জীবনযুদ্ধের কলা-কৌশল ও সান সু || আল ইমরান সিদ্দিকী

জীবনযুদ্ধের কলা-কৌশল ও সান সু || আল ইমরান সিদ্দিকী

বার্নস অ্যান্ড নোবেলে ঢোকার মুখে ‘ক্লাসিক বুক’ সেকশনে পেলাম সান সু’র বিখ্যাত বই ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’। সান সু (Sun Tzu) চীনের ইস্টার্ন জউ কালপর্বের (আনুমানিক ৭৭১ থেকে ২৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একজন মিলিটারি জেনারেল, সমরবিদ ও দার্শনিক। তাঁর ‘আর্ট অব ওয়ার’ আধুনিক সমরবিদ্যায় কিছুটা গৌণ হয়ে উঠলেও, যুদ্ধের মূলনীতি অনেকাংশে সব যুগে একই থাকে। তাছাড়া ’যুদ্ধ’ শব্দটাকে জীবনের যত ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করি, সব ক্ষেত্রেই ‘আর্ট অব ওয়ার’ থেকে আমাদের শেখার কিছু আছে। ঘরে-বাইরে, অফিসে-আদালতে, খেলার মাঠে, রাজনীতিতে, যেখানেই প্রতিযোগিতা আছে, লড়াই আছে, টিকে থাকার তাগিদ আছে, সর্বত্রই ‘আর্ট অব ওয়ার’ প্রযোজ্য।

সান সু তার বইয়ের শুরুতে পাঁচটি মূল বিষয়ের কথা বলেছেন অর্থাৎ এই পাঁচটি নিশ্চিত করার পর যুদ্ধপরিস্থিতিভেদে অন্যান্য কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

১. দ্য মোরাল ল  : এই নীতি অনুসারে, সৈন্যরা যে-কোনো পরিস্থিতিতে সেনাপতির অনুগত থাকতে, পরিস্থিতি অনুকূল বা প্রতিকূল যা-ই হোক না কেন। অর্থাৎ, প্রশ্ন যদি আদর্শের হয়, তাহলে আদর্শ ত্যাগ করা যাবে না। আপনাকে আপনার আদর্শের অনুগত থাকতে হবে।
২. হ্যাভেন  : এই নীতি অনুসারে, দিন বা রাত, গ্রীষ্ম বা শীত অর্থাৎ যে-কোনো পরিবেশে যুদ্ধ করার কৌশল জানা থাকতে হবে। নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটিই আপনার জয় নিশ্চিত করবে।
৩. আর্থ  : এই নীতি মূলত হ্যাভেন নীতির সম্প্রসারণ। লক্ষ্য কাছে থাক বা দূরবর্তী হোক, নিরাপদ হোক বা অনিরাপদ হোক, স্কোপ কম থাকুক বা বেশি, লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যে-কোনো পরিস্থিতিতে সমান দক্ষ হতে হবে।
৪. দ্য কমান্ডার  : এটি প্রথম নীতি ‘দ্য মোরাল’-এর সম্প্রসারণ। এই নীতি অনুসারে আপনাকে প্রজ্ঞাবান হতে হবে। সাহস, নিষ্ঠা ও কৃপা এই তিন গুণ থাকতে হবে। সবই আছে আপনার, কিন্তু দূরদর্শিতা নাই, তাহলে হবে না।
৫. মেথড অ্যান্ড ডিসিপ্লিন  : এই নীতি বলে, আপনি যুদ্ধ করতে চাইলে যুদ্ধের খরচ সম্পর্কে আপনাকে সচেতন হতে হবে। যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য কী পরিমাণ রসদ দরকার পড়বে এবং তা কোন পথে আসবে, সে-সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। সেনাবাহিনীতে সাবডিভিশনগুলি স্পষ্ট করতে হবে, অর্থাৎ কারা কোন গ্রুপে এবং কখন কোন দায়িত্ব পালন করবে, তা স্পষ্ট হতে হবে। জীবনযুদ্ধে যারা আপনার শরিক, তাদের ক্ষমতাকে চিনতে হবে এবং দায়-দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে।

এই পাঁচটি বিষয় আপনি নিশ্চিত করতে পারলে, সান সু আপনাকে আরও কিছু উপদেশ দিচ্ছেন। ‘আর্ট অব ওয়ার’-এ মোট তেরোটি অধ্যায় আছে। এই তেরোটি অধ্যায়ে যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। সেখান থেকে কিছু উপদেশ তুলে ধরছি :

ক. যখন আপনি আক্রমণ করতে সমর্থ, তখন আপনার প্রতিপক্ষ যেন মনে করে আপনি অসমর্থ। অর্থাৎ আপনাকে আপনার শক্তি-সামর্থ্য গোপন করতে হবে। সান সু প্রয়োজনমাফিক শক্তিপ্রয়োগের পক্ষে, অকারণ শক্তি-প্রদর্শনে নারাজ। জীবনযুদ্ধে সে-ই জেতে, যে আনপ্রেডিক্টেবল। আপনার প্রতিপক্ষ আপনার থেকে দুর্বল হলেও, সে যেন আপনাকে মেপে না ফেলে।
খ. আপনার প্রতিপক্ষ যদি হট হেডেট লোক হয়, তাহলে তাকে খোঁচাতে থাকুন নানাভাবে। ক্রিকেটে উইকেটকিপার, স্লিপে দাঁড়ানো খেলোয়াড়রা যে-কাজ করে ব্যাটসম্যানের সাথে। খোঁচান। উত্যক্ত করুন। অসময়ে উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করুন। এমন কিছুও করুন, যাতে সে আপনাকে দুর্বল ভাবে।
গ. প্রতিপক্ষের দুর্বলতায় সবার আগে আঘাত করুন। দুর্বল জায়গা সবল করতে প্রতিপক্ষ বেশি সময় নেবে না। এমন পরিস্থিতিতে দেখা দিন, যে-পরিস্থিতিতে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত।
ঘ. সান সু বলেছেন, ‘যদিও আমরা জানি আহাম্মকেরা বেশি তাড়াহুড়া করে কিন্তু এটাও সত্য চালাক লোক বেশি দেরি করে না।’ তাছাড়া যুদ্ধ যত দীর্ঘমেয়াদী হবে, যুদ্ধের খরচও তত বেশি হবে। বেশি এনার্জি নষ্ট করা বোকামি।
ঙ. যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সান সু সচেতন ছিলেন। তিনি মনে করেন মাঠে নেমে যুদ্ধ করে জেতাটা আপনার ক্ষমতার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ না। মাঠে নেমে যুদ্ধ না করেই প্রতিপক্ষের ধৈর্য ও প্রতিরোধক্ষমতা ভেঙে ফেলতে পারাটাই সব থেকে বড় কাজের কাজ। সান সু প্রতিপক্ষের সৈন্য ও রসদ ধ্বংস না করে বরং অধিগ্রহণ করার পক্ষপাতী।
চ. ভালো যোদ্ধা অফেন্সের তুলনায় ডিফেন্সকে বেশি গুরুত্ব দেয়। আপনার ডিফেন্স যদি মজবুত হয়, যদি আপনি জানেন আপনার দুর্বলতা কোথায় এবং তার প্রতিকার করেন, তাহলে সুযোগ সন্ধান করা ছাড়া আপনার আর কোনো কাজ থাকে না। পরাজয় তো ঠেকালেন, এখন শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। কোন লোক তার প্রতিপক্ষকে ভুলক্রমে একটা সুযোগ দেয় না? সেই সুযোগের অপেক্ষা করুন, অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করুন। আপনার পরাজয়ের কারণ আপনি, কিন্তু আপনার জয়ের কারণ আপনার প্রতিপক্ষ। জিতবেন কি না সেটা যদি নিশ্চিত করতে না-পারেন, অন্তত এটুকু নিশ্চিত করেন যে আপনি হারবেন না।
ছ. আপনি বড় সেনাবাহিনী নাকি ছোট সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি বড় সেনাবাহিনীর সাথে নাকি ছোট সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছেন, সেটাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি আপনার সেনাবাহিনীকে ঠিক সময়ে ঠিক সিগ্ন্যাল দিতে পারছেন কি না। অর্থাৎ কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকা যাবে না। প্রতিপক্ষকে ভুল তথ্য দিতে চাইলে, সেটা যেন প্রতিপক্ষের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছায়, সে-ব্যবস্থা নিতে হবে।

সান সু নয় (০৯) রকম যুদ্ধক্ষেত্রের কথা বলেছেন। নয় রকম যুদ্ধক্ষেত্রে নয় রকম কৌশল অনুসরণ করতে হবে। একই কৌশল সব জায়গায় প্রয়োগ করা বোকামি। এই নয় রকম যুদ্ধক্ষেত্রের একটি হলো ‘ডিফিকাল্ট গ্রাউন্ড’, যখন আপনি প্রতিপক্ষের দেশের কলিজার মধ্যে ঢুকে পড়েন। উদাহরণ স্বরূপ, যখন আপনি ফেসবুকে কারও সাথে তার পোস্টে গিয়ে দেশ-কাল-রাজনীতি নিয়ে তর্ক করা শুরু করেন, তখন সেটা ডিফিকাল্ট গ্রাউন্ড। কারণ, পোস্টের কোন কমেন্ট থাকবে, কোন কমেন্ট মুছে ফেলা হবে, সেক্ষেত্রে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিপক্ষের থাকে। তাছাড়া সেই পোস্ট তার বন্ধুদের চোখে যতটা পড়ে, আপনার বন্ধুদের চোখে ততটা পড়বে না। ফলে খেলার মাঠে আপনার প্রতিপক্ষ স্বাগতিক, পুরো গ্যালারি তার। সেক্ষেত্রে আপনি যেটা করতে পারেন, আপনার করা একটি মোক্ষম কমেন্ট আপনি কপি করে আপনার ওয়ালে পোস্ট করতে পারেন প্রতিপক্ষকে মেনশন করে। তাতে আপনারই স্বাগতিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। আর কিছু না-হোক, অন্তত দুই ওয়ালে তর্ক চলবে। দুই গ্রাউন্ড মিলে লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড তৈরি হবে।

সান সু দার্শনিকতায়ও অনন্য ছিলেন। তিনি লাওৎসে ও চৈনিক নীতিবিদ্যার গুরু কনফুসিয়াস দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ফলে তিনি অনুশোচনা ও সহমর্মিতার বিষয়েও সচেতন ছিলেন। যুদ্ধ একটি অমোঘ বাস্তবতা। টিকে থাকার সংগ্রাম সবখানেই আছে, সবকিছুতেই আছে। জীবনযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হতাশ করার পাশাপাশি সহমর্মিতা ও অনুশোচনারও প্রয়োজন আছে। কারণ জীবন একটাই। আপনার-আমার মতো আমাদের প্রতিপক্ষেরও সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের অধিকার আছে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে আপনার-আমার মতো সাফল্যের প্রয়োজন তারাও অনুভব করে। প্রতিযোগিতা তো সহযোগিতার মতো সুন্দর, একভাবে দেখলে প্রতিযোগিতা তো সহযোগিতাই। সেখানে পাশবিকতার স্থান থাকতে পারে না।


আল ইমরান সিদ্দিকী রচনারাশি

COMMENTS

error: