অরুণেন্দু দাসকে (Arun Das) চিনতে পারছেন না, তাই তো? অস্বাভাবিক কিছু না, তার কথা তো কোথাও শোনা যায় না তেমন। মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত অ্যালবামে থাকা নিচের এই গানগুলো নিশ্চয়ই কমবেশি শুনেছেন।
* জানাতে যত যাই কথায় / হারাই ততই মানে / ভালোবাসি তোমায় / তাই জানাই গানে
* দিশেহারা যে মোর মন / কিসে সার্থক এ-জীবন
* ও গঙ্গা, তুমি চলেছ ঢেউয়ে ঢেউয়ে কোথায়?
* যাস কোথা তুই / কীসের এত তাড়া? / কেন নিস না কানে / বলছি একটু দাঁড়া
* ভিক্ষেতেই যাব গো আমি ভিক্ষেতেই যাব
* পেরিয়ে মাঠের সীমানা ওই মেলা বসেছে, চরকি ঘোরে, পাঁপড় ভাজায় …
* সারারাত আমি হই শুধু আমার / নির্ঘুম নির্জনতায় বাড়ে আঁধার
এগুলোর সবই লিখেছেন এবং সুর করেছেন (আবার কোনোটা গেয়েছেনও) অরুণেন্দু দাস। একটু আগে Sinaভাই ইনবক্সে জানালো অরুণেন্দু দাস আর নেই, তথ্যসূত্র রূপম ইসলামের ফেসবুকপোস্ট। এরপর কলকাতার আরো কয়েকজনের থেকে তথ্য যাচাই করে দেখলাম সত্যিই তিনি আর নেই।
ব্যক্তিগত কিছু সমস্যায় কয়েকদিন ধরে খুব মনখারাপ ছিল, আজ আরো খারাপ হয়ে গেল। অরুণদা আর নেই, ইচ্ছা ছিল তিনি কলকাতায় থাকা অবস্থায় দেখা করব, সাক্ষাৎকার চাইব।
তাকে তো আমরা তেমন চিনি না, তবে তিনি গানের রাজ্যে অনেকদিন আছেন। নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় সুম-অঞ্জনরা যে জীবনমুখী ধারার চল করেন, এই ধরনের গানগুলোই অরুণেন্দু দাস ১৯৫৬ সাল থেকে করে আসছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম গিটার-সিঙ্গার-স্যংরাইটার; অথচ তিনি সবসময় লুকায়িত, লোকচক্ষুর আবডালেই থেকে গেছেন।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কলেজে আর্কিটেকচার পড়ার সময় গারফাঙ্কেল-কোহেনদের গানের প্রেমে পড়ে গিটার বাজানোর চর্চা শুরু করেন, সেসবের সুরে কথা বসানোও শুরু করেছেন তখন, মানে তাদের গান বাংলায় অ্যাড্যাপ্টেশন করতেন। তিনি কেবল কলেজের অনুষ্ঠানে আর বন্ধুদের আড্ডায় গান গাইতেন।
গিটার হাতে বাংলা গান বাঁধার প্রথম এই কারিগরের গান কলেজের বাইরে আসেনি কারণ তখন হেমন্ত-মানবেন্দ্র-সতীনাথ-সন্ধ্যা-শ্যামলদের গানে কলকাতা মাতোয়ারা। তার এই বিদেশি ঢঙের গান নেয়ার মতো অবস্থা বাংলা গানের শ্রোতাদের ছিল না। তার গান সেভাবে বাইরে না আসার আরেকটা কারণ তিনি ষাটের দশকের শেষের দিকে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের লোকসংগীতের সঙ্গে তিনি তখন নিজেকে ঝালিয়ে নিতে থাকেন। অরুণেন্দুর অধিকাংশ গানই সেই সময়ে লেখা। তিনিই প্রথম বব ডিলানের Blowin’ in the Wind গানটাকে বাংলা অ্যাড্যাপ্টেশন করেন, নাম দিয়েছিলেন ‘আরও কত পথ বলো হাঁটলে মানুষ তবে সে মানুষ হবে?’
প্রিয় অরুণদা নিজের ইচ্ছেতেই গান বাঁধতেন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসে গাইতেন। গৌতম চট্টোপাধ্যায় যদি তার খোঁজ না পেতেন, তার সম্পর্কে না জানতেন তাহলে হয়তো আমরা কেউই তাঁর নাম জানতাম না। মহীনের ঘোড়াগুলি যখন নব্বইয়ের দশকে আবার ফিরে আসে তখন তাদের সম্পাদিত চারটি অ্যালবামের প্রত্যেকটিতেই অরুণেন্দুর গান ব্যবহার করেন। প্রথম সংকলন ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ বেরোয় ১৯৯৫ সালে, শেষটা ১৯৯৯ সালে। এই গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জন্যই কিন্তু অরুণেন্দুকে চিনেছে অনেকেই, তাও খুব অল্প পরিসরে।
তাঁর সম্পর্কে গৌতম চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “অরুণদা সেই কবেকার আগেকার এক নাগরিক চারণ। আমাদের সব্বার আগে, ঘোড়াদেরও আগে এগিয়েছিল তাঁর গান।”
গানকে যিনি চিরকাল মনে করেছেন ব্যক্তিগত সাধনা সেই অরুণদার শুভাকাঙ্ক্ষীরা মিলে ২০০৪ সালে প্রেস্টো স্টুডিও থেকে তাঁর একমাত্র অ্যালবাম ‘অরুণদার গান’ মুক্তি দিয়েছিলেন, এছাড়া তাঁর গানের আর কোনো সঙ্কলন নেই। ইউটিউবে কিছু গান পাওয়া যায় যেখানে তাঁকে গিটার বাজিয়ে গাইতে দেখা যায়, সেগুলোর সবই আড্ডায় রেকর্ড করা। রূপম ইসলাম ‘বাংলা রক’ ম্যাগাজিনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, এছাড়া তাঁর আরো দুয়েকটা সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে বিখ্যাত গায়িকা মৌসুমী ভৌমিকের উদ্যোগে লন্ডনেই হয়েছিল তাঁর গানের অনুষ্ঠান। তাঁকে নিয়ে ঋতম সরকার একটা ডকুমেন্টারিও বানিয়েছেন, সেটা দেখানোও হয়েছে কিছু কিছু জায়গাতে।
মহীনের ঘোড়াগুলির অ্যালবামে প্রকাশিত তাঁর লেখা, সুর-করা আর গাওয়া গানগুলো বাদে বাকি গানগুলোর অধিকাংশই তাঁর অ্যালবামে ছিল, সেটার ছবিও দিলাম।
ইউটিউবে গান : এখানে
ডকুমেন্টারি ‘অরুণদার গান’-এর ট্রেইলার : এখানে
[metaslider id=”7352″]
… …
- অরুণেন্দু দাস : কবেকার সেই নাগরিক চারণ || গৌতম কে. শুভ - February 3, 2019
COMMENTS