শামীম কবীর : বিষাদঘন শিরোনাম || আহমদ মিনহাজ

শামীম কবীর : বিষাদঘন শিরোনাম || আহমদ মিনহাজ

নব্বইয়ের বিচিত্র তরঙ্গে সওয়ার কবিদের মাঝে স্বকীয়তা প্রথম একদশকেই গড়ে নিতে পেরেছেন এরকম কবি সংখ্যায় অধিক ছিলেন না। পাঠক হয়তো চকিত বিক্ষেপে বেশকিছু কবির নাম প্রাসঙ্গিক ভাবতে পারে। সূচনার দিনগুলোয় উজ্জ্বল শামীম কবীর, মজনু শাহ, মোস্তাক আহমাদ দীন, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, টোকন ঠাকুর, আলফ্রেড খোকন ছাড়াও আরো কিছু নাম সেখানে যোগ করা যায়। অনতিসংক্ষেপ তালিকায় শামীম কবীর বিষাদঘন শিরোনামের দ্যোতক ছিলেন! চব্বিশে পা রাখা যুবকের না-ফেরার দেশে স্বেছাপ্রস্থানের খবর কবিবন্ধু ও পাঠকদের বুকে শেল হয়ে বিঁধেছিল। আধুনিকবাদী কবিতায় ব্যক্তির শিখরস্পর্শী নিরালা নিষ্ক্রান্তির গুণগানে হুমায়ুন আজাদ তখন সরব ছিলেন। তাঁর পাঠ্যতালিকায় তরুণ কবির আত্মযন্ত্রণার বাখান জায়গা করে নিতে পেরেছিল কি না কে জানে!

ভেবেছিলাম যে কোনো স্রোতের মধ্যেই এইভাবে নির্বিকার
ভাবলেশহীন যাবো আলাভোলা বাতাসের মতো, যে-রকম
জন্মগ্রহণেরও আগে, অনেক আগেই আমি মায়ের জঙ্ঘার
খুব গোপন জানালা দিয়ে দেখেছিলাম রৌদ্রের বিভ্রম…
(কিন্তু)

আজাদীয় প্রতিমাছকে পঙক্তিগুলো মনে হয় বাহবা কুড়াত। ‘মায়ের জঙ্ঘার খুব গোপন জানালা দিয়ে’ দেখা ‘রৌদ্রের বিভ্রম’ দ্ব্যর্থক মনোবীজের উপমা,— অস্তিত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষকে সে প্রশ্ন উঠাতে বাধ্য করে। সাহিত্যিক ও দার্শনিক মতবাদ ধার করে একে ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়, যদিও শামীম কবীরের কবিতা পাঠের সময় এইসব বকবকানি অপ্রয়োজনীয় ও নিরর্থক মনে হতে থাকে। স্বল্পায়ু কবিতাযাপন আর প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে সুহৃদরা কমবেশি লিখলেও বড়ো সত্যটি সেখানে গৌণ থেকে গিয়েছিল,— তাঁর কবিতায় গুঞ্জনরত ‘ব্যক্তি আমি’ দশকি প্রথায় আটকে থাকার পরিবর্তে সময়-পরিপার্শ্ব থেকে ব্যক্তিসত্তার বিলোপ ঘটানোর মিশনকে বীজমন্ত্র করে নিয়েছিল। নব্বইয়ের কালপর্বে কবিতা লিখছিলেন,— এই তথ্যের বাইরে দশককে তাঁর আলাদা করে দেওয়ার কিছু ছিল না। সত্তার অস্তিত্ব যাপনের উদ্দেশ্য সন্ধানে নিমগ্ন ভাষার কোনো দেশ, দশক ও মতবাদ থাকে না। শামীমের কবিতা সেই ধারায় জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরছিল।

মিথ্যে আশাবাদ, মেকি নৈরাশ্য, বানোয়াট মরমি অনুভূতির প্রবাহে শামিল হয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় যেসব কবিতা খুব শব্দ করে তার কোনোটি কবিকে নাগালে পায়নি। সময়বৃত্তে জাগিয়ে রেখেও সময় তাঁকে সেখান থেকে ছেঁটে ফেলেছিল। আবুল হাসান জাঁক করে মায়ের জরায়ু ছিঁড়ে ধরায় আগমনকে গাল পেড়েছিলেন। শামীম কবীর এতে প্রভাবিত হলেও তাঁর উচ্চারণভঙ্গি সেখানে পৃথক পথে মোড় নিয়েছিল। ওই বয়সে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন জন্ম ও মরণের মধ্যবর্তী পরিসরে ঝুলে থাকা জীবনের পক্ষে ‘আমি কে বা কেমন এই দিন যাপন’ ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া আকাশে গুলতি ছোঁড়ার শামিল! পাথর ওপরে ওঠে এবং প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মাটিতে গড়ায়। নিজের সময়বৃত্ত বা এর চারপাশকে প্রত্যাখ্যানের নেশা কবির ভাষাঅঙ্গে তাই প্রবল হয়ে ওঠেনি, এবং না ছিল একে গ্রহণীয় ভাবার জিগীষা! যুগ-যুগান্তর ধরে এরকম কবি জন্মগ্রহণ করে চলেছে যারা মানবসংঘে নিগমবদ্ধ থাকলেও সেখানে যাপনের যৌক্তিকতাকে বৈধতা দানে অপারগ হয়ে পড়ে। সময়বৃত্তে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না বুঝে সে কিন্তু উদ্বিগ্ন হয় না, বরং জগৎ জুড়ে সচল অস্তিত্বের প্রতি মমতা রক্তে স্পন্দিত অস্থিরতাকে কেন প্রশমিত করতে পারছে না এই ভাবনাটি তাকে উদ্বিগ্ন রাখে। এরকম বোধে শামিল হওয়ার কারণে দ্বিরাভাস কবির পিছু ছাড়ে না :—

একটি নোম্যানসল্যান্ডের পথ বেয়ে বসে আছি
অন্য এক দোল খাওয়া মাঠে
মাঠের উত্তরে আছে উঁচু এক বিম্বনাশী টিলা
সে টিলার খাঁজে ভাঁজে ফুটে থাকে দোদুল ফুলেরা…
(একটি নোম্যানসল্যান্ডের স্বপ্ন)

বয়স্ক হওয়ার দিন থেকে এই দ্বিরাভাস যাকে দখলে নিয়েছে সেই লোকের পক্ষে ঘরামির মাঝে স্থির থাকা কঠিন। আত্মমৈথুনে নিজেকে ফকির করা তার জন্য নিয়তিনির্ধারিত :—

আর আমি সেই নোম্যানসল্যান্ডেতে শুয়ে ব’সে
হস্তমৈথুনের জন্য ঝোপঝাড় তৈরি ক’রে নেবো
আর আজ আমি উষ্ণ উজ্জ্বল কাঠের জুতোয় ঢুকে
মজা লুটি সাত-রশ্মি দিবস রজনী জন্ম-উদ্বাস্তু।
(একটি নোম্যানসল্যান্ডের স্বপ্ন)

শামীম কবীরের ক্লেশের সঙ্গে লোকে যাকে ব্যক্তিবৈরাগ্য নামে দাগায় তার পার্থক্য রয়েছে। এহেন বৈরাগ্যের শিকার ব্যক্তি পরিপার্শ্বের সঙ্গে ঘাপলা পাকায় আর নিস্ফল আক্রোশ ও শিখরস্পর্শী নিঃসঙ্গতায় নিজেকে নিঃস্ব করে যায়। শামীম কবীরের কবিতায় এমতো বৈরাগ্য সুলভ নয়। তাঁর অন্তর্দহন আবুল হাসান বা শহীদ কাদরীর পন্থায় সামাজিক বীতরাগ ও বৈরাগ্যের বাতিকে নিজেকে ঘনবদ্ধ করেনি। হুমায়ুন আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ এমনকি খোন্দকার আশরাফ হোসেনে প্রকট ব্যক্তি আমির মহার্ঘতা বিঘোষণার ধরনটি সেখানে একপ্রকার অনুপস্থিত বলতে হয়। ইয়ার্কিঘন পরিহাসে ‘ব্যক্তি আমি’ ও ব্যক্তিসমগ্রর ভবিতব্যকে হাস্যকর করে তোলার প্রবণতায় পটু নিকট-অগ্রজ গোমেজ বা মাসুদ খানের ভাষাঅঙ্গও কবির কবিতায় জায়গা করে নিতে পারেনি। এই কবির সমস্যা সে নিজে! অহংসত্তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর দিন থেকে একে মোকাবিলার উপায় সন্ধানে নেমে কবি আর পথ খুঁজে পায়নি :—

অনেক লালার স্বাদ লেপ্টে আছে কমনীয় ত্বকে
নখের চিহ্নের আঁচে উপত্যকা ঘুরে উঠে আসা
একটি অচল মোহ ডিঙিয়ে কাতর সেই ত্বক
সমস্ত সাধের বিনিময়ে শুধু প্রাণ ভিক্ষা করে
সমস্ত সাধ্যের বিনিময়ে আজ প্রাণ ভিক্ষা করে

সম্ভবত নৃশংসতা কেটে গ্যাছে মহুয়া প্রভাবে
আঠালো বলয় এসে এঁটে বসে রাতজাগা ঘাড়ে
এখন সমস্ত বেদনা চুকে গেলে বড়ো ভালো হয়
এখন গভীর আর অতীত লেহন করা চকিত ভুলের
ক্ষমার অযোগ্য কথা ব্যথাতুর থাবাতে মিলায়

জানি না কী ভুল থেকে শুরু হয় এই ঘুমঘোর
আস্তে আস্তে সিংহপনা মিশে যায় অচেনা আভায়…
(সিংহঋতু)

নব্বইয়ের কালসীমায় ক্রমব্যক্ত কবিতার উপকরণ শামীম কবীরের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়নি যার তালাশে অন্য কবিরা তখন পাতালে নামছিলেন। পোর্তুগিজ কবি ফার্নান্দো পেসোয়ার ছায়ায় তাঁকে হয়তো দুদণ্ড ভাবা যায়। জীবনে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় থাকার ঘটনা ভিনদেশি কবির কাছে সমান অর্থবহ ও নিরর্থক ছিল! To love myself is to feel sorry for myself.—‘অশান্ত কিতাব’ (The Book of Disquiet)-এ পেসোয়ার অহং থেকে নিষ্ক্রমণ লাভের কসরত সম্পর্কে নব্বইয়ের শামীম কবীর অবগত ছিলেন কি-না জানা নেই, তথাপি পেসোয়ার জীবনবোধে অতিরঞ্জিত আত্মসচেতনা যে-মহার্ঘতা লাভ করেছিল তার ক্ষীণ আভা যেন নব্বইয়ের অনতি-তরুণ কবির মুখাবয়বে খেলা করে বেড়ায়। স্থানবাস্তবতায় দাঁড়ানোর মাটি পেসোয়া খুঁজে পায়নি এবং শামীমও তা-ই! পেসোয়া অবশ্য কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে বোনা বিশ্বে ডুব দিয়ে বাস্তবতার একঘেয়ে ছক থেকে নিজের মুক্তি খুঁজে নিয়েছিল। রূঢ় বাস্তবতায় সচল পরিপার্শ্বে ব্যক্তির গমনাগমনকে স্বপ্নগ্রস্ত কাল্পনিকতায় বিলোপ করার খেলা শেষ নিঃশ্বাস অবধি সে ধরে রেখেছিল। ক্রুড রিয়েলিটি নয় বরং ব্যক্তির অহংসত্তায় সক্রিয় প্রতিভার জোয়ারে বাস্তবতাকে ফিকশনের আদলে নির্মাণ ও সেখানে সত্তার অনুপ্রবেশ ঘটানোর ভাবনা পেসোয়াকে জীবনভর তাড়া করে বেড়িয়েছে :—

লোকজনের সঙ্গে বাতচিত করতে গেলে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়ব। ভুতুড়ে আর কাল্পনিক বন্ধুগণ, কেবল স্বপ্নেই তাদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়, ওরা হচ্ছে বাস্তব ও সারগর্ভ,— মুকুরে প্রতিবিম্বিত ছবির মতো তাদের ধীশক্তি যেন কিরণ বিলায়।

মহান উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সীমাহীন স্বপ্ন আমারও ছিল, যেমনটি ঘরে মালামাল সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ছেলেটি অথবা দর্জি মেয়েটির থাকে, কেননা সকলেই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নগুলো পূরণে কিছু লোকের সামর্থ্য আমাদের মাঝে প্রভেদ ঘটায়, অথবা এটি হয়তো নিয়তি যে এগুলো পূরণ হবে। মালামাল সরবরাহে নিয়োজিত ছেলেটি আর দর্জি মেয়েটির সঙ্গে স্বপ্নে আমি অভিন্ন হয়ে উঠি। কেমন করে লিখতে হয় সে আমি জানি আর সেখানে তাদের সঙ্গে আমার একমাত্র যা তফাত। হ্যাঁ, লেখালেখি হচ্ছে ক্রিয়া,—ব্যক্তিগত এক পরিপার্শ্ব, যেটি ওদের থেকে আমায় পৃথক রাখে। তবে আত্মায় আমি তাদের সমান।
(ডোলোরাস ইন্টারলুড ও ল্যাটিনি; দ্য বুক অব ডিসকোয়েট; ভাষান্তর : লেখককৃকত)

অতিরঞ্জিত আত্মসচেতনার ফাঁদবন্দি বঙ্গদেশের শামীম কবীরের অহংবৃত্ত স্বাপ্নিক সংযোগে পুড়ে খাঁটি হওয়ার আগে স্বেচ্ছাপ্রস্থানের গান শুনে ফেলায় তাঁর কাব্যযাত্রা পেসোয়ার ন্যায় পরিপূর্ণতা পায়নি। নিজের সম্পর্কে যখন তুমি কৌতূহলী হয়ে উঠবে তখন নিজেকে খুন করার উপায় থেকে কী করে বাঁচবে সেটি ভেবে রেখো;—এই বোধে শান দেওয়ার অবকাশ চব্বিশ বছর বয়সে নিরুদ্দেশের খাতায় নাম লেখানো কবির কপালে জোটেনি। পরিণতির চূড়ায় আরোহণের আগে সময় তাঁকে নিরাশ হতে বাধ্য করেছিল, ‘এই ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে / …ভীষণ অস্থির / হাতে সে ক্যাবল বিষণ্ণ খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির। / কবির আঙুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ / অন্ধকারে পড়ে থাকে সে-ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে / ঢেকে অস্তিত্বের ক্ষত।…’ (দ্রষ্টব্য : এই ঘরে একজন কবি)। রক্তমাখা গালিচায় নিজের অন্ত দেখে ফেলার পেসিমিজম যাকে কব্জা করে সে তখন নৈরাশ্যকে অমোঘ বলে আঁকড়ে ধরতে চায়। শামীম কবীরের পেসিমিজমে অবশ্য বিবমিষা ও প্রত্যাখ্যানের মনোবিশ্ব আধিক্য লাভের পথ পায়নি, উল্টো নিজের সত্তাযাপনকে ‘কসমিক সিকনেস’ (cosmic sickness) নামে দাগানোর ঠাট্টা ও উসকানি সেখানে চোখে পড়ে :—

কয়েকশো হাজার আর আরও একটি
করাতের মধ্যে শুয়ে
ঠ্যাং তুলে কে আবার গান গায়…
(মালিনীকে জল তুলে দিতে হলে বাগানেই রাত্রপাত হবে)

কী এক ভাষার লোভে বেঁচে থাকি
কী এক প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা
যা কিছু সকল শংকা যা কিছু স্বচ্ছল
জীবনের কে কোথায় ঊষর মলের ভাণ্ড ত্যাগ করে
উদরে পুরেছে কালো গোলগাল অপেক্ষার বীজ…
(ভোরবেলার স্বপ্ন নিয়ে ভাসা)

করাতের নিচে মুণ্ডু সঁপে দিয়ে গান গাওয়ার নির্বিকার রঙ্গ কবিকে ইশতেহারধাঁচে নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য বিলি করার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়! ওপার বাংলায় হাংরি আন্দোলন থেকে উঠে আসা কবিদের মধ্যে এই প্রবণতা একদা প্রকট আকারে মুখ ব্যাদান করেছিল। ফালগুনী রায়-র ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’ হয়তো নগ্ন সত্যের উন্মোচন কিন্তু ইশতেহারধর্মী বিবৃতির ছলে ব্যক্তি আমির নিজেকে মহার্ঘ করে তোলার সিউডো-পেসিমিজম বা ছদ্ম-নৈরাশ্য কেমন যেন উৎকট লাগে কানে! শামীমের নৈরাশ্য সেদিক থেকে কবিআত্মার অতল থেকে উঠে আসে। যে-কারণে তাঁর বলতে বাঁধেনি,—‘তবে আমি যা কল্পনা করি / নষ্ট হলে পুনরায় সারাবার সহজাভ / পথ থাকা চাই…’ (দ্রষ্টব্য : অস্থায়ী; দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান)। পরিপার্শ্ব থেকে এটি পাওয়া নয় বরং মানবঅস্তিত্বের পাতাল থেকে সহজাত ছন্দে উঠে আসা সুর তাঁর সত্তাকে দখলে রাখে। ‘আমি কে?’ —এই জিজ্ঞাসার মধ্যে নাম-বিড়ম্বনা ও স্ববিরোধী যত ব্যাধিঘোর জন্ম নেয় শামীম কবীর সেই অসুখের নাম। পরিপার্শ্ব নয় বরং আত্মিক স্বাতন্ত্র্য অর্জনের ক্ষুধাকে কেন্দ্র করে কবির উৎকণ্ঠা পাঠকের পদতলে লুটায় :—

খুব ক্রুর মুখোশের মতো মনে হয় এই নাম। অতিকায়
রূপালী তিমির মতো—আমার মর্মমূলে এই খুব নিবিড়
আপন নাম নিদ্রিত রেখেছে এক বিশুদ্ধ আগুন (তন্দ্রায়
নিভে গ্যাছে তার সব তুখোড় মহিমা) এই প্রিয় সশরীর
নাম এক দাঁতাল মাছির মতো অস্তিত্বের রৌদ্র কুঁরে খায়
রাত্রিদিন; আষ্টেপৃষ্ঠে কাঁটাতার হোয়ে আছে—শামীম কবীর
এই তুচ্ছতর নাম : গোপনে, ত্বকের নিচে খুব নিরুপায়
এক আহত শিকারীর নামের মোহন ফাঁসে জড়ায় তিমির।
(শামীম কবীর)

‘খুব’ ও ‘নিরুপায়’ শব্দ দুটিকে শামীম এমন করে একত্রে গেঁথেছেন যারা আপনা থেকে এই বার্তাটি জানিয়ে দিতে ব্যগ্র,—গাঢ়ভাবে চাইলেও তার পক্ষে পরিপার্শ্বের রস টানা সম্ভব নয়, কারণ দিকচক্রবাল জুড়ে সক্রিয় ব্যক্তি আমির অস্তিত্বে যতি টানার সময় ঘনিয়েছে! শামীম কবীরের জন্য অনিবার্য ছিল এই উচ্চারণ :—‘কাঁদে বালিহাঁস / কাঁদে উঁচু চিল / কাঁদে মধ্যবর্তিনীরা আর সবুজ ফাঙ্গাস / আমি জানি না আমি কী খুঁজি’ (দ্রষ্টব্য : দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান)। নিজের ‘নির্ণয় ন জানি’ কবিকে দশকি-ছকে ফেলে আলোচনা করা তাই দুরূহ। অহঙের নিরাময় ঘটাতে ব্যর্থ যত কবিজন সময়-পরিপার্শ্ব থেকে নিজেকে পৃথক করেছেন শামীম কবীরের স্বেচ্ছাযাত্রা সেখানে শামিল হওয়ার কারণে দশকবৃত্তের বাইরে বসে তাঁকে পাঠ যাওয়া উত্তম সুবিচার মনে হয়।


শামীম কবীর সংক্ষিপ্ত : কবিতার সংকলন
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: