বহু আনন্দধ্বনি চারপাশে
আমি আজ উঠে যাব
আমাকে উত্থান দাও
— উপরের কথাগুলো বলেছিলেন শামীম কবীর, ১৯৭১-১৯৯৫, কোনো-এক কবিতার মাঝখানে। এরপর একসময় সত্যি তিনি উঠে গেলেন, উত্থান ঘটালেন, জগতের এই নৃশংসমধুর আনন্দযজ্ঞ হইতে নিজেই নিজেরে উইথড্র করে নিলেন। অবশ্য অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব, উপস্থিতি-অনুপস্থিতি, থাকা আর না-থাকা নিয়া বাহাসে না-যেয়ে শামীম কবীরের কবিতায় এই মৃত্যুমধু, স্যুইসাইডচিন্তা, হাজির দেখব পঙক্তির পর পঙক্তিতে। একেবারে গোড়ার দিককার কবিতা থেকে শেষ নোট অব্দি, শামীম কবীর, নিশ্চয় আমরা লক্ষ করি মৃত্যুমুখরিত। মোচ্ছবে থাকতে না-চাওয়ার অভিপ্রায় তিনি সৃজনকালীন সর্বত্র প্রকাশ করে গেছেন। ভুবনের মোচ্ছবে মেতে থেকে আমরাও কদাচ ক্লান্ত হই। তখন কবিতা পড়ি শামীম কবীরের। পরক্ষণে ফের মেতে উঠি মোচ্ছবে মাতোয়ালা রাইতের সনে, বেহুঁশ বৈশাখে বিবস্ত্র করি বিধুমুখী বিপত্তারিনীরে, শাড়ি ধরে মারি টান এ-জনমে রাধিকার আমি বেপথু বনমালী।
নিবন্ধের গোড়াতেই বলে রাখি যে এই নিবন্ধের শেষে শামীম কবীরের গোটা-বাইশ কবিতা টাইপ করে রেখে দেয়া হলো। নোট দেখে ভাই করিসনে ভয়, নিম্নে তাহার কবিতা আছে। কাজেই স্কিপ করে শেষাংশে যেয়ে কবিতাগুলো পড়ে নিন। কবিতাগুলো চয়িত হয়েছে ‘দ্রষ্টব্য’ প্রকাশিত ‘শামীম কবীর সমগ্র’ থেকে। শামীম কবীর সমগ্র থেকে শামীম কবীর সংক্ষিপ্ত। অ্যাব্রিজড্ শামীম কবীর। গোটা অ্যান্থোলোজিটা যারা দেখতে চান, তাদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে যে এই বইটা আজকাল আউট-অফ ছাপা। কাজেই অ্যাব্রিজড্ ভার্শন থেকে একটু চোখ বুলিয়ে আন্দাজ নেয়া যায়। কিন্তু এমন নয় যে এইগুলোই শামীমের প্রতিনিধিতাকারী কবিতা, স্বীকার করি যে এগুলোরও অ্যাপিল কম নয়। এই বাইশটা কবিতা বাছা হয়েছে একান্ত নোটকারের পছন্দ ও সুবিধানুসারে। টাইপের সুবিধা। শামীমের বেশিরভাগ কবিতাই ক্ষীণপ্রস্থ পঙক্তির হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা। টাইপ করার বিশেষ স্কিল ও কনভিনিয়েন্স দরকার। তাছাড়া এই কবিতাগুলো অত প্রচারিতও নয় বিধায় এগুলো জনসমক্ষে নিয়া আসার একটা চেষ্টাও করা যাচ্ছে এতদসঙ্গে।
‘শামীম কবীর সমগ্র’ বইটা বার হয়েছিল বগুড়ার ‘দ্রষ্টব্য’ ছোটকাগজের উদ্যোগে। ওই পত্রিকায় — ‘দ্রষ্টব্য’ নামক মোটামুটি মোটাসোটা ছোটকাগজটায় — শামীমের ‘নভেরা’ ইত্যাদি কবিতা আমরা আগে থেকেই পড়েছি, বই বেরোনোর আগে। বইটা ছাপাখানা থেকে পাঠকহাতে এসেছে ১৯৯৭ সাল নাগাদ। তদ্দিনে শামীম কবীর বিষয়ক প্রচুর মিথ ডালপালা ছড়িয়েছে। তার প্রেম, আচ্ছন্নতা, নেশা ও নৈঃশব্দ্য-নৈঃসঙ্গ্য তথা অ্যালিয়েনেশন প্রভৃতি নিয়া। আমরা জেলাশহরগুলোতে ছোটকাগজের খোঁজতালাশ করে বেড়াতাম সে-যুগে এবং ছোটকাগজস্রোত আজকের ন্যায় এত ক্ষীণ হয় নাই তখনও। ১৯৯৭ সালে শামীমসমগ্র বের হয় যখন, আমরা তখনও চাকরিবাকরি পাবো ভবিষ্যতের বছর-পাঁচ পরে এমন একটা বেহাল অবস্থায় দাঁড়ায়ে। বইটার গাত্রমূল্য তখনকার একশকুড়ি বাংলাদেশি মুদ্রা। আজ থেকে বছর কুড়ি/পঁচিশ আগের একশকুড়ি মানে কত টাকা, তা আমার ন্যায় বর্তমানে বার্ধক্যবাতিল ও তৎকালে টিউশনিজীর্ণ লোকজন স্মরণ করে উঠতে পারবেন নিশ্চয়। অ্যানিওয়ে। বইটা ওই-সময় খরিদ করতে ব্যর্থ হই। বছর-পাঁচ বাদে যখন সংগতি অর্জন করে উঠি ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটা মেলাবার, তখন বইটা আর খুঁজে পাই না আমাদের শহরের সবচেয়ে বেদরদ দাম-রাখা বইব্যবসায়ীর দোকানে। শরণ নেই বগুড়া-আবাসী এক বন্ধুর। তিনি কথা দিয়া কথা রাখেন নাই। কিন্তু কথা দিয়া কথা রাখাটাখা তার কাজের মধ্যেও পড়ে না বটে, কেননা তিনি কবি, হ্যাঁ, তিনিও কবি। দিয়াছেন বই, কিন্তু আমারে না, দিয়াছেন অন্য লোকেরে। তারে অভিশাপ দেই নাই, অগত্যা তার নিজের কালেকশন থেকে বইখানা সাধ্যিসাধনায় চেয়ে এনে দুই-নজর বুলায়ে দিন-কয়েক শিথানে রেখে ঘুমিয়ে শেষে ফেরায়েও দেই মালিকেরে। এর আরও বছর-পাঁচ গেলে পরে এক দরাজদিলা বান্ধব বইটা তার নিজের বক্ষশেল্ফ থেকে এই নিবন্ধকারের হস্তে তুলে দিয়ে বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকে আরও-একটা সম্প্রদান কারকের নজির স্থাপন করেন। এই হলো আমার ‘শামীম কবীর সমগ্র’ বইয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী।
বইটা নানা কারণেই রিপ্রিন্ট হয়ে বেরোনোর দাবি রাখে। এক হচ্ছে এর পাঠকডিম্যান্ড, দুই এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এ-ই যে বইটার প্রয়োজনীয় প্রচুর সংস্কার দরকার। বানানসাম্য ও কবিজীবনতথ্য তো খুবই জরুর। বানানের কারণে ব্যক্তিগতভাবে এই নিবন্ধকারের প্রচুর অস্বস্তি হয় বইটা পড়তে যেয়ে। একটা ব্যাপার হচ্ছে যে, কবির অভিপ্রায়। এ-রকম বানানেই সম্পাদনা করা হয়তো কবির অভিপ্রেত ছিল। সেক্ষেত্রে আরেক ডিবেইট ওঠে। আমরা উদাহরণ না-দিয়ে এক-দুইটা কথা ঝটিতি বলে ফেলি। এই বইটা কার হাতে সম্পাদিত হয়েছে, কে এর বানান ইত্যাদি এবং ম্যানাস্ক্রিপ্ট দেখে প্রুফ সংশোধন করেছেন, কে বা কারা এর সম্পাদনাপর্ষদসংশ্লিষ্ট ইত্যাদি কিচ্ছুটির কোনো হদিস বইটিতে নেই। কেবল ‘দ্রষ্টব্য’ প্রকাশ করেছে, এইটুকু তথ্য আমরা আন্দাজ করে নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটলম্যাগ হিশেবে তৎকালে মশহুর ‘দ্রষ্টব্য’ ব্যক্তিবিরোধী হয়ে এইটা এডিটিংকাজে হাত দিয়েছিলেন কি না, তা দিতেই পারেন, কোনো বক্তব্য আমরা পাই না। ব্যক্তিনাম না-দিয়ে এডিটিং খুবই, কি বলব, ইম্যাচিউর ব্যাপার। রেস্পোন্সিবিলিটি নিতে কেউ চান নাই হয়তো। ভবিষ্যতের রিডার কোথায় কোন লিঙ্ক ধরে একটু খোঁজ নিতে যাবে যে শামীমের ম্যানাস্ক্রিপ্টে কেমন বানান ছিল, যদি হবহু তা-ই ছাপানো হয় বইতে সেক্ষেত্রে দেখতে হবে ম্যানাস্ক্রিপ্টের সুরতহাল-ময়নাতদন্তপূর্বক যে ওই বিশেষ ধাঁচের বানান কবির সচেতন প্রয়োগপ্রয়াস কি না। এইসব আপনি কোথা যেয়ে কারে জিগাইবেন? দ্য অ্যান্সার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড?
বইটিতে একটি ভীষণ মর্মদ্রাবী প্রিফেস লিখেছেন শামীমের সতীর্থ মজনু শাহ। উনিও কবি হিশেবে রেগ্যুলার কবিতাপাঠকের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছেন পরবর্তীকালে। অ্যানিওয়ে। একদম অন্তিমে একটা সংক্ষিপ্ত কবিপরিচিতি দিয়ে দেয়া হয়েছে, এই বইটায়, যেখান থেকে এটুকু জানা যায় যে শামীম জন্মেছেন বগুড়া জেলায়, বিড়ালাক্ষ ও গৌরবর্ণ। প্রতিষ্ঠানগত পুঁথিবিদ্যায় অনাগ্রহবশত পড়াশোনা অসমাপিত বা অর্ধসমাপিত মর্মে একটা ইনফো আমরা এই পরিচিতিচিলতে থেকে জেনে উঠি। ইন্ট্রো অংশে যে-ভূমিকাটি লিখেছেন মজনু শাহ, সেখানে বেশ মর্মাচ্ছন্ন স্বরে শামীমকে এঁকেছেন তিনি। কবির কাজকর্মের বেশকিছু চাবিশব্দবন্ধ নিয়া কাব্যগদ্যান্বিত ভূমিকাংশটুকু মূল্যবান ইন্টার্প্রিটেশন উপহার দেয় আমাদিগেরে। যেইটা হয় আর-কি যে কাব্য নিয়া কথা বলতে যেয়ে জরুরি জ্ঞাতব্য জানানো হয় না। আমরা এই সমগ্রে যে-আলাদা নামের আওতায় পাণ্ডুলিপিগুলো ছাপা হতে দেখি, সেগুলো শামীম কবীর জীবদ্দশায় ছেপেছিলেন কি না ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর সহসা অন্তত বইটির ভিতর থেকে জানতে পাই না। এইগুলো জানতে ইচ্ছেও করে কখনো কখনো।
একসময় আমরাও চন্দ্রগ্রস্ত হয়ে পড়ি কেউ কেউ, অনেকেই, ধস্ত হতে থাকি জীবিকাদানবের হাতে কেউ-বা। শামীমপাঠ মুলতুবি রাখতে হয় অনেকদিন। শুধু ১৯ এপ্রিল এলে, বা কোনো কোনো সোমবারে, এমনকি ঋতুপর্ণ ঘোষনির্মিত ‘ঊনিশে এপ্রিল’ দেখতে বসে, আমাদের মনে পড়ে শামীম কবীরের মুখ। আমরা বলাবলি করি, শামীমকে নিয়ে গেছে চন্দ্রড্রাগনেরা। এই ‘চান্দ্র ড্রাগন’ কয়েনেজ অবশ্য অকালে-প্রয়াত তথা আত্মহন্তা কবি শামীম কবীরেরই। ‘তোমাকে যে কথা বলা হবে / তার সব নিয়ে গ্যাছে চান্দ্র ড্রাগনেরা’ — শামীম কবিতা স্টার্ট করেছেন এই জোড়পঙক্তি দিয়ে। কবিতার নাম ‘১৯ এপ্রিল’, কবির জন্মদিন এইটে; এই জন্মতারিখ নিয়ে একাধিক লিখেছেন তিনি কবিতা, আর সোমবার, কবি যেন অবসেসড ছিলেন নিজের জন্মবারটি নিয়েও; কবির জন্মবার সোম। কবিতাটা দীর্ঘ; সূচনা লাইনদ্বয়ের পরবর্তী তিনলাইনের স্ট্যাঞ্জা : ‘চান্দ্র ড্রাগনেরা ভালো ভদ্র সদাচারী / কেবল তোমার জন্য কথা আনতে গিয়ে / ড্রাগনের শ্বাসে পুড়ে শক্ত হলো ঘাড়’ — এরপর অনেক স্তবক পেরিয়ে এইমতো : ‘ঊনিশে এপ্রিল ছিল সোমবার — বেলা সাড়ে দশ / অতি একটি সাধারণ জন্ম হলো’ … ইত্যাদি পঙক্তির পাবে দেখা। চান্দ্র ড্রাগন, অতএব, শামীম কবীরের ইহাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। তা সেইটা যারই হোক, কাজে লাগা আর কাজে লাগানো নিয়া কথা, কাজে লাগলেই হলো। অ্যাক্নোলেজ করলে কি আর না-করলেই কি, কিচ্ছু বোঝাবুঝির বেইল নাই লোকের। খুঁটিয়ে-পড়া হার্মাদ পাঠকের সংখ্যা আশাব্যঞ্জকভাবে কমছে। ভাগ্যিস! নইলে আমার মতো লোকের এদ্দিনে কট-অ্যান্ড-বোল্ড হয়ে বারোটা বাজিয়া যাইত। তো, বলছিলাম, শামীম কবীরের প্রসঙ্গ উঠলেই মনে পড়ে আরেকজনের কথা, কবি তিনি, অনন্য রায়। নিজেকে অবশ্য কবি হিশেবে ভাবতেন না তিনি, নিজের ব্যাপারে তার স্বঘোষণাটা দারুণ কৌতূহলোর্দ্রেকী : ‘শাস্ত্রবিরোধী চিত্রবর্ণগন্ধময় প্রবন্ধকার’ মনে করতেন তিনি নিজেকে। ডেভিলিশ এলিম্যান্টস্ এস্তেমাল করে বাংলা কবিতাকে এই দুইজনেই ভিন্নদ্যোতনায় কীর্তিত করেছেন; ব্যোদলেয়্যরের দোজখসঞ্জাত ক্লেদ-ক্লিন্নতার বাইরে যেয়ে এদের কবিতা আলাদা আওয়াজে গেঁথে আছে ধরিত্রীগ্রন্থের টাইমলাইনে। এরা টাইম পেয়েছেন অতীব অল্প, শরীরী আয়ুর দিক থেকে, করে গেছেন অভাবিত অনেক তবুও। ‘প্রথিতযশা প্রৌঢ় হওয়ার চেয়ে অপমানিত বালক হওয়াই শ্রেয়’ মনে করেছিলেন যিনি, যাঁর কাছে ‘প্রজ্ঞা আর-কিছুই নয়, দৃশ্য এবং দ্রষ্টার মধ্যে একটি হাইফেন’ — অনন্য রায় রেখে গেছেন ‘আলোর অপেরা’, ‘দৃষ্টি অনুভূতি ইত্যাকার প্রবাহ’ প্রভৃতি নিঃশ্বাসকল্পগুলো।
বলেছি আগেও, বলি আবারও যে এখানে কেবল কবির স্বল্পদৈর্ঘ্য কবিতাগুলোই গৃহীত হলো। স্বল্পদৈর্ঘ্য বলতে যে-কবিতাগুলো শরীরসংস্থানের দিক থেকে বেঁটেখাটো। ছোট কলেবরের কবিতা আর্থস্তরে বা ব্যঞ্জনাবিচারে ব্যপ্তিবিস্তৃত হতে পারে, নিশ্চয়, সেই বিবেচনায় যাবেন পাঠকেরা যার যার মতো করে। এখানে আমরা শামীম কবীরের ছোট ছোট কবিতাগুলোই পড়ব। তবে সমগ্রধৃত সমস্ত ছোটকলেবর কবিতাই যে নেয়া হয়েছে তা নয়। এমন আরও ছোট ছোট আকারের কবিতা শামীমসমগ্রে লভ্য। নমুনা আকারে একটা লাম্-সাম্ নির্বাচন করেছি শুধু, খুব-একটা পাল্লা-বাটখারার ব্যবহার আমরা কাব্যচয়নের ক্ষেত্রে করতে পারি নাই নিজের পঠনপাঠনগত অদক্ষতার কারণে। এলোমেলো পড়ার চেয়ে এ-রকম নানামুখী নির্বাচিতা কাব্যসমুজদারদের কাছে এবং বিশেষভাবেই কবিতার বা শামীম কবীরের নয়া পাঠকগোষ্ঠীর কাছে ল্যুক্রেটিভ মনে হতে পারে আন্দাজ করেছি।
কিংবা শামীম কবীরের কবিতার টেক্নিক, ডিকশন, পরীক্ষানিরীক্ষা, স্টাইল, ভোক্যাব্যুল্যারি নিয়া ফার্দার কোনো মুল্যাঙ্কনও করতে চাইছি না আমরা আপাতত সংকলন পড়বার সময়। কেবল কবিতাগুলোই রিসাইট করতে চাইছি নিবিড় উচ্চারণে। কেবল ছোট ছোট কবিতা কতিপয় শামীম কবীরের। অত্যন্ত অকালেই নিজের শরীরী জীবন নিভিয়ে দেয়া শামীম তার সতীর্থ কবিবন্ধুদের অনেকের কাছেই ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার আত্মহত্যাকাণ্ডের আগে-পরে, এই চিত্রটা আমরা চাক্ষুষ করেছি বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের লিটলম্যাগকেন্দ্রী বাংলাদেশের কবিতায়।
বেঁচে থাকলে এই দ্বিসহস্রকুড়ি খ্রিস্টাব্দে এসে কবির বয়স পঞ্চাশ ছুঁতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের বছরে জন্ম, পঁচানব্বইয়ে প্রস্থান, চব্বিশ বছরের উপান্তেই বিদায়। কী আর এমন হতো, সহসা ভাবি, পঞ্চাশ পূর্ণ করতে পারলে? দেখতেই তো পাচ্ছি ফিফটি-হাঁকানো কবির সমবয়সীদেরে, এমন কোনো ঘোড়ার আন্ডা ঠাহর তো হয় না। কাজেই, উনিশে এপ্রিল শামীম কবীরের জন্মদিনে কেবল কিছু ছোট ছোট কবিতাই পড়ব তার। সেই হিসাব অনুসারে এইটা শামীম কবীরের জন্মদিন উদযাপন বলা যায়। শামীম কবীর বার্থডে রিকল্।
পড়ি ‘শামীম কবীর সংক্ষিপ্ত’।
শামীম কবীর সংক্ষিপ্ত : কবিতার সংকলন ।। কবিতাবাছা, টাইপ ও ভূমিকা / জাহেদ আহমদ
জাল
একদিন জাল ফেলতে যাব
জাল ফেলার খুব আনন্দ
জাল ফেলা বিষয়ে আমার পরিচিত এক জেলে আছে
সে বলে জাল তুলে কতকিছুই তো ধরা পড়তে
দ্যাখা যায় কিন্তু জালের আসল কাজ হলো মাছ ধরা
আমি মাছ খাই না
একদিন জাল ফেলতে যাব
অবশ্য আমার মাছ না-উঠলেও চলবে
আমার ঘর
এখন সময় হলো
আমার লাল ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার
আমি দু-পায়ের হাড় বাজিয়ে ফিরব
আমার ঘরে
না কোনো ফুলের ঝাড়
কেবল মৃত্যু
আমার ঘরে কী সুন্দর সাজানো
বালু
একপা আগাই আর দুপা পিছাই
দৌড় অসম্ভব নয় তবে
বহু পরিশ্রান্ত হব
গভীর বিস্তৃতির সীমানা ছাড়ানো
সমুদ্র পায়ের নিচে রেখে
আমি যাচ্ছি তোমার দিকেই
আমি যাচ্ছি বালুপায়ে বালিকার দেশে
ধাঁধা
ডাকঘরে পোস্টকার্ডবিক্রেতা
যে কোনোদিন পোস্টকার্ড কেনেনি
সে জবাবগুলি জানত
কিন্তু লাখ লাখ পোস্টকার্ডে লেখা
ভুল বহু উত্তরের ভারে ভরে গেল
ধাঁধানিক্ষেপকের পকেট
তা সে জানত না
কারণ সে টিভি দ্যাখে নাই
ও চাঁদ
যে চাঁদ মাস্তুলে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গ্যালো
যে চাঁদ সাগরে টুকরো টুকরো হয়ে
. ঝরে পড়ল
যে চাঁদ সমুদ্রের নিচে শুয়ে আছে
. খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে
সে-চাঁদ তুমি নও
তুমি তার প্রেতাত্মা
বুক
মায়ের কষ্টের কথা
শালিক ও বাবুইয়ের মৃদু হট্টরোলময় দিবাবসানের
অত্যন্ত আগেই তার চূড়ান্ত সময় এসে
নিভিয়ে দিয়েছে ঝরোকার দেশান্তরী পাখি
শুধু প্লবতার গন্ধ ভেসে যায়
মায়ের কষ্টের কথা
দিকে দিকে গোল হয়ে জমে
ফেটে উঠবার উপক্রম
তবে কখনো ফাটেনি মৃদু বুক
উপ-বাস
বাসের অযোগ্য এক বিলাসভবনে সারারাত
ধসে-পড়া খিলানের খল-শব্দ প্রাণ পেতে শুনি
এখানেই অবশেষে যাত্রা শেষ মোর
মাঠ
মাঠে ঝরছে তর্জনী ও ধারা : মাঠ নেই
বিদ্ধ বিদ্ধ দিক আর প্রচুর বাজের সমতালে
গজায় টাওয়ার এক
আমি তাতে বসে
তর্জনীয় ঝড় দেখি, মাঠ নেই নেই
ভাবনার কাল
রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলে
লোকজন না-ভিজেই
যত্রতত্র ঢুকে পড়ে
মানুষ ক্যানো যে রোদে পুড়ে তবু বৃষ্টিতে ভেজে না
জ্যান্ত ঘোর বাস্তবতা তাড়া করে গুহ্যের ভিতর
পুরে ফ্যালে বোধয় বোধয়
আর তাই যে-রকম একবার বিধবার শখ হয়েছিল
সংকুচিত আঠালো ধাত্রের মধ্যে টলে
আর তার ক-হাজার একাতম রাত
কিন্তু তার রোজ শখ হয়
অথবা সধবা মাসী বিধবার বেশ ধরে ডেকে পাঠিয়েছে
তুই অবাক আঠার মতো লেগে থেকে ঠায় ঠায়
বৃষ্টিতে ভিজিস আর বৃষ্টিতে ভিজিস
হঠাৎ বৃষ্টি কি শেষ নাকি বৃষ্টি লেশ
আবার ব্যস্ততা নামে তাকে ছেদ করে
সে তখন ভেদ্য হয়ে থাকে ভাবনায়
প্রতিক্রিয়াশীল ও জালজ
যা আমি লিখিতে আর বলিতেও চাই তাহা
ভুল ব্যাকরণে
এক মণ ধান থেকে সের দশ চাল হয় কম
যা হবার কথা ছিল নয়
এক ট্যাঙ্কে সন্তরণ আর-ট্যাঙ্কে পুঁটি তেলাপিয়া
অনেক তো বন্য গাছ না নাম জেনেই আমি তাদেরও খুঁড়েছি
হুলে হাত ফুলে গ্যাছে ফলে
. প্রতিক্রিয়া হয়
তাই ভুল ভুল ব্যাকরণে যাহা ইচ্ছা আজি
. তাহাগুলি কবো
ক্রান্ত হব ভ্রান্ত বিকরণে
রাত
আমি মেশিনের বরপুত্র, বৈদ্যগিরি জানা ছিল ভালো
বলো তুমি কাঁদছ ক্যানো?
এমন যে কাঁচা কাজ, শ্বাসাঘাতহীন কান্না শোনা যায়
তুমি আমাকে বলছ না ক্যানো কথা?
সারা বাড়ি রঙ হলো, এবং সময় আছে বাতাস নেবার
পেকে ওঠো
তারপর অস্ত্র পাচার করি চোখভর
জানালা খুলেই এক মহাশূন্য
অন্তহীন আলো
ফলে কিছুই দ্যাখার বাকি রইল আর নয়
নুয়ে এসে মন্ত্র নাও মেশিনের, এত রাতে
রাজহংস শিকারের উরুজলে ডুবে মরা ভালো
কাঁধ
আদি ধুলাবালির থেকেই মাপ নিয়েছিলে
প্রাণের পাখি ভুলে গ্যাছো তুমি
উড়বে আর বইবার ভার ফেলবে রাশি রাশি নিচে
ফেলবে আর ফেলবার জন্য দিন দিন তলদেশ নেবে
তাই ঝড় তিনি অবলম্ব গাছের চূড়ায় দেন ছাতা
চুলায় শুকিয়ে যায় চা, চমকানো আদি ধুলা
বালির থেকেই তিনি হন
আসলে এখন ঝড় ঝাপটা থেকে সরে আছেন
. উর্ধ্বে
ছায়া
ভিখারীকে সব বললে পাপ হবে
তাই আধুলি ভাঙাই
সাধ হয়, দরজায় গরু থাকবে বাঁধা
আর সামনে থাকবে চাষ বাস ঘাস
ফলে আসতে হবে বাতাসের বেগে
উড়ে উড়ে
তোরঙ্গ
এ রঙ্গ আমার আর
এ রঙ্গ তোমার আর
এই রঙ্গ সকলের, তাই
তালা দিয়ে রাখা আছে পাঠের দোকানে
বাকশো ভেদ করে আছে চশমাবিক্রেতার রাগী চোখ
জানতে হলে যোগ চাই, ধরি
সেদিন দুপুরে আমি কাঁপলাম
মাজার
কে এসেছে বুক দিতে কেল্লা ঢাকা
তাকে ডাবের পাতায় মুড়ে শিস ফোটে
কারণ যে ফুঁড়ে
সমোদরা জেনে মাতা তোমার যৌবন ছুঁয়ে, যাই
বিশেষ ফাটল
এ বাড়িতে আমি থাকি আমি থাকি দেয়ালের কাছে
এ বাড়িতে বহুদিন থেকে আমি দেয়ালের মতো
দেয়ালের মতো আছি আমি আছি দেয়াল জড়িয়ে
আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল
আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল
আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল
ফাটলেরা রোজ রাতে মাটিতে মাটির মতো শোয়
দেয়ালের পাঁজরায় বটশিশু শেকড় ছড়ায়
বাড়িতে পিঁপড়ে আছে, আমি আছি দেয়াল রয়েছে
বাড়িতে পিঁপড়ে আছে দাঁতাল হাতির মতো তারা
দাঁতাল হাতির মতো ফুটো খোঁজে আমার হাঁটুতে
আমার হাঁটুতে ফুটো খোঁজে ফুটো খোঁজে দেয়ালের
আমিও ফাটল খুঁজি বিশেষ ফাটল দেয়ালের
[কখনো কি দেয়ালের বিশেষ ফাটল থাকে কোনো]
পিঁপড়ে ফাটল খোঁজে আমিও ফাটল খুঁজি খুঁজি
আমিও পিঁপড়ে হয়ে খুঁজি এক বিশেষ ফাটল
যদিও শরীরময় দেয়ালের অজস্র ফাটল
আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল
তবুও পাই না খুঁজে সে-বিশেষ গোপন ফাটল
কখনো কি দেয়ালের বিশেষ ফাটল থাকে কোনো
শরীর
মতো পতঙ্গের পথে নেচে এসো আমাদের ম’ ম’ বান্ধবী
টুপি দিয়ে বুক ঢেকে, রোদ
দ্যাখায় বা উড়ে থাকা স্বচ্ছ গোরা হাল্কা অবস্বাদে
যেটুকু মমতা মাখা সব খেতে হবে
আর ছয় পায়ে ছয়েক বাদাম
বিষ
অসম্ভব মৃগ হাওয়া টগবগিয়ে কোথায় চলে যায়
কোথায় থেকে আসে
কিছু আমরা জানতে পারি নাই
হে মৃগাশ্ব, কিংবা বলি টমেটোর চারায় যা ফলে
জলাকীর্ণ টর্নেডোর ঝাঁকি খেয়ে ফেটে পড়বার পরে
কিন্তু কিছুই ঘটে না, শুধু
মনে থাকে সেই আগেকার লোটা আর সালাদ প্রদান
জনে জনে, থেমে থেমে
অসমাপ্ত পূর্ণ গতি নিয়ে তোর যাওয়া আর
যুগ্ম হয়ে ফিরে আসা তোরই
নশ্বর এ মৃগবিকিরিত যান, আরবার কি জাদু শেখাবে?
কষ্ট
সফেন শোকের স্বাদ থেকে যেতে পারে কিন্তু
সাত কই?
আমি চল বল্লাম, অমনি এ চলে সে চলে সব চলে
কিন্তু আর কই?
মৃগব্যাধ
ভুলন্ত চকোরী বনে আলুথালু অরণ্য সংগীত;
শুয়ে আছে তীব্র নারী : সে আমার আবহ সন্ন্যাস।
আমি কি ভিখিরি কীট আর জানি দৃশ্যের বিকার?
ভ্রমণে বৃক্ষের ডানা বাঁওড়ের কার্নিশে ওড়ায়—
বনভূমি মৃগ-মাতা : আমি তার শাপান্ত ঈশ্বর!
গজারি গাছ
শান্ত সমাহিত মন দশমণ পাথরের নিচে
রূপালি কিরিচে কাটা চন্দ্রমুণ্ড হেঁটে যায়
সরাগ সন্ন্যাসে
গাঁজা পোড়ে
ক্ষণে ক্ষণে বেঁচে বেঁচে গজারি বনের দৃশ্য
আর
দুপুরের দাব দপ্তরীটির কাঁখে চেপে
বাতাসের অভিলম্বে ভাসমান
গো-চোনায়
. ধুয়ে
. মুছে
. বাঁকা চাকু
তৈরি হয় নীলিমা শিকারী
সেখানে বাইশ খণ্ড ধ্যান পেতে বসে আছে
ঋষি খর্পর
শিরোনামহীন
(অংশ)
…
একবার উত্তরে যাই
একবার দক্ষিণে
পূর্বেও একবার
পশ্চিমের লাল লোলুপতা থেকে কোনো বিচ্ছেদ ঘটে না
তবু সূর্য অস্ত যায় বহু বারবার
কেন্দ্রে নিয়োজিত যে নিটোল পরিবার
তার আজ পরিচয় নেওয়াবার দিন
…
চায়ের বাকশের মধ্যে লাশ হয়ে থাকা
কী যে মজাদার
…
নিজস্ব ভ্রমবিন্দুতে সিন্দুর লাগা দেখে
আজকে কবির মৃত্যু
আজকাল নিরোধক রাশি রাশি ঢাল
উড়ে উড়ে জুড়ে বসে কাঁধে
…
ঐ যে সিঁড়ি ঐ সিঁড়িগুলি পাতলা পাতলা ধাপ
ঐ যে লিকুইড রেলিং তার
ঐ যে পায়ের ছাপ লাল কাদাগুলি।
…
ফুলটির টলটলে ছায়াগুলি ঢেকে গ্যাছে
পাতায় পাতায়
তার ’পরে পদ্যেরা গড়াগড়ি খায়
পদ্যপাতায় আরও সংক্ষেপে
আমি শুধু পদ্ম বলে লিখি/শিখি
…
এসো হে গরিষ্ঠ বায়ু এসো এসো
. কৃপা করে যাও
এসো এসো লু-করণী এসো হে উন্মাদ
এসো এসো দ্যাখা করো নিহত কবিকে
তার আহত শব্দের ঘ্রাণ
পড়ে আছে বন্ধ দরজার আগে
এসো হে ঊষর বাত্যা বাঁজা প্রলাপের বার্তা
নিয়ে যাও এবং ছড়াও ঐ উচ্চকণ্ঠ
. রমণী পরাগী গাঁদা সাপের খোলসে
এসো হে উত্তপ্ত বায়ু এসো আর
. কৃপা দিয়ে যাও
…
বহু আনন্দধ্বনি চারপাশে
আমি আজ উঠে যাব
আমাকে উত্থান দাও
…
মনে হয় তুণ্ড পাবো আজ
আসর উল্টে দেওয়া তুণ্ডের ওজন
অচেনা পুষ্পের ঘ্রাণ বুকে পরে
এতকাল অপেক্ষায় আছি
…
কী এক কথার লোভে বেঁচে থাকি
মৃত্যু দূরে নয়
ইচ্ছার পালক হয়ে মৃত্যু জেগে থাকে
…
চেয়ার — যে বসে আছে
তার কাছে চারবার পায়া ভিক্ষা করে
হাঁটা শিক্ষা করো
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS