গাজায় বসবাস করা লোকজন নিজেদের শরীরে নানারকম সনাক্তকরণ চিহ্ন এঁকে নিচ্ছে, হাতে ব্রেসলেট পরছে, যাতে মৃত্যুর পর তাকে আর তার পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তি হিসেবে চিনতে পারা যায়। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন না করতে হয়। কেউ কেউ পরিবারের অর্ধেক সদস্যদের অন্য শহরে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যাতে আসন্ন মৃত্যু সবাইকে একসাথে দুনিয়া থেকে বিদায় না করতে পারে। এই যে অবধারিত মৃত্যুকে সামনে রেখে, কিংবা টুল হিসেবে নিয়ে জীবনকে ডিফাইন করার প্রক্রিয়া, অ্যাকাডেমিক পরিভাষায় এরই নাম নেক্রোপলিটিক্স।
এত অমোঘভাবে মৃত্যু এর আগে নাজিল হয়েছিল জার্মান কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, আজকের ইসরায়েলে সেটলার ইহুদিদের পূর্বপুরুষদের ওপর। ইসরায়েলে সেটল করা ছিল ইহুদিদের বায়োপলিটিক্স, বেঁচে থাকার কৌশল। কালেক্রমে নির্যাতিত হয়ে উঠল নির্যাতক। এত বিপুল মৃত্যু তাদের কেবল হিংস্রভাবে বেঁচে থাকাই শিখিয়ে গেল। যারা হলোকাস্ট সার্ভাইব করল, তারাই বানিয়ে ফেলল পরবর্তী হলোকাস্ট!
মাহমুদ দারবিশের কবিতা পড়তাম ছোটবেলায়। ফিলিস্তিন একটা অবশ্যম্ভাবী ইউটোপিয়া তখন। আমাদের ছেলেবেলায়। স্কুলের এক বন্ধু সেই ক্লাশ এইটে পড়া অবস্থাতেই ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করতে পালিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চলে এল! ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হলো, আর ওর পেছন পেছন যেন ফিলিস্তিনের স্বপ্নটাও আরো দরদি হয়ে আমাদের মফস্বল শহরে গেঁড়ে বসল। ফিলিস্তিন নিয়ে বাংলার কবিরাও যে কত কত কবিতা লিখল! কত হাজার হাজার সংকলন বের হলো! তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই এমন হয়েছে, ফিলিস্তিন দিয়ে ডিফাইনড হয়েছে তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। সারাবিশ্বের জন্য প্রতিরোধ আর মুক্তির প্রতীক হওয়ার পরেও ফিলিস্তিন আজো মৃত্যু দিয়েই তাদের ছেঁড়াখোঁড়া জীবনকে ডিফাইন করে চলেছে।
যারা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ জারি রাখছেন, তাদের শুকরিয়া। আমার নার্ভ অতটা শক্ত নয়। বৈপ্লবিক বন্ধুদের অভাবে আমি ধীরে ধীরে পেসিমিস্ট হয়ে পড়েছি। আমার জীবদ্দশায় ফিলিস্তিন হাইপোথিসিস নাল প্রতিপন্ন হয়েছে। আশাবাদী হবার জন্য এখন আপনাদের জীবনের ওপর ভর করতে হবে। গাজায় লোকজন যেমন ব্রেসলেট পরছে যাতে মৃত্যুর পরেও তাদের চেনা যায়, পোস্ট-ফিলিস্তিন বৈপ্লবিক দুনিয়ায় আমাদের চেনার উপায় কি — আমরা যারা আমাদের তারুণ্যে ফিলিস্তিনকে থিয়োরাইজ করেছিলাম?
ন্যায় সাম্য স্বাধীনতা মে বি আমাদের সবচে সুন্দর কেতাবি আবিষ্কার, কিন্তু পৃথিবীতে আজো জাঙ্গল রুলই চলে।
COMMENTS