কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ

কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ

 

ত্রিশের দশকের বিশিষ্ট কবি অশোকবিজয় রাহা (১৪ নভেম্বর ১৯১০-১৯ অক্টোবর ১৯৯০) একাধারে যশস্বী প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক।  পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি হতে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অশোকবিজয় রাহা  নামে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এর লেখক অমল পাল। কিন্তু এতেও তাঁর ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রবন্ধটি অগ্রন্থিতই রয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়। নিচে The Murarichand College Magazine (Vol, X1X, 1936-37, No. iii., P., 101-111) হতে ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধটির বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত রেখে সংকলন করা হলো।

দুষ্প্রাপ্য রচনাটির সংগ্রাহক মোহাম্মদ বিলাল (সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট) কর্তৃক লিখিত সুপরিসর ভূমিকাটি পড়ার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন :

মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল

সেদিন হঠাৎ Jeans-এর The Mysterious Universe-খানা হাতে এলো। তা’র পর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো একটা দিন তার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলো পড়ে কাটালুম। সত্য বলতে কী, বইখানার সর্বশেষ অধ্যায় Into the Deep Waters-টিকে বাদ দিলে এর কোথাও লেখকের মৌলিক চিন্তাধারার কোন ছাপ দেখতে পাওয়া যায় না। লেখক নিজে বৈজ্ঞানিক, তাই বিজ্ঞানের বড়ো বড়ো সত্যেগুলোকে খাঁটি বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টি নিয়ে সুস্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছেন এবং পরে সেইগুলো তাঁ’র বই-এর মধ্যে একটি বিশেষ পর্যায়ক্রমে বিন্যাস করেছেন মাত্র। কিন্তু তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, অতি চমৎকার লাগছে তা’র লেখা—মনে হলো যেন কোনো প্রথম শ্রেণীর কবির কাব্য পাঠ করছি—অতি বলিষ্ঠ তা’র কল্পনা, অতি সমৃদ্ধ তা’র ভাষা এবং অতি সুন্দর তা’র উপস্থাপন। আরো একটা কথা ভাবছি : কবি এবং বৈজ্ঞানিকের মাঝখানে যে এক বিরাট প্রাচীর দেখা গিয়েছিল সভ্যতার প্রথম সূর্যোদয়মুহূর্তে, Jeans-এর বইখানা প’ড়ে মনে হচ্ছে সেটা আদপে কোনো প্রাচীরই ছিল না, জমাট কুয়াশা দূরে থেকে চুনকাম করা পাকা দেয়ালের ভ্রম জাগিয়াছিল মাত্র,—তার উচ্চারণ ছিল সত্য, কাঠিন্যটা ছিল অনুমান। তাই আজ যখন সূর্য আরো খানিকটা উপরে উঠেছে, তখন উভয় জগতের মাঝখানে অতি-সূক্ষ্ম সিল্কের পর্দার মতো একটুখানি স্বচ্ছ বাষ্পলেশ অবশিষ্ট আছে মাত্র।

কিন্তু এখানে আমাকে ভুল বোঝার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের বইখানা নিয়ে হঠাৎ ভাবোদ্বেল হ’য়ে এমন ক’রে এতগুলা কথা বলা হয়তো আমার উচিত হচ্ছে না, কেন-না পাঠক হয়তো মনে ক’রে বসবেন আমি বইখানার ঈষৎ ভাববাষ্পস্ফীত দার্শনিক উপসংহারটির দিকে বিশেষ নজর রেখেই এত উচ্চ প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হ’য়ে উঠেছি। গোড়াতেই তাই আমার বলা উচিত যে এটা মোটেই সত্য নয়। বরং Jeans তার বই-এ এই উপসংহারের লেজটা না জুড়ে’ দিলেও আমার কাছে এর সাহিত্যিক মূল্যের এতটুকু তারতম্য ঘটত না। অবশ্য তথাকথিত বৈজ্ঞানিকের দার্শনিকতা করার কোনো অধিকার নেই এমন কথা বলার মতো মতিভ্রান্ত আমি হইনি, তবু এটা অতি সত্য কথা যে Jeans-এর এই দার্শনিক ব্যাখ্যাটিকে যথার্থ এবং যুক্তিসঙ্গত ব’লে ধ’রে নিলেও আমরা বলতে বাধ্য যে-একটি বিশেষ সুরে বাঁধা, তা’র সঙ্গে উপসংহারের সুর একেবারেই মেলে না। উপসংহারে এসেই বইখানার art ব্যাহত হয়েছে।

যাক,—Jeans-এর বইখানা পড়লুম। উপসংহার বাদ দিয়ে বইখানা যা লাগলো, এক কথায় বলতে গেলে ‘চমৎকার’। অবশ্য তাঁর শেষ অধ্যায়টিকে যে ভালো করেই না পড়েছি তা’ নয়, বার-তিনেক পড়েছি; তবে প্রথমবার পড়েই এটাকে এ-বই থেকে মনে-মনে মুছে’ ফেলেছি. এবং শুধুমাত্র এই লেখাটিকে নিয়েই সম্পূর্ণ আলাদা একখানা বই কল্পনা করে নিয়েছি। বোধ করি এতে করে এতটুকু অন্যায় করিনি লেখকের প্রতি, কেন-না লেখক নিজেই তাঁর ভূমিকার এই উপসংহারটিকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরণের লেখা বলে কবুল করে নিয়েছেন। বস্তুত এই স্বীকারোক্তির জন্য মনে মনে তার সাহিত্যিক প্রতিভার তারিফ না করে পারছিনে।

এই তো গেলো Jeans-এর লেখার সঙ্গে আমার মোটামুটি সংক্ষিপ্ত পরিচয়। কিন্ত এই পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে আমি আরো একটি বৃহত্তর বস্তুর নিকটবর্তী হতে পেরেছি, এইটে-ই হোলো আমার কাছে সবচেয়ে বড় জিনিষ। এখন মনে হচ্ছে এই-যে মানুষ এত কাল ধ’রে কাব্য এবং বিজ্ঞানের মধ্যে একটা আকাশ-পাতাল ব্যবধান রক্ষা করে এসেছে, এটা যেন একটা অতি বড় অন্যায় আচরণ মানুষের। সত্য বটে, কাব্যলোক ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখের অশ্রুহাসির আনন্দবেদনার তীব্রমধুর ভাবানুভূতির অতি-সূক্ষ্ম শিশিরজালের চিত্র-বিচিত্র আলোক-ঝালরে ঝলমল করছে, এবং এ-ও অতি সত্য কথা যে বিজ্ঞান জগৎ ব্যক্তিনিরপেক্ষ সার্বজনীন বিচারবুদ্ধির নিত্যনব অনুশীলনে উদ্ভাবিত নানা আইন-কানুনে গড়া সোজা-চলার সদর রাস্তা এবং বাঁকা চলার অলি-গলিতে ছাওয়া এমন একটি নাগরিক রাজত্ব, যার মোড়ে-মোড়ে দৃশ্য-অদৃশ্য, স্থূল-সূক্ষ্ম, সরল-বক্র বেড়াজালের তারে জড়ানো নব-নব মহা যন্ত্রের অন্তহীন ষড়যন্ত্র;—কিন্তু এটা তো হলো একটা একপেশে দেখা। কাব্যের ব্যক্তিগত অনুভূতি যেখানে সার্বজনীন অনুভূতিতে পরিণত হচ্ছে, ব্যক্তিগত ভাবধারা যেখানে বিশ্বজনীন ভাবধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, সেখানে সেই আশ্চর্য পরিবর্তন ব্যাপারের মধ্যে ক্রিয়া করছে কল্পনা; আবার বিজ্ঞান যেখানে তার অধিকৃত সাময়িক রেখাটানা চতুঃসীমার মধ্যে শাসনব্যবস্থার সূচনা করছে সেখানে আপাতত খুঁটিনাটি বিচার বুদ্ধির চুলচেরা হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত বটে, কিন্তু যেখানেই সে নব-নব সত্যের জন্মভূমি আবিষ্কার করতে বেরিয়েছে সেখানে সেই আশ্চর্যতম অভিযানের মধ্যে ক্রিয়া করছে কল্পনা। এই কল্পনা না থাকলে কাব্য শুধু ব্যক্তিগত জীবনের আটপৌরে সুখ-দুঃখের ‘আহা’-‘উহু’তে সীমাবদ্ধ হয়ে রইতো, এবং এই কল্পনার অভাবে বিজ্ঞানের আইন-কানুনগুলা আদৌ রচিত হোতো কি-না সন্দেহ,—ছাড়া-ভাঙা যুক্তি-তর্কের টুকরো-টুকরো ধারাল হাতিয়ারগুলা হয়-তো-বা কোন্ এক প্রাক-পৌরাণিক যুগের অচলায়তনের আলো বাতাসহীন অন্ধকারের তলায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে অন্ধের মতো মাথা খুঁড়ে’-খুঁড়ে’ কেবলি blind lane-এর সংখ্যাবৃদ্ধি করে চলত। অর্থাৎ এক-কথায় বলতে গেলে কল্পনা না হ’লে কাব্য যেমন কোনো দিনই তা’র উৎসমুখ থেকে শতছন্দে আবর্ত্তিত হয়ে উঠত না, বিজ্ঞানও তেমনি চিরকাল অজ্ঞানের জটিলতম অন্ত্রনাড়ীর মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ব্যর্থভাবে আপন মুক্তিপথ খুঁজে’ বেড়াত।

এখানে কথাটা আরো একটু পরিষ্কার হওয়া চাই। কাব্য বলতে আমি এখানে কাব্য-ধর্মী সব কিছুকেই ধরছি,—সঙ্গীত, চিত্র, ভাস্কর্যও এই পর্যায়ে আসছে,—যা’র মধ্যে দিয়ে একের ভাবানুভূতি বিশ্বের ভাবানুভূতিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আবার বিজ্ঞান বলতেও এখানে আমি বিজ্ঞানধর্মী সব-কিছুকেই বুঝছি—পদার্থবিজ্ঞান থেকে আরম্ভ ক’রে অর্থশাস্ত্র পর্যন্ত,—বিশ্বজনীন বিচারবুদ্ধির দ্বারা যা’ নিয়ন্ত্রিত। আমি বলতে চাই যে এই কাব্যজগৎ এবং বিজ্ঞানজগৎ একটিমাত্র পটভূমিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে,—সেই পটভূমিটি হচ্ছে কল্পনার।

অনেকেই হয়তো ভয় করবেন, আমার মস্তিষ্কের কোথাও-না-কোথাও কোনো-না-কোনো কীলক শিথিল হ’য়ে প’ড়েছে; তা’ নইলে এত বড়ো একটা অসম্ভব কথা ফস্ ক’রে ব’লে ফেলা কী করে সম্ভব হোলো যে বিজ্ঞান এবং কাব্যের মধ্যে একটা নিবিড় ঐক্যসূত্র রয়েছে। কথাটা আমিও যে না ভাবছি তা নয়; কিন্তু সামনে Robert Browing-এর বইখানা খোলা রয়েছে, টেবিলের নিচে পা’ ছড়িয়ে কেদারা চেপে’ বসেছি, প্যাডে আর ক’-খানা পাতা অবশিষ্ট আছে অনুমান করতে পারছি, ঝরনা-কলমে আর নতুন ক’রে কালি পূরবার আগে প্রবন্ধটা শেষ করতে হবে, এ-বিবেচনাও আছে, এমন অবস্থায় একেবারে  দুর্মতিগ্রস্ত হইনি এটা মনে করাই তো স্বাভাবিক,—এমন কী, এ ছাড়া আর কিছু করাটাই আমার স্থির বিচারবুদ্ধির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। যাক—আমি এখন হিসাব ক’রে দেখছি মানুষকে কবি কিংবা বৈজ্ঞানিক বলে প্রশংসা করাটা আসল কথা নয়, আসল কথা হোলো মানুষকে প্রতিভাবান বলে স্বীকার করা। সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বলিষ্ঠ কল্পনার নাম-ই প্রতিভা। এই কল্পনা থাকলে মানুষ বড়ো দ্রষ্টাও হতে পারে, বড়ো স্রষ্টাও হতে পারে। এই কল্পনা যখন তা’র দৃষ্টিকে সুদূর-প্রসারিত করে দেয় তখনি সে হয় বৈজ্ঞানিক, আবার এই কল্পনা যখন তা’র সৃষ্টিকে উদ্বুদ্ধ ক’রে তোলে তখনি সে হয় কবি।

এতগুলো কথা এমন ক’রে বলার অর্থ এ নয় যে বিজ্ঞান এবং কাব্য আগাগোড়া একই বস্তু, এবং এ দু’য়ের কোনো বৈষম্যই কোথাও নেই। আমি যে কথা বলতে যাচ্ছি সে হচ্ছে এই যে, এ দুই-ই বলিষ্ঠ কল্পনা থেকে উদ্ভূত এবং এদের প্রেরণাগত উৎস এক-ই, যদিও সেখান থেকে বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হওয়াতে এদের প্রকার বৈচিত্র্য ঘটেছে। এই দুই মুক্ত বেণীর আদি উৎসে রয়েছে প্রতিভা বা সেই দীপ্ত কল্পনার প্রস্রবণ, যা’র মধ্যে এক-ই সঙ্গে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টির অনাবিল স্বচ্ছতা এবং নূতন সৃষ্টির প্রেরণার দুর্নিবার উচ্ছ্বাস। তা’র পর দুইটি ধারা দুটি স্বতন্ত্র পথে যাত্রা শুরু করে;—একটি বন্ধুর গিরিপথে আলোড়িত আবর্তিত হ’য়ে শত বিচিত্র ছন্দে কলধ্বনিত হ’য়ে তরঙ্গে তরঙ্গে ক্ষণকালের মধ্যে বিশ্বের নানা রূপ ও সঙ্গীতবৈচিত্র্যের সৃষ্টি করে চিরচঞ্চল নৃত্যভঙ্গীতে রামধনুর ওড়না উড়িয়ে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি করতে করতে ছুটতে থাকে,—অপরটি উপত্যকার পথ ধ’রে ধীর-প্রবাহে নেমে গিয়ে দিগন্তবিস্তৃত সমভূমির দেশে নব-নব স্থির শান্ত হ্রদের সৃষ্টি ক’রে তা’রি বুকে বিশ্বের অনন্ত আকাশের ছায়া প্রতিবিম্বিত ক’রে মন্থরগতিতে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হ’তে থাকে। বস্তুত দুই-ই বিভিন্ন, মূলত দুই-ই এক।

প্রশ্ন হতে পারে, কী যে বলতে চাও একটু সহজ ক’রেই বলো-না,—উপমা জিনিসটা এ-যুগে অচল, পরিষ্কার ভাষায় ব’লে দাও, ভেবে দেখি কথাটা কতখানি সত্য। বেশ তো, প্রবন্ধ তো আর কবিতা নয় যে কালিদাসস্য বৈশিষ্ট্যটি প্রয়োগ না করলেই নয়, বাক্যগুলো এখানে রসাত্মক করার মানে হয় না, কেন-না এ পাটের বাজার,—মিষ্টান্নভাণ্ডার নয়। শুকনো মাল নিক্তিতে ওজন করার পক্ষে প্রশস্ত, যেহেতু এমনটা করলেই তা’র ঠিক ওজনটা ধরা পড়ে। প্রবন্ধ লিখতে বসে যুগে যুগে সকল লেখককেই এ-কথা মাথা পেতে স্বীকার করতে হয়েছে,—নজির খুব দূরে নয়।

যাক,—আসল কথাটাই শুরু করি। আমি বলছিলুম কী, প্রতিভা যদি সত্যসন্ধী হ’য়ে নানা ভাবানুভূতির ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্যে আত্মার আকুতিকে প্রকাশ করবার জন্য আকুলভাবে উদ্বেল হ’য়ে ওঠে, তবে একমাত্র সেই অবস্থাতেই সে কাব্যসৃষ্টি করতে পারে,—তা’ হ’লে প্রত্যেকটি ঘাত-প্রতিঘাতে তা’র মধ্যে ছন্দ তরঙ্গায়িত হ’তে থাকে, এবং সে এক মুহূর্তে এমন একটি অপূর্ব সৃষ্টিশক্তি লাভ করে যা’র উদ্রেকমাত্র তা’র সমস্ত সত্তা বাঙময় হয়ে ওঠে। অপর পক্ষে প্রতিভা যদি ভাবানুভূতির ঘাত-প্রতিঘাতের পথে না গিয়ে সত্যের সন্ধানে সম্মুখের দিকে স্থির স্বচ্ছদৃষ্টি প্রসারিত ক’রে অগ্রসর হ’তে থাকে, তা’ হ’লে একমাত্র সেই অবস্থাতেই সে বিজ্ঞানের ভাস্বর দৃষ্টিশক্তি লাভ করতে পারে।

এখানেও আমাকে ভুল বোঝা বিচিত্র নয়। এক ক্ষেত্রে সৃষ্টিশক্তির কথা এবং অপর ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তির কথা কেনো বললুম সেটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। কথাটা গোড়াতেই একবার বলতে চেয়েছিলুম কিন্তু লগ্ন তখনো আসেনি বলেই শুরুতে মোড় ফিরিয়ে নিয়েছিলুম। সেই লগ্ন এসেছে এখন, ভালো করে বোঝা-পড়া হ’য়ে যাক। ধৈর্যাভাবের অজুহাতে হঠাৎ এখন পিছিয়ে পড়ার মানে নেই। দাড়ি-কমার লাঠি-ঠেঙায় ভর ক’রে মাঝে মঝে একটুখানি জিরিয়ে নেওয়া চলে, কিন্তু ঠাঁয় ব’সে রইলে মাঠে মারা যাবার উপক্রম। গন্তব্যটা যত দূরেই হোক, আর পথটা যত দুর্গমই হোক—দুর্গমই বলতে হবে, কেন-না কর্দমাক্ত তো বটেই—মাঝামাঝি যখন পৌঁছেই গেছি, এগিয়ে তখন চলতেই হবে,—লেখককেও, পাঠককেও। শ্রান্তিটাকে এড়িয়ে যাবার উপায় যখন নেই, ভেবেই চলা যাক :

কবির মধ্যে মানব প্রতিভার বিশেষ কাজটি কী? নিজের চৈতন্যের কেন্দ্রে বিশ্বের ভাবানুভূতিগুলাকে উপলব্ধি করে সেগুলাকে রূপায়িত করা। এই রূপায়ণের মধ্যে আসে সৃষ্টির প্রশ্ন। এখানেই কবিকে স্রষ্টা হ’তে হয়। অপর পক্ষে বৈজ্ঞানিকের কাজ হচ্ছে বিশ্বের সম্বন্ধে যে-কয়েকটি বিশেষ জ্ঞান আমরা সাধারণভাবে পাই, তা’র চেয়ে ব্যাপক জ্ঞান দান করা। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকের কাজ হচ্ছে বৃহত্তর এবং সেই অর্থে সত্যতর বিশ্বের সঙ্গে আমাদের জানাশোনা করানো। এইখানে, সেই বৃহত্তর বিশ্বকে যে-দৃষ্টি নিয়ে দেখতে হবে সে দৃষ্টি তিনি নিজে লাভ করেন, এবং আমাদের সবাইকে দান করেন। বৈজ্ঞানিকের বেলা তাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে দৃষ্টিলাভের প্রশ্ন। প্রতিভা যখন ভাবানুভূতিকে বাণী দান করে তখনি সে করে রূপায়ণ, সে হয় স্রষ্টা, সে হয় কবি; আবার প্রতিভা যখন অজ্ঞানের আবরণ ভেদ করে জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ করে, তখনি সে লাভ করে সত্যদৃষ্টি, তখনি সে হয় স্রষ্টা, সে হয় বৈজ্ঞানিক।

কেউ হয়তো হঠাৎ করে বলে বসবে বুঝলুম তো বাপু, তোমার কথাগুলো; কিন্তু তা’ হ’লে বৈজ্ঞানিক যেমন কবি-ধর্মী হতে পারেন না,  কবিও তেমনি বৈজ্ঞানিক-ধর্মী হতে পারেন না—এ-কথাটা আরো একটু স্পষ্ট ভাষায় বলে ফেলাই তো তোমার উচিত; এবং গোড়াতেই যে ঐক্যসূত্রের দোহাই দিয়ে এসেছ সেটাকে মাঝখানে কর্তন ক’রে কাব্য এবং বিজ্ঞানকে দু’টো স্বতন্ত্র জগতের জিনিষ ব’লে প্রকাশ করাই তো তোমার কর্তব্য। ভাগ্যের দুর্বিপাকে শুরুতে একটা কথা কবুল ক’রে শেষ পর্যন্ত যে পাকচক্রের মধ্যে এসে পড়েছ এর থেকে রেহাই পাওয়া সহজ কথা নয়। এখন বাঁচতে হলে এটা স্বীকার করে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ, যে, কাব্য আর বিজ্ঞান একেবারে ‘জাত আলাদা’—এদের মধ্যে কোনো আপোষ-রফারই প্রশ্ন ওঠে না।

আমি বলব, আবার ঐ ‘উল্টা বুঝিলি রাম’! যদি এই মতটাকেই শেষ পর্যন্ত সত্য বলে স্বীকার করতে হোতো তা’ হলে আমাকেও এতক্ষণ ধরে এত হাঁসফাঁস ক’রে এতগুলা কথা বলতে হোতো না; এক কথায় বলতুম কাব্য ‘কাব্য’ এবং বিজ্ঞান ‘বিজ্ঞান’—‘…never the twain shall meet.’ কিন্তু এই কথাটাই সত্য নয় বলেই Kipling-কেও যেমন বলতে হয়েছিল—“But there is neither East nor West, Border nor Breed, nor Birth, when two strong men stand face to face, tho’ they come from the ends of the earth!” আমাকেও তেমনি বলতে হ’বে,—যখন বিজ্ঞান এবং কাব্যের তরফ থেকে দুইটি বলিষ্ঠ কল্পনা এসে মিলিত হয়, তখন, কাব্যও নেই, বিজ্ঞানও নেই, রয়েছে প্রতিভা।

কথাটাকে পরিষ্কার ক’রে বুঝিয়ে বলি। কাব্যের ক্ষেত্র ভাবানুভূতি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্র জ্ঞান। ভাবানুভূতিকে মূর্ত করে তোলা কবির কাজ, আর জ্ঞান-দৃষ্টিকে উন্মীলিত ক’রে দেওয়া বৈজ্ঞানিকের। এ-দিকে কিন্তু দুজনকেই বলিষ্ঠ কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়,—মানে প্রতিভার। কিন্তু শুধু কি এই-পর্যন্ত? কেবল এই-পর্যন্ত হ’লেও বিজ্ঞান এবং কাব্যকে একত্র সংযুক্ত করা একেবারে দুরাশা বলে মনে করতুম না,—আবার এর চেয়েও বড় আরো একটা জিনিষ রয়েছে যে! এইখানেই তার আলোচনা আরম্ভ করি :

বিজ্ঞান যখন দিব্যদৃষ্টিকে বহুদুর-পর্যন্ত প্রসারিত করে দেয়, তখনি বৈজ্ঞানিকের মনে সেই উদার প্রসারতার একটি ভাব-রূপ জাগে। বৈজ্ঞানিক আমাদের সকলকে সেই দিব্যদৃষ্টি দান করবার সঙ্গে সঙ্গে কখনো-বা সচেতনভাবে, কখনো-বা নিজের অজ্ঞাতসারে আমাদের মনে সেই ভাব-রূপের চিন্তারেখা বিলম্বিত ‘নীলাকাশশায়ী’ ছায়া বিস্তৃত ক’রে দিতে থাকেন। এইখানেই বৈজ্ঞানিক খানিকটা কবি-ধর্মী হয়ে পড়েন। তর্কের খাতিরে আমার এই কথাটা সাধারণ পাঠকের পক্ষে অস্বীকার  করা খুব-ই সহজ, কেন-না ‘two and two make four’ কথাটা যেমন অতি সহজে প্রমাণ করা চলে, আমার এ-কথাটাকে ঠিক তেমনি করে প্রমাণ করতে পারি নে। কিন্তু তবু কথাটা জোর গলায়ই বলছি যে-হেতু কথাটা এতটুকু মিথ্যে নয়। একে প্রমাণ করা যায় না, তবু এ সত্য,—গণিত শাস্ত্রের axiom-এর মতো সত্য,—এর প্রমাণ নেই, আছে নিদর্শন। বেশী দূরে যাবার দরকার নেই, বর্তমান যুগের পদার্থ বিজ্ঞানের বড়ো-বড়ো দু’চারটা theory-র কথা ভাবা যাক। আজকাল পদার্থবিৎ পণ্ডিতদের মধ্যে ‘আলো’ নিয়ে দেখতে দেখতে হুলস্থূল কাণ্ড বেঁধে গিয়েছে। বুড়ো Newton-এর Corpuscular theory-টার মানসম্ভ্রম  কিছুই রইলো না। ‘Wave picture’ ‘Quantum picture’ কত picture-ই যে এসে প’ড়েছে তা’র ঠিকানা নেই। Corpuscle picture-টার রূপ-পরিবর্তন ঘটল পট-পরিবর্তনেরই সঙ্গে-সঙ্গে—আবার ইদানীং Probability wave বলে আরো একটা ঢেউ উঠেছে,—এটারও নামের পিছনে একটা রূপের ইঙ্গিত উঁকি মারতে শুরু করেছে। Theory-গুলার জটিল তত্ত্ব উদ্ঘাটিত করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবার মতো দুরভিসন্ধি আমার নেই—আর সেরকম আলোচনার স্থানও এ নয়,—আমি শুধু বলতে যাচ্ছি এই যে light-এর এতগুলা theory বেরিয়েছে, এদের প্রত্যেকটির অন্তরালে-ই কি আমরা এক-একটি স্বতন্ত্র ভাব-রূপ দেখতে পাচ্ছি নে? এতগুলা Picture-এর প্রত্যেকটিই কি এক-একটি স্বতন্ত্র রূপায়ণ নয়? আরো একটা উদাহরণ দিয়ে আমার কথাটাকে একটুখানি বুঝিয়ে বলি। ধরা যাক Einstein-এর theory of relativity—এই theory-র মধ্যে দিয়ে Einstein তাঁর Continuum-নামক স্থান-কাল জড়ানো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে-একটি বিশেষ ধারণা আমাদের মনে জাগাবার চেষ্টা করেছেন, সেটা কি আগাগোড়াই একটা পরিকল্পনা নয়? আধুনিক বৈজ্ঞানিকের মতে ‘What we heve hitherto spoken of the propagation of energy, such as the passage of sunlight form sun to earth, now reduces to nothing more than the continuity of a corrugated crumpling along a line in the continuum which extends over eight minutes of our terrestrial time and about 92,500,000 miles of our terrestrial length.’ এই সমগ্র বাক্যটি কি কোনো রূপায়ণই করছে না? Continuity of a corrugated crumpling along a line কথাটার মধ্যে কি গতির একটা চিত্ররূপ দেবার চেষ্টা করা হয় নি? কবির ‘চলা যেন বাঁধা আছে অচল শিকলে’ কথাটি যদি কাব্য হতে পারে, তা’ হ’লে এই সমগ্র বাক্যটিকেও কাব্য-ধর্মী বলে স্বীকার করতে হবে। Einstein-এর Continuum-এর পরিকল্পনাটি একবারে মনে-মনে দেখবার চেষ্টা করলেই আমার কথাটা আরো স্পষ্ট হ’য়ে উঠবে। এই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ট পদার্থ বৈজ্ঞানিক Einstein যে কত বড় কবি, তা’র কল্পনা যে তাঁকে কতদূর পর্যন্ত নিয়ে গেছে সে-কথা আমরা তখনি বুঝতে পারি যখন বারবার পড়ে উপলব্ধি করতে চাই এই অভাবনীয় চিত্ররূপটি :

“…a soap bubble with irregularities and corrugations on its surface is perhaps the best representation, in terms of simple and familiar materials of the new universe revealed to us by the theory of relativity. The universe is not the interior of the soap-bubble but its surface, and we must always remember that, while surface of the soap-bubble has only three dimensions, the universe-bubble has four– three dimensions of space and one of time. And the substance out of which this bubble is blown, the soap-film is empty space weided on to empty time.” [Jeans]

যাক, দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছুতেই আমার কথাটা বিশ্বাস করতে পারতুম না ব’লেই এতগুলা নজির ঘাঁটতে হোলো। এখন আবার মুল বিষয়ে ফিরে যাচ্ছি। তা’ হলে এখন দেখা গেলো, বিজ্ঞানও একটি বিশেষ উপায়ে জ্ঞানজগতের রূপায়ণ করতে বাধ্য হয়। এর কারণ অবশ্য মনোবিৎ পণ্ডিতদের কাছে খুব-ই সুষ্পষ্ট;—মানুষের মনের গ্রহক্ষমতার মধ্যে, এমন কী, মানুষের ধারণাশক্তির মধ্যে কোনো জ্ঞান-ই একেবারে অরূপ অবস্থায় ধরা দিতে পারে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না ইন্দ্রিয়ের বিন্দু বিন্দু অনুভূতিগুলি আমাদের চৈতন্যের পর্দার উপর জড়ো হ’য়ে একটি বিশেষ ভাবরূপে পরিণত হ’য়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মনে কিছুতেই তাদের কোনো বিশেষ জ্ঞান জেগে’ উঠে না। অবশ্য, এ-রকম রূপায়ণবিহীন বিন্দুপাত চৈতন্যের পর্দার উপর দীর্ঘকাল ধ’রে চলতে পারে না,—এক সেকেন্ডেরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভগ্নাংশকালের মধ্যে বিন্দুগুলোর রূপ পরিগ্রহ করতে আরম্ভ করে, যদি না সে-চৈতন্যের অধিকারী ব্যক্তিটি অন্যমনস্ক বা অপ্রকৃতিস্থ হন। এখন, এই রকমের শত-সহস্র ভাব-রূপ স্মৃতির আকারে আমাদের মানস-স্রোতের জলরেখার ঠিক তলে-তলে প্রায় গা ঘেঁসেই ভেসে’ বেড়াচ্ছে—এই ভাব-রূপগুলাই হোলো আমাদের চিন্তার উপাদান। এইগুলার সাহায্যেই আমরা বৃহত্তর সত্যকে আমাদের মনের উপর প্রতিবিম্বিত করবার চেষ্টা করি। এই ভাব-রূপগুলা তখন জলরেখার উপরিতলে মাথা তুলে ভেসে ওঠে, এবং পারিপার্শ্বিকতায়, এদেরি মধ্যে দিয়ে আবার এদেরি প্রতিফলিত আভায় নূতন বৃহত্তর সত্যটি আমাদের চৈতন্যের মধ্যে আরেকটি বৃহত্তর ভাব-রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কথাটা চিন্তা করলেই আমরা সকলেই কিছু-না-কিছু বুঝতে পারি। আপাতত এ আলোচনা থাক। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, চৈতন্যের কেন্দ্রে জ্ঞানের ভাব-রূপে অবস্থিতি-ই বিজ্ঞানের কাব্য-ধর্ম গ্রহণের মূলগত কারণ, এবং এই কারণেই ঘটে বৈজ্ঞানিকের কবিত্বলাভের সম্ভাবনা।

এখন কবির বিজ্ঞান সাধনা কী অবস্থায় এবং কতখানি সম্ভব, সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এ-কথা আমাদের অস্বীকার করবার উপায় নেই যে কবি যখন বিশ্বজনীন ভাব-বেদনাকে বাণী দান করেন, যখন তা’কে আপন প্রকাশের মধ্যে মূর্ত ক’রে তোলেন ও বিশ্বের অন্তরে তা’কে উপলব্ধিগত সত্য ক’রে তোলেন, তখনি তিনি হয় জ্ঞাতসারে নয় অজ্ঞাতসারে আমাদের মনের মধ্যে তারি জ্ঞান জাগিয়ে তোলেন। এই জ্ঞান জেগে’ ওঠার মূলেও ঐ ভাব-রূপ। জ্ঞান জাগার সঙ্গে-সঙ্গেই যেমন জানি ভাব-রূপ জেগেছে, ভাব-রূপ জাগার সঙ্গে-সঙ্গেই তেমনি বুঝি জ্ঞানের আবির্ভাব হয়েছে। কবি আমাদের মনে জ্ঞানকে জাগিয়ে তোলেন তাঁ’র সৃষ্টির ভাব-রূপায়ণের ইঙ্গিতে—এবং এর থেকেই আমরা এক অপূর্ব দিব্যদৃষ্টি লাভ করি। এইখানেই কবিরা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞান-সাধনার পুরোহিত। সহজ কথায় বলতে গেলে কাব্য যেখানে ভাবোপলব্ধির ভিতর দিয়ে জ্ঞানদান করছে সেইখানেই সে আংশিক বিজ্ঞান-ধর্মী।

জানি, গোঁড়ার দল আমাকে তেড়ে’ আসবেন। বলবেন, কাব্য কখনো জ্ঞান দান করতে চায় না। এত বড় মিথ্যা কথা যাঁ’রা বলেন তাঁ’রা যে কেবল নিজেদের গোঁড়ামি বজায় রাখবার জন্যই আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন, এ-কথা না ব’লে পারলুম না। Shelley-র চেয়ে কল্পনার বিমান-বিহারে আর কোনো ইউরোপীয় কবি বড়ো ওস্তাদ হতে পারেন নি,—দেশ-বিদেশের সাহিত্যিকদের সবাইকে এ-কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে হ’য়েছে, কিন্তু তাঁর ‘Defence of poetry’-খানা কি এই কথাই বলছে যে কাব্য জ্ঞান দান করে না? এত বড়ো স্বপ্নদর্শী যুবক-ও কি বলেছেন না, কাব্যই জগতের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানভাণ্ডার? তিনি কি জোর ক’রে বলছেন না “Poetry is the centre and circumference of knowkedge”—ঝগড়া করতে বসি নি, এবং করবও না। কিন্তু দুঃখ হয় তা’দের জন্য, যা’রা কাব্যকে নিয়ে জয়ধ্বজা উড়িয়ে ফাঁকা-কথার ধূলিমুষ্টি দিয়ে আর-সকলের চোখকে অন্ধ ক’রে দেয়—যা’তে ক’রে কাব্যের সত্যরূপটি কিছুতেই আর-কারো চোখে পড়তে না পারে—অথচ নিজেদের প্রচার ক’রে বেড়ায় কাব্যের অতি-বড়ো সমঝদার বলে! কাব্য কি কেবল হওয়ায় ওড়ে? কাব্য কি সৌখিনি ভাব-বিলাসের একটুখানি এসেন্স?  আর কিছু নয়? কবিরা কি কেবল ভেলকিবাজি করে নাকে গন্ধ ছিটিয়ে লোক ভুলিয়ে বেড়ায়? আর-কোনো কাজই তা’রা করে না? ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস, ফের্দৌসী, সাদী, ওমর খৈয়াম, হোমর, ভার্জিল, গেটে, শেক্সপীয়ার, মিল্টন, শেলির দল কেবল এই কর্মই করেছেন? আজও এই বিংশশতাব্দীর কবিরা কেবল এই প্রতারণাতেই হাত পাকাচ্ছেন? বর্তমান যুগে ভারতবর্ষের মাথার উপরকার সাহিত্যাকাশের অদ্বিতীয় ভাস্বর-সূর্য রবীন্দ্রনাথও ঐ দলের? হায় রে দুর্মতি! জগতের জ্ঞানগুরুদের যদি এই আখ্যাই শেষ-পর্যন্ত আমরা দিই, তা’হলে মননশক্তি ব’লে কোনো কিছুই আমাদের নেই, এই কথাই এখন নির্লজ্জের মতো স্বীকার করতে হ’বে।

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা মনে পড়ছে। সে-দিন দেখলুম Cazamean এক জায়গায় শেলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁ’র Prometheus Unbound-এর উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে শেলির ‘most admirable series of lyrical moments’ নাকি এসেছে তার এই কাব্যখানির মধ্যে। আশ্চর্য্য! এত ‘admirable series of lyrical moments’ এই কাব্যে রয়েছে! তা’ হ’লে তো গোটা বইখানাই কেবল ভাবে ভরা! লেশমাত্র জ্ঞান এর থেকে লাভ করবার উপায় নেই!—অথচ শেলির Preface থেকে আরম্ভ করে বইখানা আগাগোড়া একবার পড়ে গেলে মনে হয়, এত বড়ো একটা সত্যদৃষ্টি লাভ করেছি, এত বড়ো একটা সত্যজ্ঞান লাভ করেছি যে, সে আর কি বলব! জ্ঞানের আকর বলতে যা বুঝা যায় কাব্যখানা বুঝি ঠিক তাই। আমি বলি, আমাদের গোঁড়ার দল কি বলতে চান, যে যা’ কোনো বিশেষ জ্ঞানই দান করে না—এমন যে বিকারগ্রস্থ উন্মাদ রোগীর উত্তেজনাপূর্ণ অর্থহীন প্রলাপ—তা’র মতোই একটা কিছু ছন্দোবদ্ধ ক’রে ধ’রে দিলেই Shelley-র Prometheus Unbound রচনা সার্থক হতো? যাক,—কী বলছিলুম? কাব্য যেখানে ভাবোপলব্ধির মধ্যে দিয়ে জ্ঞান-দৃষ্টি খুলে’ দিচ্ছে সেখানে সে আংশিক বিজ্ঞান-ধর্মী, বিজ্ঞান যেখানে জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে ভাব-চৈতন্য জাগিয়ে দিচ্ছে সেখানে সে আংশিক কাব্য-ধর্মী। তাই গোড়ার দিকে বলেছিলুম Jeans-এর বইখানা পড়ে মনে হচ্ছে যেন কবিতা পাঠ করলুম;—কেন-না Jeans তাঁর বই-এ পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদে বিজ্ঞানের বৃহৎ হ’তে বৃহত্তর সত্যগুলাকে ব্যাপক হ’তে ব্যাপকতরভাবে আমার চোখের সামনে মেলে ধরছে, যা’তে ক’রে সত্যের ক্রমবর্ধমান রূপটি আমার চৈতন্যের উপর ক্রমশ পরিব্যাপ্ত হয়েছে। ঠিক এমনটি হ’তে পারে কোনো বড়ো কবির শ্রেষ্ঠ কাব্য পাঠ করতে করতে।

এখন আমার কথার জালটাকে গুটিয়ে আনতে হ’বে। বাকবিস্তার সহ্য করবারও একটা সীমা আছে। শেষ পর্যন্ত একটা কথা বলেই আমি পাঠকের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করব। এইখানেই তা’র অবতারণা করি :

যদি কেউ বলেন, ‘প্রতিভার যে-একটি বিশেষ সংজ্ঞা তুমি দিয়েছ, সেটা অবিমিশ্ররূপে কোথাও আংশিকভাবে প্রকাশিত হতে দেখেছ কি?’ আমি বলব, দেখেছি। আমি এতটুকু মিথ্যা কথা বলছি নে। যাঁ’দের মধ্যে আমি এ-জিনিষটি দেখেছি, সাধারণ লোক তাদের নাম রেখেছে ‘দার্শনিক’। আপনাদের অনেকেই তাঁ’দের জানেন, আজ তাঁ’দের একটুখানি চেনবার চেষ্টা করুন। দেখবেন, তাঁ’রাই নিজেদের মধ্যে কাব্য এবং বিজ্ঞানের একত্র সমন্বয় ঘটাতে পেরেছেন, তাঁ’রাই খুলে দিয়েছেন এই দুই জগতের মাঝখানকার সেতুপথ। একটু চিন্তা করলেই দেখতে পাই কাব্য এবং বিজ্ঞানের মধ্যে যোগসম্বন্ধ রক্ষা করছে দর্শন। কাব্যের শিল্পরূপের অন্তর্নিহিত প্রাণরূপী সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছে এই দর্শন, আবার বিজ্ঞানের ধ্যানসমাহিত স্থিরদৃষ্টির গভীরতম তলদেশের জ্ঞানরূপী সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছে এই দর্শন। আমি দেখেছি, আংশিক নয়, প্রায় পূর্ণ-বিকাশও দেখেছি অবিমিশ্র প্রতিভার—অতি বিশুদ্ধ প্রতিভার—প্রাচ্যে সে প্রকাশ দেখেছি বেদান্তের ঋষিদের মধ্যে—পাশ্চাত্যে দেখেছি বিশেষ ক’রে একজনের মধ্যে—তিনি প্রথিতযশা মহামতি সক্রেটিস। হ্যাঁ, সক্রেটিস—অতি বিশুদ্ধ অবিমিশ্র প্রতিভার উৎস সক্রেটিস—তাঁ’র থেকে দুটি বিশিষ্ট প্রতিভার ধারা দুইদিকে প্রবাহিত হয়েছে—একটি প্ল্যাটোর, অপরটি এ্যারিষ্টটল-এর—একটি উপলদ্ধির অপরটি জ্ঞানের—একটি কাব্যের অপরটি বিজ্ঞানের। অতি দিব্যদৃষ্টিতে আমি প্রত্যক্ষ করেছি মানব-প্রতিভার তিন রূপের এই ত্রিমূর্তি,—সক্রেটিস, প্ল্যাটো, এ্যারিষ্টটল।

সমাপ্ত

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
অশোকবিজয় রাহা (২০১৩)। প্রবন্ধসংগ্রহ। সংকলন ও সম্পাদনা : অমল পাল। কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ;
অমল পাল (১৯৯৯)। অশোকবিজয় রাহা। কলকাতা, পশ্চিমঙ্গ বাংলা আকাদেমি;
উষারঞ্জন ভট্টাচার্য (২০১৮)। শ্রীহট্ট-কাছাড় : মনীষী, মনীষা ও অন্যান্য। কলকাতা; অক্ষর পাবলিকেশন্স্;
The Murarichand College Magazine, Vol. xix. no. iii., 1936-37, সম্পাদনা : আব্দুল বারী;
The Murarichand College Magazine, Vol. xx. no. i., 1937-38, সম্পাদনা : মন্মথ রঞ্জন চৌধুরী;
The Murarichand College Magazine, Vol. xx. no. iii., 1937-38, সম্পাদনা : মন্মথ রঞ্জন চৌধুরী;
Murarichand College Golden Jubilee Volume, II & III (1942), সম্পাদনা : অধ্যাপক মজদ উদ্দিন আহমদ, গিরীন্দ্র চন্দ্র দত্ত  ও দীগেন্দ্র চন্দ দত্ত


ভূমিকা, সংগ্রহণ ও সংকলিতকরণ : মোহাম্মদ বিলালকবি ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট। Email: mdahmedbil@gmail.com


মোহাম্মদ বিলাল রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you