স্পর্শপ্রতীক্ষায় নির্ঘুম নব্বইয়ের কবিতা || আহমদ মিনহাজ  

স্পর্শপ্রতীক্ষায় নির্ঘুম নব্বইয়ের কবিতা || আহমদ মিনহাজ  

পূর্বপরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ০৯ : নব্বইয়ের কবির নামতা    

নব্বইয়ের কবিতায় বিগত তিন দশক ধরে বিচিত্রগামী প্রবণতা দৃষ্ট হওয়ার বড়ো কারণ সেইসব অনুষঙ্গে নিহিত ছিল যার জের ধরে বাস্তবতার চেনা ছবি পাল্টাতে শুরু করে। চিরাচরিত বাস্তবতার দশকভিত্তিক রদবদলে মাত্রাগত ভিন্নতা থাকলেও একটি সংস্থিতি ও ভারসাম্য সেখানে বজায় থেকেছে; — নব্বইয়ে এসে ভারসাম্যে ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত কালপর্বে ঔপনিবেশিক একচ্ছত্রবাদের কাঠামোয় ধস অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় মহাসমর পরবর্তী পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সাংঘর্ষিক অবস্থান এবং উপনিবেশের শৃঙ্খলমুক্ত দেশগুলোয় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক একনায়কতন্ত্রের উত্থান ঘটলেও যুগচরিত্রের সংস্থিতি বিশেষ বিপন্ন হয়নি। অন্যদিকে সংস্থিতির বিপরীত প্রান্তে বিশ্বব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধনের মন্ত্রে উজ্জীবিত নৈরাজ্যের ভাষা (*ছাত্র ও তরুণদের বিদ্রোহ, ক্ষমতাকেন্দ্রের ভাষা পালটে দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান, গেরিলা যুদ্ধ ও বিপ্লব ইত্যাদি) প্রতি দশকে নতুন অঙ্গে দেখা দিলেও ভারসাম্যে বড়ো আকারের বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি। আশির অন্তে পৌঁছে সংস্থিতির ছক ভেঙে পড়তে থাকে আর নব্বই ও পরবর্তী দুই দশকে মানুষের সামাজিক জীবনধারা আমূল বদলে যায়। নব্বই ছিল সন্ধিক্ষণ; উক্ত দশকে পা রাখার পর বাস্তবতার চেনা অবয়বে কৃত্রিম ও বায়বীয় বাস্তবতার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং মানববিশ্ব নতুন সংস্থিতির সম্মুখীন হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্মুক্তায়ন ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। ঘটনাটির প্রভাবে চিরাচরিত জৈব বাস্তবতায় (Organic Reality) বায়বীয় বাস্তবতার (Virtual Reality) অনুপ্রবেশ রোখার সাধ্য কারো ছিল না।

রূপান্তরের এই অভিঘাতে বাস্তবতার চেনা অবয়বে পরস্পরবিরোধী প্রবণতার জন্ম হয়। গত তিন দশকের পটভূমি যদি  বিবেচনা করি তাহলে বলতে হয় অতীতগর্ভে বিলীন সমাজের তুলনায় একালের মানবসমাজকে অধিক দ্রুত গতিতে পরিবর্তনপ্রবণ জীবনধারায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হচ্ছে। জীবনের প্রতি পদে বস্তুগত সত্যকে (Objective Truth) অমোঘ করে তোলায় কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট পরা-প্রাকৃতিক বিশ্বে গমন ছাড়া মানুষের হাতে দ্বিতীয় বিকল্প অবশিষ্ট নেই। নব্বইয়ে পা রাখার দিন থেকে প্রাকৃতিক বস্তু ও প্রাণরাজিকে বস্তুগত সত্য রূপে বিবেচনার ঝোঁক তীব্র হতে শুরু করে। নিরন্তর রেপ্লিক্যাশনের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টির ক্ষমতায় কতখানি কার্যকর এই বিবেচনা মাথায় নিয়ে মানুষ এখন সমুদয় বস্তু ও প্রাণরাজির সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া সাঙ্গ করে। পানীয় জল থেকে শুরু করে নদী-নালা-খাল-বিল-সাগর-পাহাড়-অরণ্য, মাটির হাজার ফিট নিচে খনিজ পদার্থের সম্ভার অথবা জল-স্থল-অন্তরীক্ষে সক্রিয় প্রাণরাজিকে বস্তুগত সত্যের নিরিখে সংরক্ষণ, ব্যবহার ও রূপান্তরের ভাবনায় অধীর সমাজ নিজেকেও উপযোগবাদী ছকেই বিবেচনা করে থাকে। তথাপি খেয়াল রাখা প্রয়োজন, বস্তুগত সত্যের ওপর নির্ভরশীল জ্ঞান পরিণত অবস্থায় উপনীত হওয়ার ফলে বিচিত্র অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। অস্তিত্বের উৎস ও যাপন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি অতীত দশকের ন্যায় নির্ধারণবাদী ছকে দাঁড়িয়ে নেই। সৃষ্টির মৌল রহস্য ব্যাখ্যায় মানবজ্ঞানের পরিধি অধিক স্বচ্ছ আকার ধারণ করায় শত-হাজার বছর ধরে বিদ্যমান জ্ঞান ও ভাবধারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেও পুরোনো অনেক জ্ঞান সেখানে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতাও লাভ করছে।

পদার্থবিদ হেইনজ্ প্যাগেলস যেমন তাঁর ‘দ্য কসমিক কোড’ কিতাবে গিলগামেশের কাহিনিসূত্রে সুমেরীয় তথা সমগ্র প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পাঠ করেছেন। এই পাঠ থেকে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রাচীন সাহিত্যে বর্ণিত কাহিনিসম্ভারকে পদার্থবিদ কেন নিছক কল্পকাহিনি বা অতিরঞ্জন ভাবতে নারাজ। পৃথিবীতে জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে মানবপ্রজাতির বিবর্তনের যেসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে মানুষ একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ বলে ভাবে প্যাগেলস মনে করেন এর সঙ্গে মিথরঞ্জিত প্রাচীন কাহিনিগুলোর নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আজকের বৈজ্ঞানিক অনুসিদ্ধান্ত যেসব চমকপ্রদ প্রযুক্তি ও ব্যাখ্যা  মানুষের সম্মুখে দাখিল করে চলেছে সেগুলোর আলোকে প্রমাণ করা সম্ভব সুদূর অতীতে ঈশ্বর-দেবতা ও মানবপ্রজাতিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনার বিবরণ নিছক অতিকল্পনা বা গাঁজাখুরি ছিল না, বরং অতি-অগ্রসর সভ্যতা বি-নির্মাণের ইতিহাস ওইসব গাথা-কাহিনির প্রতি পরতে লুকিয়ে রয়েছে। স্থানকাল সংক্রান্ত আপেক্ষিকতাবাদ, সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে ঘনীভূত অনিশ্চয়তা, বংশগতিবিদ্যা বা জেনেটিক্স, ক্লোনিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সংবেদনশীল প্রাণ সৃষ্টির প্রয়াস, জীবনের সূচনায় অণুজীবের ভূমিকা, মৃত্যু ও পুনর্জীবন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত মানমন্দির ও কম্পিউটার প্রযুক্তির স্পর্শধন্য মানুষ নিজেকে এখন চরম অগ্রসর প্রাণী রূপে ভাবে, প্যাগেলস বর্ণিত অতিকাহিনির জগতে গমনের পর পাঠক দেখে অগ্রগতির এই স্মারকগুলো অতিকল্পনা নামে দাগানো সেইসব কাহিনির খাঁজে-ভাঁজে উপচে পড়ছে! সুমেরীয় তো রয়েছেই, মিশর থেকে শুরু করে সকল প্রাচীন সভ্যতায় বিদ্যমান অতিকাহিনিরা পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ, যেখানে একটি সভ্যতা আরেকটি সভ্যতার সঙ্গে বিনিময় ও সংঘাতে লিপ্ত হয়ে নিজেকে পরিণত করে তুলেছিল। সুমেরীয় ‘গিলগামেশ’ ও মিশরীয় ‘মৃতদের কিতাব’ নামক অতিকথার পাঠ থেকে পদার্থবিদ প্যাগেলস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ও হোমো স্যাপিয়েন্স নামে স্বীকৃত মানবপ্রজাতি কর্তৃক নয়া সভ্যতার সূত্রপাত ঘটানোর পেছনে অতি-অগ্রসর আন্তঃনাক্ষত্রিক (Intergalactic) সভ্যতার অবদান থাকতেও পারে।

বলাবাহুল্য প্যাগেলসের কিতাব পাঠ যাওয়ার পর এই বিশ্বাসের পক্ষে শক্ত যুক্তি রয়েছে সভ্যতাগর্বী প্রাচীন সমাজ হালফিল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল না বরং ক্ষেত্রবিশেষে অধিক অগ্রসর ছিল। যারপরনাই মিথকে নতুন আঙ্গিকে পাঠ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বিরচিত থিওলজি বা ধর্মতত্ত্বকে বিজ্ঞানের জন্য অচ্ছুৎ ভাবার প্রবণতায় পরিবর্তন আসা জরুরি বলে অনেকে মত দিয়েছেন। নব্বই ও অনতি পরবর্তী দশকে সংঘটিত মানুষের ক্রিয়াযজ্ঞে প্রতিফলিত বস্তুগত সত্যের স্বরূপ সম্পর্কে নির্ধারণী রায় প্রদানের সুযোগ তাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। নিশ্চয়তার আওয়াজ অতীতের মতো এখন আর জোরালো নেই। এইসব কার্যকারণের ফেরে মানবসভ্যতার জন্য নব্বই এক নতুন পালাবদলের রূপকার! সভ্যতার গতিধারাকে নির্ধারিত ছকে আবরণবন্দি করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো মানুষ তাকে অবারিত করার জন্য জোর কদমে ছুটতে চাইছে। মানব-ইতিহাসে বিরচিত ক্রিয়া ও ক্রিয়াভিত্তিক জ্ঞানকে কয়েক দশক আগেও যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে একুশ শতকের যুগবাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সেভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। ঘটনাটি হয়তো নব্বইয়ে-বেড়ে-ওঠা কবিপ্রজন্মকে অস্তিত্বের বিবিধ উৎসে গমন ও তাকে কবিতায় রূপ দানে প্রেরণা যুগিয়েছিল :—

যতখানি লোকালয়ে প্রকাশ, যতখানি মূর্ত—তারো অধিক বিমূর্তে
লীলা।
এইসব শব্দাবলী, অভিধান ছেড়েছুঁড়ে আমি নিঃসীম আঁধারে ডুবি,
ডুবে যায়
সংসার সময় ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান। এইসব শব্দাবলী নিকষ নরকে
নিক্ষিপ্ত
ভীষণ বোবা বধির আর জন্মান্ধ। এইসব শব্দাবলী ভীষণ ভালোবাসে
আঁধার।
(আলো, আরো আলো; দাউদ আল হাফিজ)


তবু আমি দেখি না কিছুই, অদৃশ্যমান থেকে গেছে তাবৎ পৃথিবী। শুধু জলপতনের শব্দে, মহাকালের গর্ভে আমি কান পেতে রাখি। কিন্তু সেখানে জেগেছে ধূলিঝড়, জেগেছে সৌরঝড়; আর পরিশেষে সংশয়…
(দৃশ্যহীনতায় জেগেছে কদম; তাপস গায়েন)


গলায় ফাঁস নিয়ে কবি যখন শূন্যে ঝুলে থাকে, তখন কী প্রশ্ন এসে হাজির হবে, ‘সময় কি তিরের মতো তীর্যক নাকি সর্পের মতো কুণ্ডলীকৃত হয়ে থাকা এক অশান্ত রজ্জু?’
(সময়ব্যূহে অভিমন্যু ১৩; তাপস গায়েন)


প্রকৃতির সকল প্রবাহের সাথে আমি হয়ে আছি লম্বমান, আমি আমার কাছেই হয়ে উঠি ফুল আর দীর্ঘ বল্লমের মতো অনির্দিষ্ট সময়!
(সময়ব্যূহে অভিমন্যু ১৭; তাপস গায়েন)


অসম্ভব দম্ভ জ্বলে নিজের ভিতরে,
কেম্বে হেঁটে যায়াম অতীতে? হা-হা কেম্বে
যায় গা মানুষ?
দেশের ভিতরে দেশ নাই? রাস্তা নাই অনিন্দ্য সুন্দর?
যখন মাছের মতো আমি এক রবারের মাছ
কামিন বাতাস ভেঙে শুধু গন্ধ আর
গন্ধ, পূতগন্ধ মাটির আঁশের
এই কি পুরুষবীজ, আলো, জল?
আমার পুত্রের নাম মাছ? দ্বৈপায়ন?
(মৎস্যচৈতন্যে; বায়্তুল্লাহ কাদেরী)


নাজেহাল হয়ে যাবো —
বীজ বুনানো মাটিতে যদি কোথাও উর্বর
.                    পলিও না পাই।
তবে কেনো?
রমণীরা নাইতে এসে—ভিজে গেলো,
.                   ভোরের লাবণ্য;
.                   রতিচিহ্ন রেখে যাওয়া…

বদ্ধজল! ব্যর্থতা তলিয়ে—কোমল পালকে ভাসছিলো হাঁসগুলি।
(নিরুত্তাপ চাষ; হেনরী স্বপন)

বিচিত্র উপায়ে সিমুলাক্রাম বা অনুরূপতার বিশ্ব সৃজন অগত্যা এই কালপর্বের মৌল লক্ষণ! বস্তুসর্বস্ব ইহজীবনকে যে-লোক এখানে জীবনের অন্ত ভাবে সেই লোক বিচিত্র পন্থায় প্রতিরূপতা সৃজনে নিজেকে নিঃস্ব করে যায়। বস্তুসর্বস্বতাকে অন্তিম মানতে অনিচ্ছুক ব্যক্তি আবার অন্য পথ ধরে বিপরীত প্রতিরূপতা সৃষ্টি ও সেখানে সত্তাকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয় প্রতিদিন। এই দ্বন্দ্বের কারণে প্রযুক্তিশাসিত জীবনের শিকলে বাঁধা নব্বইয়ের মানববিশ্ব সেই জ্ঞান ও সংস্কৃতি অবিরাম সৃজন করে যেটি তাকে বিধিবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার তাড়নায় অধীর রাখে এবং অন্যদিকে সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্ররোচনা যোগায়। ইতিহাসকে নতুন ভাষায় ব্যাখ্যার তাগিদে ব্যক্তি এখানে সৃজনমুখর, পক্ষান্তরে তামাদি-হওয়া পুরাতন ইতিহাসকে ফিরে পাওয়ার জন্যও তাকে ব্যাকুল হতে দেখা যায়। নব্বইয়ের সময়প্রবণতায় পরস্পরবিরোধী বহুস্বরের দাপট তাই এ-কারণে এত প্রবল! বস্তুগত সত্যে বিশ্বাসী বিজ্ঞানের ভাষা ধর্মীয় বিশ্বাস ও দর্শন থেকে আগত ভাষাকে প্রতিনিয়ত অসার প্রতিপন্ন করে, অন্যদিকে বস্তুর মৌল উপাদানের তালাশে নেমে তার ভাষায় বিশ্বাস ও দর্শনের আভা অবিরত চমকায়! নতুন যুগের উপযোগী মিথ সৃজনের চেষ্টায় প্রাচীন মিথকে নব্বই অবলীলায় বাতিল করে, আবার তামাদি-হওয়া মিথের জগৎকে নতুন করে ফিরিয়েও আনে। অতীত দশকের ভাবধারার গর্ভে ভূমিষ্ট মতবাদকেন্দ্রিক গোঁড়ামিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে এতটুকু দ্বিধা করে না, বিপরীতে নতুন যুগের ভাবধারায় ভূমিষ্ট মতবাদের সাহায্যে সেগুলোকে বৈধতা দানে সোচ্চার হয়। এইসব স্ববিরোধী কার্যকারণের ফলাফল থেকে সৃষ্ট নব্বই ও পরবর্তী দুই দশক অগত্যা দ্বৈত-বাস্তবতার বয়ানে ভাস্বর। মানুষের জীবনচেতনায় সুনির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্র সামগ্রিকভাবে এখন আর বিরাজিত নেই!

বাড়ির মালিক গেছে, অন্য  গৃহে, ধানের সন্ধানে;
হেন অবসরে
ঘটনা ও ধান, এই শব্দ দুটিকেই আমি
বহুব্যবহারে আজ
.           ক্লিশে করে ফেলি।
(ধান ও ঘটনা; কামরুজ্জামান কামু)


আজ এই আলোকিত পণ্যসমুদ্রের কালে
এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপি
আমার হাড়েও যেন শীত বিঁধিয়েছে
হাজার হাজার বছর পড়ে আছে বরফের নিচে
শিলীভূত উৎসাহের পৌরাণিক লিপিতে;
(পালকাপ্য-৩; খলিল মজিদ)


এবং অনেক অশ্মীভূত দৈবনীতিমালা
বাতাসে আসমানি বাণী চারিদিকে জাল বুনে আছে
কেবল ভূমিতে নিজের ছায়ায় ঢাকা মাটির মুহূর্তে
কোনো ভেদ নেই
তত্ত্বজ্ঞান নেই।
(দ্বিতীয় প্রহর; খলিল মজিদ)


জিহ্বায় জিহ্বা রেখে বেদনার ভাব বিনিময়, লালজিভ, নীলওষ্ঠ—
কতদিন! রসনায় স্বাদ থাকে কতকাল…
(স্বাদ; যজ্ঞযাত্রাকালে; জাফর আহমদ রাশেদ)


ঘুম ভাঙে সত্তার ভেতরে কোনো অশরীরী নিয়ে।
অবিবেচনাপ্রসূত তাহার অনুপ্রবেশ; হাসি দ্বিধাহীন।…

সত্তার ভেতরকার মৃত্যুময় অশরীরী লাশের খবর—
পেছনে আঙিনা নেই, সামনে নেই উলম্ব কবর।
(অবিনাশের সঙ্গে; জাফর আহমদ রাশেদ)


দৃশ্যত প্রচুর পাখি…অদৃশ্যত অগ্নিসত্যদিন…

দৃশ্যত প্রচুর পাখি ঝরেছিল…অদৃশ্যত সত্যের কঙ্কাল…
পাখি হে, ও নানাবর্ণ পাখি,
ডানার প্রতীক খুলে ব্যাখ্যাযোগ্য হও!

উঠলে উঠুক বেজে রাষ্ট্রসঙ্ঘে ব্যর্থ হাততালি…
(পাখিকল্পবেলা; রহমান হেনরী)


প্রতিবেশি নির্মলদা ভূয়োদর্শী ছিলেন
এখন বাড়িতে আছেন এবং
বাজার থেকে ব্যক্তিগত দেহখানা
কসাইখানা দর্জিখানায় সারিয়ে নিয়ে
পুনর্বার বেরোবেন বলে ভাবছেন …

আজকাল তার সমূহ প্রচারণাজুড়ে
দুর্ভিক্ষের চাঁদ, রোদওঠা কুকুর ও স্বাস্থ্যবতী প্রপাগান্ডাগুলো
দাপিয়ে বেড়ায়

নির্মলদা এখনো বাড়িতে আছেন—
হাঁটেন ফেরেন, বমি করেন—নিশ্চিন্ত শুশ্রূষায়…
(নির্মলদা বিষয়ক স্বকীয়া; ওবায়েদ আকাশ)

নব্বইয়ের ভাষাবিশ্বে বহমান চিহ্ন কেন্দ্র খুঁজে ফিরলেও কেন্দ্রহীন গন্তব্যে শেষতক দিশা হারায়! বহুগামী উৎসে সমাধি নেওয়া ছাড়া এই দশকের কবির পক্ষে নিজেকে ভাষা দান কঠিন। অতীত দশকগুলোয় যুগপ্রভাবক একক অথবা গুচ্ছ কবির আবির্ভাব নব্বই পরবর্তী সময়ের জন্য আর প্রাসঙ্গিক হয়ে নেই। সম্মিলিত সৃজনপ্রতিভার অবদানে কম্পিউটারপ্রযুক্তি সমকাল ও অনাগতকালের নিয়ন্ত্রক সত্তায় নিজেকে পরিণত করেছে, নব্বই ও অনুজ দশকগুলো অনুরূপভাবে পরস্পর বিপরীত ভাষাছকের সমাবেশ থেকে সম্মিলিত কবিতার যুগ সৃজনে বাধ্য বলা চলে। জীবনের সকল ছিদ্রে কান পেতে কবিতা লেখা কবির পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। ব্যক্তিসত্তা ক্রমশ ব্যক্তিসমগ্রয় মোড় নেওয়ার কারণে সামষ্টিক প্রতিভা দিনের কবিতায় রাজত্ব কায়েম করতে যাচ্ছে সে-বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। নব্বই বা অনুজ দশকে অতিকায় ব্যক্তিপ্রতিভার আবির্ভাব ঘটছে না দেখে যারা বিগত ত্রিশ বছরের কবিতাকে ফুটনোট ভাবতে অভ্যস্ত তাদের বোঝা উচিত বিশ্ব এখন অতীতবৃত্তে দাঁড়িয়ে নেই। জীবনের সকল ছিদ্রে কান পাতা চাইলেও সম্ভব নয়। ত্রিশ বছর মেয়াদী কালপর্বটি মানবসভ্যতার হাজার বছরের অর্জনকে ইতোমধ্যে অতিক্রম করায় সময়ের ঘূর্ণি জটিল ও বহুস্বরিক পথে বাঁক নিতে চলেছে। একটি বাঁকে গমন করলে অন্যটির নাগাল পাওয়া মুশকিল হয়। কবি চাইলেও সকল বাঁকে সফর করা তার কপালে নেই। সুতরাং একাধিক বাঁক ও বহুস্বর থেকে নব্বইয়ে ক্রীয়াশীল স্বকীয়তার চারিত্র্য বুঝে নিতে হবে।

পরস্পরবিরোধী স্রোতোধারায় বিজ্ঞানে পল্লবিত ভাষার সঙ্গে বিজ্ঞানবিরোধী ভাষার বিবাদ ঘটে। তামাদি ও বিদ্যমান ইতিহাস পাশাপাশি হাত ধরে চলে। বাতিল ও নতুন মতবাদের দ্বন্দ্ব, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনবেদের সংঘাত আর মরমি ভাবাবেশে বিভোর চিত্তে বস্তুবাদী বাসনার সঞ্চালন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার! আকর্ষণীয় দিক হলো এই দশকসারণির কবিতা প্রগতিপন্থার পেছনে ছুটতে ব্যাকুল নয় আবার প্রতিক্রিয়াশীলের পদলেহীও নয়। বিচিত্র অঙ্গে বহমান ভাবধারায় প্রভাবিত বোধ করলেও এর যে-কোনো একটিতে নিমজ্জন তার ভাগ্যে লেখা নেই। ঐতিহ্য ও আবহমানে নব্বই দশকের কবির সফর পৌনঃপুনিক ঘটলেও দ্যুতিভাস্বর সময়কে ফিরিয়ে আনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই দশকসারণিতে সক্রিয় কবির কাছে রাস্তাকাঁপানো রাজনীতি ও নৈরাজ্যের ভাষা তাই অধিক মূল্য রাখে না, যেখানে দাঁড়িয়ে দিনবদলের স্বপ্নে মানুষ যুগ-যুগ ধরে নিজেকে ফতুর করেছে! ইতিহাসকাতরতা, আধ্যাত্মিক শুশ্রূষার আর্তি, মরমি সংবেদন, খ্যাপা বাউলিয়ানা, অতিকল্পনার রাজ্যে সবেগে ঢুকে পড়া অথবা প্রাকৃতিক জীবনবেদে বহমান লক্ষণের একটিও নব্বইয়ে সচল কবিকে সেই বিশ্বের খোঁজ দিতে অপারগ যাকে বাস্তবিক ভাবা সম্ভব। সত্যটি স্বীকার করে নব্বইয়ের কবিদের পাঠ যাওয়া বোধহয় প্রয়োজন :—

গিলতে গিলতে জীবন উগড়াই
ক্ষমঃ গো জন্মদাত্রী ক্ষমঃ শ্বেতদুগ্ধ
জীবনের স্বাদ চেখে তিক্ত গলনালী জিহ্বা
তারারে এই ক্ষণে মৃত্যুর স্বাদ দিতে চাই
পৃথিবীর কক্ষপথে পতাকা নাড়ায়, আমিও তাই, আমিও…

প্রজাপতি মৌমাছি মধুচাক গড়ে
মৃত্যুকুসুম ফোটে গাছের কলারে
কোমল কনক ফুল কোমল কনক
অনন্তর এই ফুল বহুরঙা বীজের জনক।
(ক্ষমঃ গো শ্বেতদুগ্ধ; শাহনাজ মুন্নী)


যেমন জল আদপে জল নয়
তেমন তুমি জানার বিস্ময়
তোমারি এক পরম হাহাকার…

বিদ্যুতের ভিতরে যাওয়া যাক
কেবল গতি শুধুই ঘূর্ণন
একটি ‘আমি’ অন্য ‘আমি’-র মন
বলেছেন তো প্রফেসর ডিরাক।
(বজ্রযান; খলিল মজিদ)


নাকেমুখে বনের কাঁটা, পাতা লেগে আছে
কাঠুরিয়া শক্ত কুড়ালে কেটেছে বৃক্ষকোমর
অরণ্য হাত পা ছড়িয়ে বনের গায়ে পড়েছে
আমার শুধুই অরণ্যবাস, না কাঠুরিয়া, না শিকারি।
(শিকারি; শোয়াইব জিবরান)


নারায়ণের ঘাটে গিয়েছি কতদিন
তবু আজ মনে হয়, আমি কি দেখেছি
তোমায় মাঝি, হে নারায়ণ, দেখেছি কি
তোমায় কোনো জন্মে, এই তিতাসপাড়ে?
(নারায়ণের ঘাটে; সৈকত হাবিব)


নিটোল পানিতে সূক্ষ্ম আঘাত পড়লে ছড়ায় আভা ঘূর্ণনে
ক্রমশ বিন্দু থেকে বৃত্ত হতে হতে সেই বৃত্তাকার ঢেউ
গড়িয়ে গড়িয়ে এক সময় হাওয়া হয়ে উড়ে যায় শূন্যে

মগজের কোষে মিলিয়ে যায় জটিল জিনিস বৃত্তের ছন্দে
বৃত্ত হয়ে যায় আবারও বিন্দু তুমি আমি পড়ে রই দ্বন্দ্বে…
(বিন্দুবৃত্ত; শামীমুল হক শামীম)


গলন, গলন শুধু বর্গকে পৃথক করে কর্ণের ডেরায়।
গলে দর্প, চন্দ্রচূড়, গলনাংকে এসে
দু’পাশে বিরুদ্ধগতি দাঁড়ায় গা ঘেঁষে।
(স্থল বিভাজক। বিরুদ্ধ ভাজক। ভাজিতের দু’পাশে আগুন; পাঁশু প্রাপণ)


তবুও পথ ধ্যানমগ্নময়, পথ যায় দূরে…
ধুলো উড়নচণ্ডী, নতুন ঠিকানায় সেও যায় উড়ে…
(জন্ম মৃত্যুর বাঁকে; খোকন মাহমুদ)


একটাই মাঠ শুধু বৃত্তাকারে-চক্রাকারে…আজীবন ঘুরি,
সরণ প্রকৃত অর্থে একে তো বলে না! তবু
তোমার কুশল আমি বাঞ্ছা করি, নব-নিরাকারে…
(কুশল; রহমান হেনরী)

নব্বইয়ের কবিতায় প্রতিফলিত এইসব ঘূর্ণি বোর্হেসের মানচিত্রর (দ্রষ্টব্য  : On Exactitude in Science) স্মারক। কোনো এক যুগে মানচিত্রটি বাস্তব ছিল। অতিকায় এক রাজ্যের বিস্তৃতি ও তাকে ঘিরে সৃষ্ট পরিকল্পনা অঙ্কনশিল্পীরা যত্ন করে সেখানে এঁকেছিলেন। সময়ের পালাবদলে রাজ্যটি আর নেই! নৃপতি ও কুশলী মানচিত্রআঁকিয়েদের শত চেষ্টায় জীবিত করা সম্ভব নয়। কালের গর্ভে তারা চিরতরে বিলীন হয়েছেন। জীর্ণ মানচিত্রটি শুধু কালের বিরূপতা সহ্য করে এখনো টিকে রয়েছে। তার ছন্নছাড়া টুকরাগুলো জোড়া দিলে সুদূর অতীতে বিদ্যমান রাজ্যটি দর্শকের চোখে ভেসে ওঠে! এই মানচিত্র হলো একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব, যার সাহায্য ছাড়া অতিকায় রাজপাটের অস্তিত্বে বিশ্বাস যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। সময় এভাবে প্রতিরূপতায় সচল ও বহমান থাকে। নব্বইয়ের কবিতায় জীবিত অনুষঙ্গের বৃহদাংশ মূলত প্রতিরূপতায় সৃষ্ট বাস্তবতাকে পাঠকের দরবারে হাজির করে। দশকি কবিদের অন্তর্মগ্ন যাত্রা তাই ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র শামিল এখন! শ্মশানে চিতায় উঠেছে যে-শব সেই শব তাদের অবচেতনে ক্রিয়া করে যায়। নব্বই হচ্ছে যত অনুষঙ্গ ও উপায়কে মানুষ কবিতাচর্চার জন্য অতীতে আবিষ্কার করেছিল তার সকল উৎসে গমনের ক্ষুধা থেকে এমন এক ভাষাপৃথিবী নির্মাণের প্রয়াস যেটি তাকে জৈব অস্তিত্বে জীবিত থাকার ভরসা দিতে পারে। নব্বইয়ের কবি জাদুঘরে ঘুমন্ত সময়-প্রতিমার গা ছুঁয়ে এই আশ্বাস পেতে চায় ওরা কেউ ঘুমিয়ে পড়েনি, কেবল স্পর্শের প্রতীক্ষায় রয়েছে! এ-কারণে হয়তো মিথ, ঐতিহ্য ও আবহমান অনুষঙ্গ মাত্রাতিরিক্ত উপচে পড়ে এই দশকের কবিতায়!


গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you