রেলহুইসেল

রেলহুইসেল

দূর থেকে ভেসে আসছে রেলের  হুইস্যল। চলে যায় রেল ভেঁপু বাজিয়ে তেপান্তর চিরে, ক্ষেতজাংলা পারায়ে, যেন লোকালয় ছেড়ে কোনো অলোকালয়ে, যেন কোনো অজানা আচিনা ধামের পানে। কেউ চলে যায়, চিরতরে অথবা দিনকয়েকের সাময়িকতায়, তার প্রিয়জন ছেড়ে। রেলহুইস্যল, ট্রেনের ভেঁপু অথবা বাঁশি, কানে কেন যেন খুবই বিষণ্ন শোনায়। এমন না যে এই বিষণ্নতা গানের ন্যায় মেলোডিয়াস, আবার এমনও না যে এর আবহ-আওয়াজ হরর ম্যুভির ন্যায় ক্যায়োটিক ভীতিসঞ্চারণকর। ভয় ও বিষাদ প্রভৃতি ফিলিংসের বাইরেকার এই অনুভূতি। ঠিক অচিন নয়, ফের চেনাও মনে হয় না যেন। তবু শব্দে-ধৃত অনুভূতির বর্ণনগত যে-লিমিট্যাশন, অনুভূত অভিজ্ঞতা ডিফাইন করার যে-ক্রাইসিস, সেসব কবুল করে নিয়ে রেলের হুইস্যলের শব্দ তথা তার সাউন্ড-এফেক্টটাকে বিষণ্নধাঁচ বলে সাব্যস্ত করছি। যেমনটা বিষাদাপন্ন শোনায় খুব দূর থেকে ভেসে-আসা মাদলের আওয়াজ। বিশেষত শীতকালিক টিলাবহুল অঞ্চল তথা খাসিয়া-পাত্রপল্লির আশপাশ এলাকায়, একাধটু ঝোপঝাড়-জঙ্গলসংলগ্ন লোকালয়ে, এইধারা মাদলধ্বনি শুনে মনে হবে যেন দূর কোনো সভ্যতার মায়াডাক। মন্ত্রের মতো করুণ ও সম্মোহক দূরাগত সেই মাদলের ধুন।

অবশ্য শীতরাতে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকাডাকিটাও খুব বেদনাবাদিনী, বিষণ্নতাস্মারক। তার মানে দাঁড়াতেসে যে, শব্দের সঙ্গে একটা যোগসাজশ রয়েছে বেদনা-বিষণ্নতার, বেদনা-বিষণ্নতাই কিনা আনন্দজননী জগতের। আমাদের সুইট মেলোডি সেইগুলোই তো, যেগুলো অবিরত বলে চলে বেদনাবাহার। কথাটা খালি কিটস্ বলেছেন বলেই নয়, খেয়াঘাটের মাঝিও কথাটা জানে এবং গলা ছেড়ে প্রচারিয়া যায় জীবনভর লোকায়তিক এই ফিলোসোফি। ঠিকই তো, শব্দের সঙ্গে বেদনা তথা আদি-শুদ্ধ আনন্দের যোগ রয়েছে তো বটে। এই শব্দকেই তো বলা হচ্ছে ব্রহ্ম। ওম্, ওঙ্কার, দ্য বিগ ব্যাং। ব্রহ্মনাদ। আর কে না জানে যে, ব্রহ্মভরা অবিরল আনন্দ-বেদনা, পাশাপাশি-পিঠেপিঠি দুই সহোদরা তারা আনন্দ ও বেদনা নাম্নী দ্বিরত্না দ্বৈরথাধীনা!

আমাদের এক বন্ধুর পিতৃমৃত্যুসংবাদে স্পৃষ্ট হয়ে এই তিতপুরনো কথাগুলোই ফের নতুন করে মনে এল। ভোররাতের দিকে একদম আকস্মিকভাবেই তিনি মৃত্যুলোকে গেলেন চলে। মৃত্যু তো সবসময়ই আকস্মিক, তবু সুস্থ-সচল কেউ মারা গেলে সেই আকস্মিকতা আমাদেরে আর্ত করে অধিক। থমকায়ে দিয়া যায় যেন সবকিছু সহসা। যা-হোক, পিতৃবিয়োগের অনুভূতি কেমন আমি জানি না তা নয়, জানতাম না আগে এমন অনেককিছুই এখন আমার আপন কররেখার ন্যায় জানা। এমনকি মাতৃবিয়োগেরও হতভম্ব হরিণচক্ষের বেদনা। প্রার্থনা করি যেন সহসা সেই অনুভূতি সেই অমোঘ অভিজ্ঞতা আর-কাউকে গ্রাস না-করে। যেন কাউকেই ছায়াহারা না হইতে হয় ইন ওয়ান মর্নিং দুম করে। এই চিরিচিরি বৃষ্টি ও রৌদ্রের রঙে চুবানো অপরূপ দুনিয়ায় কেউ যেন ছায়ার অভাবে না-কাৎরায়।

হায়! — আমরা যেই বয়সে এসে পৌঁছেছি, পিতৃমাতৃস্নেহচ্ছায়া না-পারি লভিতে পুরোপুরি, না-পারি এর নেসেসিটি অস্বীকারিতে। এই পৃথিবী বৃক্ষছায়াহীন কল্পনা করা আমাদের পক্ষে সাধ্যাতীতই হবার কথা। আম্মা আর আব্বা আমাদের কাছে আলোজল-হাওয়াবাতাসের মতো, গলা উঁচায়া তার দরকার ওইভাবে ঘোষণা করতে হয় না। যার যায় তার যায়, সমবেদনা আর সহমর্ম পর্বতের মতো শুধু স্তূপাকার হয়া থাকে পড়ে একপাশে বেকার।

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: