর শর্তগুলার সাথে সাথে রাজারূপী কাদু তার ভারী মাথাটা বারবার নাড়ছিল। খেলা গোঁফের আড়ালে হাসছিল মুচকি মুচকি আর মনে মনে ভাবছিল, সার্থক জনম বিকাশের; তার মাস্টারির গুণে এখন অহাকালুও ছয়দফা বোঝে!

রাজারূপী কাদু কিংবা খেলা কেউ আর কথা বলে না। মানু মিয়াও অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না। কয়টা পাগল-ছাগলের দুঃসাহস দেখে সে পাত্থর হয়ে গেছে। তাবাদে অহাকালুর ‘ছয়দফা’ শব্দটার মধ্য দিয়ে চতুর মানু মিয়া অনেক কিছু দেখে ফেলে। শেখ মুজিব ইলেকশনে পাশ করলেও ইয়াহিয়া খান তাকে ক্ষমতা দেয়নি। তো মানু মিয়া কী করে এইসব দেড় পৈসার ছাগলদের দাবি মেনে নেয়?

মানু মিয়া ঝট করে বসা থেকে উঠে পড়ে। তার দেখাদেখি ঘোড়ামোবারকরাও ওঠে। পায়ে-চলা পথের সিঁথিকাটা সাদা দাগটা তাদের দু’দলের মাঝে দুস্তর ব্যাবধান রচনা করে পড়ে থাকে। তবু জোর করে মানু মিয়া হাসতে থাকে। যেন কিছুই হয়নি। যেন আগের মতোই সব ঠিক আছে। এইরকম ভাব দেখাতে গিয়ে মানু মিয়া জীবনে যা করেনি সবাইকে আচান্নক করে সে ডায়ালগ দিয়ে বসে, — চেমননগরের কাননে কাননে আবার ফুটিবে ফুল, পাখিরা গাহিবে গান, পরীস্তানের সামসাদ নদী দিয়ে বয়ে যাবে সুমিষ্ট জলধারা।

এইসব বলতে বলতে পিঠে লম্বা লম্বা লোম ভরতি মানু মিয়ার ভারী শরীরটা বারবার কেঁপে ওঠে। ঘোড়ামোবারক দাঁতে দাঁত ঘষে, — একটু সবুর কর, সব কয়ডারে খুন করাম চুতমারানির পুতাইন।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: